ফিচার:
পথের - চলায় কোনো ক্লান্তি নেই। পথিকের পদভার তাকে দেয় গৌরব ও চঞ্চলতার আনন্দ। কিন্তু পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট কতক পথকে করে তুলে গুরুত্বপূর্ণ, আর দূর্ভাগ্যের জীর্ণ চাদরে ঢেকে যায় কিছু পথের গতি রেখা। আঞ্চলিক জীবনের এমনি একটি পথের গৌরব পুণরুদ্ধারের কাহিনী এটি।
১৩৫০ বাংলা সনে তার বয়স ছিল কুঁড়ি বছর। সে বছরই বিয়ে করেন তিনি – বলে বুড়ো লোকটি মুচকি হাসলেন। হাতের আঙুল গুণে বের করলেন, তার বর্তমান বয়স ৯২ বছর। এখন বাংলা ১৪২২ সন। আশ্বিন মাস। ক্রান্তিয় অঞ্চলের চরম মূহুর্তগুলোর একটি প্রবাহিত হচ্ছে। বর্ষায় সৃষ্ট কাদা এখনো শুকায় নি পথ থেকে। যেখানে গাছের পাতা খুব ঘন, সেখানে পানি জমে আছে। প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো বৃষ্টিপাত হয় নি। বর্ষার মৌসুম শেষ হয়েছে আগেই। এখন অনাবৃষ্টিই স্বাভাবিক। কিন্তু মেঘের ভিড়ে যে জনপদ প্রায় মাস তিনেক ধরে অনুজ্জ্বল, সেখানে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে দূরে কোথাও চোখ রাখা প্রায় অসম্ভব। স্যাঁতসেতে মাটি থেকে আগত বাষ্প আর সূর্যের প্রচণ্ড তাপ পুরো পরিবেশটাকে ভ্যাকিউম বোতলের মতো করে ছেড়েছে। শরীর থেকে ঘাম ঝরছে ঝরঝর করে। বাতাস জমে যেন গরম বরফ হয়ে গেছে। ক্লান্তিতে থমকে গেছে পথিকের চলার গতি। পৃথিবীর প্রভাবশালী কয়েকটি নদীর পলিতে গঠিত যে বঙ্গীয় বদ্বীপ – তার ভূগোলের দু’ দুটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের জীবন্ত সাক্ষী প্রায় শতবর্ষ পেরোনো জবেদ আলীও নিজেকে প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়েছেন পথের ধারে পাতানো মাচাঙে। মাচাঙটি শ্যাওলায় জর্জরিত। শেষ মূহুর্তের শক্তি নিয়ে টিকে আছে কোনো রকমে। কিন্তু পথটি তার যাত্রালগ্নে সেই যে ঘর ছেড়েছে, তার জিরোনোর কথা ভাবে নি কোনো পথিক। কিন্তু পথের - চলায় কোনো ক্লান্তি নেই। পথিকের পদভার তাকে দেয় গৌরব ও চঞ্চলতার আনন্দ।মানুষের ইতিহাস – মূলত, পথের এই ধূলি-কণারই ইতিহাস। মানুষ একা নয়; নয় কোনো একক গোষ্ঠি বা জাতি। মানুষের বৈচিত্রের প্রভাব, গোষ্ঠি বা জাতির স্বার্থগত ভিন্নতা পথের প্রয়োজনের উপরও প্রভাব ফেলে সবসময়। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট কতক পথকে করে তুলে গুরুত্বপূর্ণ, আর দূর্ভাগ্যের জীর্ণ চাদরে ঢেকে যায় কিছু পথের গতি রেখা। আঞ্চলিক জীবনের এমনি একটি পথের গৌরব পুণরুদ্ধারের কাহিনী এটি।
খুব বেশি দিন হয়নি বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে ইছাদিঘী গ্রামে। এবং এই সব চরম মূহুর্তে বৈদ্যুতিক পাখার সুফলের চিন্তাটা সুদূর পরাহত। সূর্যের তাপে তাতানো টিনের উষ্ণতা আর বাতাসের আদ্রতা শুষে এমন এক হাওয়া উপহার দেয় বৈদ্যুতিক পাখা, জবেদ আলী তার ৯২ বছরের জীবনে যে অভিজ্ঞতা আগে কখনো পায়নি। বৈদ্যুতিক পাখার আসল স্বাদ পেতে বাসস্থানের যে অবকাঠামোগত সংস্কার দরকার তা এখানে সম্ভব হয়ে উঠেনি। ইছাদিঘী গ্রামের অর্থনৈতিক অধোগতি আমাদের বর্ণিত পথের সমান্তরাল।
