মোরশেদুল ইসলামের আমার বন্ধু রাশেদ নিয়ে আমি একটি চলচ্চিত্র-সমালোচনা লিখেছিলাম শিল্প ও শিল্পী পত্রিকার ৩য় সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি, ২০১২)। আমার সমালোচনা নিয়ে দু’টি প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটির পরের সংখ্যায় (মে, ২০১২)। একটি লিখেছেন কলকাতার হৃদয়পুর থেকে সুশীল সাহা এবং আরেকটি চলচ্চিত্রটির পরিচালক স্বয়ং। আমার মনে হয়েছে প্রতিক্রিয়াগুলোর পরে আমারও কিছু বলা উচিত। আমি বলবো মূলত পরিচালকের প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে। কারণ কোনো চলচ্চিত্র সমালোচনার পর পরিচালকের লিখিত প্রতিক্রিয়া সাধারণত দেখা যায়না। ব্যাপারটা গুরুতর।
পরিচালক দাবি করেছেন আমি চলচ্চিত্রটি ভালমতো না দেখেই সমালোচনা লিখেছি, এবং ব্যাপারটিকে তিনি ‘অপরাধ’ বলে রায় দিয়েছেন। আমি চলচ্চিত্রটি প্রথম দেখি পরিচালকেরই আয়োজিত আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে। এরপর শিল্প ও শিল্পী পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদ আমাকে পরিচালকের কাছ থেকে ডিভিডি সংগ্রহ করে আমার হাতে দিয়ে দায়িত্ব দেন চলচ্চিত্রটি নিয়ে লেখার জন্য। ডিভিডি হাতে পাওয়ায় সুবিধা হয়েছে চলচ্চিত্রটি বারবার দেখার। আমি বলছি আমি ভালো করেই চলচ্চিত্রটি দেখেছি। ছবিটির বহুল প্রশংসা করার পর (আমি লিখেছিলাম -- “শিশু-কিশোরদের উপযোগী নির্মিত মোরশেদুল ইসলামের চারটি চলচ্চিত্রের মধ্যে এটিই সবচাইতে সুনির্মিত। চাকা ছাড়া মোরশেদুল ইসলামের অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যেও আমার বন্ধু রাশেদ-এর অবস্থান থাকবে ওপরের দিকেই”) লিখেছিলাম কিছু কিছু জায়গায় পরিচালকের ‘‘অমনোযোগ আমাদের হতাশও করে”। বিপত্তি বেধেছে এই ‘অমনোযোগ’গুলো ধরিয়ে দিতে গিয়েই। ছোটখাটো ভুলত্র“টি মহৎ শিল্পকর্মকে বামনকর্ম বানিয়ে দিতে পারে, চলচ্চিত্রকার পরের প্রকল্পে সতর্ক থাকবেন -- সমালোচনা লেখার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র সমালোচকের প্রত্যাশা এইই থাকে। আমরা জানি, গ্রেট মেকারদের কাজে এরকম ছোটখাটো ভুলত্র“টি থাকেনা বললেই চলে। শিল্পপ্রয়াসী মহৎকর্ম তো বটেই, এমনকি হলিউড-বলিউডের অনেক জনপ্রিয় ছবিতেই এসব বিষয়ে কোনো আপস করা হয়না।
আমি লিখেছিলাম, “যুদ্ধ-দৃশ্যগুলো একেবারে সাদামাটা মনে হয়েছে। অন্যান্য দৃশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা গেলেও, স্কুলে ক্যাম্প-করা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মূল যুদ্ধে শফিক, রাশেদ ও ইবু ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি”। এই বক্তব্যের পর পরিচালক বলছেন “কী ভয়াবহ পর্যবেক্ষণ!” তিনি আরও বলছেন, “পর্দায় শুধু তিনজনকে দেখা গেলেও ফ্রেমের বাইরে যে আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তাঁরা গুলি করছেন, গ্রেনেড নিক্ষেপ করছেন, জয় বাংলা ধ্বনি দিচ্ছেন, তা কি একজন সাধারণ দর্শকেরও বুঝতে অসুবিধা হয়? শফিকের কণ্ঠেও সংলাপ ছিল, ‘আমাদের কাজ হচ্ছে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কভার দেওয়া’”। এটা ঠিক, গুলি, গ্রেনেডনিক্ষেপ, জয় বাংলা ধ্বনি ফ্রেমের বাইরে ছিল; কিন্তু ফ্রেমের ভেতরে, হাই অ্যাঙ্গেল ও লঙ শটে ধারণ করা, পাকিস্তানি সৈন্যদের পাল্টা গুলিবর্ষণ ও ট্রাকে করে পলায়নদৃশ্য ছিল; এর পরপরই অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা ফ্রেমে ঢুকতে পারতো, জয়ী হয়ে উল্লাসপ্রকাশ করতে পারতো। তাহলে যুদ্ধটির ব্যাপকতা বোঝানো যেত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘবদ্ধতাও প্রতিষ্ঠিত হতো। পর্দায় মাত্র তিনজন মুক্তিযোদ্ধার ভিস্যুয়াল উপস্থিতি তাই যুদ্ধদৃশ্যটিকে ‘সাদামাটা’ করেই রেখেছে।
আরেক জায়গায় লিখেছিলাম, “ক্লাসশেষে রাশেদ ও কাদেরের মধ্যে একবার ধাক্কাধাক্কি হয়। রাশেদ কাদেরকে ধাক্কা দিলে পড়ে যায়। কাদের যখন ভূপাতিত হয়, তখন কোনো বেঞ্চকে পড়ে যেতে দেখা যায়না। কিন্তু কাটের পর যখন কাদের উঠে দাঁড়ায় তখন দেখা যায় একটা বেঞ্চ কাত হয়ে পড়ে আছে। যুদ্ধজাহাজে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা শহরে আসার পরে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসে খান বাহাদুর ও তার দুই চেলা। চেলা দুইজনকে পাকিস্তানি সৈন্য যখন গুলি করে হত্যা করে, তখন সৈন্যের বন্দুকের এ্যাঙ্গেল ভিন্নদিকে থাকে, তারপরও চেলা গুলিবিদ্ধ হয়”। এই দুই পর্যবেক্ষণের বিপরীতে পরিচালক ক্লাসরুমের দৃশ্যের ক্ষেত্রে লিখলেন, “দুটি শট দুই অ্যাঙ্গেল থেকে নেওয়া হয়েছে বলেই তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন”। আমি মোটেও বিভ্রান্ত হইনি। মোদ্দা কথা হলো রাশেদ কাদেরকে ধাক্কা দিল, কাদের মাটিতে পড়ে গেল, পড়ার সময় কোনো বড় বেঞ্চ পড়েনি বা কাত হয়নি। এরপর কাদেরের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে একটা লো অ্যাঙ্গেল শট ছিল, যেখানে দেখা যায় রাশেদ ও অন্যান্য ক্লাসমেট দাঁড়িয়ে কাদেরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই শটেও দণ্ডায়মান বেঞ্চের এক কোণা দেখা যায়। এই দুই শটের একটাতেও কোনো বেঞ্চকে কাত হতে দেখা যায়নি। কেবল কাদের যখন উঠে দাঁড়াতে থাকে তখন বড় বেঞ্চ কাত হয়ে আছে দেখা যায়, যেন আগেই এগুলো পড়েছে, যার অর্থ ধাক্কাধাক্কি বা কাদেরের পতনের সময় এটা ঘটেছে। অ্যাঙ্গেল যতই পরিবর্তিত হোক, বেঞ্চটি পড়ার কোনো তথ্যই ফ্রেমে বা ফ্রেমের বাইরে দেয়া হয়নি। খান বাহাদুর ও তার চেলার হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণের বিপরীতে মোরশেদুল ইসলাম লিখলেন, “ফ্রেমের বাইরেও যে আরো সৈন্য ছিল এবং তারাও যে গুলি করছিল তা ফাহমিদুলের চোখ এড়িয়ে গেছে”। এখানেও ফ্রেমের বাইরের গুলিতে চেলা বিদ্ধ হয়েছে। ভালো কথা! কিন্তু ফ্রেমের ভেতরে সৈন্যটা আকাশমুখে বন্দুক ধরে ছিল কেন? সব সৈন্যের ঐ মুহূর্তে অ্যাকশন ছিল তিনজনকে গুলি করা, আকাশমুখো বন্দুক তখন কী শিকারে ব্যাপৃত ছিল? সঠিক কাজটি ফ্রেমের বাইরে থেকে ঘটেছে, ফ্রেমের ভেতরে কাণ্ডটিকে তাহলে কী বিবেচনা করবে দর্শক?
