লোকটা মৃদু স্বরে বিড় বিড় করলো।
আমি হাসি হাসি মুখ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। লোকটার দৃষ্টি টেবিলের উপর। কথাগুলি বলতে তার খুব দ্বিধা আর অস্বস্তি হচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম। এটা আমার কাছে আসা রোগীদের কমন সিন্ড্রোম বলা চলে। তাই আমি আমার টেবিলের গ্লাসের নীচে রাখা ছবিগুলি খুব ভেবে চিন্তে দেই। এখন যেমন রাখা আছে, একটা সাদা কালো ঘর কাটা বৃত্ত, হিপনোটিক সাপ্লিমেন্টারি হিসাবে বেশ কাজ দেয়।
"সবসময়?"
লোকটা একটু ইতস্তত করলো-
"না, সবসময় দেখি না। লুকিয়ে থাকে। কিন্তু যখন সামনে আসে......."
কথাটা শেষ করলো না সে।
"এক গ্লাস পানি খাবো।"
আমি একটু সময় নিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির গ্লাস বের করে এগিয়ে দিলাম তার দিকে।
হাতের ডাটাশিট টায় আবার চোখ বুলালাম।
হাতেম সিরাজী; বয়স বত্রিশ, অবিবাহিত।
পেশা- সাংবাদিকতা; পত্রিকার নামটা কখনো চোখে পড়েছে বলে মনে হলো না; ভুঁইফোড় কিছু হবে হয়তো। আজকাল বেকার ছেলেপেলেদের অনেককেই এমন সব পত্রিকার সাংবাদিকের আইডি নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়, পুলিশি ঝামেলা এড়ানোর জন্য। আজকেই তার প্রথম সেশন। কোন মন্তব্য করার আগে আমি পুরো ব্যাপারটা সব সময় বুঝে নেই। প্রয়োজন পড়লে এক প্রশ্ন কয়েকবার করে করি। রোগীরা যে সবসময় খুশী হয় , তা নয়। কিন্তু আমার কাজটা সহজ হয়ে আসে।
গ্লাস পুরোটা খালি করে ফেললো এক ঢোকে।
আবার শুরু করলো কথা বলা, এবার একটু দৃঢ়তা নিয়ে।
"প্রথম দেখি মাস দুয়েক আগে একটা বাসে। এর আগে কখনো দেখে থাকলেও এখন মনে করতে পারছি না। চেহারায় একটু আজব বলেই হয়তো চোখে পড়েছিলো। মাথাটা পুরো কামানো, অস্বাভাবিক ফর্সা গায়ের রঙ; একটা ঢোলা হাফপ্যান্ট পরেছে, গায়ে হাতাকাটা স্যান্ডো গেন্জি। সব ধবধবে সাদা।বয়স বড়জোর আট কি দশ হবে।" একটানা কথা বলে একটু থামলো সিরাজী।
বেশ গুছিয়ে বলতে পারে তো লোকটা। নাহ, পেশাদার সাংবাদিকের একটা ধাঁচ আছে বটে।
"দাড়িয়ে ছিল লেডিস সীট আর ড্রাইভারের মাঝখানে ইন্জিনের বনেটের পাশে। এটা সিটিং বাস বিধায় সচরাচর কেউ দাড়িয়ে যায় না। আমি হয়তো ছেলেটাকে কিছু জিজ্ঞেস ও করতাম, একটু দূরে থাকায় তৎক্ষনাৎ কোন কথা বললাম না।হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ছেলেটা একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সাংবাদিকের কৌতুহল জেগে উঠলো । ভাবলাম কাছে গিয়ে কথা বলি। একা একা এই বয়সের একটা ছেলে বাসে যাচ্ছে , কোথাও যেন একটা কিছু বেমানান।
নেক্সট স্টেপেজ আসতেই উঠে দাড়ালাম; ছেলেটার পাশের লেডিস সীটে বসা লোকটা তাড়াহুড়া করে নামতে গেলো।কিন্তু সে পা বাড়িয়ে নামতে না নামতেই ড্রাইভার বেটা সজোরে টান দিলো। মনে হয় ট্রাফিক সার্জেন্ট দেখেছে কোথাও। সাথে সাথে ফুটপাথ থেকে লোকজনের হাহাকার ভেসে এলো- 'গেলো গেলো'। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি এইমাত্র হুড়াহুড়ি করে নামতে যাওয়া লোকটা পা ফসকে একেবারে চাকার নীচে। চারদিক রক্তে একাকার। আমরা হৈ হুল্লোড় করে গাড়ী থামালাম। ড্রাইভার ব্যাটা কোন ফাঁকে যেন পালিয়ে গেলো। লোকটাকে বাঁচানোর কোন উপায় ছিলনা। এই গন্ডগোলে ছেলেটার কথা ভুলে গেলাম।'
আবারও একটু বিরতি দিলো সিরাজী। আমি তার কথাগুলি রেকর্ড করছি যদিও; তবে হাতেও কিছু নোটস নিচ্ছিলাম।
"এর দুমাস পরের কথা। নিউজ কাভার করতে গিয়েছিলাম পল্টন এলাকায়। আপনার মনে আছে নিশ্চই তত্তাবধায়ক সরকার আসার পরপর দুই জোটের মধ্যে যে মারামারিটা হলো?"
