somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিডনাইট সান...

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :









“এই নে তোর কফি…”

“থ্যাংকস মা”

“তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরিস…”

মার মুখে এই কথা শুনে মুচকি এক হাসি দিল সালমান।মা জানে সালমান আজও দেরি করে ঘুমাবে কিন্তু তার পরেও মার প্রতিদিনেরর রুটিন ওয়ার্ক এক কাপ কফি টেবিলের ওপর রেখে এই কথা বলবেনই…এবং এই কফির কথা অনেক অসুস্থতার মধ্যেও কোনদিনই ভুলেন না….বাঙালি মা দের সম্ভবত ছেলেদের যত্ন -আত্তির ব্যাপারে অন্য কোন হরমোনের নিঃসৃত হতে থাকে..যার কারণে তাঁরা কখনোই এই ব্যাপারে ক্লান্তিবোধ করেন না..



ইদানীং নতুন এক এসাইমেন্টের জন্য প্রায় রাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে সালমানের..নতুন জব.. নতুন চ্যালেঞ্জ..কোন ধরণের ছাড় দিতে রাজি না সে…এর সাথে বাড়তি যোগ হয়েছে নতুন এক গল্প….

ঢাকা শহরের সবচেয়ে ভয়ংকর মজার বিষয়টা আসলে কি..সেটা নিয়ে ইদানীং বেশ চিন্তাশীলতা নিয়েই দিন কাটছে সালমানের..মোটামোটি একটা সদুত্তরও খুজে পেয়েছে সে..হুম,”ডায়াসফোরা” এক কথায় বলতে গেলে উদ্বাস্তু..শিকড়ের সাথে সর্ম্পক শিকেয় তোলে সবাইকে এই ইট পাথরের শহরে আটঁকে থাকতে হয়। আর সুযোগ পেলেই সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ব্যাগভর্তি কাপড় -চোপড় আর পোটলা -পুটলি নিয়ে “স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার ” বলে সবাই দৌড়াতে শুরু করে …বড়ই অদ্ভুত এই শহরের মানুষগুলোর জীবন!!!

তবে এদের মধ্যে তার চেয়েও দুর্ভাগা তারাই যারা ইতো মধ্যে পাকাপোক্তভাবে শিকড়ের সাথে সব ধরণের সংযোগই কেটে ফেলেছে… তাই এদের যাওয়ার কোন জায়গাই থাকে না… কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে এদের চেয়েও দুর্ভাগা কিছু মানুষ আছে,যারা সবকিছু থাকার পরেও এই ইট -কাঠের শহরটা সবার মতো সেই সময় ছাড়তে পারে না..যেমন আমাদের আজকের গল্পের “রমিজ আলী”।

প্রিয় পাঠক,আপনারা ইতোমধ্যে বুঝতেই পারছেন, আমাদের গল্পের নায়ক সালমান আজকে রমিজ আলীকে নিয়ে বলবেন।



সালমানের সাথে রমিজ আলীর প্রথম দেখা সেবার বাড়ি ফেরার সময়..অঘুমন্ত এই শহরটায় রাতের বেলায় যে কত ধরণের অঘটন ঘটতে পারে সেটা মোটামোটি সকলেই জানে..সেবার ঈদের ছুটিতে ভার্সিটি থেকে ফিরতে ফিরতে একটু বেশিই দেরী হয়ে গেল.. তখন ঢাকা ছাড়ার শোরজোরে সবাই ব্যস্ত থাকলেও সালমান তখন ঢাকায় আসার পথ ধরেছে..রাজশাহী থেকে অনেক আগেই বাসের পথ ধরার পরও বেশ রাত হয়ে যায়… ঈদের সময় এদেশের মহা সড়কগুলো যে চলন্ত গাড়ি -ঘোড়া নিয়ে অন্তত মরণ রূপ ধারণ করে নিথর হয়ে বসে থাকে সেটাও সবারই জানা… মেইন রোড থেকে সালমানদের বাড়িটা একটু ভেতরেই বলা চলে..অন্যান্য সময় এলাকার রাস্তার মোড়টা থেকে রিকশা পাওয়া গেলেও ঈদের সময় বলে রাস্তায় কুকুর -বিড়ালের সংখ্যাটাও কম..তাই আল্লাহ নাম নিয়ে হাটতে লাগলো সালমান….