আমি লিখেছিলাম “রাশেদের চরিত্রে চৌধুরী জাওয়াতা আফনান এবং ইবুর চরিত্রে রায়ান ইবতেশাম চৌধুরী মোটামুটি মানিয়ে গেলেও অন্যান্য কিশোর চরিত্রের অভিনেতার অভিনয়ে জড়তা লক্ষ করা গেছে”। পরিচালক লিখলেন, “কিশোর অভিনেতাদের অভিনয়ে জড়তা ছিল বলে ফাহমিদুল যে মূল্যায়ন করেছেন তা তাঁর স্বাভাবিক ও সাবলীল অভিনয় হৃদয়াঙ্গম করার ব্যর্থতা বলেই আমি মনে করি”। পরে তিনি বলেছেন যে রাশেদ চরিত্রের অভিনেতা পরিণত অভিনয় করেছেন। আমি বলেছিলাম তিনি মোটামুটি মানিয়ে গেছেন। আমি জড়তার প্রসঙ্গটি এনেছিলাম রাশেদ ও ইবু বাদে অনান্য চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তাদের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে।
আমি লিখেছিলাম “টাইটেল কার্ড ও এন্ড টাইটেলের নেপথ্য সঙ্গীত মনে ধরার মতো হলেও বাকি সময় জুড়ে ইমন সাহার সঙ্গীত তেমন কিছু যোগ করেনা”। কিন্তু এই কথাটিও পরিচালকের পছন্দ হয়নি। টাইটেল ও এন্ড টাইটেলের সঙ্গীতের প্রশংসা করলেও ভেতরের কোথায় কোথায় আমার পছন্দ হয়নি তার ব্যাখ্যা আমি দিইনি। অথচ একে তিনি বর্ণনা করেছেন “ভালো কিছুকে প্রশংসা করতে না পারার ব্যর্থতা” হিসেবে।
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাসে কিশোররা ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মার্চের প্রথম দিককার আলোচনাকে মূল্যায়ন করেছিল ‘দুঃসংবাদ’ হিসেবে। কারণ ওরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিয়ে দিলে স্বাধীন বাংলা হবেনা। রাশেদের মত ছিল, ভাসানী ঠিকই বলেছেন, তার এক দফা, এই দেশ স্বাধীন বাংলা হবে। এই প্রসঙ্গ এক জটিল স্পর্শকাতর ইস্যুতে আলো ফেলে -- যে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেশুনে পদ্ধতিগতভাবে ধীরে এগুচ্ছিলেন স্বাধীনতার দিকে, কিন্তু ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠন এবং জনগণের একাংশের চাপ ছিল আরও দ্রুত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার। হয়তো এই গোষ্ঠীর মত (এখানে রাশেদ ও তার বন্ধুরা) এবং রাজনীতিবিদ ভাসানীর মত প্রায় একই ছিল। উপন্যাসে এই বিষয়টিতে চকিতে ঢোকা হয়েছে এবং সাফল্যের সঙ্গে বেরিয়ে আসা হয়েছে। স্বাধীনতার মত-পথ নিয়ে আন্দোলনকারীদের মতবিরোধ থাকতেই পারে, থাকেই Ñ উপন্যাসে ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করা হয়নি। কিন্তু চলচ্চিত্রে এটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চলচ্চিত্র পরিচালকও যদি বিষয়টাকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে বেরিয়ে আসতে পারতেন, তবে কত ভালোই না হতো! তাই আমি লিখেছিলাম, “ঐতিহাসিক তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে মূল উপন্যাস থেকে পরিচালক কিছুটা সরে এসেছেন। উপন্যাসে দেখা গেছে রাশেদরা চিন্তিত ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা পাবার জন্য দরকষাকষি করছেন; যদি তাকে ক্ষমতা দেয়া হয় তবে স্বাধীনতা আসবে না, পাকিস্তানই টিকে যাবে। তারা বরং স্বাধীনতার জন্য মাওলানা ভাসানীর যে এক দফা, তাতে আস্থাশীল ছিল। রাশেদদের এই ভাবনা ধরে নিতে হবে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঔপন্যাসিকের ভাবনা। কিন্তু পরিচালক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ রাখতে চাননি। ফলে ভাসানীর প্রসঙ্গ একেবারেই উল্লেখ না করে মুক্তিযুদ্ধের যে বয়ান এই চলচ্চিত্রে হাজির করা হয়েছে, তা প্রাধান্যশীল একরৈখিক বয়ান, যা এমনকি ক্ষমতাসীন সরকারের সেন্সরবোর্ড বা অপরাপর ক্ষমতাকেন্দ্রকে তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট হয়েছে”। যাইহোক, এই বিশ্লেষণটি পরিচালকের একেবারেই পছন্দ হয়নি। তাই তিনি লিখলেন, “ফাহমিদুলরা যতই ‘প্রাধান্যশীল একরৈখিক বয়ান’ বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার বা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে খাটো করার অপচেষ্টা করুন, ঐতিহাসিক সত্য তাতে বিন্দুমাত্র ম্লান হয়না”। অবশ্যই ঐতিহাসিক সত্য ম্লান হবে না, অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে পুরো দেশ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, সবাই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিল, পুরো জাতিকে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে দেখেছিলাম। কিন্তু তার মধ্যেও নানান রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয়, জাতিগত, লৈঙ্গিক পার্থক্য-বৈচিত্র্য ছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল আওয়ামী-মুসলমান-বাঙালি-পুরুষের হবে না। অন্যান্য অভিজ্ঞতাকেও আমলে আনতে হবে। তাই এটা মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃতি-অসম্মান-খর্ব করার মামলা না। এই মামলা বৈচিত্র্যের -- অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য মুক্তিযুদ্ধের সম্পদ। আর ‘ফাহমিদুলরা’ মানে কী? বহুবচন কেন? আমাকে কাদের গোত্রভুক্ত করার চেষ্টা করছেন পরিচালক? তিনি কি খেয়াল করেছেন যে ঐ দলে মুহাম্মদ জাফর ইকবালও পড়ছেন? এটা খুব দুঃখজনক যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আলোচনায় প্রাধান্যশীল মতের বাইরে কোনো কিছু দেখলে তাকে দ্রুত স্বাধীনতাবিরোধীদের শিবিরে পাঠিয়ে দেবার একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছে। এই প্রবণতা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসপাঠকেই বরং ক্ষতিগ্রস্ত করে।
লেখা: ১৫ জুলাই, ২০১২
প্রকাশ: শিল্প ও শিল্পী, সংখ্যা ৫, অক্টোবর ২০১২