নিউজ চ্যানেলে খবর পড়ছে সুদর্শন এক যুবক। সংবাদ পাঠের পাশাপাশি দুই হাত নেড়ে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করছে। যদিও গুরুত্বপূর্ণ কোনো খবর নয়, কেবলমাত্র সময় ক্ষেপণের জন্য লিমা তাকিয়ে আছে স্ক্রিণের দিকে তবুও প্রায়ই সে খেই হারিয়ে ফেলছে। যুবকের চোখ ওকে আকর্ষণ করছে। অদ্ভুত একটা মায়া আছে ওর চোখে। লিমার মনে হচ্ছে কেবলই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সংবাদ পাঠকের নাম সে জানে না। জানার তেমন কোনো কারণও নেই। নিয়মিত টেলিভিশন দেখা হয় না। গ্রামে থাকাকালীন সময়ে ডিশ লাইনের সংযোগ ছিল না। ফলে নিউজ বলতে বিটিভির রাত আটটার সংবাদ। সৌম্য চেহারার মধ্য বয়স্ক বা বয়স্ক সংবাদ পাঠক গম্ভীর হয়ে দেশের উন্নয়নের খবরাখবর জানিয়ে দিত। এরকম হাত-মাথা নেড়ে সংবাদ উপস্থাপন করতো বলে মনে পড়ছে না লিমার। শুধুমাত্র সংবাদের জন্য যে আলাদা চ্যানেল থাকবে এটাই কখনো মনে হতো না। এই যুবক যদি বিটিভির তালিকাভুক্ত গম্ভীর সংবাদ পাঠক হতো তাহলে কেমন হতো তা কল্পনা করার চেষ্টা করলো সে। ফিক করে হেসে ফেললো। চটপটে এই যুবকের পক্ষে হাত-মাথা স্থির রেখে গম্ভীরভাবে কথা বলা সম্ভব হতে পারে এমন কোনো সম্ভাবনাই নেই। বরং উপস্থাপকের ভূমিকায় সুযোগ দেয়া যেতে পারে। কোনো অনুষ্ঠান শুরুর আগে হাত-মাথা নেড়ে হাসি হাসি মুখে সে হয়তো বলবে- কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের সৌজন্যে এখন আপনারা দেখবেন ধারাবাহিক নাটক- ওমুক। আজ দেখবেন নাটকটির এগারোতম পর্ব। তারপর একটা ঝকঝকে হাসি দিয়ে উধাও হয়ে যাবে সে। ওমুক নাটকের এগারোতম পর্ব শুরু হবার আগে বিজ্ঞাপন শুরু হবে। অনন্তকালের জন্য বিজ্ঞাপন বিরতি। দর্শকরা ভুলে যাবে কোন নাটকের এগারোতম পর্ব শুরু হবার কথা ছিল।
- কেমন আছো এখন লিমা।
বিজ্ঞাপন বিরতির কল্পনা থেমে গেল। মিসেস সুলতানা ড্রইংরুমে ঢুকলেন। বাসার মধ্যেও তিনি দু’টি সার্জিকাল মাস্ক পড়েছেন। লিমাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে হাত নেড়ে ইশারায় বসতে বললেন। তিনি নিজেও বসলেন, তবে লিমার থেকে যথেষ্ট বজায় রেখে।
মিসেস সুলতানা যে দূরত্ব রেখে বসেছেন তা লিমার চোখে এড়ালো না। বসতে বসতে বললো, এখন ভালো আছি আন্টি। তবে শরীর খুব দুর্বল।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, শরীর তো দুর্বল হবেই। কতগুলো এন্টিবায়োটিক গেছে শরীরে। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক করছো তো?
- জি আন্টি। খাচ্ছি। মেসে থাকি তো, খাবার সমস্যা কম বেশি লেগেই থাকে। তাছাড়া নিজে রান্নাবান্না করার মতো সুস্থতা এখনো আসেনি। সময় লাগবে কিছুদিন।
- তা তো বটেই। নেগেটিভ এসেছে কবে? টেস্ট করিয়েছো তো?