আকাশে জিলহাজ্জ মাসের সেই অষ্টমী চাঁদটা তখনো ডুবে যায় নি..অন্যান্য সময় সামনে থেকে সুরেলা সুরে দু’একজনকে মধ্য রাতের অখন্ড নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে গান করতে করতে আসতে দেখা গেলেও আজকে এমন কাউকেই দেখা যাচ্ছে না এমকি কোন শ্রমজীবীর বুকপকেটের চাইজিন ফোনে ভীষণ শব্দে বাজতে থাকা হেড়েঁ গলায় গাওয়া কোন গান বাজাতে বাজাতেও পথ চলতে দেখা যাচ্ছে না..

ঢাকা শহরটা যে এই সময় অন্য সময় থেকে একদমই ভিন্ন ধারার এক বিশ্রী রূপ ধারণ করে এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই..আপনি শহরের কোন এক এলাকার রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করলেই দেখতে পাবেন ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সারি সারি ইট পাথরের বিশাল বিশাল সব খাচাঁর লম্বাকৃতির বিরাট বিরাট সব ছায়া..এরই মাঝ দিয়ে হেটে যাবার সময় চারপাশে তাকালে আপনার মনে হতেই পারে, আপনি কোন মৃত্যুপুরীর মাঝখান দিয়ে হেটে যাচ্ছেন.. অন্যন্য সময় দূরে কোন জানালা দিয়ে আলো ভেসে আসতে দেখা গেলেও এই সময় খাঁ খাঁ করতে থাকা ইমারতগুলো থেকে আলোর কোন অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না… কোথাও কোন প্রাণের স্পন্দন নেই…একে মৃত্যুপুরী ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে..কিছুটা যুদ্ধ বিধস্ত ঘুমন্ত হোমস বা আলেপ্পো শহরের মতো…

একেই তো এই শহরে কয়েকটা কুকুর, বিড়াল আর কয়েকটা কাক ছাড়া প্রাণের স্পন্দনসম্ভলিত কোন প্রাণই নেই … এই শহরের মানুষগুলো তো স্পন্দনসম্বলিত ন’টা -পাচ’টার কিছু যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না…

কিছু দূর হাটার পর এক জটলা কুকুর এক সাথে দাড়িয়ে চিৎকার করতে দেখে কিছুটা থমকে দাড়ালো সালমান…না,সালমান কুকুর ভয় পায় না…কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে মধ্যরাতের ভদ্র-অভদ্র সব মানুষকেই এই শহুরে কুকুরগুলো সন্দেহের চোখে দেখে…কিছুটা পুলিশ পুলিশ ভাব আর কি…সামনে যাকেই দেখে চোর চোর লাগে..এই শহুরে কুকুরগুলোর ভাব-গতি কিছুটা এমনই যে এরাই এই এলাকার বিশস্ত দফাদার!!! এদের ভাব গতি দেখে যখনই সে দৌড়ানি টাইপের কিছু একটার প্রিপারেশন মোটামোটি নিয়েই ফেলে ছিল, তখনই পিছন থেকে ‘ট্রু ‘করা বাঁশির শব্দ শুনে জানে পানি ফিরে পেল সালমান…আর তখনই অট্রালিকার অন্ধকারময় সেই ছায়া ভেদ করে বেরিয়ে আসলেন “রমিজ চাচা”….



কানের কিছুটা কাছেই ‘ট্রু’ শব্দটা শুনেই টেবিল থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাড়ালো সালমান।্খাকি রঙের সেই রঙচটা বাদামি শার্ট আর লুঙ্গিটা পড়ে হাতে শতাব্দী প্রাচীন এক টর্চ আর ডান্ডা নিয়ে তাদের বাড়িটার ঠিক নিচ দিয়েই হেটে যাচ্ছেন রমিজ চাচা।এই দিক তাকাচ্ছেনন টর্চ লাইটের আলো ফেলছেন আর বাঁশিটি দিয়ে শব্দ করছেন।

সে বার একদম বাড়ির ঠিক নিচ পযর্ন্ত পৌছে দিয়েছিলেন সালমানকে….সামান্য কিছু সময়েই সালমান তার সাথে কথা বলে বেশ ভালোই ভাব জমিয়ে ফেললো…শহুরে ভিড়ে ঢাকা পরা এই গ্রাম্য মানুষগুলো এক সহজাত স্বভাবই হচ্ছে, যখনই কোন শহুরে মানুষ আধো আধো স্বরে তাদের কাছে নিজেদের সম্পর্কে জানতে চায়,তখনই তারা হড়বড় করে তাদের আদ্যোপান্ত বলা শুরু করে দেয়..

