somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ময়ূরাক্ষী, একজন হিমু! (তৃতীয় পর্ব)

০৭ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাইজান কি হিমু সাজছেন?
রাস্তায় দাঁড়ানো একটা প্রাইভেট কারের সামনের সীটের জানালা দিয়ে মাঝ বয়সী একজন লোক হাসিমুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আজকাল ঢাকার রাস্তায় কালে ভদ্রে অনেক হিমু দেখা যায়। তবে স্যার মারা যাবার পর থেকে এই সংখ্যাটা বেশ কমে গেছে মনে হয়। আগে একুশের বইমেলায় প্রতিদিনই দেখা মিলত হিমুদের। আমি প্রায় সপ্তাহখানেক হল ঢাকার রাস্তায় এই বেশে ঘুরছি। আজই প্রথম কেউ একজন আমাকে দেখে হিমু সাজার কারণ জিজ্ঞেস করল। এ’কদিনে কিছু মানুষ উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল বটে, কিন্তু কথা বলার আগ্রহ কেউ দেখায়নি।
আমি প্রাইভেটকারটা ঘুরে দুটো চক্কর দিলাম। গাড়ীর ভিতরে আর কেউ নেই। অর্থাৎ সামনে যে লোকটা বসা আছে সে নিঃসন্দেহে গাড়ীর ড্রাইভার। গাড়ীর মালিক বা মালিক বংশীয় কারো জন্য বসে বসে অপেক্ষা করছে। গাড়ীর মালিকেরা কখনও কোন কারণ ছাড়া পার্ক করা অবস্থায় নিজ গাড়ীতে বসে থাকে না।
আমাকে দেখতে কি হিমুর মত মনে হয় শাহিন মিয়া।
আমি স্পষ্ট দেখলাম লোকটার মুখ অনেকটা হা হয়ে গেছে। তার মানে আমি যেটা বলেছি সেটা মিলে গেছে। একবার যেহেতু মিলে গেছে সুতরাং আরও দুই একবার মিলে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।
আপনে আমার নাম জানলেন ক্যামনে স্যার?
ভাইজান থেকে স্যারে চলে গেছে। এটা ভালো। সে এখন ধরে নিয়েছে আমি বড় ধরনের কেউ। আমার পোশাকের চাইতে তার উপর বেশি প্রভাব ফেলেছে আমি যে তার নাম জানি এই বিষয়টা। এ ধরনের লোকেরা অল্পতেই অবাক হতে ভালবাসে।
তোমার আপা কই? তার তো এখন গাড়ীতে থাকার কথা। তোমাকে কিছু বলেনি?
না তো স্যার। আপামনির ক্লাস আছে। আর আধাঘণ্টার মধ্যেই চলে আসার কথা। আপনি কি ইমরান স্যার?
‘হুম’ গলাটা গম্ভীর করে বললাম।
আমি শুনছিলাম আপনার সাথে আপামনির বিয়ের কথা চলতেছে।
শোন শাহিন, তোমার আপামনির সাথে আমার আজ এখানে দেখা করার কথা। আমি মনে হয় একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। যা হোক, তুমি এক কাজ কর। আমি গাড়ীতে উঠে বসি। তুমি এসিটা চালু করে দাও। এসি আছে না?
অবশ্যই আছে স্যার। আপনি উঠে বসেন।
ভালো একটা গান চালু করে দাও। তোমার আপামনি না আসা পর্যন্ত গান শুনি।
কোনটা দিব স্যার?
তোমার পছন্দ কোনটা?
