১
ছবিতে যাঁকে দেখতে পাচ্ছেন, তিনি সৈকত মল্লিক। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের (গণসংহতি আন্দোলন) কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার একজন সদস্য। ছবিতে কয়েকজন পুলিশ-কে দ্যাখা যাচ্ছে তাঁকে বুট দিয়ে লাথি দিতে। এরা পরবর্তীতে সৈকত মল্লিকের পায়ে গুলিও ছুঁড়েছে এবং তিনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে এডমিটেড আছেন।
নিশ্চয়ই আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে সৈকত মল্লিকের সাথে পুলিশের এই আচরণ কেন।
না, সৈকত মল্লিক-কে কোনো নাশকতামূলক কাজের জন্য পুলিশ এমন নির্মমভাবে পেটায় নাই বা তাঁর পায়ে গুলি ছোঁড়ে নাই। সৈকত মল্লিক-কে পেটানো হয়েছে এবং তার পায়ে গুলি ছোঁড়া হয়েছে, কারণ দফায় দফায় সরকার যে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই চলেছে-যার ফলে জনগণের জীবনযাপন হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর-সৈকত সেই মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। এই চাওয়াটা তো কোনো অন্যায় নয়, নিশ্চয়ই? সকলেই চায়। গোপনে চায়, ফিসফিস করে চায়, মনে মনে চায়। তবে সৈকত মল্লিক ও তার কমরেডরা একটু ভিন্নভাবে চেয়েছেন। তাঁরা প্রকাশ্যে চেয়েছেন, চিৎকার করে চেয়েছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে চেয়েছেন।
তাই এই লাথি, এই গুলি।
এবং আমাদের এই আন্দোলন আজকের নয়। নতুন কিছু নয়। অনেকদিন থেকেই গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা তার সামর্থ্যের সবটুকু শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুত বন্দর রক্ষা করার জন্য আন্দোলন করে আসছে। আন্দোলন করে আসছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করা ও সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবীতে। তাজরিন গার্মেন্টসে শ্রমিক হত্যার বিচার করা থেকে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার করার দাবি সহ যে-কোনো প্রকারের রাষ্ট্রীয় বা রাষ্ট্রীয়-পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করে আসছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। এবং সর্বোপরি, জোট- মহাজোট বৃত্ত ভেঙে জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলে বাংলাদেশের একটি বিপ্লবী রূপান্তর সাধনের উদ্দেশ্যে।
সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাম মোর্চা গত ১৮ই ডিসেম্বর ৭ দফা দাবীতে হরতাল ডেকেছিল (নিচে হরতালের লিফলেট দেওয়া হল।)
সেই হরতাল সম্পর্কে বাম মোর্চার বয়ানঃ
Click This Link
সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই আজ জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেয় গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস এবং বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে। কিন্তু এই যৌক্তিক কর্মসূচিতে আজ সরকারের পেটোয়া বাহিনী তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে, ফ্যাসিস্ট বর্বরতায় আহত করেছে সৈকত মল্লিকসহ বাম মোর্চার আরো অনেক নেতাকর্মীকে। আহত হয়েছেন কাকন, বাহার, নাহিদসহ ছাত্র ফেডারেশনের বহু কর্মী। (নিচে খবরের কাগজের নিউজ লিংক দেওয়া হল।)
Click This Link
Click This Link
২
আহমদ ছফা একবার কোনো এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "মানুষের প্রধান সংকট নিজের ভেতর থেকে নিজেকে উন্মোচন করার সংকট।" মনে হয় তাঁর এই অসাধারণ কথাটি আজকের বাংলাদেশের ব্যাপারে সরাসরি প্রযোজ্য। আমরা প্রায় সবাই বুঝতে পারছি নানান রঙ বেরঙের আদর্শের বুলির আড়ালে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর এই দলগুলো প্রতিটি-ই লুটেরা চরিত্রের, যারা এই দেশটাকে শুষে ছিবড়ে বানানোর কাজ ছাড়া আর কোনো কিছুতে উৎসাহী নয়। এরা কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে, কেউ আল্লাহর আইন কায়েমের, কেউ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের, কেউ বা অন্য কিছুর। কিন্তু এদের সবার এক এবং অদ্বিতীয় বিশ্বাস লুটপাটতন্ত্রে। এরা জাতীয় শিল্পের বিকাশ ঘটাচ্ছে না, কেবল পরিধি বাড়াচ্ছে গার্মেন্টস শিল্প নামের বন্দিশিবিরের আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শ্রমবিভাজনের নকশা অনুসারে। এদের কারণে কৃষক পাচ্ছে না ফসলের ন্যায্য মূল্য, এদের কারণে হুমকির মখে আজ এদেশের প্রান প্রকৃতি। নারীর জন্য এরা সারা দেশটাকেই পরিণত করেছে একটা রেইপ ক্যাম্পে। শিক্ষা ব্যবস্থার নামে এরা কায়েম করছে এক কর্পোরেট দাসব্যবস্থা। আমরা সবাই সবই জানছি, বুঝছি; কিন্তু তবু নীরবে সব সয়ে যাচ্ছি জড়পদার্থের মত। আমরা কিসের অপেক্ষায় আছি? কোনো ত্রাণকর্তার, যে এসে উদ্ধার করবে আমাদেরকে? সেরকম অপেক্ষায় কেবল হিটলারের মতন দানবই আসতে পারে। নাকি আমরা ৯/১১-এর মত কোনো সিভিল-মিলিটারি সরকারের আগমনের প্রতীক্ষায়? কিন্তু তেমন কেউ এলে এইদেশের শোষণমূলক ব্যবস্থা একটা জেল্লাদার চকচকে চেহারা পাবে কেবল, শোষণ আরো শক্ত ও মসৃণ হবে। আমাদের প্রধান সংকট তাই, ছফার কথানুসারে বলা যায়, নিজের ভেতর থেকে নিজেকে উন্মোচন করার সংকট। অন্য কেউ নয়, আমাদের নিজেদেরকেই সংগঠিত হতে হবে নিজেদের সামষ্টিক অস্তিত্বরক্ষার প্রয়াসে। নইলে, সামনে অন্ধকার কেবল গভীর থেকে গভীরতর হবে। আর সেই অন্ধকারে আমরা হারিয়ে যাবো।
৩
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা জনগণ যাতে সংগঠিত হতে পারে তার জমিন তৈরি করার কাজ করে যাচ্ছে সর্বশক্তি দিয়ে। জনগণ যদি বাম মোর্চার আন্তরিকতাটুকু উপলব্ধি করতে পারে এবং বাম মোর্চার লড়াই সংগ্রামে-যা আসলে জনগণেরই সংগ্রাম-সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে, নিদেনপক্ষে সমর্থন দিয়ে সংগঠিত হতে থাকে তবে সেই দিন দূরে নয় যেদিন আমাদের আর বলতে হবে না "আমরা পরিবর্তন চাই", যেদিন আমরা বলতে পারব "আমরা পরিবর্তন করেছি"।
তার আগ পর্যন্ত সৈকত মল্লিক আর কমরেডরা জনগণের জন্য লড়ে যাবেন তাঁদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে।
সেই লড়াইয়ের ডাক দিয়ে যাই...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:১১