আমরা যেখানে বসে গল্প করছিলাম, তার পাশেই পরিত্যক্ত একটি ধানের কলের বিধ্বস্ত স্থাপনা পড়ে আছে। এর নির্মাণকাল ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ। ঈসায়ী হিসাবে ১৯৬৬ সাল। ধান ভাঙানোর জন্য এর সমসমায়িক এত বড় ইঞ্জিনের স্থাপনা সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সম্ভবত আর একটিও নেই। তাছাড়া দেড় যুগ আগেও ইছাদিঘীর মতো প্রান্তিক জনপদে পারিবারিক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ধান ভাঙানোর জন্য ঢেঁকির ভূমিকা ছিল মুখ্য। সেখানে এতবড় একটি স্থাপনা ইছাদিঘী গ্রামের কুষি অর্থনীতির গুরত্বকে প্রমাণ করে।
স্মৃতিচারণ করছেন প্রায় শতবর্ষীয় জবেদ আলী
যেন ঊনপঞ্চাশ বছর পূর্বের প্রাণ শক্তি ফিরে এলো জবেদ আলীর শরীরে। আড়মোড়া দিয়ে ওঠে বসলেন। এই কলঘরকে ঘিরে তার স্মৃতিগুলি বর্ণনা করলেন একের পর এক। কিন্তু সে সবের কিছুই অবশিষ্ট নেই। কল্পনা ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশের পাসপোর্টই জবেদ আলীর স্মৃতির রাজ্যে আজ আর আমাদের পৌঁছতে সাহায্য করবে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। আমার প্রাণও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল পথে পা ফেলার জন্য।
এক মিনিট হেটেই ইছাদিঘীর দেখা পেলাম। ইছাদিঘী গ্রামের নাম এই দিঘীর নামকে কেন্দ্র করেই। এবং ইছাদিঘীর নামে এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব আছে ১৯৩৮ সাল থেকে। আমরা যে পথের কথা বলতে পথে নেমেছি, এই দিঘীর সাথে তার একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে।
ঐতিহাসিক ইছাদিঘী
বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস নির্মাণই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে বর্তমানে অবহেলিত একটি পথের গুরুত্ব অনুসন্ধান যে অনেকটা আষাঢ়ে গল্পের মতো শুনাবে তা বলাই বাহুল্য। তা সত্ত্বেও দু’টি উপাদান এই পথের প্রাচীনত্ব প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। জবেদ আলীর মতো আরো কয়েকজন বেঁচে আছেন ইছাদিঘী গ্রামে; যারা বলছেন, তারা তাদের ছোটবেলায় অনেকগুলো ভগ্নপ্রায় ইটের স্থাপনা দেখেছেন এখানে। তাদের বর্ণিত ইটের সাথে বর্তমানে নির্মিত ইটের কোনো মিল নেই। তারা জানালেন, ইটগুলো ছিল বড় বড় চাইয়ের মতো। কোঠাঘর নির্মাণের সময় যেমন এক ফুট অন্তর অন্তর কেটে দেওয়া হয়, অনেকটা সে রকম। কিন্তু সেগুলো যে ইটই এবং মাটি পুরিয়েই বানানো হয়েছে, এটুকু বুঝার স্থাপত্যিক জ্ঞান তাদের রয়েছে বলে জানালেন, জবেদ আলীর সমসাময়িক আরেক প্রবীণ। কিন্তু ইটের স্থাপনাগুলো ঠিক কেন নির্মিত হয়েছিল, সে প্রশ্নে ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে চুপ মেরে গেলেন জবেদ আলী।