- এই তো পরশুদিন স্যাম্পল দিয়েছি। আজই রিপোর্ট পেলাম।
মিসেস রহমান খানিকটা স্বস্তিবোধ করলেন বোধহয়। গা ছেড়ে দিলেন সোফায়। লিমাকে বাসায় এলাউ করবেন কিনা এটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। মেয়েটা কোভিড পজিটিভ অবস্থায় যেন বাসায় না আসে সেজন্য অসুস্থতার কথা জানা মাত্রই ওকে ছুটি দিয়েছেন, নিয়মিত ফোন করে খোঁজ খবর রেখেছেন। ছেলের জন্য নতুন কোনো টিচার সিলেক্ট করেননি। ক’টা দিন না হয় পড়ালেখা একটু কমই হলো। লিমা মেয়েটা ভালোই পড়ায়। এরকম একজন টিচারকে কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না। তাছাড়া মেয়েটার মধ্যে এক ধরনের সততা আছে। কোভিড সিম্পটম দেখামাত্রই সে জানিয়েছে, অন্তত কোনো কিছু হাইড করেনি। লিমার অসুস্থতার কথা জানার পর অনিককেও কয়েকদিন অবজার্ভেশনে রেখেছিলেন তিনি। পরম করুণাময়ের দয়ায় ছেলেটার তেমন কোনো সিম্পটম দেখা যায়নি।
লিমা খানিকটা অস্বস্তিতে ভোগে। টাটকা একটা মিথ্যা বলেছে সে। মোটেও কোভিড টেস্ট করায়নি। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে পিসিআর টেস্ট করতে খরচ অনেক আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে টেস্ট করানোটা ইদানীং একটু কঠিন হয়ে পড়েছে। টেস্ট কেইস বেশি হবার কারণে ওরা কেবলমাত্র ষাটোর্ধ মানুষগুলোর জন্য বাসায় গিয়ে স্যাম্পল কালেকশন করছে আর অন্যান্যদের জন্য রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ থাকলেও নিকটবর্তী কোনো এক স্থানে গিয়ে স্যাম্পল দিতে হবে। ব্যাপারটা একটু ঝামেলার। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাছাড়া হাসপাতালে গেলে সংক্রমিত হবার বা ছড়ানোর সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। সে তো প্রথমবারও টেস্ট করাতে চায়নি। এমন কি প্রথম কয়েকদিন কাউকে জানায়ওনি। শুরুতে দুই-তিনদিন হালকা জ¦র আর শরীর ব্যথা ছিল। লকডাউনের কারণে ভার্সিটির ক্লাশ-পরীক্ষা স্থগিত হবার পর খোলার কোনো নামগন্ধ ছিল না। কাজেই নিয়মিত বের হবার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে তিনটা টিউশনি করে সে। সেখানেও কয়েকদিন ফাঁকি দিয়েছে। জ্বর মানেই যে কোভিড হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনোরকম নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল মেসের অন্যান্য বোর্ডারদের থেকে। ওর রুমমেট মেয়েটাও আগের সপ্তাহে গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। কিন্তু গোলযোগ বাঁধলো চতুর্থদিন। মেসের কোনো একরুমে নাকি ইঁদুর মারা গিয়েছে। একজন মেস মেম্বার ইঁদুর মরা বিষ ছড়িয়ে রেখেছিল মেঝেতে। বিষ নাকি কাজও করেছে। চারপাশে পঁচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু ইঁদুর ব্যাটার মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে না। লিমার এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সে কোনোরকমে অন্যদের থেকে গা বাঁচিয়ে চলছিলো। কিন্তু মরা ইঁদুরটা ওর রুমেই পাওয়া গেল। ওটার গা থেকে এতো তীব্র দুর্গন্ধ বের হচ্ছিলো যে আশেপাশের সবাই নাকে কাপড় চাপা দিলো। আর যে মেয়েটা ইঁদুরটা শনাক্ত করলো ওর খাটের নীচ থেকে সে দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে সেখানেই বমি করে ভাসালো। সবার সন্দেহের দৃষ্টি তখন লিমার দিকে। সে কি তাহলে কোনো গন্ধই পাচ্ছে না! মুহূর্তে ওকে একঘরে করা হলো। জোড় করে কোভিড টেস্ট করানো হলো। একদিন পর রিপোর্ট এলো- পজিটিভ।
কোভিড পজিটিভ হয়ে যতটা না নিজের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে ভয় পেলো, তারচেয়ে অনেক বেশি চিন্তা হলো টিউশনিগুলোর জন্য। এই বাজারে তিনটা টিউশনি পাওয়াও কঠিন। মেসের মেয়েরা সবাই দূরত্ব রেখে চলা শুরু করলেও নিয়মিত খাবার-ওষুধ পৌঁছে দিত ওর দরজার বাইরে। পাঁচ দিনের মাথায় জ্বর চলে গেলো কিন্তু দুর্বলতা কাটলো না। তাছাড়া কোনো কিছুর গন্ধ না পেয়ে খুবই অস্বস্তি লাগছিলো। যা কিছুই খায় তার কোনোটার গন্ধ না পাওয়ায় সবকিছু মাটি-ঘাস মনে হচ্ছিল। খেতে বসে লেবুর টুকরোগুলো বারবার নাকের কাছে ধরছিলো, যদি একটু গন্ধ পাওয়া যেত। বডি স্প্রের নতুন বোতলটা একটানে অর্ধেক খালি করে ফেললো একদিন। কিন্তু বিধি বাম, খাটের তলায় মরে থাকা ইঁদুরের বিকট দুর্গন্ধ যে পায় না তার কাছে কোনো গন্ধই গন্ধ নয়। তবুও কিছু একটা গন্ধ পাবার জন্য লিমার আকুলতার শেষ নেই। চারপাশে গন্ধ খোঁজে। লিপস্টিক, পাউডারের ডিব্বা, সাবান শ্যাম্পু, কাপড়ের স্তূপ, লকারে রাখা নেপথলিনের বড়ি সবকিছুর থেকেই ঘ্রাণ নেবার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় সে। একদিন সকালে ব্রাশ করতে গিয়ে ওর মনে হলো- টুথপেস্টের গন্ধ পাচ্ছে। মিন্ট ফ্লেভার টুথপেস্ট। টিউব থেকে অনেকটা টুথপেস্ট বের করে হাতে নিল। নাকের কাছে ধরলো, বড়ো একটা শ^াস নিল। কিন্তু কোনো ঘ্রাণ পেলো না। একটু আগে যে পুদিনা পাতার গন্ধ পেলো সেটা নেহাতই কি কল্পনা ছিল? লিমার ব্যাকুলতা বেড়ে যায়। গন্ধহীন জীবন থেকে সে মুক্তি পেতে চায়। কোভিড নেগেটিভ হবার পরও নাকি ঘ্রাণ শক্তি ফিরতে সময় লাগতে পারে। এমনি সব উপদেশ শুনে শুণে সান্ত¡না খোঁজে লিমা।
- অনিক বাসায় নেই, শুনেছো বোধহয়। ওর খালার বাসায় গিয়েছে।
- জ্বী আন্টি। শুনলাম।
- ও তোমাকে অনেক মিস করেছে। আজ দেখা হয়ে গেলে ভালো হতো।
- অনিকের পড়ায় অনেক গ্যাপ হয়ে গেল আমার জন্য। সরি আন্টি।
- না না, সরি হবার মতো কিছু হয়নি। একটু জোড় দিয়ে চালিয়ে নেবে। এই গ্যাপ কোনো প্রব্লেমই নয়।
খাবার ট্রলি নিয়ে ঢুকলো কমবয়সী একটা মেয়ে। মেয়েটাও মাস্ক পড়েছে। সম্ভবত কাপড়ের মাস্ক। একটু ময়লা-ময়লা লাগছে। হয়তো নিয়মিত পড়া হয়না। ট্রলিটা একটু দূরে রেখে চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে পড়লো। মেয়েটাকে লিমা আগেও অনেকবার দেখেছে। মাঝেমধ্যে দুই একটা কথাও হয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে একটু সহজ হবার জন্য হাসলো, কিন্তু মেয়েটার কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। মিসেস সুলতানা হাত বাড়িয়ে ট্রলিটা কাছে টানলেন। একটা পিরিচে গাজরের হালুয়া আর অন্যটায় ডিম মামলেন, সাথে চায়ের কেটলি। তিনি কেটলি থেকে কাপে গরম পানি ঢাললেন, চিনি মেশালেন। তারপর কৌটা থেকে একটা টি-ব্যাগ বের করে কাপে রাখলেন। ইশারায় লিমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
লিমা খুব মনোযোগ দিয়ে চা বানানো দেখলো। তিনি খুব যত্ন নিয়ে চা বানান। এই বিষয়টা লিমার খুব ভালো লাগে। ওর জন্য কেউ এতো যত্ন নিয়ে কিছু করছে ভাবতেই মন ভরে যায়।
- নাও শুরু করো। আমি একটু আসছি।
মিসেস সুলতানা উঠে গেলেন। লিমা মেয়েটার দিকে তাকালো। সে এখনো শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লিমা বললো, কেমন আছো তুমি?
