somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিভীষিকার সেই কালরাত্রিতে

২৫ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৩:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কেবল বাঙালি জাতির ইতিহাসে নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। এ দেশের মানুষের কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বর্বর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠেছিল এই কালরাত্রিতে।

আজ থেকে ৪৪ বছর আগে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালি গণহত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে মধ্যরাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এদিন সন্ধ্যায় ঢাকা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সোজা চলে যান এয়ারপোর্টে। এর আগেই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে পাক প্রেসিডেন্ট বিমানে করে ঢাকা থেকে পালানোর আগে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে পাক সেনাবাহিনীকে বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে যান। তার সেই নির্দেশ অনুযায়ী ভয়াল এই রাতে হানাদার বাহিনী ঢাকায় অজস্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ হত্যা করে।

মাত্র এক রাতে কেবল ঢাকা শহরেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় অন্তত ৫০ হাজার ঘুমন্ত মানুষকে। হত্যাযজ্ঞ চলে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের বুকে নেমে আসে পাকিস্তানের বর্বর সেনাদের অত্যাচার, উত্পীড়ন, পাশবিকতা ও হিংস্রতার থাবা। সে নিধনযজ্ঞ চলে মুক্তিযুদ্ধের টানা নয় মাস। পাকিস্তানির বাহিনীর এই বর্বরোচিত হামলা থেকেই সূচিত হয় জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের।

সেই কাল রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ। গাঢ অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়া মানুষদের হত্যা করতে নরকের দরজা খুলে জলপাই রংয়ের ট্যাঙ্ক নিয়ে বেরিয়ে আসে হানাদাররা । রাত সাড়ে ১১টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ছড়িয়ে পড়ে শহরময়। আকাশ কাঁপিয়ে চিত্কার করে ওঠে রিকয়েললেস রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ-নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। রাতভর চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ, ধ্বংসের তাণ্ডব।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই হতচকিত অসংখ্য মানুষ ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। দানবীয় বাহিনীর আক্রমণের বিভীষিকায় নিমজ্জিত হল ঢাকা। কেঁদে উঠল শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাত, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস। মানুষের কান্নায় ভারি হল আকাশ। চারদিকে তখন কেবল আগুনের পিণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ, মানুষের মর্মন্তুদ চিত্কার। মধ্যরাতেই ঢাকা পরিণত হল লাশের শহরে। রচনা হল পৃথিবীর এক জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার ইতিহাস।

বাঙালি স্বাধীকার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে অভিযানে নামে ১৮নং পাঞ্জাব, ২২নং বেলুচ, ৩২নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিল ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এই সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে।অপারেশন সার্চলাইটের নকশা অনুযায়ী ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় আড়াইশ' ছাত্র ও প্রগতিশীল ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়।

বিভীষিকার এ রাতের প্রথমভাগে রাজারবাগ পুলিশ বাহিনী ও পিলখানার বাঙালি ইপিআরদের নিরস্ত্র করে পাকিস্তানি সেনারা। সেই কালরাতে বাঙালিদের পক্ষ থেকে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে উঠে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রের আক্রমনে ধূলোয় মিশে যায় থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে গড়া সেই প্রতিরোধ। রাজারবাগে পুলিশের সদর দফতরে সে রাতে ১১শ’ বাঙালি পুলিশের রক্ত ঝরিয়েও ক্ষান্ত হয়নি বর্বররা, গুঁড়িয়ে দেয় পুরো ব্যারাক, জ্বালিয়ে দেয় সবকিছু।

সেই রাতেই গ্রেফতার করা হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল আওয়ামী লীগ প্রধান বাঙালীর প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তবে গ্রেফতারের আগে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি তত্কালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে যন।

এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার। পাকিস্তানীদের পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে পূর্ব পাকিস্তানের সারাদেশে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। জীবন বাঁচাতে প্রায় ১ কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, সামরিক বাহিনীর বাঙালী সদস্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে মুক্ত করতে কয়েক মাসের মধ্যে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সারাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।
দীর্ঘ নয় মাস বুকের রক্ত ঢেলে লড়াই করে ৩০ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে বাঙালি জাতি পায় স্বাধীনতার দেখা। যুগে যুগে শোষিত ও নির্যাতিত একটি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন পূরণ হয় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৩:২০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×