তাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে - সেই বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারনা থাকা দরকার। যে প্রশ্নসমূহ আলোচিত পোস্টে উঠে এসেছে তাতে মূলত তিনটা শিরোনামে ভাগ করা যায়:
১) বঙ্গবন্ধুর ক্ষমার প্রেক্ষিতে জামাত নামক একটা "বাংলাদেশের জন্মের বিরোধীতাকারী দল" কি রাজনৈতিক অধিকার পেয়ে গিয়েছিলো?
২) বাংলাদেশে চলমান গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আলোকে জামাত কি গনতান্ত্রিক শক্তি হিসাবে কাজ করছে?
৩) একটা দেশে কোন অগনতান্ত্রিক সংগঠন নিষিদ্ধ করা কি গনতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী?
উপরের বিষয়গুলো নীচে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে:-
১) ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যখন পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরনপণ সংগ্রামে লিপ্ত - তখন “ জামাত” একটা সংগঠন হিসাবে নীতিগতকারনে সেই মুক্তির সংগ্রামের শুধু বিরোধীতিই করেনি - রাজাকার, আল-বদর, আলশাসম বাহিনী তৈরী করে সক্রিয় ভাবে পাকহানাদারদের সহায়তা করেছে। দেশের মানুষ যখন মুক্তি আশায় অসহনীয় কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছিল - তখন জামাত একটা সংগঠন হিসাবে তাবেদার মন্ত্রী সভায় গিয়েছে, পাতানো নির্বাচনের অংশগ্রহন করেছে। এর সবই প্রমান মিলে তাদের পত্রিকা “দৈনিক সংগ্রাম”এর ১৮৭১ সালের সংখ্যাগুলোতে।
এরই প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর জামাতসহ স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতার পরপরই জামাতের অনেক নেতাকর্মী জেলে যায়, অনেকে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান নেয়। বিদেশে থাকা জামাত নেতারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। যতদিন না দেশে তাদের জন্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরী হয় - ততদিন তারা বিদেশে বসে বাংলাদেশ বিরোধী কার্যক্রম চালাতে থাকে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ১৯৭৫ সালের হত্যাকান্ড পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্মীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
তারপর সামরিক শাসক মে: জে: জিয়াউর রহমানের সাথে আঁতাত করে এরা দেশে ফিরে আসে। তখন থেকেই প্রচার শুরু হয় বঙ্গবন্ধু এদের ক্ষমা করে দিয়েছে। এটা একটা বিরাট ভুল ও প্রপাগান্ডা। সাধারন ক্ষমার আওতায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী সাধারন কর্মীদের ক্ষমা করা হয় - যাতে এরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সাধারন ক্ষমার আওতায় সেই ৩৪ হাজার ৬০০ রাজাকার, মুসলিমলীগ কর্মী, জামাত কর্মীদের ক্ষমা করা হলেও তাদের পুরানো বিশ্বাসের রাজনীতি করা অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। তাদের সেই অধিকার ফিরে পাবার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, সাধারন ক্ষমা ঘোষনায় সুস্পষ্ঠ ভাবে উল্লেখ ছিল যে, “এই আদেশ বলে দন্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা), ৩০৪ ধারা (হত্যার চেষ্টা), ৩৭৬ ধারা (ধর্ষন), ৪৩৫ ধারা (অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরক দ্বারা ক্ষতি সাধন) ৪৩৬ ধারা (বাড়িঘর ধ্বংসের অভিপ্রায়ে অগ্নিসংযোগ বা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্মের চেষ্টা) মোতাবেক অভিযুক্ত বা দন্ডিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না”
এখানে যেমন ঢালাও ভাবে ক্ষমা করা হযনি - তেমনি বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার সময়েও অনেক অপরাধীর বিচার চলছিলো। পরে সামরিক আদেশে সেই বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
সুতরাং জামাতের পুর্নবাসন এবং বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশ বিরোধী রাজনীতির চলানোর সাথে কোন ভাবেই বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে বক্তব্য প্রদান করা সত্যের অপলাপ মাত্র।