আমার হিন্দি গান ভালো লাগে।
দাও, হিন্দি গান শুনি।
আন্দাজে লেগে যাওয়া দুইটা ঢিলের বদৌলতে আমি এখন শাহিনের আপামনির হবু জামাই। মোটামুটি ভালো মানের একটা গাড়ীতে বসে এসির হাওয়া খাচ্ছি। গান চলছে। “পিয়া বাসান্তি রে, কাহে সাতায়ে আ যা” ......... গানটা খুব সম্ভবত ওস্তাদ সুলতান খানের গাওয়া। এর আগেও কোথায় জানি শুনেছিলাম।
আমার হাতে সময় মাত্র আধা ঘণ্টা। শাহিনের আপামনি আসার আগেই আমাকে কেটে পড়তে হবে। এই আধা ঘণ্টার মাঝে কিছু জিনিসের লিস্ট করে ফেলতে হবে।
নাম্বার এক, আমার থাকার জন্য একটা জায়গা খুঁজতে হবে। থাকা বলাটা পুরোপুরি ঠিক হবে না। বলা উচিত লুকোনোর জন্য। যেখানে আমার পরিচিত লোকেরা আমাকে খুঁজে পাবে না। বন বাদাড় এরজন্য সবচে ভালো জায়গা। কিন্তু মহাপুরুষেরা বনে বাদাড়ে থাকেন না। তাঁরা থাকেন লোকালয়ে। এর পেছনে যথেষ্ট শক্ত কারণ আছে। মানুষ হয়ে মানুষের মাঝে থেকে নিজেকে মানবীয় চাহিদা থেকে বাঁচিয়ে রাখার কারণেই তাঁরা মহাপুরুষ। বনে বাদাড়ে ঘুরে এই সার্টিফিকেট অর্জন করা সম্ভব না। আমি মহাপুরুষ না। আমি শুধু এই ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে চাই। এবং খুব ভালভাবেই করতে চাই।
স্যার আপামনি আসতেছে। আপনাকে এই কাপড়ে দেখে নিশ্চিত টাসকি খাবে।
শাহিনের চোখেমুখে বেশ উত্তেজনা। তার আপামনি হবু স্বামীকে হলুদ হিমুর বেশে দেখে বড়সড় টাসকি খাবে এটা মনে মনে চিন্তা করে সে বেশ মজা পাচ্ছে।
আমি আর নাম্বার দুইয়ে যেতে পারলাম না। এখন আগে গাড়ি থেকে নেমে সটকে পড়া দরকার। সেটারও সুযোগ পেলাম না। আমি নামার আগেই শাহিনের আপামনি হাজির হয়ে গেল।
মেয়েটা এসেই সরাসরি গাড়ীতে উঠে পড়ল। আমার ধারনা সে বাইরে থেকেই আমাকে দেখতে পেয়েছে। অচেনা একজন মানুষ একটা কটকটা হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে তার গাড়ীতে বসে আছে এ নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। গাড়ীতে উঠেই বলল, শাহিন ভাই, তাড়াতাড়ি চলেন। আর এসিটা বন্ধ করে দ্যান।
শাহিন হতাশ হয়ে গাড়ি স্টার্ট করল। আপামনির টাসকি খাওয়া না দেখার হতাশা।
মেয়েটা যেহেতু আমার উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিল না, তাই আমিও তার দিকে না তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে থাকলাম। একটু পর শাহিনকে বললাম, এসিটা ছেড়ে দাও তো শাহিন, প্রচণ্ড গরম লাগছে।
বলেই অপেক্ষা করলাম পেছন থেকে মেয়েটা কিছু বলে কিনা! কোন কথা এল না পেছন থেকে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি ঠিক নেই। শাহিনের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম গাড়ীতে কেউ নেই।
স্যার আপামনি আপনাকে ভিতরে যেতে বলেছেন।
আমি দ্বিতীয়বার কোন চিন্তা না করে আস্তে আস্তে বাসার ভেতর ঢুকে পড়লাম। ঢোকার সময় আশেপাশে কোনোদিকে তাকালাম না। বাড়িটা বাহির থেকে যতটা না, তার থেকে ভেতরে অনেক বেশি পরিপাটি। দোতলা বাড়ি। আমি নিচতলায় ঢুকেছি। নীচতলাটা মনে হয় অতিথিদের বসার জন্য। বড় হলরুমের মত। দেয়ালে কয়েকটা জলরঙয়ের ছবি টানানো। এই রুমে এসি আছে। কিন্তু এসি চলছে কিনা বুঝতে পারলাম না। বেশ গরম। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এসির রিমোট পেলাম না। শেষমেশ একটা সোফায় বসে পড়লাম। এই রুমে কোন ঘড়ি নেই। ঘড়ি না থাকার কারণ ভেবে ভেবে সময় পার করা যায়।
ঘরের কোণে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম হয়তো কেউ এসে ফোনটা ধরবে। পরপর দুবার বাজার পরও কেউ এল না। তৃতীয়বারের বেলায় আমি নিজেই ধরলাম। অতি বিনীত স্বরে বললাম,
হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। শুভ মধ্যদুপুর। আপনি এই মুহূর্তে কাকে চাচ্ছেন?
