somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শোনো তাজেল গো || এক সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয় যাত্রাপালা 'রহিম বাদশাহ ও রূপবান কন্যার' একটি চমৎকার গান

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের ছোটোবেলায় বিনোদনের প্রধানতম উৎস বা উপকরণ ছিল যাত্রাপালা। যখনই কোথাও যাত্রাপালার পাট শুরু হতো, গ্রামময় সাড়া পড়ে যেত এবং যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হওয়ার দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো মানুষ। এ নিয়ে ব্লগে এর আগে দুই পর্বে সমাপ্ত পোস্ট ছোটোবেলায় দেখা আমাদের যাত্রাপালা লিখেছিলাম। এ নিয়ে আমার গল্পও আছে - কুটিমিয়ার যাত্রা দেখা

ছোটোবেলায় স্বাভাবিকভাবেই বড়োদের সাথে (বড়োদের বলতে বাবা-মাকেই বোঝাচ্ছি) যাত্রাপালা দেখতে যেতে হতো, যদিও অনেক সময়ই বন্ধুবান্ধবদের সাথে (মা-বাবা ছাড়া) যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমাকে বাড়ি থেকে একা ছাড়া হয় নি। যেবার বাড়ি থেকে সর্বপ্রথম একা একা রাতে বের হওয়ার অথোরিটি পেয়ে গেলাম, সেবার আমাদের পাশের গ্রাম সুতারপাড়ায় 'রহিম বাদশাহ ও রূপবান কন্যা' যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হলো। যদ্দূর মনে পড়ে, সহপাঠী নুরুল ইসলাম, আবুল, ফজলু- এদের সাথে গিয়েছিলাম। তখন হাইস্কুলে পড়ি। যারা অভিনয় করবেন, তাদের অনেকের সাথেই পরিচয় আছে, এবং তারা সবাই আমার বয়োজ্যেষ্ঠ। পরিচয়ের সূত্র ধরেই অভিনেতাদের সাজাবার বাড়িতে (গ্রিনরুম বিশেষ। এর বোধহয় একটা প্রচলিত নাম আছে, ভুলে গেছি) পর্যন্ত যাওয়ার প্রিভিলেজ হয়েছিল। দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম ও মজা পেয়েছিলাম, একেকজন কালো বা শ্যামলা গাত্রবর্ণের মানুষকেও কীভাবে কসমেটিক্স দিয়ে ফর্সা বা সুন্দর করে ফেলে।

গ্রামের যাত্রাপালাগুলো শুরু হতে হতে অনেক রাত হয়ে যেত। অনেক যাত্রাপালা রাত ১২টার দিকে শুরু হয়ে ভোর বা সূর্য ওঠা পর্যন্ত চলতো। সুতারপাড়া গ্রামের 'রূপবান' যাত্রাপালা সম্ভবত রাত এগারটার দিকে শুরু হয়েছিল। প্রধান চরিত্র রূপবান কন্যা ও তাজেলের পাট যিনি নিয়েছিলেন, তাদের দুজনকেই আমি চিনতাম। সুতারপাড়ার এক বনেদী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে, জনাব আইয়ুব আলী চোকদার সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র বাবুল ভাই হয়েছিলেন 'রূপবান'। এখানে বলে রাখি, আপনারা আশা করি জানেনও, ঐ সময়ে যাত্রাপালার পাত্রপাত্রীরা সবাই 'পুরুষ' ছিলেন; তবে, ঐ যাত্রাপালার পর অনেক যাত্রাপালাতেই বিভিন্ন স্থানে পেশাজীবী অভিনেত্রীদের নায়িকা চরিত্রের জন্য আনা হতো। এবং, যাত্রাপালার অন্যতম আকর্ষণ থাকতো নর্তকীদের নাচ, যাদের আমরা 'বাইয়ালি' বলতাম। সেই বাইয়ালিরাও পুরুষই ছিলেন। পরের দিকে প্রফেশনাল ফিমেইল ড্যান্সারদের আনা হতো; ততদিনে যাত্রাপালার আবেদন ঢাকা পড়ে যেতে থাকে বিভিন্ন স্থানে সিনেমা হল গড়ে ওঠার কারণে।

