somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধর্ষিতার ও ধর্ষকের ধর্মীয়/জাতিগত পরিচয় তুলে ধরাটা কি জরুরী?

০৫ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি ১১ বছরের 'হিন্দু' মেয়েকে জোরপূর্বক 'মুসলমান' বানানো হয়েছে, তার নাম রাখা হয়েছে আয়েশা (এই ঘটনাটা গুরুত্বপূর্ণ, দাগ দিয়ে রাখেন, এটা নিয়ে লেখার শেষ অংশে লিখছি), এরপর তাকে টানা ৫৫ দিন ধর্ষণ করা হয়েছে।

একটা প্রশ্ন উঠছে, এবং ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়, যেঃ ''ধর্ষিতার ও ধর্ষকের ধর্মীয়/জাতিগত পরিচয় তুলে ধরাটা কি জরুরী?'' এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই লেখা। আমার উত্তর একান্তই আমার ব্যক্তিগত, আপনি একমত হতেও পারেন নাও পারেন, সেটা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।

ধর্ষণের প্রধান কারণ পুরুষতন্ত্র, ''মানুষ হিসেবে নারী পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট, তাই নারী পুরুষের অধীন, এবং সে-কারণেই পুরুষ নারীর সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে'' এই ধারণা। পুরুষতন্ত্রের বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নারীবাদীরা করতে পারবেন, আমি সহজভাবে যা বুঝি সেটাই লিখলাম, আমাদের আপাতত এতটুকুতেই কাজ চলে যাবে। কিন্তু ধর্ষণের একমাত্র কারণ পুরুষতন্ত্র নয়।

১৯৭১এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশী দোসর রাজাকাররা এই জনপদের প্রায় ৩ লাখ বাঙালি ও আদিবাসী নারীকে ধর্ষণ করেছিলো, আমরা যাঁদের আমাদের কপটতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাষায় 'মা বোন' ডাকি, যদিও এখন ন্যাকা ন্যাকা গলায় যাঁদের মা বোন ডেকে 'দেশপ্রেম' দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে এই সমাজ তাঁদের গ্রহণ করতে রাজি হয়নি 'নষ্ট মেয়ে' উপাধি দিয়ে। এটা সত্য যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুরুষতান্ত্রিক ছিলো, কিন্তু কেবল পুরুষতন্ত্রের কারণেই কিন্তু তারা এই সিস্টেমেটিক রেইপ ক্যাম্পেইন চালায়নি, এর পেছনে আরেকটা কারণ ছিলো। পাকিস্তানিদের ভেতরে এই ধরণের একটি ধারণা বিরাজমান ছিলো যে পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলমানরা ঠিক 'আশরাফ মুসলমান' নয়, কারণ এখানকার মুসলমানরা সব হিন্দু থেকে কনভার্ট হয়েছে, এরা সবাই হচ্ছে 'আধা হিন্দু।' আর হিন্দু এবং অ-বাঙালি আদিবাসীদের একটি বিশাল অংশ তো ধর্মীয় পরিচয়েই অমুসলিম। ফলে পাকবাহিনীর কাছে এই ধর্ষণ ছিলো অমুসলিম ও 'আধা হিন্দু'-দের বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদের একটি অপরিহার্য অংশ। জামায়াতে ইসলামের তাত্ত্বিক গুরু সাইয়েদ আবু আলা মওদূদী পাক বাহিনীর এই লাইনের সাথে মিল রেখেই ফতোয়া দিয়েছিলেন, পূর্ব বাংলার নারীরা 'গণিমতের মাল।', সেই সময়ের দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় এই ফতোয়া অত্যন্ত যত্নের সাথে ছাপা হয়েছিলো। সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছে এখানে ধর্ষণ পুরুষতন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ব্যবহৃত হচ্ছে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ার হিসেবেও। ঠিক এই কারণেই, উপরে যেমন করা হয়েছে, যাঁরা ধর্ষিত হয়েছেন তাঁরা যে 'বাঙালি হিন্দু নারী', 'বাঙালি মুসলমান (পাকিস্তানিদের চোখে আধা-হিন্দু) নারী' বা 'আদিবাসী নারী' হিসেবেই ধর্ষিত হয়েছেন তা তুলে ধরতে হবে।

আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ভারতের গুজরাত গণহত্যায় যাঁরা খুন হয়েছেন ও ধর্ষিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন 'মুসলমান।' এবং অরুন্ধতী রায়ের ''লিসেনিং টু দি গ্রাসহুপারসঃ ফিল্ড নোটস অন ডেমক্রেসি" বইটা যাঁদের পড়া আছে, তাঁরা সবাই স্বীকার করবেন, গণহত্যাকারীদের সবাই হিন্দু মৌলবাদী আরএসএস-বিজেপি-শিবসেনা-বজরং দলের সদস্য-সমর্থক, যাদের একত্রে বলা হয় সংঘ পরিবার। সেই কার্নেজে অংশ নেওয়া অনেকেই, অরুন্ধতীর বইটির দোহাই, বলেছে যে তারা যা করেছে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার হাউশ থেকেই করেছে। এখন কেউ যদি বলেন, গুজরাত গণহত্যায় যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছেন তাঁদেরকে 'মুসলমান মেয়ে' বলা যাবে না, সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? তারা তো মুসলমান মেয়ে হওয়ার কারণেই ধর্ষিত হয়েছেন!!!