অপরপাশ থেকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন এল, তুমি কে বলছ?
জী জনাব! আমার নাম হিমু। ভালো নাম হিমালয়। শাহিনের আপামনি আমাকে এই বাড়ির ভেতরে এসে বসতে বলেছেন। আপামনির নাম এখনো জানতে পারি নি। ইনফ্যাক্ট আমি তাকে এখনো ঠিক মত দেখিইনি। দেখা মাত্র আমি নাম জিজ্ঞেস করে আপনাকে জানিয়ে দেব। আর যদি আপনি চান ...............
আমার কথা শেষ হবার আগেই ভদ্রলোক একরকম চেঁচিয়ে উঠলেন।
বদমাইশ! তুই আমার বাড়িতে ঢোকার সাহস পেলি কোত্থেকে? তোকে এ বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে কে? সত্যি করে বল তুই আমার মেয়েকে কি খাইয়েছিস?
স্যার আপনার মেয়ের নামটা কি একটু বলা যাবে? আপনার মেয়ে কি খেতে পছন্দ করে তাও একটু বলে দিন।
হারামজাদা! তুই আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙেছিস আর তার নাম জানিস না! আমার সাথে ফাইজলামো করিস? তুই জানিস আমি তোকে বাংলাদেশ থেকে হাওয়া করে দিতে পারি।
আমি ফোন রেখে দিলাম। ভদ্রলোক গালাগালিতে চলে গেছেন। আরও কিছুক্ষন থাকলে হয়তো অশ্রাব্য কিছু শুনতে হতে পারে। এইটা কোন সমস্যা না। হিমুরা বেশ লম্বা সময় ধরে অশ্রাব্য জিনিস শ্রাব্যতার সীমার মাঝে শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু উনি ক্ষমতার কথা বলা শুরু করে দিয়েছেন। মানুষ সবচে অক্ষম। সবচে অক্ষম প্রজাতির কাছে থেকে ক্ষমতার ভাষণ হিমুরা আমলে নেয় না। সবচে ক্ষমতাবান যে সে এখনো চুপ আছে। আসলেই তো, সে কেন চুপ আছে? তার হয়তো ক্ষমতা ছুটে যাবার ভয় নেই। আসলেই, যাদের ক্ষমতা ছুটে যাবার ভয় থাকে তারাই মানুষকে হাওয়া করবার জন্য উতলা হয়ে থাকে। সবথেকে ক্ষমতাবান যেদিন মৌনতা ভাঙবে সেদিন মানুষ কি করবে? হয়তো সেদিন সেই ক্ষমতার নিচেই আশ্রয় নিতে চাইবে সবাই। মানুষ সত্যিই একটি আজব প্রাণী।
আমি এবার সোফার উপর শুয়ে পড়লাম। কারো বিয়ে ভাঙার মতো কিছু করেছি কিনা চিন্তা করতে লাগলাম।
এবার যে আমার ঘুম ভাঙালো সে খুব সম্ভবত সেই মেয়েটি যার সঙ্গে আমি গাড়ীতে করে এসেছি। আমার মনে হল এই মেয়েটিই টেলিফোনের ওই ভদ্রলোকের মেয়ে। মেয়েটির দিকে তাকালাম। চোখে ঝাপসা দেখছি। বেশ লম্বা সময় ধরে ঘুমিয়েছি মনে হয়। মেয়েটার মুখ ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না। চোখে পানি দেয়া দরকার। হুট করে বলে ফেললাম, ম্যাডাম বাথরুমে যাব। চোখে ঠিকভাবে দেখতে পারছি না।
আমার কথা শুনতে পেল বলে মনে হয় না। জেরা করার ভঙ্গিতে বলল, আপনি কি যেখানে সেখানে এভাবে ঘুমিয়ে যান? অচেনা একটা মানুষের গাড়ীতে মিথ্যে কথা বলে উঠলেন, উঠে নাক ডেকে ঘুমুলেন। আবার সেই মানুষের বাড়িতে এসেও পুরো চার ঘণ্টা দিব্যি ঘুমিয়ে কাটালেন। আপনার একটুও ভয় হল না?
