বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বছরে পড়লাম। কীভাবে যে দুইটা বছর কাটালাম জানি না। তবে এইটুকু জানি, দুই বছর আগে যে আমি ছিলাম সে আমি আর নেই।
আমার জীবনে অভিজ্ঞতার কমতি নেই। যদি বলি অভিজ্ঞতা একটু বেশিই তবু খুব ভুল বলা হবে না। আমার বয়সী সমসাময়িক বন্ধু-বান্ধবীদের তুলনায় একটু বিচিত্র। তাই পরিমানে বেশি বলার চেয়ে বিচিত্র বলাটাই শ্রেয়। আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসা ভাল হবে না। কেননা, আমরা সবাই নিজের কথা বলতে বা শুনতে ভালোবাসি। যে কথাবার্তা বা ঘটনা আমাদের নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন বা অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্ক রাখে না, তা আমাদের শুনতে ভাল লাগে না।
কিন্তু কেন? কখনো কি আমরা চিন্তা করেছি? নিজের সাথে খুব বেশি যুক্তি-তর্ক করলে একটা উত্তর বেশিরভাগ সময় পেয়েছি।
আরে ভাই, মানুষটাই হল খ্যাঁত। এমন আজব টাইপের আবার সখ থাকে নাকি!!
এমন কাজ মানুষ করে! সেটা আবার বলে বেড়াচ্ছে সবাইকে।
ইশ! ভাব দেখে গা জ্বলে যায়। নিজেকে বেয়ার গ্রিলসের ভাতিজা মনে করে!
আরো কত কি! কিন্তু সব জবাব বিশ্লেষণ করলে একটা উত্তরই হয়- আমরা আমাদের চিন্তার সীমারেখার বাইরে চিন্তা করতে পারি না। অন্যভাবে বললে হয়- আমাদের চিন্তার সীমারেখা আমরা ছোট করে রেখেছি। আমাদের পৃথিবীটাকে ছোট করে রেখেছি।
প্রতিদিন ঘুমানোর সময় আমরা অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমাই যেন পরের দিনের সূর্যের সাথে আমাদের চুক্তি আছে। কমপক্ষে ৬০ বছরের আগে যেন আমাদের রুটিনের ব্যাঘাত না ঘটে। এইজন্য জীবনটা জীবন না অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অথচ যদি ব্যাপারটা এমন হতো- ঘুমানোর আগে আমাদের ঠোঁটে স্মিত হাসি থাকতো। নাহ, আজকের দিনটা ভাল গিয়েছে। আজকে আমি নিজের নতুন একটা বৈশিষ্ট্য জানলাম। আমি তো ভাবতেই পারিনি, এটা আমি পারব। কি ভয়ে ভয়েই না শুরু করলাম। প্রথম প্রথম ভুল হল কিন্তু আস্তে আস্তে ঠিক অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
সত্যি বলতে কি, আমরা আসলে একেকটা ভীতুর ডিম। হ্যা, ডিমই। ভালো করে ভাবলে দেখা যাবে এখনও আমরা পৃথিবীতে এসে পৌঁছাইনি। বলা যায়, ডিমের ভেতরে আছি। কেন বললাম? আমি যা বুঝি তা বলার চেষ্টা করি নাহয়।
জন্মের পর থেকে আমরা অভিভাবক, পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয় আর সমাজের হরেক রকম মানুষের ছত্রছায়ার মধ্যে থাকি। এটা অবশ্যই আমি আমার নিজের দেশের পরিমণ্ডলের কথা বলছি। প্রথম কয়েক বছর পরিবার আর আত্মীয় স্বজন নিয়েই আমাদের জীবন।
আর একটু বড় হলে প্রতিবেশী আর এলাকার মানুষদের প্রবেশ ঘটে আমাদের জীবনে। তারপর আস্তে আস্তে সমাজের অনেক ধরনের মানুষের সামনে পড়ি আমরা। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতাই বলব।
শিশু থেকে পদোন্নতি পেয়ে কিশোর বয়সে যখন নিজ এলাকায় খেলতাম, ঘুরতাম বা বাঁদরামি করতাম তখনকার কথা। তখন দেখা যেত যেখানেই যাই না কেন কেউ না কেউ অবশ্যই চিনত। ঐ মানুষটার আমি ছেলে বা ভাতিজা বা ভাগনে বা নাতি বা অন্যকিছু। হয়ত আদর করত আর নাহয় বকাঝকা করত। আদর করলে তো হলোই, পেয়ে গেলাম অভিভাবক। আর যদি স্নেহ না করত, তবু কি কি বাঁদরামি করেছি তার রিপোর্ট ঠিকই বাসায় চলে যেত।
স্কুলে তো বাবা-মা হানা দিতোই কয়েকদিন পর পর। কয়েকদিন পর পর না হলে রেজাল্টের দিন না এলে চলতই না। তাও আবার শুধু ক্লাসটিচার না, পুরো স্কুলে যত টিচার আছে সবার সাথে দেখা করে ছেলের খোঁজ-খবর নিতে হতো। হাড্ডি আমার, মাংস আপনার টাইপের চিরাচরিত কথামালা। আর গোপন ষড়যন্ত্র কাকে বলে তাও শিখেছি স্কুলেই। টিচারদের সাথে অভিভাবকদের ষড়যন্ত্র। ছেলে কি করে না করে টা জানার একটা না একটা উপায় ছিল এই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য।
তারপর আসে কলেজের কথা। নিয়মকানুনে কড়া যেই কলেজ, আমাদের ঠাইও সেই কলেজে। আর অভিভাবকের ষড়যন্ত্র এবার আরও বৃহৎ পরিসরে চলে। ছেলে বড় হচ্ছে যে! এখন খারাপ পথে গেলে আর ফেরানো যাবে না। একটা মজার ব্যাপার হল, যতই নিয়মকানুন কড়া হোক, ছেলে-মেয়ে একসাথে যে কলেজে সেই কলেজ আগেই বাতিল হয়ে যেত। নিতান্ত বাধ্য না হলে সেই কলেজের ধারে-কাছে ঘেঁষতে দেবে না।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয় এর পালা। এর সম্পর্কে এখন কিছু বলতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হলে তবেই বলব।
তবে এত কথার অর্থ অভিভাবকের নিন্দা নয় কিন্তু। আশা করি ভুল বুঝবেন না। আমাদের অভিভাবকেরা আমাদের ভালোর জন্যই এত কিছু করে। এটা এখন না বুঝলে ভবিষ্যতে একদিন না একদিন আমরা সবাই বুঝতে পারব। তবে হ্যা, তাদের পদ্ধতি হয়তবা সনাতন রয়ে গিয়েছে। যেটা হয়তো কিছুটা ভুলের সৃষ্টি করে মাঝে মাঝে।
এই কথা, সেই কথা থেকে কত কথা বলা হয়ে গেল। এত কথার উদ্দেশ্য এই ছিল, আমরা এখনো আমাদের অভিভাবকের বানানো আরামদায়ক ডিমের ভেতর জীবনযাপন করছি। কিন্তু সেই ডিমের খোলস থেকে একদিন আমাদের বের হতেই হবে। তাই যদি ঐ ডিমের ভেতর নিজেকে অভ্যস্ত বানিয়ে ফেলি, তবে খোলস ভাঙলে হয় চিল-শকুনের হাতে পড়তে হবে নয়তো কুয়োর ব্যাঙ হয়ে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ!
এই জন্য প্রথমেই নিজেকে জানতে হবে। কিন্তু নিজেকে জানার জন্য যত বড় আয়নার সামনেই দাড়াই না কেন, নিজেকে কিন্তু দেখা যাবে না। একেবারেই দেখা যাবে না বলতে গেলে কেমন একটু অস্বস্তি লাগছে, একটু প্রতিফলন তো চোখে পড়বেই। কিন্তু সেই প্রতিফলন বুঝার জন্যও তীক্ষ্ণ চোখ লাগে।
কীভাবে জানা যায় তাহলে! অন্য উপায় বের করি। কাউকে জিজ্ঞাসা করি আমার সম্পর্কে। দেখি কি বলে। যেনতেন মানুষকে তো আর জিজ্ঞাসা করবো না, বিদ্বান কাউকেই জিজ্ঞাসা করবো। তাতে আয়নাও লাগবে না, আবার আমার মত পণ্ডিত মহাশয়ের বিশাল বড় লিখাও পড়তে হবে না। দুঃখের ব্যাপার হল, এই পদ্ধতিরও কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া যাচ্ছে না। আমাদেরকে সবচেয়ে ভাল জানে আমাদের পরিবারের মানুষেরা। কিন্তু অভিভাবকত্বের সনাতন পদ্ধতি বা বর্তমান জীবনপদ্ধতি অথবা সমাজব্যবস্থা অথবা কু-প্রথা অথবা কিছু না কিছু আমাদের সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করেছে।
তাই একমাত্র উপায় বরং নিজেই কোন পদ্ধতি বের করা। তা থেকে যদি একটুখানি প্রতিফলন পাওয়া যায়! তবে সেটায় আবার অন্ধবিশ্বাস করে বসে থাকলে চলবে না। বিশ্বাস তখনই করা যাবে যখন সেটা আমরা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করবো।
আমার থেকে যদি কিছু বলি তবে এইটুকুই বলব, নতুন কিছুর প্রতি সবসময় আগ্রহী থাকা। নতুন কিছু পেলেই নিজেকে পরীক্ষা করা। প্রচলিতভাবে বললে- নিজেকে বাজিয়ে দেখা। যদি ভাল সুর আসে তবে এটা আমি অথবা এটা আমার হতে পারে, না ভাল সুর না আসলে এটা আমি না বা এটা আমার না। তবে চেষ্টার ক্রুটি থাকা চলবে না।
আবার বাজিয়ে দেখা বন্ধও করা যাবে না।কারণ, নিজেকে যদি আমরা খুঁজে পাইও, তবে সেই আমিকে নিয়ে কতদিন আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবো! একদিন না একদিন ঠিক পুরানো হয়ে যাব। তখন আবার এই লিখার লেখককে তার পরিচয় বুঝাতে এসে পড়তে পারেন আপনারা। তাই নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থেই উপদেশমুলক কিছু বলছি এবার। প্রতিনিয়ত নিজেকে আবিস্কার করতে হবে। প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তনও করতে হবে। তবে ভালোর দিকে, উন্নতির দিকে, নিজের ইচ্ছার দিকে, নিজের সপ্নের দিকে।
ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে ব্যাতিক্রম তো ব্যাতিক্রম, নিয়ম নয়। তাছাড়া আমি আমার অনুভূতি বললাম। আপনার অনুভূতি তো আমার থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ ভোর ৫:৪০