মনে থাকবেনা আবার! একদিনে জনাবিশেক নোংরা রাজনীতির বলি হয়ে গেলো! মাথা ঝাকালাম আমি।
"ঠিক মুখমুখি অবস্থায় যখন আসলো দুই গ্রুপ। ছেলেটাকে দেখলাম একদম মাঝে। লাঠি দিয়ে যখন পান্জাবী পড়া লোকটাকে প্রথম আঘাত করা হলো; ছেলেটা ঠিক তখন পাশে দাড়িয়ে। আতংকে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আশপাশের লোকদের দেখে মনে হলো, কেউ তার উপস্থিতির ব্যাপারে সচেতন নয়! অবশ্য তখন এতোটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল; সবাই তো নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। মাটিতে পড়ে গিয়ে নিথর না হওয়া পর্যন্ত ছেলেটা সেই লোকটার পাশে ছিল। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল আমার দিকে। আর সব ফটো সাংবাদিকের মতো আমিও অনেকগুলি ছবি তুলেছিলাম। শেষবারের মতো লাশের ছবি তুলে লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে দেখি, ছেলেটা নেই।"
আমি মুখ খুলবার আগেই সিরাজী জবাব দিয়ে দিল- " নাহ, কোন ছবিতেই ছেলেটাকে দেখা যায়নি। যেন, সে কোন মানুষ ছিলনা- একটা অশরীরি!"
একটু কেঁপে উঠলো যেন তার গলাটা। তারও দুএক সপ্তাহ পরের কথা।
অসুস্থ এক আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিক্যাল এ, মেডিসিন ওয়ার্ডে। কোন এক কারণে, সে রাত টা আমাকেই থাকতে হয়েছিলো রোগীর পাশে। এটেনড্যান্সের জন্য একটা সোফা রাখা ছিল। সেখানটায় বসেই রাতটা কাটাতে হলো। কিন্তু আতংকের বিষয় হলো, পুরো রাত ধরে বাচ্চাটা এই ওয়ার্ডে আসা যাওয়া করলো। নার্সরা যখনই ঢোকে, সাথে সাথে সেও ঢোকে। পল্টনের ঘটনার পর, আমার একবার মনে হয়েছিলো ছেলেটা আমার মন গড়া কল্পনা। তাই এই ঘটনাকেও আমি দৃষ্টি বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন ভেবে নিলাম।"
বাঃ! লোকটা চিন্তা ভাবনায় দেখি বেশ পরিষ্কার! আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম। সিরাজীর কথা বার্তাকে মনে হয় আরেকটু গুরুত্ব দেয়া যায়!