ম্যাডাম চাইনিজ একটা প্রবাদ আছে, “If you want happiness for an hour, take a nap” অর্থাৎ আপনি যদি এক ঘণ্টার জন্য সুখী হতে চান, তাহলে আর কোন দিকে না তাকিয়ে সরাসরি ঘুমিয়ে যান।
মেয়েটা শব্দ করে হেসে উঠলো। আমি সত্যি সত্যি এত সুন্দর হাসি কখনও শুনিনি। আমার কথাটাতে কি আসলেই হাসার মতো কিছু ছিল!
কিছু খাবেন? নিশ্চয়ই ক্ষুধা আছে পেটে?
অবশ্যই খাবো। বাসায় কি গরম ভাত আছে? না থাকলে তাড়াতাড়ি করে কয়েকটা চাল ফুটিয়ে দিন। সাথে ডিমভাজা আর আলুভর্তা হলেই চলবে। যদি ঘি থাকে তাহলে ওটাও দিয়ে দেবেন।
ঘি নেই। আনিয়ে দিচ্ছি। আর বাথরুম আপনার সোজা। হাতমুখ ধুয়ে দোতলায় চলে আসুন।
আমি বাথরুমে চলে গেলাম। চোখে পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করলাম। এত বড় বাথরুম! এখানে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে গোসল করা যাবে। বড়সড় সাইজের একটা বাথটাব বসানো এক কোণে। বেশ দামী একটা শাওয়ার লাগানো। পুরোটাই টাইলস করা। গোসল করবার লোভ হচ্ছে। এমনিতেই দু দিন হল গোসল হয় না। এখনকার জন্য আপাতত হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে আসলাম। আমার মনে হল এই বাড়িতে আরও অনেকবার আসতে হবে আমাকে। কোন একসময় করে নেব গোসল।
বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখলাম একজন বয়স্ক মহিলা টাওয়েল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, ছোট আফা আপনারে নিয়া খাবার টেবিলে যাইতে বলছে।
খাবার দিয়েছেন?
জী হ।
আমার মনে হচ্ছে এই মহিলা আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। টাওয়েল দেবার সময় হাত কাঁপছিল। কথা বলার সময় দেখছি কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
আপনার নাম কি?
আমি জরিনার মা খালা।
অবাক নাম। মা খালা একসাথে। খুব সম্ভবত নামটা এরকম হবে, ‘জরিনার মা’ খালা।
আচ্ছা ‘জরিনার মা’ খালা আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
মহিলা কোন কথা না বলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম, চলেন তো খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
আমি খেতে বসার আগে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ছোট আফা কই?
আফা ঘুমাইছে। আপনারে খাইয়া চইলা যেতে বলছে।
অবাক কাণ্ড। মেয়েটাকে তো দেখতেও পারলাম না।
আমি খেতে বসলাম। গরম ভাত, ডিমভাজা, আলুভর্তা, সাথে ঘি।
‘জরিনার মা’ খালা, রান্না কি আপনার আফা করেছে?
জী।
মহিলা বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছে। খুব সম্ভবত দোয়া দরূদ পড়ছে। মনে হচ্ছে তার সামনে বসে মানুষ না স্বয়ং জিনের বাদশা আলুভর্তা আর ডিমভাজা দিয়ে ভাত খাচ্ছে।
আমি মোটামুটি দানবীয় স্টাইলে খাবার শেষ করার পর বললাম, খালা কাছে আসেন আপনার সাথে কিছুক্ষন গল্প করি। এরপর চলে যাব।
এবার মনে হয় তিনি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন। হাত জোর করে বলতে লাগলেন,
‘হুজুর আমারে মাফ কইরা দ্যান। আমি দরকার হইলে এই বাড়ির চাকরি ছাইড়া দিমু। আমার স্বামী হাঁটতে চলতে পারে না। আমার কোন ক্ষতি কইরেন না।‘ বলেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল।
মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল। এর কান্না এখন কিভাবে থামাই। আর আমি কোনদিক দিয়ে উনার হুজুর লাগি! আর কোন উপায় না দেখে জোরে করে একটা ধমক দিয়ে বললাম, এই বুড়ি! একদম চুপ। আর তিন সেকেন্ডের মধ্যে কান্না না থামালে তোর স্বামীর ঘাড় আজ রাতেই মটকাব।
আমার ধমকে কারেন্টের মত কাজ হল। বেচারি এক্কেবারে চুপ হয়ে গেল।
এবার আমি যা যা জিজ্ঞেস করব সোজা সাপ্টা উত্তর দিবি। নাহলে তোর ঘাড়ও মটকাব। সত্যি করে বল তুই আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছিলি কেন?
হুজুর আপনে তো সবি জানেন। তারপরেও গরীবের কাছে জিগান ক্যান। আর কেউ না বুঝলেও আমি জানি আপনি আমার আফারে পাইছেন। আর কেউ না জানলেও আমি জানি আপনে অনেক বড় জিনের বাদশা।
তুই কিভাবে জানিস আমি জিনের বাদশা? আমি তোর আফারে পাইছি? পুরোটা বল। এক লাইনও বাদ দিবি না।
আপনে তো জানেন ছোট আফার বিয়া ঠিক ছিল ইমরান নামে এক স্যারের সাথে। উনি অস্লিয়া থাকেন (আমি ধরে নিলাম এইটা হবে অস্ট্রেলিয়া) আগামি ফাল্গুনের পনর তারিক বিয়া হওনের কতা আছিল। বড় সাহেব ম্যাডামরে নিয়া দেশে গেছেন। আত্মীয় স্বজনরে নিজ হাতে বিয়ার কাড দেওনের লিগা। আফার আইজ সকালে কি জানি হইল, বড় সাহেবরে ফোন দিয়া কইল উনি বিয়া করবেন না। ইমরান স্যাররেও না কইরা দিছে।
তোর ছোট আফার নাম নাই। নাম বল।
হুজুর, মাফ চাই। আমি আফার বাপের নেমক খাইছি। আফা আমারে উনার নাম কইতে নিষেধ করছে।
তারপর বল।
আফা বলে উনি নাকি কাইল রাতে খোয়াব দেখছে হলুদ পাঞ্জাবী পড়া একজন মানুষ উনারে নিতে আসবে। আমি শুইনাই বুজছি হে যারে স্বপ্ন দেখছে সে মানুষ না। আমি জানি আপনে এই বাড়িতে আসবেন। আমার বাপে বড় কবিরাজ আছিল। সে বলতো কোহেকাফের জিনের বাদশা হলুদ কাপড় পড়ে। হুজুর আপনের পায়ে পড়ি আপনে আমার আফারে ছাইড়া দেন।
আমি সব কথা শোনার পর বেশ ঠাণ্ডা গলায় বললাম, দেখ ‘জরিনার মা’ খালা, আমি কোন জিনের বাদশা না। আমার নাম হিমু। জিনরা ভাত আর আলুভর্তা খায় না। তাদের পছন্দের খাবার হল গোবর আর হাড্ডি। তোমার আপা কোন স্বপ্ন দেখে নাই। সে যেটা দিয়ে আমার কথা বুঝেছে তাকে বলে সিক্সথ সেন্স। বুঝেছ?
জরিনার মায়ের পক্ষে সিক্সথ সেন্স বোঝার কথা না। তারপরেও সে ঘাড় নাড়াল। আমার কেন জানি মনে হল আসলেই এই মেয়ের সিক্সথ সেন্স প্রবল। যদি তাই হয় তাহলে আমার সাথে তার অনেক লম্বা একটা সময়ের জন্য বাধা পড়তে হবে।
তোমার আপা কোন রুমে আছে? আমাকে দেখাও।
জরিনার মা আমাকে নিয়ে যাবার আগেই মেয়েটা এসে ঢুকল। আমি ক্লাস টেনে পড়বার সময় একটা ইংরেজি ছবির পোস্টারে ঠিক এরকম একটা মেয়ে দেখেছিলাম। ছবিটার নাম ঠিক মনে নেই। সেখানে মেয়েটা একটা গোল টুপি পড়ে একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। ওইসময় মনে হয়েছিল সেই মেয়েটা পৃথিবীর সবচে সুন্দর মেয়ে। আজকের এই মেয়েটাকে মনে হয় চোখ বুজে ওই পোস্টারের মেয়েটার জায়গায় বসানো যায়।
মেয়েটা ঢুকেই বলল, খালা তুমি নিচে যাও।
জরিনার মা দেখলাম আবারো বিড়বিড় করে দোয়া দরূদ পড়া শুরু করেছে। সে এখনো আমার ব্যাপারে সন্দেহের মাঝে আছে।
আপনার কি ধারণা আমি আপনাকে স্বপ্ন দেখে বা আপনার সম্পর্কে আগেভাগে জেনে বিয়েতে না করে দিয়েছি?
