স্কুলজীবনে একটা বন্ধু ছিল। বন্ধু তো সবারই থাকে , এটা আবার আলাদা করে বলার কি হল! হ্যা, আলাদা করে বলার আছে কিছু।
স্পষ্ট বলতে পারছি না, কিন্তু হয়তো ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শ্রেণীর কথা। আমি স্কুলে বরাবর সবার সাথে মিশলেও নিজের এলাকাতে ভাব-ওয়ালা ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলাম।কারণ ছিল অবশ্যই। আমরা একটা পাঁচতলা বাসাতে থাকতাম। বাসাতে মোট ছয়টা ফ্লাট ছিল। একটাতে ছিলাম আমরা, আর একটাতে ছিল আমার চাচির পরিবার। বাকি রইল, চারটা ফ্লাটের কথা। যারা থাকত, তারা মনে হয়, পরিবার এর বাইরে ছিল না। সবার সাথে সবার সুসম্পর্ক ছিল, একেবারে বাসার ছোট্ট সদস্য থেকে সবচেয়ে বড় সদস্য কেউ এর বাইরে ছিল না।
আমাদের ছোট্ট একটা বাসা। একটা বাসায় কোন কিছু রান্না হলে তার ঘ্রাণ ঠিক অন্যদের নাকের আড়াল করা যাবে না। তাই এখন যখন কারো বাসার রান্নার ঘ্রাণে সারা বাড়ি ম-ম করে, তখন কেবল হা-হুতাশ করতে হয়। আর প্রিয় কিছু রান্না হলে, একটা পেট-খারাপ হওয়ার বদদোয়া না দিলে শান্তি পাওয়া যায় না।
কি করব! কথায় আছে না, মানুষ অভ্যাসের দাস। তো, আমরা কেমন দাস ছিলাম, তাই তো? তখন আমার বাসা, তোমার বাসা বলে কোন কথা ছিল না। কার বাসায় কোন অনুষ্ঠান হোক আর না হোক, ভাল কিছু রান্না হলে আমাদের বিচ্ছু বাহিনীর শর্তহীন আমন্ত্রণ ছিল।
ভুল বুঝবেন না আবার। নামে বিচ্ছু বাহিনি হলেও অবিবাহিত পূর্ণবয়স্ক দামড়া ছেলে-মেয়েরাও(বুঝবেন প্রেমের আবেগে ভাসমান যুবক-যুবতী) এর অন্তর্গত ছিল।
আর অনুষ্ঠান হলে সবার আমন্ত্রণ। শুধু খাবারের লোভে তো বয়স্ক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলারা সবসময় যেতে পারেন না। ভদ্রতার খাতিরে নিজেকে আটকে রাখা লাগতো। তবে বেশি সময় নয়। দেখা যেত, প্রতিটা বিচ্ছুকে ট্রে-তে করে খাবার বাসার জন্য নিয়ে আসতে হয়েছে।
আর বিচ্ছু বাহিনির ব্যাক্তিগত দুনিয়া ছিল বাসার ছাদ। খেলা, আড্ডা, ঝগড়া, প্রেম সব হত ছাদে।
তো যা বলছিলাম, এই বিচ্ছুবাহিনী থাকার কারণে বাইরের কার সাথে তেমন মেশা হত না। কিন্তু বিচ্ছুবাহিনী ভাঙল যখন এক এক করে সবাই বাসা বদল করল। না করে উপায় ছিল না। সাথে সাথে ছয় ফ্লাটের বিশাল এক পরিবারও ভাঙল। তারাই ভাল জানবে কেমন কষ্ট হয়েছিল তাদের। সবচেয়ে যে পরিবার নতুন, তারাও হয়তো দশ থেকে পনের বছর পুরনো ছিল।
মূলকথায় আসি এবার। বিচ্ছুবাহিনী একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর একা ছিলাম। এবার প্রথম খেয়াল হল, আমাদের এলাকাতে আরও কিছু ছেলে-মেয়ে আছে। তারাও বিকেলে বের হয়, খেলা করে, আড্ডা দেয়, তবে বাসার বাইরে এবং এলাকার ভেতরে।
সমস্যা হল এবার আমার। আমি তো এতদিন ওদের প্রতি সামান্য আগ্রহও দেখাইনি। তাই তারা তাদের দলে আমাকে প্রবেশ করতে দিতে নারাজ। চেষ্টা করতে থাকলাম ওদের সাথে মেশার। এই চেষ্টাতে সবার আগে মিশলাম এক ছেলের সাথে। নামটা বলব না। ভাল একটা সম্পর্ক তৈরি হল। বলা যায় এলাকার অন্য সবার থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
