somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাপক নীলু-৩

০১ লা জুন, ২০১১ সকাল ৯:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৯.০৫.১১
রবিবার

নীলু,
আমাদের এলাকায় যে বুড়ো পোস্টম্যান ছিলেন তার বাহন দ্বিচক্রযানটা ছিলো খুব অদ্ভুত- মনে হতো এই বুঝি খুলে পড়লো তার কোন কলকব্জা! আর ঐ পোস্টম্যান দাদুও ছিলেন অন্যরকম- কেমন যেন পাগল পাগল। এলাকার সব জায়গার চিঠি বিলি করার শেষে আসতেন আমাদের বাড়িতে, প্রায়ই ঠিক মধ্যদুপুরে- যখন আমরা খেতে বসতাম। আমার মা, ঠাকুরমা, কাকীমারাও যেন জানতেন এই অত্যন্ত সহজ সরল আর ভালো মানুষটার দুপুর বেলার খাবার আমাদের বাড়িতে খাওয়া মোটামুটি নিয়মভুক্ত। তখন তো মোবাইলের যুগ ছিলো না, তাই ভরসা ছিলো হলুদ খামে আটকানো কথামালা, আর আমার জ্যাঠামণি, পিসী, সেজোকাকা, বাবা সবাই বাড়ির বাইরে থাকতো বলে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি আসতো, ফলে দিনে দিনে অবচেতনে ঐ বুড়ো পোস্টম্যান দাদু আমাদের আপনজনই হয়ে ছিলেন। নাম জানা ছিলো না তার, কিন্তু দৈবাৎ তার অনুপস্থিতি লম্বা সময়ের হলে মনে হত কী যেন একটা ঘটছেনা!
আমি জীবনে প্রথম চিঠি লিখি ক্লাস টু’তে পড়ার সময়। আমার জ্যাঠামণি তখন দূরের শহরে থাকতো। ভেবে দেখ্ বাড়ির সবথেকে ছোট্ট বাবুটা সদ্য শেখা বর্ণগুলোকে কোনরকমে সাজিয়ে যদি লিখে ফেলে গোটা একটা চিঠি তবে দূরে থাকা আপনজন তা হাতে পেয়ে কেমন আনন্দ পাবে। এই সেদিন জ্যাঠামণি কাছে পেয়েছিলাম সেই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। চিঠিটা জানিস কী লিখেছিলাম? শোন্ তবে-
“মণি, তোমার গবেষণার খবর ভালো তো? মণি, তোমার আলুগাছ বড় হয়েছে। এক ফানা কলা খেয়েছি। তো মার জন্য থুয়ে দিয়েছি। আমাদের পরীক্ষা ঈদের পরে। বাড়ির সবাই তোমার জন্য মাতাল। টাকার জন্য চিন্তা করোনা। গরুর দুই কেজি করে দুধ হচ্ছে। গোয়ালঘর বেঁধেছে। তুমি ভালো আছো, ভালো থেকো। জয়গুরু দিয়ে শেষ করলাম।”
কেমন লেগেছে বল্ ? হয়তো বাড়ির বড় কেউ আমায় শিখিয়ে দিয়েছিলো কথাগুলো, কিন্ত তাতে কী যায় আসে; চিঠি মানে তো শুধু কথা বা তথ্য নয়, তার সাথে জড়িয়ে থাকে স্পর্শ, খামভর্তি করে পাঠিয়ে দেয়া কিছু মুহূর্ত!
আমাদের বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে চিঠি পড়া ছিলো প্রায় উৎসবের মত একটা উপলক্ষ্য। সন্ধ্যার পর উঠোনে মাদুর পেতে চিঠি পড়া হচ্ছে- এ যেন আমি এখনো চোখ বুঁজলেই দেখতে পাই। চিঠি যেই লিখুক না কেন সবথেকে ছোট্ট আমার জন্য ছোট আলাদা একটা চিঠি থাকতোই, যাতে সম্বোধন থাকতো আমার নামের শেষে ‘বাবু’ দিয়ে।
আচ্ছা নীলু, তোর কি মনে পড়ে শেষ কবে তুই চিঠি লিখেছিস, কিংবা চিঠি পেয়েছিস! মোবাইলে sms, ফেসবুকে chatকরে হতো তথ্য জানানো যায়, কিংবা sorry আদান প্রদান করা যায়; কিন্তু বুকের মধ্যে রয়ে যায় কি তার কোন রেশ? বল্ তো কার কোন sms’র কথা তোর মনে আছে, তার চেয়ে ঢের সহজেই মনে করতে পারবি হলুদ খাম খুলে কোন কালে কবে পেয়েছিলি কার হাতের ঘ্রাণ, অথবা কার কোন কষ্টের বিলাপ, অথবা খুশির মিষ্টি সুবাস!
পুরনো চিঠির বাক্স খুলে খুঁজতে খুঁজতে সেদিন একটা চিঠিতে দেখলাম আর্টকলেজ-পড়ুয়া পিসী বাড়িতে জানাচ্ছে তার ভালো কোন ব্যাগ নেই, কাছে হাত খরচের টাকা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। পিসীর এখন সংসার হয়েছে, মেয়েরা বড় হয়েছে; তবু হঠাৎ করে পিসী আমার কাছে হয়ে গেল এক অভিমানী কিশোরী যে তার অভাবী ভাইদের কাছে বিভিন্ন আবদার করছে, আর না পেয়ে কান্নাকাটি করছে। হাতের মধ্যে চিঠিটা আর চোখে পবিত্র দু’এক ফোঁটা জল নিয়ে বুঝলাম কত মায়াভরা এক জগতে বাস করি আমি- আমাদের চারপাশে কত আলো!
মাঝে একদিন সেই পুরনো পোষ্টম্যান দাদুর সাথে দেখা, এখন অবশ্য আর পোষ্টম্যান নন- দেখি শরীর একেবারে ভেঙ্গে গেছে, চোখের দৃষ্টি যেতে বসেছে। নিজেকে চেনানোর পর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “কত বড় হয়ে গেছো, বাবু!” তারপর আমার বাড়ির সবার খবর নিলেন একেবারে কাছের আত্মীয়ের মত করে। বললেন তার কষ্টের কথা, জীবনে কিছু না পাওয়ার কথা। শতমানুষের হাজার খুশির বার্তা বয়ে শেষবেলায় তিনি খুব ক্লান্ত, অসহায়। নীলু, পৃথিবীতে সহজ স্বাভাবিক ভালো মানুষগুলো কিছু পায়না কেন বলতে পারিস? পুরনো জিনিস মানেই কি ফেলনা?
বড্ড সেকেলে বলে চিঠি লেখার রীতিকে ছুড়ে ফেলেছিস্ জানি, তারপরও আমার কথা শুনে একবার বাড়ির পুরনো পোটলা পুটলি ঘেঁটে যতগুলো পারিস পুরনো চিঠি খুঁজে পড়ে দেখিস্। দেখিস্ কিছু না পাবিই!
আর শোন্, মোবাইল করিস্ না, পারলে চিঠি দিস্।
ভালোবাসা।
ইতি।
তোর বন্ধু।

প্রাপক নীলু-১
প্রাপক নীলু-২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×