২) নানান ঘাত প্রতিঘাত, সামরিক শাসন আর পাল্টা সামরিক শাসনের মধ্যে দিয়ে যখন দেশ অতিক্রম করছিলো - তখন জামাত তাদের মধ্যপ্রাচ্যের খুঁটির জোরে সেই সকল গনবিরোধী সরকার গুলোর কাছ থেকে গোপন ইমিউনিটি পেতে থাকে। এরা শুধু যে রাজনৈতিক ভাবেই প্রভাবশালী হবার চেষ্টা করেছে তা নয় - ধর্মের লেবাসে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেছে। একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে - গনতান্ত্রিক পরিবেশে জামাত আসলে একটা অগনতান্ত্রিক দল। জামাত তাদের দলের গঠনতন্ত্রের কোথাও বাংলাদেশকে একটা গনতান্দ্রকি দেশ হিসাবে গড়ে তোলার কথা বলেনি। বরঞ্চ জনগনের ক্ষমতার বিপরিতে এরা সুচতুর ভাবে “আল্লার সার্বোভৌমত্বের” কথা বলেছে। এরা ক্ষমতায় আরোহনের সর্বশেষ পথ হিসাবে ইসলামী বিপ্লবের কথা বলেছে। কিন্তু কার্যত দেখা যায় - এরা গনতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহন করে সাধারন মানুষকে ধোকা দিচ্ছে। এরা একদিকে সতলোকের শাসনের কথা বললেও - নিজেরা দূর্নীতি করেছে এবং একটা দূর্নীতিবাজ সরকারকে সমর্থন করেছে। জামাতের বিগত ১৫ বছরের কর্মকান্ড এবং তাদের গঠনতন্ত্রের কোথাও তাদের অতীত অপকর্মকে নিয়ে লজ্জা বা দু:খ প্রকাশের নজির দেখা যায়নি। বরঞ্চ এরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জনগুলোকে বিতর্কিত করে তাদের অপকর্মকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করছে। মূলত জামাত গনতন্ত্রের ছদ্মবেশ ধারন করে গনতন্ত্র বিরোধী একটা সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসাবে বাংলাদেশে কর্মকান্ড চালাচ্ছে। কোন সংগঠনের এহেন কর্মকান্ড বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থী এবং অবৈধ।
৩) গনতন্ত্র যদিও অবাধ মতপ্রকাশের অধিকার দেয় - তথাপি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তারও কিছু সীমারেখা নির্ধারন প্রযোজন হয়ে পড়ে। তাই দেখা যায় - পৃথিবীর সকল গনতান্ত্রিক দেশে কিছু সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের উদাহরন হিসাবে পূর্ব-বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, হরকতুল জেহাদ বা জেএমবির কথা বলা যায়। কর্মকান্ড গনতান্ত্রিক রীতিনীতির সাথে সামজ্ঞস্যপূর্ন না হওয়ায় তাদের কাজকর্ম অবৈধ। তেমনি বিশ্বের সব দেশে যুদ্ধে পরাজিত শক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকে - এরা করা দরকার হয় সামনে আগানোর জন্যে। যারা পরাজিত - যদি ওদের রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া হয় তবে তারা তাদের অপকর্মগুলোকে বৈধ হিসাবে বিবেচনার জন্যে জনগনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। এতে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়বে। যা সামগ্রিক ভাবে একটা দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতির পক্ষে অন্তরায়। গত ৩৫ বছর যাবত এই কাজটাই করছে জামাত। জামাত ১) বাংলাদেশের প্রচলিত গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, ২) প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা, ৩) প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ৪) মুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা, ৫) নারীর অধিকার আর ৬) প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার বিরোধী। যা এক কথায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিরোধী। এরা প্রবল প্রচারকার্য চালায় এই সকল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। প্রকৃত অর্থে একাত্তরের পরাজয়ে যা তারা হারিয়েছে - গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগে তার সবটুকু ফিরে পাওয়া এদের লক্ষ্র - এবং সেই লক্ষ্যেই তাদের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং গনতন্ত্রের নামে - একটা রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনকে অবাধ কর্মকান্ড চালানোর বৈধতা দানের মাধ্যমে কি বাংলাদেশ তার ভবিষ্যতে একটা কঠিন সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না?
উপরে তিনটা প্রশ্নের উত্তরে বিস্তারিত আলাপ করা হলো। আশা করা এতে সবার কাছে পরিস্কার হবে কেন - "মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল জামাতের রাজনীতি করার অধিকার নেই!"
আসুন - দেশে বিদেশে সবাই মিলে সোচ্চার হই - বাংলাদেশের একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে - বাংলাদেশে জামাত নামক সংগঠনকে অবৈধ সংগঠন হিসাবে ঘোষনা করে তাদের কর্মকান্ড বন্ধ করা হউক।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭ রাত ১০:৪৬