এই নতুন আগুন নেভাতেই হবে
একসময় বাংলা ছিল বৌদ্ধদের চারণভূমি। পাল শাসনামলের সুদীর্ঘ সময়ে বৌদ্ধধর্ম এই অঞ্চলে প্রধান ধর্ম ছিল। পরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেনদের শাসন শুরু হয় এবং তাদের আগ্রাসী আচরণের কারণে বৌদ্ধরা ভারতের উত্তরে নেপালসহ অন্যান্য অঞ্চলে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পালিয়ে যায়। পরে মুসলমানরা বঙ্গে আসলে, থেকে-যাওয়া বৌদ্ধদের বড় অংশ দলে দলে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়। এজন্য প্রাধান্যশীল হিন্দুরা পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের অনেকক্ষেত্রে ‘নেড়ে’ ডাকতো, কারণ ন্যাড়ামাথার বৌদ্ধরা ব্যাপকমাত্রায় মুসলমান বনে গিয়েছিল। মুসলমানদের নিকটতম প্রতিপক্ষ এসব কারণে ব্রিটিশ আমলে কিংবা আরও পরে বরাবর হিন্দুরাই ছিল, বৌদ্ধদের সঙ্গে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা-আক্রমণের ঘটনা তেমন ঘটেনি। বর্তমান বাংলাদেশে বৌদ্ধদের সংখ্যা শতকরা এক ভাগেরও কম। রাজনৈতিক কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বা চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি-মুসলমানদের কাছ থেকে জাতিগত বিরাগের শিকার হয়েছে, কিন্তু বৌদ্ধরা আলাদা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় আক্রমণের শিকার হয়নি কখনোই। তাই কক্সবাজারে বৌদ্ধরা কেন উগ্র মুসলমানদের ধর্মীয় আক্রমণের শিকার হলো তার বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি। বাংলাদেশের মানুষদের ধর্মীয় সহাবস্থান, সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতি তথা গণতন্ত্র চর্চার যতটুকু অবশিষ্ট আছে, তার সঙ্কটাপন্ন অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা কিংবা তার উন্নয়নের জন্য পুরো বিষয়টিকে আন্তরিকভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন।
মানবসভ্যতার ইতিহাস রাজ্যদখল, জাতিনিধন ও নিবর্তনের ইতিহাস, কিন্তু উদার মানবিকতা ও সহনশীলতাই মানুষের আরাধ্য থেকেছে সবসময়। ফলে বিভিন্ন ধর্ম-জাতি-বর্ণের সহাবস্থানই সভ্যতার পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। কালক্রমে আধুনিকতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দীক্ষায় শান্তি-স¤প্রীতির বাণীই মানুষের অন্তরে ঠাঁই নিয়েছে। বিশেষত মধ্যযুগে ইউরোপীয় নৃশংসতা, কিংবা বিংশ শতাব্দিতে দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং উপনিবেশের অবসান হবার পর বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িক ও জাতিঘৃণা নিন্দনীয় বিষয়ে পরিগণিত হয়ে উঠিছে। কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্বে কিংবা জিনে থেকে গেছে ঘৃণার উত্তরাধিকার। জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক উগ্রতা মাঝে মাঝে সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপটের পালে হাওয়া দেয়, সেই হাওয়া দাবানলের মতো পুড়িয়ে দেয় ‘অপর’ সংখ্যালঘুর ঘর-বাড়ি-উপসনালয়। কিছুদিন আগে হাটহাজারিতে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর, কয়েকদিন আগে রাঙামাটিতে চাকমা সংখ্যালঘুদের ওপর, আর এখন বৌদ্ধ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাই তার প্রমাণ।
মানবসভ্যতার এতটা পথ পাড়ি দিয়ে তবে কি ধর্মীয় ও জাতিগত উন্মাদনা নতুন নতুন চেহারা পাচ্ছে? গত এক দশকে বৈশ্বিক পর্যায়ে ‘সন্ত্রাসী’ মুসলমানরা পরিণত হয়েছে শ্বেতাঙ্গ-খ্রিস্টীয়-জায়নীয় পুঁজিবাদের আক্রমণের ও ঘৃণার লক্ষ্যে। প্রায়ই রসুলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে কার্টুন প্রকাশিত হচ্ছে, খুব স¤প্রতি আমেরিকায় তৈরী হয়েছে অবমাননাকর এক চলচ্চিত্র। খ্রিস্টান-ইহুদীদের ঘৃণা করার ক্ষেত্রে মুসলমানরা নিশ্চয়ই আগের চাইতে অনেক বেশি উন্মত্ত। ফলে এক চলচ্চিত্রেই পুরো পৃথিবীর মুসলমান ফুঁসে উঠেছে, জ্বলেছে অনেক আগুন। আর বাংলাদেশে এক ফেসবুক চিত্রই জ্বালিয়ে দিয়েছে অনেক মন্দির, অনেক বাড়িঘর, ধ্বংস হয়েছে অনেক পুরাকীর্তিসম মূর্তি ও নিদর্শন। এই ভৌত ধ্বংসলীলার পাশাপাশি মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে সা¤প্রদায়িক বিষবাষ্পের নতুন উৎস। এই ঘটনা ধর্মান্ধ মুসলমানদের দেবে অনুপ্রেরণা আর বৌদ্ধদের মনে জন্ম দেবে ভয়, ঘৃণা ও হতাশা সংমিশ্রিত এক অস্বস্তিকর অনুভূতির।
