হেডনোট
যাতে নিজের নাম খুঁজে দেখার জন্য অনেকেই ব্লগে ঢুকে না পড়েন, এজন্য শুরুতেই বলে রাখছি, একেবারে শেষের দিকে শুধু তিনজন ব্লগারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ব্লগারদের নাম উল্লেখ করা নিয়ে এ পোস্ট নয় বলে দুঃখ প্রকাশ করছি।
**
ব্লগে ঢুকেই যে-পোস্টটা সামনে পড়ে ওটাই পড়ি। একনজরে প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে গেলে আকর্ষণীয় বিষয় বা আমার প্রিয় বিষয়ের কোনো পোস্ট দেখলে সেটাতে ক্লিক করি। এরপর, প্রথম পাতায় প্রিয় কোনো ব্লগারের পোস্ট চোখে পড়লে সেটাতে ক্লিক করি। একটা সময় ছিল, যখন আমি কদাচিৎ প্রথম পাতায় আসতাম; সরাসরি চলে যেতাম ‘অনুসারিত ব্লগে’; যাদেরকে অনুসরণে রেখেছি তাদের পোস্ট পড়তাম কোনো বাছ-বিচার না করেই। যারা অনুসরণে ছিলেন বা এখনো আছেন, তারা সবাই আমার প্রিয় ব্লগার; লেখা ও তাদের নিজস্ব গুণে বা ব্যক্তিত্বেই তারা আমার প্রিয় ও অনুসারিত ব্লগার হয়েছিলেন। কিন্তু, কোনো একসময়ে ব্লগের চাইতে ফেইসবুকে সময় দিতে থাকলাম বেশি। তখন ‘অনুসারিত’ ব্লগারের লিস্ট ছোটো করে নিয়ে এলাম; যাদের ব্লগ সবসময়ই দেখি, তাদের আর অনুসরণে রাখলাম না, কারণ, এমনিতেই তাদের ব্লগে যাওয়া হবে।
কিন্তু, তথাকথিত অনেক ব্রিলিয়ান্ট ও ট্যালেন্টেড ব্লগারদের ব্লগ আমি এড়িয়ে চলি। যারা জীবনে একবার আমার সাথে বেয়াদবি করেছেন, অযৌক্তিকভাবে ঘাড় তেড়ামি করেছেন, তারা যেই লেভেলের ব্লগারই হোন না কেন, ভুলেও কোনোদিন তাদের ব্লগে ঢুঁ মারি নি। যাদের কথা বা কমেন্টে, বা পোস্টের কন্টেন্টে অহংকারের উপাদান থাকে, আমি তাদের ঘৃণা করি ও তাদের পোস্টে যাই না। যারা অহেতুক অন্যকে ব্যক্তি-আক্রমণ করে বসেন, তাদেরকে ঘৃণা করি। যারা সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা বলেন, তাদের কোনো এথিক্স নাই। রাত্রে মনে হলো তিনি খুব ধার্মিক, সকালে এক পোস্ট বা কমেন্ট পড়ে মনে হলো তিনি নাস্তিক (আমি বলে রাখি, আমি আস্তিক। আমার বিশ্বাস থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে পারবে, এমন কেউ নেই)। আমি এদের পোস্ট এড়িয়ে চলি।
কাউকে দেখেছি, কবিতা বা গল্প বোঝেন বলে মনে হয় না, কিন্তু সাধারণ মানের এক কবিতায় প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিলেন। অথচ, অন্য কিছু উৎকৃষ্ট কবিতা বা গল্পে গিয়ে তাকে ‘এটা কোনো কবিতা হয় নাই’, ‘একে কবিতা বলে না’, ‘এটা কোন গল্প হইল?’ বলতে দেখা যায়। এদের মূল উদ্দেশ্য থাকে ব্যক্তি-আক্রমণ। এদেরকে যেমন এড়িয়ে চলি, আবার এদের দু-একটা প্রশংসাসূচক কমেন্টকে যারা সত্যি মনে করে লাফাতে থাকেন, ফেইসবুকে স্ক্রিনশটও শেয়ার করতে কসুর করেন না, তাদেরকে এড়িয়ে চলা সম্ভব না হলেও তাদের প্রতি সম্মান কমতে থাকে। আমার কাছে খারাপ লাগে এ জিনিসটা যে, অনেকেই আবার এই ব্যক্তি-আক্রমণকারীদের শুধু পছন্দই করেন না, প্রমোটও করে থাকেন। যারা এই ব্যক্তি-আক্রমণকারী ব্লগারদের নিয়ে ব্লগ বা ফেইসবুকে পোস্ট দিতে থাকেন, আমার কাছে মনে হয়েছে, তাদের একটা উদ্দেশ্য থাকে- সেটাও হীন- তা হলো ‘হিট’ পাওয়া। আমি এদেরকেও এড়িয়ে চলি। আমি কোনো ব্যক্তি-আক্রমণকারীর পোস্ট পড়ার জন্য ব্লগে আসি না। একটা গ্রাম্য প্রবাদ আছে- এক ডেকচি দুধে একফোঁটা গো-মূত্রই যথেষ্ট, দুধ নষ্ট হওয়ার জন্য। আপনার পোস্ট বা কমেন্টে যত মূল্যবান কন্টেন্টই থাকুক, আপনার নেগেটিভ অ্যাটিচুড আমি ঘৃণা করি।
যারা বিন্দুমাত্র নেগেটিভ কমেন্ট বা সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন না, বা যারা মনে করেন ব্লগে একটা যেন-তেন মানের পোস্ট দিলেই ‘অসাধারণ’, ‘অতুলনীয়’, ‘রবীন্দ্রনাথের পর এই প্রথম এমন লেখা পড়লাম’- এমন সব কমেন্টে তাদের পোস্ট ভরে ফেলবো, বাজারে তেলের দাম বাড়িয়ে তাদের পোস্টে এসে ঢেলে যাব, তাদের পোস্টে আমি পা মাড়াই না। একটা পোস্ট ধৈর্য নিয়ে পড়ে একটা গঠনমূলক কমেন্ট করা অনেক শ্রমের দরকার (মেধার কথা বাদই দিলাম)। যারা এই শ্রমের মূল্য বোঝেন না, তাদের পোস্টে গিয়ে নিজের মূল্যবান সময় ও মেধা ব্যয় করার অর্থ হলো এগুলোর অপচয় করা। আপনি একটা পোস্ট পাবলিশ করলে আপনি শুধু উৎসাহ পাবার জন্য ভূরি ভূরি প্রশংসাই আশা করতে থাকবেন, আপনার মানসিকতা এমন হলে এটা খুবই বাচ্চাসুলভ ভাবনা। আপনার ম্যাচিউরিটি উন্নত করার অনেক অনেক সুযোগ রয়েছে।
আপনি একযুগ পর এসে একটা পোস্ট লিখবেন, আপনার পোস্টে কমেন্টও করবো, কিন্তু আপনি উত্তর দিবেন বেছে বেছে, অন্য কারো পোস্টে যাবার ব্যাপারে আপনার আকাশচুম্বী অহংকার, নিজেরে ‘আমি কী হনুরে মনে করেন’ - ওহে চান্দু, তুমি এমন কোনো সেলিব্রেটি হও নাই, অত বড়ো পণ্ডিতও না, খালি মুখে পট পট করলেই বড়ো হওয়া যায় না, অন্যরে ছোটো বললেই মানুষ তোমারে বড়ো কইবো না, তোমার লেখায় সেই জিনিস থাকতে হবে। তোমার লেখায় একবার যদি আমার একটা কমেন্ট পাইয়া থাকো, ওটা তোমার সাত জনমের ভাগ্য, দ্বিতীয়বার আর পাবে না, যদ্দিন তুমি মানুষের কাতারে না নেমে আসছো।