মেয়েটা কিছু বললো না। যদিও তার খুব বলতে ইচ্ছা করলো যে, অনিক ভাইজান বাসাতেই আছে। খালার বাসায় যায়নি। কিন্তু একথা বলার মতো সাহস ওর হলো না। কোনোদিন হবেও না।
- আমাকে ভয় লাগছে?
সে কিছু বললো না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
- ভয়ের কিছু নেই। আমি এখন সুস্থ। পুরোপুরি সুস্থ।
সে এবারো কিছু বললো না। চোখ নামিয়ে ফেললো।
- তুমি বরং যাও। আমি এখন মাস্ক খুলবো।
মেয়েটা মনো হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দ্রুত ঘর ত্যাগ করলো সে। লিমা মনে মনে হাসলো, কী বিচিত্র একটা পৃথিবী! একটা ক্ষুদ্র ভাইরাস মানুষগুলোকে কেমন বদলে দিল!
সময় নিয়ে, ধীরে-সুস্থে মাস্ক খুললো সে। নিজের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে। এ বাড়ির গাজরের হালুয়ায় দেশী ঘি’য়ের একটা পরিচিত সুগন্ধ হয়। টি-ব্যাগের ট্যাগে থাকে চাইনীজ-জাপানিজ লেখা। নাকের নিচে কাপ ওঠাতেই এক মাদকতাময় ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে যায় ইন্দ্রিয়। কোনো কোনো সময় আবার অদ্ভুত অপরিচিত স্বাদ থাকে চায়ের কিন্তু কোনো গন্ধ থাকে না। টি ব্যাগের ট্যাগে থাকা চাইনীজ-জাপানিজ লেখা পড়ার চেষ্টা করে দেখেছে সে, চায়ের ফ্লেভার বের করার জন্য।
প্রথমেই গাজরের হালুয়ার এক টুকরা চামুচে কেটে ঠোঁটের সামনে ধরলো। জোড়ে একটা শ্বাস নিল। সেই পরিচিত দেশী ঘিয়ের সুগন্ধের প্রত্যাশা। কিন্তু পেলো না। নিমিষেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সারাটা দিন একবারের জন্যও কোনো ঘ্রাণই পায়নি সে, তবুও হয়তো গাজরের হালুয়া দেখে অসম্ভব একটা প্রত্যাশা দানা বেঁধেছিল। মাঝে মধ্যে নাকটা কেটে ফেলতে ইচ্ছা করে। যে নাকের গন্ধ নেবার ক্ষমতা নেই, সে নাক থাকাও যা, না থাকাও তা। সেদিন একটা পুরো মালটা নাকের চারপাশের ঘষে রেখেছিল। যথারীতি কোনো লাভ হয়নি। বরং আঁঠালো আঁশগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় ত্বক থেকে ছাড়াতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।
চাইনীজ জাপানিজ টি ব্যাগের নাম পড়ার পড়ার চেষ্টা করলো না লিমা। নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করে আবারো ব্যর্থ হলো। গাজরের হালুয়াটার কোনো গন্ধ না পাওয়ার পর চা’য়ের ক্ষেত্রে কোনো আশা রাখাটা ঠিক হয়নি।
প্রায় মিনিট দশেক পর মিসেস রহমান প্রবেশ করলেন। লিমা ততক্ষণে চা শেষ করেছে। মিসেস রহমান একটা খাম এগিয়ে দিলেন ওর দিকে।
- নাও, রাখো।
লিমা খামটা নেবার সময় খুব লজ্জিত হবার চেষ্টা করলো। মাসের অর্ধেকের বেশি সময় না পড়িয়ে বেতন নেয়াটা লজ্জার পর্যায়েই পড়ে। যদিও সে খামের লোভেই এসেছে বলা যায়।
লিমা যখন অনিকদের বাসা থেকে বের হলো ততক্ষণে সূর্য নিভে গেছে। পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমে গেছে। সাধারণত সন্ধ্যার এ সময়টাতেই সে নিয়মিত বের হতো। লেক সার্কাসের দোতলা বাসাটা থেকে বের হয়ে কয়েক মিনিটের হাঁটা দূরত্ব কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে লোকাল বাসে চড়ে কলেজ গেট হয়ে মেসে ফেরে। আজ অবশ্য হাঁটতে হলো না। পাশের মোড়েই একটা রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। অন্যান্য দিনের তুলনায় চারপাশটা বেশ নিরব। একান্ত প্রয়োজন না হলে মানুষজন বের হয় না। সুতরাং রিকশাওয়ালাও মোহাম্মদপুরের যাত্রী পেয়ে খুশি মনেই টানা শুরু করলো।