রূপবান যাত্রাপালাটি যখন দেখি, সম্ভবত ঐ সময়ে আমি ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ি এবং ততদিনে আমি আমাদের জয়পাড়া সিনেমা হলে সিনেমাও দেখেছি (আমার দেখা প্রথম ছায়াছবি। ফলে, সিনেমার অভিনয়ের সাথে যাত্রাপালার অভিনয়ের পার্থক্য বেশ বুঝতে পারি।

সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও 'রূপবান' যাত্রাপালা ছিল আমার জন্য ব্যাপক অভিজ্ঞতার এক যাত্রাপালা, যা দেখে আমি প্রভূত আনন্দ পেয়েছিলাম। বাবুল ভাইয়ের কণ্ঠে রূপবান কন্যার গান যেন অমর্ত্যের সুর হয়ে ঝরে পড়ছিল, আমি এতটাই মুগ্ধ ও তন্ময় হয়েছিলাম। এই বাবুল ভাই পরবর্তী বছরই বোধহয় আমাদের গ্রামে 'সয়ফুল মুলুক ও বদিউজ্জামান' যাত্রাপালায় 'সয়ফল মুলুকের' পাট নিয়েছিলেন, এবং সেখানে যাত্রাপালার নায়ক, আমাদের গ্রামের চিরসবুজ নায়ক জিন্নত ভাই ও বাবুল ভাইয়ের কণ্ঠের জাদুতে দর্শকশ্রোতাগণ ছিলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো সম্মোহিত।

'রূপবান' যাত্রাপালায় তাজুলের অভিনয় এবং গানও ছিল বাবুল ভাইয়ের সাথে প্রায় সমানে সমান। (তাজেল অভিনেতার নাম আমি এ মুহূর্তে ভুলে গেছি)।

যাত্রাপালা শেষ হতে হতে সকাল হয়ে যায়। একরাশ মুগ্ধতা ও তৃপ্তি নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরি।

ছোটোবেলায় 'রূপবান' ছায়াছবির গান (সালাহউদ্দিন পরিচালিত ও ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) সাড়াদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখন তো কালেভদ্রে বিয়েবাড়িতে বা কোনো অনুষ্ঠানে গান বাজানোর জন্য মাইক আনা হয়, কিন্তু সেই সময়ে বিয়ে অনুষ্ঠানসহ আনন্দ উদ্‌যাপনের যে-কোনো অনুষ্ঠানে মাইকের গান ছিল আবশ্যিক একটা বিষয়। এবং মাইক বাজানো হয়েছে, কিন্তু রূপবানের গান বাজানো হয় নি, বিশেষ করে বিয়েবাড়িতে, এমন নজির খুব কম ছিল।

সারা বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয়তা প্রাপ্ত ও সাড়াজাগানো এ গানগুলো আমারও মন মাতিয়ে রাখতো। রাতের বেলা, ১০টার দিকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রূপবানের গান বাজানো হতো। আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম। অনেক সময় ঘুমের ঘোরেও শুনতাম, বাজছে রূপবানের গান - আমার বাড়ির দক্ষিণ ধারে গো, ও দাইমা কীসের বাদ্য বাজে গো শোনো দাইমা দাইমা গো।

পোস্টটা ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে গেলো। মূল উদ্দেশ্য ছিল শুধু গানটা শেয়ার করা - শোনো তাজেল গো। এটা শেয়ার করতে যেয়ে উপরের কথাগুলো চলে এলো।

রূপবানের পালাগান থেকে 'রূপবান' (১৯৬৫) ও 'রঙ্গীন রূপবান'সহ (পরিচালক - আজিজুর রহমান, ১৯৯৫) 'রূপবান' শীর্ষক বেশকিছু ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতে। এতেই বোঝা যায়, রূপবান এ বাংলার মানুষের মনে কতখানি স্থান জুড়ে আছে।