সহকর্মীর সাথে লেখক (সাদা পাঞ্জাবি)
জবেদ আলী বর্ণিত স্থানগুলোতে আমরা দু’ দিন হাটাহাটি করলাম। তার এক জায়গায় মধ্য বয়সী একটি বট গাছ গজিয়ে উঠেছে, তার পাশেই হাল আমলে নির্মিত হয়েছে একটি নাট্য সংঘের ঘর। তার বারান্দায় দাঁড়ালেই কালচে সবুজ রঙের পানির কোদাল দিঘী (স্থানীয় উচ্চারণে কোদাইলা)। তারপর যে জায়গাটায় আমরা অনুসন্ধান পরিচালনা করলাম, আশেপাশের ভূমি থেকে দু’ তিন ফুট উচ্চতা জায়গাটাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। জায়গাটি দেখতে মাঝারি আকারের চালার (আশেপাশের জায়গা থেকে উঁচু ভূমি) মতো দেখায়। বর্তমানে যার অর্ধেকটাই ব্যবহৃত হচ্ছে ইছাদিঘী গ্রামের কবরস্থান হিসেবে, আর বাকিটুকু ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি ভূমির আওতাভুক্ত। আমরা অনেকটা হতাশ হলাম এখানে কিছু খুঁজে পাওয়ার দুরাশার কথা চিন্তা করে।
ভূ-প্রকৃতিগত দিক বিচারে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিকে যে ২৪ টি অঞ্চল এবং ৫৪ টি এককে ভাগ করা হয়েছে, তার মধ্যে ইছাদিঘী গ্রামের অবস্থান মধুপুর গড় অঞ্চলে। যাই হোক তথ্য-উপাত্তের দৈন্যতার জন্য এখানকার প্রথম বসতির আলোচনায় আমরা যাব না। একটি পথের হারানো মুখরতা স্মরণে আনা পর্যন্তই আমরা আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। জবেদ আলী বর্ণিত যে স্থাপনার চিহ্নগুলো আমরা হারিয়ে ফেলেছি, খুড়াখুড়ির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে কী ছিল এই স্থাপনাগুলো সে সম্পর্কে জানার জন্য আপাতত আমাদের হাতে যা আছে তা হচ্ছে – কিংবদন্তি।
দিন কয়েক হলো ঈদুল-আযহার ঈদ শেষ হয়েছে। পথে হাটা যায় না। কোরবানির পশুর নাড়ি-ভুড়ির গন্ধ বাতাসে মিছিল করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কিংবদন্তি এভাবে হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় না। তাকেও খুঁজে বের করতে হয়। সপ্তাহখানেক পরের এক সকালে মাওলানা আলী আজাদ পথে হাটছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে ইছাদিঘীর নামে একটি দাখিল মাদ্রাসা পরচিালনা করছেন তিনি। দৃষ্টিতে তার মুগ্ধতার স্ফূরণ। আমরাও তার সঙ্গ নিয়ে হাটছিলাম। হঠাৎ আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে একটি সরাইখানা ছিল। জমিদাররা যাওয়ার সময় এখানে বিশ্রাম বা রাত্রি যাপনের জন্য থামতেন। কিন্তু কারা ছিলেন সেই জমিদার? কিংবদন্তিও সে প্রশ্নে নিশ্চুপ। কিংবা কোথায় যেতেন তারা? মাওলানা সাহেব বললেন, ময়মনসিংহ। জমিদারী ব্যবস্থা টিকে থাকা পর্যন্ত কারা ছিলেন এই এলাকার জমিদারীর দায়িত্বে? ভাওয়াল এস্টেটের জমিদার বা পূর্ববর্তী মুগল আশ্রিতদের কেউ একজন হলেও মোটামুটি একটি সিদ্ধান্ত আসা যেত। কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় উপাদান - দিঘীটি সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে বাঁধা সৃষ্টি করে।
বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এ পর্যন্ত আমরা যতগুলো প্রাচীন মানব বসতির নিদর্শন খুঁজে পেয়েছি, তার প্রায় সবগুলিই নদী কেন্দ্রিক। বাংলাদেশে প্রাপ্ত সভ্যতার বড় বড় কেন্দ্রগুলিও নদীর কাছাকাছি গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া নদীর পলিতে গঠিত এই বঙ্গ বদ্বীপে নদীই ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। জঙ্গলাকীর্ণ বিস্তৃত সমতল ভূমিতে বাংলাদেশের ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার ভূমিকা পালন করত এক সময়। নদীর এই প্রাকৃতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রাচীন বাংলায় এক সময় বাণিজ্য ভিত্তিক সভ্যতা গড়ে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু যেখানে এই নদী ব্যবস্থাপনা ছিল না, সেখানে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের বিকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অস্তিত্বশীল ছোট-বড় অসংখ্য দিঘী। যথাযথ অনুসন্ধান এবং গবেষণা করলে প্রাচীন ও মধ্য বাংলায় দিঘী কেন্দ্রিক মানববসতি বিকাশের ভিন্নতর একটি ইতিহাস সংযুক্ত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সে যাই হোক। বাংলাদেশের কয়েকটি দিঘীর কিংবদন্তি মিশ্রিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্থানীয় কোনো শাসক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে বা অন্য কোনো কারণে দিঘী খনন করেছেন। সেই দিঘী খননের কোদাল ধোয়ার জন্য খনন করেছেন পাশাপাশি আর একটি দিঘী। এবং দিঘী খুড়ার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আকাশে বান ডাকা শুরু হলে তার প্রতিদানে আর একটি দিঘী খনন করা হয়। কিন্তু দিঘীতে পানির দেখা নেই। অবশেষে বেদনাদায়ক কোনো বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দিঘীকে জলময় করা সম্ভব হয়। কয়েকটি দিঘীর কিংবদন্তি পরীক্ষা করে আমরা মোটামুটি এই একই কাহিনী পেয়েছি। সবচেয়ে নিকটবর্তী সাগরদিঘীর সাথে ইছাদিঘীর হুবুহু মিল খুজে পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ইছাদিঘীকে ঘিরে সাগরদিঘীর মতো ভৌতিক কোনো কিংবদন্তি নেই। কিন্তু সাগরদিঘীতে যেমন পাশাপাশি তিনটি দিঘী – সাগরদিঘী, কোদালদিঘী, বন্যাদিঘী; ইছাদিঘীকে ঘিরেও এ রকম তিনটি দিঘীর অস্তিত্ব আছে – ইছাদিঘী, কোদাইলা (কোদালদিঘী), বোনাদিঘী (বন্যাদিঘী)।
গুগল ম্যাপে ইছাদিঘী, কোদালদিঘী ও বন্যাদিঘীর অবস্থান