আচ্ছা, ধর্ষিতার ধর্মীয় পরিচয় না হয় তুলে ধরছি, ধর্ষকের ধর্মীয় পরিচয় তুলে ধরাটা কি জরুরী? যেই ধর্ষকেরা অই মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে তারা মুসলমান, এটা যদি তুলে ধরি, তাহলে কি ইসলামের অবমাননা হবে? না, হবে না, নিশ্চিত থাকেন। এই ধর্ষকেরা বা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইসলামের অথরিটি না, গুজরাতের গণহত্যাকারীরাও হিন্দু ধর্মের অথরিটি না, ধর্মের লেবাসে জুলুম চালালেই কেউ সেই ধর্মের অথরিটি হয়ে যায় না। ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম দুটোরই হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে, বাঙালি মুসলমানের ঘরে যেমন জন্ম নিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলামের মতো অসাধারণ মানুষ, তেমনই বাঙালি হিন্দুর ঘরেও জন্ম নিয়েছেন জীবনানন্দ দাশের মতো মানুষ। বরং যারা ইসলামের নামে ও হিন্দু ধর্মের নামে মানুষের উপরে জুলুম চালাচ্ছে, ইনসানিয়াতের অপমান করছে, তারা যে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের দোহাই দিয়ে জুলুম চালিয়ে এই দুই ধর্মেরও অবমাননা ঘটাচ্ছে সেটা তুলে ধরতেই জালেমদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে হবে।

তাই যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই লেখা সেই প্রশ্নের উত্তর, আমার মতেঃ "ধর্ষিতার ও ধর্ষকের, উভয়ের, ধর্মীয়/জাতিগত পরিচয় তুলে ধরা অবশ্যই জরুরী। সেই সব ক্ষেত্রে, যেখানে ধর্মের/জাতির দোহাই দিয়ে ধর্ষণ হচ্ছে। তবে যেখানে শুধুমাত্র পুরুষতন্ত্রের কারণেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সেখানে ধর্মীয় পরিচয় তুলে ধরা জরুরী নয়।"

নামকরণের জটিলতা

১১ বছরের মেয়েটিকে জোর করে 'মুসলমান' বানানো হয়েছে এবং 'আয়েশা' নাম দিয়ে টানা ৫৫ দিন ধর্ষণ করা হয়েছে। এই নামকরণের ব্যাপারটা আরেকটা জটিলতা তৈরি করেছে, এটাকে কাকতালীয় ভাবতে পারলে খুশী হতাম, কিন্তু ভাবতে পারছি না। দুনিয়ায় এতো আরবি ফারসি নাম থাকতে 'আয়েশা' নামটিই কেন দেওয়া হল? আমার ধারণা ধর্ষকরা অত্যন্ত সূক্ষভাবে ইসলামের অবমাননা করার জন্যই এ কাজ করেছে। আমরা সবাই জানি মহানবী হজরত মুহাম্মদের স্ত্রী, উম্মুল মোমেনিন (বিশ্বাসীদের জননী)-এর একজন, ছিলেন আয়েশা। খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম জন আবু বকর সিদ্দিকের কন্যা আয়েশাকে মহানবী বিয়ে করেছিলেন, কারণ আল্লাহ তাঁকে স্বপ্নে এমনটি করার কথা বলেছিলেন, মহানবীর এই বিয়ে এবং অন্যান্য বিয়ের কারণ-তাৎপর্য সম্পর্কে চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গোলাম মোস্তফার 'বিশ্বনবী' নামক বিখ্যাত গ্রন্থটিতে। কিন্তু সেটা বিষয় না, বিষয় হচ্ছে, জোর করে মেয়েটির ধর্মান্তর ঘটানোর পর 'আয়েশা' নামটি কি মহানবীর প্রতি কটাক্ষ করার জন্য রেখেছে অই ধর্ষকেরা?

আমার ধারণা সে-জন্য, আর তাই ধর্ষণের পাশাপাশি এই ধৃষ্টতার জন্যও কিন্তু অই ধর্ষকদের ফাঁসি চাওয়া যায়। সেটা কি কেউ চেয়েছেন? আমি এখনো কাউকে চাইতে দেখিনি।

'নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি চাওয়া, আর এইসব ধর্ষকের ফাঁসি না চাওয়া, দুটোই যে নিয়ন্ত্রণ করছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তার জন্য আর কোনো উদাহরণ লাগবে?

[ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধরণটা উপলব্ধি করার জন্য কিছু কেতাব পাঠ করলে খারাপ হয় না। বদরুদ্দীন উমরের 'সাম্প্রদায়িকতা' দারুণ, আর রোমিলা থাপারের 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' ঐতিহাসিক বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ধারণা ভেঙে দিতে সাহায্য করতে পারে। আহমদ ছফার "শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়" উণিশ শতকের তথাকথিত 'বাঙালি রেনেসাঁস'-এর ওপর ও বাংলা সাহিত্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব নিয়ে দারুণ প্রোভোকেটিভ একটি রচনা, একই লেখকের 'বাঙালি মুসলমানের মন' প্রবন্ধটি বুঝতে সাহায্য করবে কেন বাঙালি মুসলমান সমাজকে সাম্প্রদায়িকতা তাড়া করে ফেরে।]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:৪৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×