"সেই বেডের রোগী কিন্তু দিব্যি সুস্থ। পরদিনই রিলিজ নেবার কথা। কিন্তু ভোরের দিকে ঘটলো অঘটনটা। নার্স এসে একটা ইনজেকশন পুশ করার পর থেকেই সেই বেডের লোকটা খুব অস্থির হয়ে পড়লো। মিনিট পনেরো না যেতেই নেতিয়ে পড়লো ছটফট করতে করতে। এই নিয়ে হুরুস্থুল সারা হসপিটালে। পত্রিকায় মনে হয় দেখে থাকবেন- নার্সের ভুল ইনজেকশন দেয়ার কারণে কিছুদিন আগে যে রোগী মারা গেল, সেই ঘটনাটাই ছিল এটা! যেটা আশা করেছিলাম, লোকটা মারা যাবার পর বাচ্চাটাকে আর দেখতে পাইনি।"
"আমি ঘটনাগুলোকে মিলানোর চেষ্টা করলাম। সাইকোলজির কিছু বইপত্র সংগ্রহ করে একটু পড়াশোনাও করলাম। কিন্তু কোনভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য কিছু খুঁজে পেলাম না। কাউকে বলার মতো কিছু ছিলনা সংগত কারণেই; এটাকে হ্যালুসিনেশনই ভাববে সবাই। আপনার নামটা পত্রিকার কোন এক ফিচারেই পেয়েছিলাম। আসবো কি আসবো এমন করতে করতেই আবার ঘটনা ঘটতে শুরু করলো।"
"এটা কবেকার কথা?" জানতে চাইলাম আমি। দিনক্ষণ জানাটা প্রয়োজনীয়।
"হাসপাতালের ঘটনার একমাস পরের কথা; আজ থেকে দুসপ্তাহ আগের।"
লোকটা আবার পানি চেয়ে নিল।
একটু বিরতি দিয়ে শুরু করলো এবার। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে মনে হলো।
"র্যাব একটা কুখ্যাত সন্ত্রাসীকে গ্রফ্তার করেছে শুনতে পেলাম। প্রেস ব্রিফিং কাভার করতে আমিও উত্তরার র্যাব-১ এর অফিসে গেছি। ফটোসেশনে লোকটার ছবি তোলার সময় আবার দেখলাম ছেলেটাকে! ক্যামেরা ডিজিটাল হওয়ায় সাথে সাথেই প্রিভিউ দেখলাম ক্যামেরার ছোট্ট এলসিডি মনিটরে। নাহ , ছেলেটা নেই। অথচ দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, ল্যাংড়া কুদ্দুসের গা ঘেষে মোঁচওয়ালা র্যাবটার পাশে দাড়িয়ে আছে। মন বল্লো আজকেই কুদ্দুসের জীবনের শেষ রাত। তবে এবার ছেলেটা উধাও হলোনা! কুদ্দুসকে নিয়ে যাবার পরও হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে রইলো মোঁচু র্যাবটার গা ঘেষে।"
"এরপর কি হলো?"- দ্রুত মনে করার চেষ্টা করলাম, র্যাবের কোন সদস্য মৃত্যুর ঘটনা হয়েছিলো কিনা?!
"পরদিন দুপুরেই প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হলো র্যাবের কার্যালয় থেকে। ল্যাংড়া কুদ্দুস ক্রস ফায়ারে নিহত! ছেলেটার উপস্থিতি নিয়ে আমি অতোটা চিন্তায় তখনো পড়িনি। ধরে নিয়েছিলাম আমার কোন ইনস্টিংক্ট এর কারণে এই হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।" -তার গলার স্বর আবারও একটু ক্ষীণ হয়ে আসলো যেন।
"কিন্তু তিনদিন আগে থেকে বদলে গেলো সব হিসেব নিকেশ। যার জন্য আমি আপনার কাছে না এসে পারলাম না।"
সিরাজীর গলায় পুরোপুরি আত্মসমর্পনের সুর!
"বাচ্চাটাকে আমি আমার ঘরে প্রথম দেখতে পাই পরশু দিন ভোর বেলায়! এর পর থেকে একমুহুর্তের জন্যেও সে আমাকে ছেড়ে যায়নি। এমনকি এখনও তাকে আমি আপনার চেয়ারের পাশে দেখতে পাচ্ছি"- সিরাজীর গলার স্বর প্রায় ফিসফিসানির পর্যায়ে চলে এসেছে।
আকস্মিকতার ধাক্কায় খোদ আমি নিজেই একটু চমকে গেলাম।
" এখানে? আমার চেম্বারে? আমার পাশে?!"
"জী"
অনেক কষ্টে পাশ ফিরে দেখা থেকে নিজেকে সংযত রাখলাম।
ব্যাটা গল্প তো ভালোই বলে দেখি! একেবারে ভুতুড়ে চমক যাকে বলে।
"স্যার আমার ধারণা, বাচ্চাটা কেবল খুন হতে যাওয়া লোকদের পাশে থাকে। আমার জন্য কোন একটা দূর্ঘটনা অপেক্ষা করছে। আমাকে বাঁচান স্যার।"
সিরাজীর গলায় অসহায় অনুনয়ের সুর!