বড়ো রাস্তায় ওঠার আগেই হ্যান্ডব্যাগে রাখা খামের মুখটা খুলে দেখলো একবার। পুরো এক মাসের বেতনই দিয়েছে। মনটা খুশিতে ভরে গেল। গুনগুন করে একটা গানও গাইতে ইচ্ছা হলো লিমার।
রাত আটটার আগে মিরপুর রোডে রিকশা চলাচল নিষেধ। এখনো আটটা বাজেনি। তাই লিমার মনে খানিকটা দ্বিধা ছিল। কিন্তু ওদের রিকশাটা যখন কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড মোড়টা পাড় হচ্ছিলো তখন সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ ওদের দিকে মনোযোগ দিল না। রিকশাওয়ালাও বেশটা জোড়ে টেনে চললো।
বত্রিশ নম্বর মোড়ের একটু আগে ধানমন্ডি সেকেন্ডারী ট্রান্সফার স্টেশন আছে। স্টেশন মানেই যে ট্রেন বা বাস থামবে, যাত্রী ওঠানামা করবে- এমন নয়। ওখানে কিছু ভ্যান আসে, যারা পুরো ধানমন্ডি ও আশেপাশের এলাকা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে এই স্টেশনে জমা করে। দেখতে অনেকটা বিশালাকার ডাস্টবিনের মতো। রাস্তার এই অংশটুকু উৎকট গন্ধে ভরে থাকে সবসময়। নাকে কাপড় চেপে পার হতে হয়। কোভিডকালীন সময়ে অবশ্য মাস্ক পড়ে থাকায় মুখে কাপড় না দিলেও চলে। সেকেন্ডারী ট্রান্সফার স্টেশনের কাছাকাছি যেতেই লিমা মাস্কটা খুলে ফেললো। কাঙ্খিত উৎকট গন্ধে ভরে থাকা চারপাশে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিল সে। ঠিক সেসময় একটা অঘটন ঘটলো। পেছন থেকে দ্রুত বেগে আসা একটা মোটর সাইকেলের আরোহী ওর হাতের ব্যাগটা ধরে টান দিল। লিমা তখন চোখ বন্ধ করে বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো। হাতে ব্যাগ পেঁচিয়ে থাকার কারণেই হোক বা খানিকটা অসতর্কও থাকার কারণেই হোক সে রিকশা থেকে পড়ে গেল। ব্যাগের ফিতা ছিঁড়ে যাবার আগ পর্যন্ত বেশ মোটর সাইকেল আরোহী কয়েক মিটার দূরত্ব টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল ওকে। একটা বর্জ্য সংগ্রহের ভ্যানের সাথে ধাক্কা খেলো লিমা। ভ্যান থেকে বেশ কিছু বর্জ্য এসে পড়লো ওর ওপর। কয়েক মুহূর্তের জন্য লিমা কিছুই বুঝতে পারলো না। খানিকক্ষণ অন্ধকার। তারপর যখন আলো ফিরলো তখন ওর হাতে থাকা ব্যাগের কথা, রিকশার কথা, পড়ে গিয়ে হাঁটুতে, কোমরে পাওয়া আঘাতের কথা কিছুই সে অনুভব করতে পারলো না। কেবল মনে হতে লাগলো পৃথিবী গন্ধময়। ডাস্টবিন থেকে সংগ্রহকৃত ময়লাগুলোর মাঝ থেকে পঁচে যাওয়া সবজী, পাকা কলা, পুডিং, বনরুটির গন্ধ আলাদা করতে পারলো সে। অপরিচিত বেশ কিছু গন্ধও পেল, হতে পারে পোড়া তেলের গন্ধ। নাকের ওপর থেকে কেঁচোর মতো পেঁচানো কিছু বস্তু সরালো। নুডুলসের গন্ধও পেল, সাথে টমেটো সস। চোখ বুজে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো লিমা, যেন গন্ধময় একটা সময়ের জন্য যুগ যুগান্তরের অপেক্ষা শেষ হলো।
ফটো: গুগলমামা।