আমি আর আমার বন্ধু মিলে অনেক কিছু করতাম। বড়দের ভাষায় বললে বলতে হবে, দুষ্টুমি করতাম। তার মধ্যে একটা হল নানা জায়গায় দুজন মিলে ঘুরতে যাওয়া। এটা আমাদের জন্য অপরাধ ছিল। আরও একটা কথা মনে আছে। আমরা দুজনেই বাইরের নানা রকমের জলখাবার পছন্দ করতাম। নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে যেটা খেতে মনে চাইতো তার দাম জেনে আসতাম। পকেট তো তখন গড়ের মাঠ। তাই কষ্টে কষ্টে দুজনের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে মনের আশা পুরণ করতাম।
বললাম না, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তাই বন্ধুত্ত্বের মাঝের ঝগড়া তো আর বাদ যাবে না। একেবারে বাচ্চা বাচ্চা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া হত। অবশ্য আমরা তখন তো বাচ্চাই ছিলাম।
একবারের কথা, খুব ঝগড়া হয়েছে। কথা বন্ধ। অবস্থা এমন, একই গলি দিয়ে হাটি বিকেলে, কিন্তু দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিই। আবার গলির অন্য প্রান্তে দেখা হয়, আবার মুখ ঘুরিয়ে নিই। আমাদের কারণে বাকি সবার খেলা হচ্ছে না। কারণ, আমাদের ছাড়া তখন খেলা জমত না। তাই কিছু ছেলেদের নিয়ে আমি, আর কিছু ছেলেদের নিয়ে সে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সামনা-সামনি হলেই উল্টো পথ।
সেবারের ঝগড়াটা অনেকদিন চলল। ওর ব্যাপারটা জানি না, কিন্তু আমি হয়তো ওইদিনই ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতাম। আর ভাল লাগছিল না। স্কুল থেকে ফিরতে দেরী হয়ে গিয়েছিল আমার। এলাকায় এসেই শুনি, সবাই মিলে পুকুরে গোসল করতে যাচ্ছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, তখনও কিছু পুকুরের অস্তিত্ব ছিল ঢাকাতে। সখ করে বিশাল বাহিনী নিয়ে অনেকেই গোসল করতে যেত।
বন্ধুটা জানত আমি সাঁতার জানি না। সাঁতার সেও জানতো না। তারপরও পুকুরে যাচ্ছে জানতে পেরে আবার রাগ লাগল। কথা বললাম না। ওরা সবাই মিলে চলে গেল দল বেঁধে। আমি বাসায় ফিরলাম। খেয়ে-দেয়ে বারান্দায় বসে আছি যখন, তখনই কানে এসেছিল কথাটা। চিৎকার করে বলছিল- অমুক পুকুরে ডুবে গেছে! পুকুরে ডুবে গেছে! কেমন বোধ করেছিলাম এত বছর পর আর মনে নেই।
বারান্দাতেই ঠায় বসে ছিলাম। খালাম্মার চিৎকার শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেই তার লাশটাকে ওর বাসায় নিয়ে যেতে দেখলাম। হ্যা, লাশ। তখন আর কেউ ওকে নাম ধরে ডাকছিল না।
আমি তো যেতেই চাই নি। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের কথা সবাই জানতো। আমাকে প্রায় জোর করেই ওকে দেখতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল ওর সারা শরীর। আর মসজিদের কাঠের নড়বড়ে খাট-টাতে শুয়ে ছিল। আমাকে দেখানোর জন্য ওর মুখ থেকে চাদর সরানোর আগেই আমি চলে এসেছি। কেন যেন চলে এলাম। হয়তো কান্না চাপতে।
ভাল হয়েছে দেখিনি চেহারাটা। ঐ নিষ্প্রাণ চেহারাটা মনের মধ্যে থাকলে এখন আর তাকে হাসোজ্জল চেহারাতে স্মরণ করতে পারতাম না। মাগফিরাত কামনা করি বন্ধু তোমার!
একটা কথা মনের মধ্যে প্রায়ই উঁকি দেয়। আমার সাথে ওর ঝগড়া না হলে হয়তো ও ঐদিন পুকুরে যেত না। আমরা আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে সহি-সালামতে হয়তো কোন একটা ফাস্টফুডের দোকানে বসে বার্গার খেতাম আধা-আধি করে।