ঘ্যাস ঘ্যাস করে প্রেসকিপ্শনে কয়েকটা অষুধের নাম লিখে দিলাম।
কিছু ইনস্ট্রাক্শন দিয়ে দিলাম অটিসাজেশন মতো।
"এই ওষুধগুলিও নিয়মিত খান। আশা করছি সিচুয়েশন বদলে যাবে। আপাততো যা দেখছেন, সেটাকে মনের ভুল হিসাবে ইগ্নোর করে যান"।
অনেক সময় নিয়ে গল্প ফেঁদেছে লোকটা। আরো দুইটা রোগী দেখা হয়ে যেতো এতোক্ষণে। হয়তো গলায় কিছুটা অসন্তোষের ছোঁয়া পেয়েই সিরাজী আর উচ্চবাচ্য করলো না। ভিজিট টা দিয়ে চলে গেলো।
সিরাজীর ঘটনাটা দিন দুয়েক মাথার ভেতরে ছিল। তার সিন্ড্রোমগুলি কিছুটা আলাদা বলেই হয়তো। সবসময় তো আর এমন কেইস আসেনা!
এই সময় আবার আমার ক্লিনিকের পার্টনার শহীদুলকে নিয়েও একটু ঝামেলায় পড়ে গেলাম। টাকা পয়সা নিয়ে একটা বড় ধরণের গন্ডগোলে পড়েছিলাম আগেই। ব্যাটা মনে হয় কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। বেশ কদিন ধরেই হিসেব নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করেছে। ঝর্ণা আভাস দিয়েছিলো আগেই; বলছিলো শহীদুল নাকি ইদানীং ওকে সন্দেহ করা শুরু করেছে! ওর মোবাইল নাকি মাঝে মাঝেই নেড়ে চেড়ে দেখে। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ঝর্ণার ব্যাপারটা নিয়েও একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে আমাকে।
যাইহোক, দিন পনেরো বাদে যখন রিসেপশনের ছেলেটা জানালো, সিরাজী নামের একটা লোক এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই সিরিয়াল ভেঙ্গে দেখা করার জন্য চাপ দিচ্ছে; প্রথমে মনে করতে পারিনি কিছু। পরে, স্মৃতি হাতড়ানোর পর নামটা পরিচিত মনে হওয়ায় তাকে ঢুকতে দিতে বললাম।
চেম্বারে ঢুকতেই তার চেহারা দেখে মনে পড়ে গেলো সব।
যাক, ব্যাটা মরেনি তাহলে! কি যে সব আজব রোগের চিড়িয়া আসে!
"কেমন আছেন সিরাজী সাহেব? সব ঠিক তো........?"
প্রশ্ন শেষ হবার আগেই সে উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে শুরু করলো।
"স্যার, আমি জেনে গেছি বাচ্চাটাকে কেন দেখতে পেতাম!"
"কেন?"- প্রশ্নটা আপনা আপনি আমার মুখ থেকে বের হয়ে আসলো।
"বলছি। তার আগে শুনুন সেদিন কি হয়েছিলো, যেদিন আপনার চেম্বারে প্রথম এসেছিলাম।"
তার গলার স্বরে এমন কিছু ছিলো, হেসে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। রিসেপশন এ ফোন করে বলে দিলাম যাতে এখন আর কাউকে ভেতরে না পাঠায়।
"এবার বলেন সিরাজী সাহেব, কি হয়েছিলো সেদিন?"
"সত্যি বলতে কি আপনি শেষ কথাগুলি বেশী গুরুত্ব দেননি বলে মনটা আকটু খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। কোন ভাবেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না আপনার দেয়া সাজেশনের উপর। আনমনে হাটতে হাটতে গলির মোড়ে ঢুকতেই ছিনতাইকারী ধরলো! দুদিক থেকে দুজন। একটার হাতে পিস্তল আরেকজনের কাছে রামদা। আর...., আর তখন বাচ্চাটা ঠিক আমার পাশে! মন বল্লো, সিরাজীরে, আজকেই তোর শেষ দিন। কিছু একটা কর; এমনি এমনি হাল ছেড়ে দিস না। আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, বাচ্চাটাকে যেদিন থেকে আমার সাথে সবসময় দেখতে পাচ্ছিলাম, তার দুদিন পরেই ভার্সিটির পুরানো এক ছাত্রনেতা বন্ধুর কাছ থেকে একটা পিস্তল ধার নিয়ে এসেছিলাম। তার পর থেকে কেন যেন নিজেকে একটু বেশী আত্মবিশ্বাসী লাগলো। মনে হতো এমনি এমনি কাউকে ছেড়ে দিবো না। সে র্যাব হোক, ঘাতক বাস ড্রাইভার হোক বা যেই হোক!"
মনে মনে আঁতকে উঠলাম, ব্যাটা দেখি মোটেই সাধু পুরুষ না!
"পিস্তলটা কাজে দিলো! একটানে কোমড় থেকে বের করে, পিস্তল ধরা ছোড়াটার দিকে তাক করেই ট্রিগার চেপে দিলাম। ধাম করে শব্দ করে পড়ে গেলো ছোড়াটা। সাথের সন্ত্রাসীটা রামদা ফেলেই দৌড় দিল। আমি পিস্তল হাতে কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই বসে পড়লাম। কতক্ষণ বসে ছিলাম জানিনা। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যা হয়ে গেছে। কিন্তু বাচ্চাটাকে আর দেখলাম না! পুলিশ আর র্যাব এসে যখন জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো; তখন আশে পাশের অনেকেই সাক্ষী দিলো আমার হয়ে! নিজেদের গুলিতে নিজেরাই ঘায়েল হয়েছে- এমনটাই মনে হলো সবার কাছে। আমার পিস্তলটাকেও ওদেরই মনে করলো সবাই। আঁধার থাকার কারণে কেউ আসল ঘটনা বুঝে উঠতে পারেনি। তারপরও দিন পনেরো হাজতে থাকলাম, টাকাও খরচ হলো কিছু।
স্যার, আমি জেলে বসেই বুঝেছি, বাচ্চাটাকে কেন দেখেছিলাম!"
"কেন?"
" আমার বুঝতে ভুল হয়েছিলো। বাচ্চাটা আসলে খুন হতে যাওয়া লোকের সাথে থাকে না। সে থাকে খুনীর সাথে! এ্যাকসিডেন্টের ঘটনায় সেই ড্রাইভার ছিল খুনী, বাচ্চাটা তার পাশেই দাড়িয়ে ছিল। পরেরবার পল্টনে যেই লোকটা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারছিলো, বাচ্চাটা তাকেই সঙ্গ দিচ্ছিল। হাসপাতালে মেয়ে নার্সটা যতবার রুমে ঢুকছিলো বাচ্চাটা তার সাথে সাথেই ছিল। ভুল ইনজেকশনটা সেই ই দিয়েছিল। আর ল্যাংড়া কুদ্দুসের ক্রসফায়ার করেছিলো মোঁচওয়ালা র্যাবটা। বাচ্চাটা তার পাশেই দাড়িয়ে ছিল।"
একনাগাড়ে এতো গুলি কথা বলে একটু হাঁপিয়ে গেছে সিরাজী।
" স্যার, আপনাকে কথাগুলি জানিয়ে রাখলাম; কারণ বাচ্চাটাকে আমি এখন দেখতে পাচ্ছিনা ঠিকই; কিন্তু আর কেউ কখনো যদি আপনার কাছে এমন ঘটনা নিয়ে আসে। তাহলে আমার অভিজ্ঞতাটা আপনার কাজে লাগবে। তাই বিরক্ত করে গেলাম। কিছু মনে করেন নিতো, স্যার........."
সিরাজী কথা শেষ করার আগেই ধরাম করে চেম্বারের দরজা খুলে গেলো। ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকলো আমার পার্টনার শহীদুল! তার ফর্সা মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে আছে। হাতে একগাদা কাগজ!
"উই নিড টু টক্!"
তার গলায় পাথরের কাঠিন্য!
সিরাজী কিছু একটা গন্ডগোল আঁচ করতে পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো।
"স্যার, আমি তাহলে আসি!"
বেড়িয়ে গেলো সে।
কিন্তু আমার দৃষ্টি বা শ্রুতি কোনটাই শহীদুল বা সিরাজী কারো দিকে নিবদ্ধ ছিলনা।
আমি দেখছিলাম বাচ্চাটাকে। ফর্সা, গোলগাল, মাথায় একদম কম চুল। স্যান্ডো গেন্জি আর হাফপ্যান্ট পড়া। বড় বড় কালো চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ক্যাবিনেটের ওখানে একটু আগেও কেউ ছিলনা। রুমে আছে এখন কেবল দুজন মানুষ।
আমি ও শহীদুল।
বাচ্চাটা কাকে সঙ্গ দিচ্ছে?!
ভাবছি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




