এক গহীন জঙ্গলে ছোট একটা গাছের ডালে বাস করতো একটা ডানা ভাঙা টুনটুনি পাখি। ডানা ভাঙা ছিল বলে পাখিটা কোথাও উড়ে যেতে পারতো না, কারো সাথে ঘুরতে যেতে পারতো না, মিশতে পারতো না! টুনটুনি তার ভাঙা ডানা নিয়ে আশেপাশের ঘাস আর ঝোপের ভেতর থেকে ছোটখাটো পোকামাকড় ধরে খেত আর মাঝে মাঝে তার ছোট্ট বাসায় বসে করুণ সুরে বিষন্ন মনে গান গাইতো।
একদিন একটা দাঁড়কাক সেই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় টুনটুনির গান শুনতে পেল। এমন করুণ গলায় কে গান গাইছে সেটা জানতে কাকটার খুব কৌতুহল হল। কাক খুঁজে খুঁজে টুনটুনির বাসাটা বের করলো। ছোট্ট বাসায় ছোট ডানা ভাঙা পাখিটাকে দেখে কাকের খুব মায়া হলো! সে টুনটুনির সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্প করলো। টুনটুনির চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ! সে যতই এটা ওটা নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে কাক ততই আগ্রহ নিয়ে তার প্রশ্নের জবাব দেয়। এক সময় সন্ধ্যা হয়ে গেল। কাক সেদিনের মতো বিদায় নিল, তবে কথা দিয়ে আসলো সে প্রায়ই টুনটুনির সাথে গল্প করতে আসবে। টুনটুনির আনন্দ আর ধরে না। সে প্রতিদিনই একগাদা কৌতুহল আর উৎসাহ নিয়ে কাকের জন্য অপেক্ষা করে আর টুনটুন করে গান গায়। কাক আসে, টুনটুনিকে রঙবেরঙের গল্প শোনায়। কখনো ঝমাঝম চলা রেলগাড়ীর গল্প, কখনো কালো ধোঁয়া বের করে চলতে থাকা স্টিমারের গল্প, তো কখনো ডাস্টবিন ভর্তি রসালো সুস্বাদু লোভনীয় খাবারের গল্প। এসব গল্প শুনতে শুনতে ডানা ভাঙা টুনটুনিটা যেন আপন চোখে পৃথিবীটাকে দেখতে পায়। কাকের গল্প গুলো সব তার নিজের গল্প মনে হয়। প্রায়ই আফসোস হয়, ইশ ডানা দুটো যদি তার ঠিক থাকতো তাহলে সেও কাকের মতো এতকিছু দেখতে পেত! আর কাউকে শোনাতে পারতো এমন গল্প। একদিন টুনটুনি কাকের কাছে আবদার করে বসলো যে সেও যাবে তার সাথে পৃথিবী দেখতে।
ছোট টুনটুনির আবদার শুনে কাকের মায়া হলো। যদিও তারপক্ষে টুনটুনিকে নিয়ে সবকিছু দেখানো সম্ভব ছিল না। তাই শেষে ঠিক করলো টুনটুনির নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য সে পৃথিবীটাকে তার কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। এরপর কাক যেখানেই যায় তার কর্কশ গলায় ‘কা কা কা’ করে অন্য পাখিদের বলতে থাকে, “ঐ জঙ্গলে যদি কখনো যাও ছোট টুনটুনিটার সাথে দেখা করে এসো, সে তোমাদেরকে সুন্দর গান শোনাতে পারবে।” কাকের কথা ময়ূরের কানে গেল, কাকের কথা রাজহাঁসের কানে গেল, কাকের কথা দোয়েলের কানে গেল, কাকের কথা ঈগলের কানে গেল, এমনকি নিরীহ ঘাসফড়িঙও বাদ গেল না। ছোট টুনটুনির গান শোনার জন্য সবাই উদগ্রীব। একে একে ময়ূর গেল, রাজহাঁস গেল তার দলবল নিয়ে, ঈগল গেল, দোয়েল গেল, বাবুই গেল, টিয়া গেল, গেল সবুজ ঘাসফড়িঙ। যেই যায় মুগ্ধ হয়ে টুনটুনির গান শোনে আর টুনটুনিকে শোনায় তাদের দেখা পৃথিবীর গল্প। নিজের চারপাশে এত এত পাখি পেয়ে টুনটুনির আনন্দ আর ধরে না। দেখতে দেখতে ছোট টুনটুনির ছোট্ট বাসাটা যেন সুখে ভরপুর হয়ে গেল। সব সময়ই কেউ না কেউ তার সাথে থাকতো, আর থাকতো গল্প আর গান।
এদিকে কাক তখনও টুনটুনির বাসায় যেত। কিন্তু দিন দিন কাকের প্রতি টুনটুনির আগ্রহ কমতে থাকলো। সে ময়ূরের সাথে লেজ দুলিয়ে নাচে, রাজহাঁসের হাঁটার ভঙ্গি নকল করে, কখনো বা ঈগলের মতো থাবা উঁচিয়ে ঘাসফড়িঙকে ভয় দেখাতে চায়। দাঁড়কাকের কর্কশ গলার গল্পের চেয়ে ঈগলের শিকার ধরার কাহিনী তার কাছে অনেক বেশী রোমাঞ্চকর মনে হতো। দাঁড়কাকের ডাস্টবিনের খাবারের গল্পের চেয়ে টিয়াপাখির লালমরিচ খাওয়ার গল্প তার কাছে বেশী মজার লাগতো। একসময় দাঁড়কাক অনুভব করলো যে তাকে ছাড়াই টুনটুনিটা বেশ ভাল আছে। যদিও টুনটুনির সাথে গল্প না করলে দাঁড়াকাকের ভাল লাগে না, কিন্তু টুনটুনির আনন্দ দেখে সে আর কিছু বললো না। সে কমিয়ে দিল টুনটুনির বাসায় যাওয়া। অন্য পাখিরা যখন টুনটুনির ছোট্ট গাছতলায় নাচের আসর বসাতো দাঁড়কাক তখন কোন এক ডাস্টবিনের ভাঙা দেওয়ালে বিষন্ন মনে বসে থাকতো। দাঁড়কাকের আর উড়তে ইচ্ছে করে না, নতুন কিছু দেখতে আগ্রহ হয় না। আর উড়ে দেখেই বা করবে কি? সে তো আর আগের মতো টুনটুনিকে গল্প শোনাতে পারছে না। তবুও টুনটুনিটা ভাল আছে এই মনে করে সে এ শহরে ও শহরে উড়ে বেড়াতো লাগলো বিচ্ছিন্ন ভাবে। এখনো যদি আপনারা শহরে যান, দেখবেন একটা বিষন্ন দাঁড়কাক এলামেলো ডানা ঝাপটিয়ে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আনমনে ডেকে উঠছে ‘কা কা কা।’
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Sylvanlobo
জানুয়ারী ২২, ২০১৬
রামপুরা, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:২৪