বাংলা গানে আমি সর্ভভুক - এ কথাটা আমি অনেক জায়গায় বলেছি। যখন যে-গানে ডুবে যাই, ঐ গান নিয়েই থাকি একটানা অনেকদিন। গত কয়েকদিনে আমি তুমি যে আমার গানের লিরিকে আমার নিজের সুর করেছি, যাতে মূল সুর করেছিলেন কিংবদন্তি সুরকার সুবল দাস, এরপর যথাক্রমে তোরা যে যা বলিস ভাইতুই ফেলে এসেছিস কারে মন করেছি। তার আগে আরেকটা যাত্রাপালার গান করেছি - ৮০'র দশকে আমাদের দোহার উপজেলায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল 'কমলার বনবাস' নামক একটি যাত্রাপালা, যার উপর ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে (মান ভালো মনে হয় নি আমার কাছে), ইউটিউবে অসংখ্য যাত্রাপালাও দেখা যায় - সেই যাত্রাপালার একটা গানের প্রথম তিন লাইনের সুর ও লিরিক আমার মুখস্থ ছিল, কিন্তু মাঝে মাঝেই সেই সুর হঠাৎ হঠাৎ আমার কণ্ঠে এসে গুন গুন শুরু করে। এই সুরের উপর ভিত্তি করে আমি দুই অন্তরা লিরিক লিখি এবং সুরও তৈরি করি- আমি কোথায় যাই, আমি কোথায় যাই রে। গতরাতে বসেছিলাম লালনের 'সহজ মানুষ' করার ইচ্ছে নিয়ে। কিন্তু তা থেকে আমি হঠাৎ চলে গেলাম রূপবানের গানে। এটা খুব প্রাণের গান, তাই এটা থেকে আগে নিষ্কৃতি পাওয়ায় বাসনায় এটা শেষ করলাম।

কণ্ঠে সবসময় সুর ও মেলোডি আসে না। গতরাতে গাইতে যেয়ে দেখি গলায় বেশ মেলোডি আসছে। ওটার উপর সারাদিন কাজ করার পর বিকালের দিকে দেখি যে এবার কণ্ঠে সুর আরো বেশি মেলোডিয়াস। অতএব, বিকালেও আরেকবার রেকর্ড করি। সেটাই ফাইনাল করে ফেললাম।

গানের ইউটিউব লিংক : প্লিজ এখানে ক্লিক করুন - শোনো তাজেল গো

অথবা নীচের লিংকে ক্লিক করুন :



কথা ও সুর : রূপবানের যাত্রাপালার গান। গীতিকার ও সুরকার অজানা। ইউটিউবের বিভিন্ন লিংকে গীতিকার হিসাবে 'রূপবান' (১৯৬৫)-এর পরিচালক 'সালাহউদ্দিন'-এর নাম দেখা যায়।

মূল শিল্পী : 'রূপবান' (১৯৬৫) ছায়াছবিতে নীনা হামিদ এবং 'রঙ্গীন রূপবান' (১৯৯৫) ছায়াছবিতে রুনা লায়লা কণ্ঠ দিয়েছেন। ছায়াছবির গানে দুই অন্তরা দেখা যায়। তবে, আমি ইউটিউবে আপলোডকৃত বিভিন্ন যাত্রাপালার গানে তিন অন্তরাও দেখেছি। আমার গাওয়া গানের দ্বিতীয় অন্তরাটি ছায়াছবির গানে আমি পাই নি।

এ মিউজিক ভিডিওতে মিউজিক কম্পোজিশন ও কণ্ঠ : খলিল মাহ্‌মুদ
মিউজিক কম্পোজিশন গাইড : বেবি লাবিব

লিরিক :

শোনো তাজেল গো
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
শোনো তাজেল গো
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
শোনো তাজেল গো
মন না জেনে প্রেমে মইজো না


আগে না চিনিলে গো তারে
প্রেম করিলে পড়বে ফ্যারে
শেষে কাঁদলে এ দুঃখ যাবে না
শেষে কাঁদলে এ দুঃখ যাবে না
শোনো তাজেল গো
মন না জেনে প্রেমে মইজো না

প্রেম পিরিতির এমনি গো ধারা
এক পিরিতির দুইজন মরা
এমন মরা মরে কয়জনা
এমন মরা মরে কয়জনা
শোনো তাজেল গো
মন না জেনে প্রেমে মইজো না

আমি করি বন্ধুর গো আশা
তুমি তাজেল সর্বনাশা
এত জ্বালা আর প্রাণে সহে না
এত জালা প্রাণে সহে
এত জালা আর প্রাণে সহে না

শোনো তাজেল গো
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
শোনো তাজেল গো
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:৩৮
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×