সাগরদিঘীর খননকারী হিসেবে স্থানীয় পাল বংশীয় রাজা সাগর রাজার নাম পাওয়া যায়। যদিও তার সময় নির্দেশ করা যায় নি। ইছাদিঘীর সাথেও এ রকম একটি জনশ্রুতি আছে বটে। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়নি আজ পর্যন্ত। স্মৃতিফলক, মুদ্রা বা ইতিহাস নির্ণয়ের জন্য অন্যকোন উপাদানও আবিষ্কার করা যায়নি এখনও। শেষমেষ শব্দার্থতত্ত্বের (Semantics) আশ্রয় নিচ্ছি আমরা; যেখানে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করে অতীত ইতিহাসের ইঙ্গিত তালাশ করা হয়। সেই হিসেবে ব্যাকরণগত দিক দিয়ে ইছাদিঘী সমাসবদ্ধ একটি শব্দ; যার সমাস নিষ্পন্ন অর্থ হতে পারে -১. ইছার দিঘী, ইছা নামে কোনো ব্যক্তি ছিলেন তার দ্বারা খননকৃত দিঘী। ২. ইছা বা চিংড়ি মাছের দিঘী, যে দিঘীতে প্রচুর ইছা বা চিংড়ি পাওয়া যায়। ৩. ইছা খানের দিঘী।
প্রথমত, ১ নং অর্থটি সঠিক হলে এতো আলোচনার প্রয়োজনই হতো না। বলে দেয়া যেতো যে, ইছা নামে স্থানীয় কোনো ভূম্যাধিকারী দিঘীটি খনন করেছেন বলে তার নাম অনুযায়ী দিঘীটির নাম হয়েছে ইছাদিঘী। কিংবদন্তি এ রকম কোনো স্থানীয় ব্যক্তির নাম প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি এখনো। ২ নং অর্থটি তর্কাতীতভাবে উড়িয়ে দেয়া যায়। ইছা বা চিংড়ি যদিও মাছ নয়, তবু বিশেষ একটি জলজ প্রাণীর আধিক্যের কারণে দিঘীটির পরিচয়সূচক নাম হবে – এ রকমটি ভাবা যায় না। তাছাড়া কোনো দিঘীতে পরিকল্পিত চাষাবাদ ছাড়া ইছা বা চিংড়ির প্রাচুর্য কোথাও দেখা যায় নি। আমাদের কাছে ৩ নং যে অর্থটি বাকি আছে, সমগ্র বাংলার ইতিহাসে সে নামে কেবল একজন ব্যক্তিকেই চিহ্নিত করা যায়; তিনি হচ্ছেন মসনদ-ই-আলা ঈসা খান – একজন মহান সেনানায়ক, জাতীয় বীর এবং মোগল আগ্রাসন প্রতিরোধে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের প্রধান। ঈসা খান নামের বানানের বিষয়টি আলোচনা করলেও আমরা এ সম্পর্কে আমাদের আলোচনার সপক্ষে সমর্থন পাই। যেমন মাহেনও (১৯৪৯) পত্রিকায় বর্তমান ঈসায়ী বানানের পূর্বতন রূপ ইছায়ী। আর আমরা দেখেছি ইছাদিঘীর পাড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বানানে ইছা রূপটি বহাল আছে সেই ১৯৩৮ সাল থেকে। তাছাড়া ঢাকা শহরের অদূরে শীতলক্ষা নদীর তীরে মাটি খুড়ে যে সাতটি কামান পাওয়া গেছে, তার একটিতে মসনদ-ই-আলা ঈসা খানের নামের বানান পাওয়া যাচ্ছে – সরকার শ্রীযুত ঈছা খাঁ। বাংলা স্বরধ্বনিতে য়ি ধ্বনির সাধারণত হ্রস্ব বা দীর্ঘ উচ্চারণ নেই। ই একটি মৌলিক স্বরধ্বনি, ঈ যৌগিক স্বরধ্বনি; কিন্তু দু’টি ধ্বনির উচ্চারণই য়ি। তাহলে আধুনিক ঈসা বানানটি যে ইছা – রই বিবর্তিত রূপ সে বিষয়ে সন্দেহ থাকছে না। আমরা যদি ধরেও নেই যে, ইতিহাস বিখ্যাত ঈসা খানের নামানুসারেই ইছাদিঘীর নামকরণ করা হয়েছে; এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দিঘীটির খননকারী তাহলে কে?