সালমান একমনে হাটতে হাটতে রমিজ আলীর গল্প শুনছিল… প্রায় বিশ বছর ধরে রমিজ আলী ঢাকা শহরে থাকেন।ময়মনসিংহের মানুষ।পরিবার সেখানেই থাকে।দিনের বেলাও এক ফ্যাক্টরিতে সিকিউরিটি গার্ডের আর রাতে এই এলাকা পাহারা দেন..

কথায় কথায় বলতে লাগলেন,” ক্যালা, দুই ভেলা ছাকরি করি বুজঝেন নি??,..এখ ভেলা কইরা পোসাই থো না”..

তাঁর মেয়েটা বড় হয়েছে,কিছু দিন পরেই বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা আছে..ঈদে বাড়ি যেতে পারছেন না কারণ, এখন থেকেই কিছু কিছু টাকা হাতে রাখা দররকার।রাস্তায় দাড়িয়ে বাড়ির পথে ছোটা মানুষগুরো দেখেন… তার মেয়েটা খুব রাগ কেরেছে বাবা আসবে না শুনে..মেয়ের কথা বলতেই শার্টের হাততা দিয়ে চোখটা ঢলতে শুরু করলেন..সম্ভবত চোখে পানি চলে এসেছিল…এখন বাড়ি গেলে এই মাসের অর্ধেক কেটে রেখে দেবে।তাই প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাড়ি যেতে পারছেন।

এই উপমহাদেশের সকল কন্যা দায়গ্রস্ত পিতারাই কন্যা জন্ম নেয়ার পর তাকে মানুষ করার চিন্তা আগে তাকে কি কি জিনিস সাথে করে বিদায় করা যায় সেই চিন্তা করেন..রমিজ আলীও সেই রকমই একজন পিতা।

এই রাত বিরাতে ঘুরা ঘুরি করে চাকরি করতে কেমন লাগে জিঞ্জাসা করতেই ফুরফুরে স্বরে সালমানকে উত্তর দিলেন”হারাদিন বইয়া তাখনের চাখরি করি, আর রাইতে হাট্টা হাট্টা মানযা সোজা করি,খারাপ লাগেনা”!

হাটতে হাটতে কি ভাবেন, সালমান এই প্রশ্ন করতেই হেহেহে করে হাসি দিয়ে বললেন,”কি আর করুম,আল্লা লগে খতা কই???,আল্লারে জিগাই, বেহেশতের নাশপাতিডি খাইতে কেমন হইবো,আর কত এই হেই…”

রমিজ চাচার সাথে সালমানের দ্বিতীয় বার দেখা হয় দু’তিন মাস পরে..সালমানদের বাড়িরর গ্যাসের রেগুলেটা চুরি হয় যাওয়া, বাড়িওয়ালা সমিতির বৈঠকে।চুরির দায়ে রমিজ আলীর বেতন থেকে টাকা কেটে রাখা হবে।সালমানকে চিনতে পরেই এক আকুতি ভরা চোখে তার দিকে তাকালেনন তিনি।শেষমেষ সালমান গরীবলোক অনেক কিছু বুঝিয়ে শুনিয়ে মাফ করিয়ে দিল।



রমিজ চাচারা আজীবন ভর শত শত হাজার টাকায় বানানো ইট পাথরের খাচাগুলোর পাহারা দিয়ে যান..তাদের কোন ছুটি নেই -পেনশন নেই. এরাই এই সমাজ সবচেয়ে উচ্ছিষ্ট পদার্থেরর ন্যায় ব্যবহিত হন..প্রয়োজন শেষেই রমিজ চাচাদের দরকার ফুরিয়ে যায়..এই সমাজ মাস শেষে কয়েকটা নোট গুজে দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেন..আর রমিজ চাচারা রাতের সূর্য হয়ে এই ইট -পাথরের শহরের আলো হয়ে জেগেরন…..!!




সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৫৮
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×