শীতের জাম্বু পোশাকে আমার অনীহা ছোট বেলা থেকে। আম্মুকে মা-দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রবল শীতের মধ্যে ঘামতে হতো। এরকমও হয়েছে, জোর করে পরানো জাম্বু সুয়েটার সিঁড়ির রেলিঙয়ে ঝুলিয়ে চলে গেছি। এগুলো বাচ্চা বেলার কাহিনী। আরও বড় যখন হয়েছি, বুঝতে শিখেছি- শীতের পোশাক নিয়ে অনীহা কাটেনি। প্রথম সমস্যা ভারত্বের অস্বস্থি। এর ওপর নিজেকে কেমন ফুটবল টাইপ মনে হয়। আমার নির্ভার পৌষ মাঘ ফুল হাতা গেঞ্জির ওপর দিয়ে বেশ কেটে যেত। কিন্তু গত বছর গ্রামের দিকে বেড়াতে গিয়ে প্রথম বুঝতে পারলাম, আমার কেতা দুরস্ত রসিকতা আর টিকবে না। জোর করে টেকাতে গেলে রসিক শীতে মরার প্রবচন আংশিক সত্য প্রমাণিত হতে পারে। অর্থাৎ একেবারে পটল না তুলে ফেললেও নির্ঘাত নিওমনিয়া বাধাতে পারি। অতএব ঝুঁকির কারবারে লাভ কি! এই শীতের শুরুতেই দেখে শুনে একটা বস্তাধর্মী জিনিস কিনে ফেললাম। গত ক’দিনের শৈত্য প্রবাহের সময় সেই বস্তা গায়ে চাপিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভাবছিলাম বেড়াল কম ঠেলায় গাছে চড়েনা। আমাদের দেশে ঠাণ্ডাটা ক্রমশ এতই বেয়াড়া হয়ে উঠেছে যে আমার মত বেয়াড়া রসিকবাবুকে বস্তায় ঢুকিয়ে ছেড়েছে।
এই বেয়াড়া ঠাণ্ডা, শীতের অব্যাহত উল্লম্ফনের পেছনে দায়ী মূলত গ্রিন হাউজ এফেক্ট বা জলবায়ু পরিবর্তন। বিষয়টি নিয়ে এখন আলোচনা পৃথিবীজুড়ে। লেখালেখি, কনফারেন্স, সেমিনার, দরকষাকষি, চলছে অনেক কিছুই। এগুলো থেকে চোখ ফিরিয়েও আমরা বলে দিতে পারি কিছু একটা ঘটছে। গত তিন বছরে আমাদের অঞ্চলের পাশ থেকে নাতিশীতোষ্ণ গুণবাচক শব্দটি অনেকটাই দূরে সরে গেছে, যাচ্ছে। গ্রীষ্মে গরম যেমন অসহনীয় হয়ে উঠছে, শীতকালে ঠাণ্ডাও সহ্য সীমার ভেতরে থাকছে না।
উন্নত বিশ্ব প্রকৃতির উপর স্বেচ্ছাচারী জুলুম করে যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে- এখানে আমাদের করার তেমন কিছু নেই। কিন্তু রাস্তার পাশে কুঁকড়ে মুকড়ে যে শিশুটি মরে থাকছে, তার জন্য কিছু করার সামর্থ্য যেমন আমাদের আছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট ছোট অনেক উদ্যোগ চোখে পড়ছে। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে পুরানো কাপড় জমা করার তোড় জোড় দেখছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও কিছু কাজ হচ্ছে। কিন্তু এসব ক্ষুদ্র উদ্যোগে এই গণ বিপর্যয়ের এক শতাংশ মোকাবিলা হবে না। প্রয়োজন ব্যাপক গণ সচেতনতা। রাষ্ট্রের কিছু দায় কর্তব্য আছে। রাষ্ট্রই এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে কিছু হবে না। কেন হবেনা সেই পুরানো বয়ান নতুন করে হাজির করার মানে দেখছি না। প্রত্যেককে নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
সেদিন কুয়াশার ভেতর প্যাকেট হয়ে বের হয়েছি। খুব ভোরে। দেখলাম আগুন জ্বালানো হয়েছে। গোল হয়ে বসে থাকা মানুষগুলোর পাশে একটি কুকুর দাঁড়িয়ে। ওর জন্যও জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মনে হল, এই পরাক্রান্ত ঘনঘোর কুয়াশা থাকবে না। আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াবে রৌদ্রকরোজ্জল দিন। এই ছোট খাট সহমর্মিতাগুলো থেকে যাবে। দিনের পরে রাত আসবে- তবুও!