ঈসা খানের সমসাময়িক ভাওয়াল রাজ্যের জমিদার ছিলেন বাংলার বিখ্যাত বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ফজল গাজী। তাঁর রাজ্য চাঁদ গাজী (চাঁদ প্রতাপ), তালা গাজী (তালিপাবাদ) ও বড় গাজী (ভাওয়াল) এই তিনটি পরগণায় বিস্তৃত ছিল। ইছাদিঘী ছিল তালিপাবাদ পরগণার অন্তর্গত, যা এখন সখিপুর উপজেলাধীন কালমেঘা নামে অধিক পরিচিত। যাই হোক, ভাটি বা পূর্ব বাংলার শাসক মসনদ-ই-আলা ঈসা খানের সঙ্গে ফজল গাজীর প্রগাঢ় মিত্রতা ছিল। ফজল গাজীর একটি স্থায়ী স্থল বাহিনী এবং বিপুল সংখ্যক রণতরী সম্বলিত শক্তিশালী নৌবহর ছিল। সামরিক দিক দিয়ে ফজল গাজী ছিলেন ঈসা খানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
১৫৭৮ ঈসায়ী সনে মুগল সুবাদার খান জাহান ভাটি অঞ্চল আক্রমণ করেন এবং ভাওয়ালে শিবির স্থাপন করেন। দুজন আফগান দলপতি ঈসা খানের সঙ্গে মৈত্রী ভঙ্গ করে মুগলদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ঈসা খান মুগল বিরোধীতায় অটল থাকলে শাহ বরদী ও মুহম্মদ কুলীর নেতৃত্বে তাঁর বিরূদ্ধে এক বিশাল মুগল নৌ-বাহিনী পাঠানো হয়। বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত কস্তুল নামক স্থানে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ঈসা খানের মিত্র মজলিস দিলওয়ার ও মজলিস প্রতাপের হাতে নিদারুণভাবে পরাজিত হয়ে মুগল বাহিনী পালিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম দিকে ঈসা খান পশ্চাদপসরণ করেন। তাহলে তিনি কি ঐ সময়ই তালিপাবাদ পর্যন্ত এসেছিলেন? এবং যুদ্ধের কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্ধুরের সাথে গড়তে চেয়েছিলেন শক্তিশালী কানেক্টিভিটি? এ রকমটি হলে মসনদ-ই-আলা ঈসা খানের সামরিক জ্ঞানের অনন্য নিদর্শন আজকের ইছাদিঘী। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, মুগল নৌ ও স্থল বাহিনী দ্বারা ঈসা খানের গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি এগারসিন্ধুর ও জঙ্গলবাড়ি আক্রান্ত হলে তাঁর সামরিক জোটের অন্যতম মিত্র ফজল গাজীর দিক থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়ার জন্য একটি নিরাপদ পথ নিশ্চিত করা। যুদ্ধের কৌশলগত দিক দিয়ে ভাওয়াল, তালিপাবাদ পরগণা থেকে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি, এগারসিন্ধুরের পথে ইছাদিঘীর অবস্থানগত গুরুত্ব বর্তমানের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও উপলব্ধি করা যায়। তাছাড়া তালিপাবাদ হয়ে কিশোরগঞ্জের পথে মুগলদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তেমন ছিল না। তাই বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের যাতায়াতের নিরাপদ মাধ্যম হতে পেরেছিল সে দিনের মুখরিত এই পথ।
মসনদ-ই-আলা ঈসা খানের সামরিক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ পথ
আমরা যখন এই ধারণা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি, সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার তখন আমাদের দৃশ্য থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দু’ তিনটি প্রবীণ শালবৃক্ষ যেন নৈশব্দের কোলাহল নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কাহিনীর পথ ছেড়ে আমরা যখন অন্য পথে পা বাড়ালাম, অনেক দিন আগে পড়া জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার কথা মনে পড়ে গেল আমার:
'আমাকে খোঁজো না তুমি বহু দিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;-এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলোপৃথিবীর পারে
আমরা দু’জনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’-বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রান কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে।
এক সময়ের মুখরিত এই পথ; নবীন সঙ্গিনীর কাছে নিজের আভিজাত্যের কথা বলতে পেরে তার প্রাণও কী ভরে গেল একটু!
কৈফিয়ত:
*বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী।
*বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান, প্রথম খণ্ড, গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি।
*বাংলার ইতিহাস, মোগল আমল, আবদুল করিম।
*বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইট অব বাংলাদেশ।
*ইতিহাস ও ঐতিহাসিক, মমতাজুর রহমান তরফদার।
*বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ, জীবনানন্দ দাশ।