যখন ব্লগে প্রচুর সময় দেয়ার মতো সুযোগ ছিল, তখন অনেক ব্লগারের গল্প, কবিতা, ছড়া অনেক সময় নিয়ে পড়তাম, যথাসাধ্য সাজেশন দেয়ার চেষ্টা করতাম। কোনো কোনো ব্লগার সেগুলো খুব সাদরে গ্রহণ করতেন, অনেকে আবার অনুরোধও করতেন তাদের লেখার ব্যাপারে কিছু গঠনমূলক পরামর্শ দেয়ার জন্য। দিতাম যথারীতি। একজন ব্লগার তার অনেক গল্প ও কবিতা আমার কিছু গঠনমূলক আলোচনার প্রেক্ষিতে ইম্প্রুভ করেছিলেন। একদিন একজন ব্লগারের কোনো এক পোস্টে ‘নেগেটিভ’ বা ‘সমালোচনামূলক’ কমেন্টের ব্যাপারে আলোচনা উঠতেই সেই ব্লগার ঠাস করে আমার অবদানকে নাকচ করে দিয়ে অন্য এক ব্লগারের ভূয়সী প্রশংসা করা শুরু করলেন! আমার চোখের সামনে তাও। আমি অবাক হয়ে গেলাম, একজন মানুষ কীভাবে এমন হিপোক্রেট ও লাইয়ার হতে পারেন! তো, সেই ব্লগার যদি কোনো মানবতা বা সততার ব্যাপারে লাফালাফি করতে থাকেন, তখন সেটা আমার কাছে খুব হাস্যকর ও বালখিল্যতা ছাড়া আর কী মনে হবে? এমন ব্লগারদের শুধু পোস্টই না, তাদের নিকনেইমটা আমার কাছে অসহ্য মনে হয়। হিপোক্রিসির একটা মাত্রা থাকে, তার সেটাও অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।
কখনো অন্যের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না। আল্লাহ সবাইকে সমান মেধা দেন নি। আপনি যদি মনে করেন আপনার মেধা আমার চাইতে বেশি, তাহলে আপনি এটাও জানেন যে, আপনার চাইতেও বহুগুণ মেধাবী ব্লগারের অভাব নাই। আবার মেধাবী হলেও, স্থান-কাল ভেদে তার প্রকাশ বা প্রয়োগে হেরফের হতে পারে। কিংবা, কোনো বিষয়ে আপনার জ্ঞান হয়ত একটু বেশি, আমার সে বিষয়ে জ্ঞান কম, অথবা একেবারে নাও থাকতে পারে। কারো জ্ঞান নিয়ে খোটা দেয়া বা খোঁচা দেয়া হলো বর্ণবাদিতার শামিল। ওটা করা অন্যায়।
একবার একটা গল্প পড়ার পর আমার কাছে গল্পটার কিছু ত্রুটি ধরা পড়লো। কমেন্টে উল্লেখ করার পর রিপ্লাইতে ব্লগারকে বেশ উত্তেজিত মনে হলো। তার কমেন্টের সারাংশ ছিল- আমি গল্পটা বুঝি নাই, ওটা আমাকে আবার পড়তে বললেন। আমি মনে মনে অট্টহাসি দিলাম- ওহে চান্দু, তোমার এই গল্পটা নেহায়েতই ‘বালখিল্য’ টাইপের; এটা বোঝার জন্য দ্বিতীয়বার কেন, ক্লাস সিক্স-সেভেনের ছাত্র হলেই মোর দ্যান এনাফ। এরপর থেকে ঐ ব্লগারের পোস্টে আর যাওয়া হয় নাই।
আপনার সাথে কমেন্ট আদান-প্রদানে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এ সম্পর্কের কিছু সুফলও আছে। সেই সুফলের কথা বলতে গেলে হয়ত আমার উপরের কন্টেন্টের সাথে কিছুটা সাংঘর্ষিক হতে পারে। যেমন, আপনি এমন বিষয়ে একটা পোস্ট লিখলেন, যে ব্যাপারে হয়ত আমার ‘একমত’ বা ‘সহমত’ হওয়ার চাইতে ‘দ্বিমত’ পোষণ করাটাই সঙ্গত হয়। এক্ষেত্রে প্রথমত আমি আপনার পোস্ট এড়িয়ে যাই। কোনো বিশেষ কারণে কমেন্ট যদি লিখতেই হয়, হয়ত লিখলাম- ‘সুন্দর পোস্ট’, ‘ভালো আলোচনা’, ইত্যাদি।
যার সাথে একটা সুন্দর ও নির্মল বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তিনি হঠাৎ একটা কটু কথা বলে ফেললে সেটা মেনে নেয়া সম্ভব হয় না। এরকম ‘ভালো’ বন্ধুকে কীভাবে কটু কথা বলা যায়, সেটা জীবনেও আমার মাথায় ঢুকবে না (আমি গঠনমূলক সমালোচনার কথা বলছি না)। একজন ব্লগারের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তার দীর্ঘ পোস্টগুলো পড়তাম, মন্তব্য করতাম। হঠাৎ একদিন সেই ব্লগার এমন ভাবে কমেন্টের উত্তর দেয়া শুরু করলেন, আমি হতবাক হয়ে গেলাম তার আচরণে। তাকে ফিরতি কমেন্টে জিজ্ঞাসাও করলাম, কোনো কারণে তার মন বিক্ষিপ্ত কিনা যে-কারণে এমন ভাবে রিপ্লাই দিচ্ছনে। তিনি নিশ্চিত করলেন, তিনি ঠিক আছেন এবং জেনেশুনেই এভাবে রিপ্লাই দিচ্ছেন। আমি রেগে যাই নি, অনেক শক্ত কিছু কথা বলতে যেয়েও নিজেকে সংযত রেখে নীরব থাকলাম। আমি এমন ব্লগারকেও চিরতরে পরিত্যাগ করেছি। তাদের ব্রিলিয়ান্ট পোস্ট বা কমেন্ট আমার কাছে পায়ের আলগা ধুলোর মতো, পা ঝাড়া দিলেই ওগুলো ঝরে পড়ে যায়।
আমার অনুভূতিগুলো খুব সূক্ষ্ম। অনুভূতিগুলো সূক্ষ্ম সবারই। অনুভূতি যত সূক্ষ্ম, অভিমান তত ব্যাপক। আমি প্রচণ্ড অভিমানী। ‘অভিমান আমার সম্পদ’- এটা আমি অহরহ বলে থাকি।
কাউকে তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে (যেগুলো আল্লাহ প্রদত্ত) খোঁচা দেয়া বা খোঁটা দেয়া অন্যায় মনে করি। তুই কালো। তুই দেখতে পঁচা। তুই আনস্মার্ট। তোর কণ্ঠ হাঁসের মতো। তুই বেঁটে। তুই লুলা। তুই ন্যাংরা। তুই তোতলা। তোর উচ্চারণ ভালো না। তুই গরীব। তুই মূর্খ। এসব বলা আর তার বুকে ছুরি দেয়া আমার কাছে সমান মনে হয়। কাজেই, কাকে কী বলবেন, তা বলার আগে ভাবুন এ কথাগুলো তাকে কতখানি আহত করতে পারে।
খায়রুল আহসান, আহমেদ জী এস, ডঃ এম এ আলী ভাইয়ের মতো ব্লগাররা আমার আদর্শ। তারা বিনয়ী ও ভদ্র। দায়িত্বশীল। একটা বিষয়কে কীভাবে উপস্থাপন করতে হয়, এটা যেমন তারা জানেন, একটা তিক্ত বিষয়কে কীভাবে খুব পজিটিভলি গ্রহণযোগ্যভাবে কমেন্টে তুলে আনা যায়, এটা আমরা তাদের কাছ থেকেই শিখতে পারি।
ভালো ব্লগারদের অনুসরণ করতে হবে। প্রমোট করতে হবে তাদেরকেই।
আমাদের নেগেটিভ এটিচ্যুডকে ধীরে ধীরে পজিটিভনেসের দিকে নিয়ে আসি; জ্ঞানচর্চা, সাহিত্যচর্চা, তথ্য আদান-প্রদানসহ বিনোদনের একটা মুখরিত ও প্রাণবন্ত কেন্দ্রভূমি হিসাবে আমাদের এই ব্লগ জ্বলে উঠুক, এই কামনা করছি।
১২ জুন ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:১৫