বৈশ্বিক পর্যায়ে ইহুদি-খ্রিস্টান বনাম মুসলমানের বিবাদের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট -- ক্রুসেড, প্যালেস্টাইন সঙ্কট ইত্যাদির কথা এক্ষেত্রে স্মর্তব্য। কিন্তু বাংলাদেশে বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধের কোনো পূর্বসূত্রিতা নেই বললেই চলে। তাহলে এই উন্মাদনা কেন? অনেকেই একে পূর্ব-পরিকল্পিত বলছেন। একজন মানুষও মরেনি, কিন্তু অনেক মন্দির ভস্মীভূত হয়েছে, হাজার হাজার আক্রমণকারী দ্রুত সমবেত হয়েছে, চারিদিক থেকে বাস-ট্রাকযোগে মুসলমানরা রামু শহরের প্রধান চৌরাস্তায় সমবেত হয়েছে, আক্রমণকালে ব্যবহার করেছে গান পাউডারের মতো দাহ্য পদার্থ। আক্রমণের যোগসূত্র হিসেবে বার্মার রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বৌদ্ধদের হাতে মুসলমানদের নিধন হওয়াকে যুক্ত করেছেন। কক্সবাজার জেলা ঐ রাখাইন প্রদেশেরই পার্শবর্তী ভূখণ্ড, আক্রমণের শিকার রোহিঙ্গা মুসলমানরা শতবর্ষ আগে বাংলাদেশ থেকেই বসতি স্থাপন করেছিল বার্মায়। ফলে বার্মা সরকারের কিংবা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর পুশব্যাকের শিকার রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। এভাবে কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা কিংবা স্থানীয় মুসলমানদের যৌথ সা¤প্রদায়িক ঘৃণা হয়তো ধীরে ধীরে তৈরী হয়েছে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে। মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বোধকে উস্কে দিয়ে রেখেছিল আমেরিকায় তৈরী সেই চলচ্চিত্র। সরকার ইউটিউব বন্ধ করে শেষরক্ষা করতে পারলো না, ফেসবুকে উত্তম বডুয়ার কোরান অবমাননার ভার্চুয়াল ছবি জ্বালিয়ে দিল অসংখ্য মন্দির, পুড়িয়ে দিল অনেক বাড়িঘর।
এই সাম্প্রদায়িক আক্রমণে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতা বহুবারের মতো পুনরায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শনিবার রাতের রামুর উত্তেজনা রবিবার উখিয়া বা পটিয়ায় ছড়াতেই পারে, কিন্তু মুসলমানদের মন্দির পোড়ানো থেকে নিরস্ত্র করা গেলনা কেন? কিংবা রামুর ঘটনাটিই বা এতদূর গড়ালো কিভাবে, যোগাযোগ-প্রযুক্তির প্রসারের এই সময়ে? আর সরকারপক্ষ তাদের চিরচেনা প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামাতের ওপর এর দায়ভার ন্যস্ত করেছে। অথচ নানান প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে রামুতে শুরুর জনসভায় বক্তৃতা ও নেতৃত্ব দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে তুলেছিল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। রোহিঙ্গা, জামাত কিংবা অন্যান্য দলের জঙ্গিগাষ্ঠী এই নাশকতামূলক ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ মুসলমানদের সম্মিলিত সা¤প্রদায়িক উগ্রতা এই ঘটনার জন্য দায়ী। আবার সহিংসতা ঠেকাতে অনেক বিবেকবান মুসলমানও দাঁড়িয়ে গেছে, যদিও তারা ঘটনাকে এড়ানে পারেনি। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, মামলা দেয়া হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের বিরুদ্ধে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা কি নিশ্চিত হতে পারি যে যথাযথ তদন্ত হবে এই ঘটনার, শাস্তি দেয়া হবে প্রকৃত দোষীদের?
এই ঘটনার দায় সরকার এড়াতে পারেনা। তাই সরকার ও প্রশাসনের কাছে দাবি, ঘটনার শিকার যারা তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ধ্বংসলীলায় যেসব মন্দির ও স্থাপনা ভস্মীভূত হয়েছে, সেগুলো পুনর্নির্মাণ করে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে হবে, যদিও বুদ্ধের অস্থি ধাতুর মতো অনেক অমূল্য বৈশ্বিক সম্পদকে ফিরে পাওয়া সম্ভব হবেনা। এবং অবশ্যই দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। এরপরও সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে বৌদ্ধদের মনে লুপ্ত আস্থাকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা যাবেনা। এক্ষেত্রে সমাজে উদার ও গণতন্ত্রমনা মানুষদের কাজ করে যেতে হবে, যাতে আর কোনো সা¤প্রদায়িক আক্রমণ সংখ্যালঘু মানুষকে বাস্তবে ভিটেমাটি থেকে ও চিন্তাচেতনায় যেন উন্মূল করে না তোলে।
০২ অক্টোবর, ২০১২
![](https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/css/images/generic-ads-580x400.jpg)
শোকের উচ্চারণ।
নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন
যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?
৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?
মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন
আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন
প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন
কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।
এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন
আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন