"চশমার কারিশমা"
লেখক-ফাহিম মুবাশশির
কছিম উদ্দীন আমার দাদু।পাড়া গায়ে সকলেই ডাকতেন ডাকু সাহা বলে।কথিত আছে দাদু জন্মের দিনে এ পাড়ায় ডাকাত পড়েছিলো।সে সময় দেশে নামের খুব আকাল,তাই এই নাম।
বেশ আগে একবার শহরে বেড়াতে গিয়েছিল দাদু।দাদু দেখলো,কি একটা বস্তুতে যেন অনেকের চোখ ঢাকা।দেখতে স্বচ্ছ অথবা কালো গ্লাস বাকা দুটি আংটা দিয়ে কানের সাথে জড়ানো।শহরে এটাকে বলে ‘চশমা’।কারও চোখে বা কপালে ওটা দেখলেই হা করে তাকিয়ে থাকতো দাদু।বাড়ি আসার সময় পথের পাশে এক চশমার দোকানে ঢুকে এপাশ-ওপাশ দেখেও একটা জুতসই চশমা বের করতে পারলো না দাদু।দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো,ভালো চশমা হবে?
-কম পাওয়ারের নিবেন,না বেশি পাওয়ারের?
-দাম কোনটার কত,শুনি?
-দাম সব একই।
তাহলে বেশি পাওয়ারই দিন,কমটা নিয়ে লাভ কি!?
চশমা নিয়ে ফুরফুরে মনে গাঁয়ে চলে এলো দাদু,একদিন চশমাটা চোখে দিয়ে মাছ বিক্রেতাকে দাদু হাঁকাল ,এই ইলিশ মাছটার দাম কত রে?মাছওয়ালা তো থ!বড় বড় চোখে ডালার দিকে তাকালো।ডাকার এক পাশে একটা ছোট পুটি মাছ ঝিল ঝিল করছে রোদে।অট্টহাসি দিয়ে মাছওয়ালা বললো দাদা ২০০ টা টাকা দেন।
অত চাইলে বিকিবি কি করে শুনি?বড্ড বেশি হলো রে!
দিন না টাকা পঞ্চাশ কম!
হয়েছে,ঢোকা আমার ব্যাগে।দাদু ১০০ টাকার একটা কচকচে নোট দিয়ে বাড়ি এসে দাদিকে বললো,বড় একটা ইলিশ আছে ব্যাগে।
দাদি দা-বটি নিয়ে কাটতে গিয়েই বাধালো ঝামেলা।সারা বয়াগ খুজে কোথাও দাদুর বর্ণিত ইলিশের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া গেলো না।হুংকার ছুটলো দাদুর পানে।
কই তোমার ইলিশ মাছ,আমার কালাচান!
চক্ষে তো একেবারেই দেখো না,দেখি?এই,এই যে ইলিশ-বলে ব্যাগের এক কোণা থেকে বের করলেন।জামার কলারে দাদির হাতে টান লাগাতেই দাদুর চশমা ছিটকে পড়লো মাটিতে।খালি চোখে মাছটা দেখেই দাদুর চোখ দুটি ছানাবড়া।এতটুকুন চুনোপুটি কিনেছে ১০০ টাকা দিয়েই।
মনের খেদে পরদিনই গেলো শহরে।চশমাটা দোকানে ফেরত দিয়েই হাঁটা দিলো।একটু হাঁটতেই এক বৃদ্ধা রমণি কপালে চশমা ঠেকিয়ে মুখটা বাঁকিয়ে চলে গেলো।
অসম্ভব!চশমা আমার লাগবেই।দাদু ফিরে এলো দোকানে,দোকানিকে বুঝিয়ে একটা কম পাওয়ারের চশমা নিলো এবার।এখন আর ঝামেলা নেই এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো দাদু।
একদিন শশুড় বাড়িতে নিমন্ত্রণ পড়লো।সাধারণত শশুড় বাড়িতেই জামাইদের জমপেশ খাতিরদারি হয়।আমার দাদু চলল সবার আগে।সামনে পড়লো নদী।চশমাটা তখনো চোখেই ছিলো।এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে ডানে -বায়ে সরে গিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো দাদু।
একটা ছোট নালা,ওপারে যেতে পাঁচ কদমই যথেষ্ট।অথচ বোকা মানুষগুলো খালি খালি নৌকা ডাকে…।
দাদু হাত দশেক পেছনে সরে পাঞ্জাবিটা গোছালো।জুতো দুটো নিলো দুই হাতে।মারলো দৌড়, হেঁইয় বলে দিলো লাফ! পড়লো গভীর জলে।চশমাটা চোখেই।মাথা উচিয়ে দেখে কয়েক হাত দুরেই কিনারা!ডুবে ডুবে সামনে সাঁতরে সাঁতরে সামনে এগোলো দাদু।আবার তাকিয়ে দেখলো,তীর খুবিই কাছে।অতঃপর হাত -পা চালালো দ্রুত।আবার হুপ করে মাথা উচিয়ে দেখলো,সামনেই তীর,আবার চললো।কিন্তু কূল পাচ্ছে না কেনো? হঠাৎ পেছনে টান পড়লো।কে যেনো দাদুকে টেনে উঠাচ্ছে একটি ছোট্ট নৌকায়।
দাদু বললো,এ নৌকায় আমার ভার সইবে না।শিগগিরই তলিয়ে যাবে।উঠাস নে,তোরা ডুবে যাবি! ছেড়ে দে আমাকে…।
দাদুকে তীরে তোলা হলো।হাত-পা কাঁপছে থরথর,পেটটা ফুলেছে ডুবে ডুবে জল খেয়ে।চশমাটা কপালে ঠেকিয়ে কৃতকর্মের সমীকরণ কষছে দাদু!
দাদি এসে গলা ফুলিয়ে বলে উঠলো,ওরে বুড়ো! সাঁঝের বেলায় ফুলবাবু হয়ে সাঁতরাবার সখ হয়েছে?
ইচ্ছে তো মাঝে মধ্যেই হয়।
গম্ভীর গলায় দাদু চশমাটা দেখিয়ে দিয়ে বললো,এ-ই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।ভালোই বলতে পারো।
দাদি ছোঁ মেরে চশমাটা নিলো।দাদুর বাধা সত্ত্বেও একঢিলে নদীর মাঝখানে ফেলতে ফেলতে বললো,বুড়োকে ডুবিয়েছে জলে এবার তুমি যাও তলে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:২৮