আমার ধারণা আপনি ইমরান সাহেবকে পছন্দ করেন না। আপনি আপনার বাবাকে সরাসরি কথাটা বলতে পারছিলেন না। যখন তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন তখন আপনি একটা কথা বানিয়ে বলে দিলেন। হলুদ পাঞ্জাবীর কথাটা চলে আসার কারণটা হতে পারে আপনি হয়তো হিমুর কোন বই কাল রাত্রে পড়েছিলেন। দুপুরে যখন আমাকে গাড়ীতে দেখলেন তখন আপনার মনে হল আপনি আমাকে বাড়িতে এনে আপনার কথার সপক্ষে একটা জোর দাবি দাঁড় করাতে পারবেন। যদিও এটাতে কোন কাজ হবে না। আপনার বাবা ধরে নেবেন পুরোটাই আপনার সাজানো। তবে আপনার লাভটা হল, ইমরান সাহেবও হয়তো আর দ্বিতীয়বার এই বিয়েতে রাজি হবেন না।
আপনি তো খুব ভালো যুক্তি দেখাতে পারেন। হিমু তো কখনও যুক্তি নিয়ে চলে না। ওটা তো মিসির আলীর কাজ। ঠিক আছে আপনি এখন চলে যান।
আমার কেমন জানি ইচ্ছে করছিল আরও কিছুক্ষন থাকতে। আমি বলে ফেললাম, আমি কি বাইরে আপনার সাথে কিছুক্ষন হাঁটতে পারি?
আপনার খেয়াল আছে এখন কটা বাজে?
আমি অবাক হয়ে দেখলাম সন্ধ্যা নেমে গেছে।
তুমি কি জান আজ পূর্ণিমা? মেয়েটা জানালার কাছে গিয়ে বলল।
আসলেই তো আজ পূর্ণিমা! আমি হিমু অথচ পূর্ণিমার খবর আমার জানা নেই! আচ্ছা! মেয়েটা কি আমাকে তুমি করে বলল?
আমি যাই।
হিমু! কোন সিক্সথ সেন্স নয়। আমি আসলেই তোমাকে কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি। আমি দেখেছি তুমি আমাকে নিয়ে ময়ূরাক্ষীর তীরে বসে আছ। আমরা পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। আমি দুষ্টুমি করে তোমার মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে ছিলে।
আমি আর দাঁড়ালাম না। পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করে দিলাম। মেয়েটা আমার পিছে পিছে নিচতলায় গেটের বাইরে পর্যন্ত আসলো। বাইরে জ্যোৎস্নার ঢল নেমেছে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম না। কারণ আমি এখনো হিমু হতে পারি নাই। এই মেয়েটার প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করছি। হিমুরা কখনও কিছুর প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে না। কারণ হিমুরা শুধু জ্যোৎস্নার আলো ছাড়া আর কিছু গায়ে মাখে না। মনে মনে ঠিক করলাম পুরোপুরি হিমু না হওয়া পর্যন্ত জ্যোৎস্না দেখব না। জ্যোৎস্নাকে ততদিনের জন্য ছুটি।
আমি মেয়েটাকে রেখে এগিয়ে যেতে লাগলাম। পিছন থেকে আওয়াজ এল, আমার নামটা শুনলে না হিমু?
আমি এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালাম। আমার মনে হল মেয়েটার নাম রূপা। আমি জানি মেয়েটার নাম রূপা। কারণ জ্যোৎস্নার ঢল কখনও হিমুদের একা ভেজায় না। ধরণীর কোন এক কোণে একজন হিমু যখন জ্যোৎস্নায় ভিজে একাকার হয় তখন কোন এক কোণে একজন রূপাও জ্যোৎস্নায় ভিজতে থাকে। (চলবে..)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৫৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×