ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রচার পত্র, উন্মুক্ত চিঠি, কাগজ ও প্লাস্টিকের পোষ্টার, ব্যানার ইত্যাদিতে ঢেকে গেছে ঢাকা। মাইকের উচ্চ শব্দে চারিদিক প্রকম্পিত যেন! কানের পর্দা ফাটানো নির্বাচনী প্রচারণার শব্দ এখন ঢাকা শহরের যে কোনো এলাকাতেই শোনা যাচ্ছে। প্রায় সকল প্রার্থীকে নিয়ে গাওয়া হচ্ছে ছড়া ও গান। কিছুক্ষণ পরপর প্রার্থীকে জনগণের সেবা করার সুযোগ দেয়ার গলা ফাটানো আহবান জানানো হচ্ছে প্রচারণায়। কেন তিনি অন্যদের চেয়ে যোগ্য প্রার্থী সে নিয়ে চলছে জোর প্রতিযোগিতা। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'প্রচারণায় আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে রাত আটটার পরে মিছিলে উচ্চ শব্দে এক সংগে মোটর সাইকেলের হর্ন বাজিয়ে, মাইকে জোরে চীৎকার করে স্লোগান ও গান বাজিয়ে প্রচারণা চলছে বিভিন্ন পাড়ায়। প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো পোষ্টারে ছেয়ে রয়েছে ঢাকা। এই পোস্টার যেখানে সেখানে ঝরে গিয়ে পরিবেশও দূষণ করছে। প্রচারণার সময় কর্মীরাও রাস্তাঘাটে আবর্জনা ফেলে যাচ্ছেন।'
উৎসব মূখর পরিবেশের কথা বলা হলেও নির্বাচনী প্রচারণার কান্ডজ্ঞানহীন পদ্ধিতিতে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের বহু উপকরণ রয়েছে। পরিবেশ দূষণের নূন্যতম কোন উপ্লভদ্ধি আমাদের নির্বাচন কমিশন ও রাজনীতিবিদদের আদৌ আছে কিনা তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহের অবকাশ আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন মানুষের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা না দিলেও অন্তত একটা নিশ্চয়তা দেয়, সেটা হচ্ছে নির্বিচার পরিবেশ দূষণের। এইসব প্রচারণাতে হচ্ছে ভূমি দূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, পানি দূষণ, জলাবদ্ধতা এবং শব্দ দূষণ। পরিবেশ বোধ ও দায়িত্বহীন প্রচারণা নিয়ে রাজনীতিবিদ ও নির্বাচন কমিশনের লজ্জ্বিত হওয়া উচিৎ বলে মনে করি। আর এই যে, প্রার্থীরা যাদের প্রচারণাই দূষণ বহুবিধ কেন্দ্রিক, নির্বাচিত হলে পরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও শহরের দেখভালে তারা যে দায়িত্বহীন আচরণ করবে সেটা সহজেই অনুমেয়। শুধু ঢাকা নয়, প্রতিটি স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের এমনটা দেখা যায়।
মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনী প্রচারণার প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, বৈধ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অঢেল অর্থে চলে নির্বাচনী প্রচারণার ঢামাঢোল। রাজনীতি ও নির্বাচন যে অর্থ লগ্নি করা এবং নির্বাচনী বিনিয়োগ তুলে আনার দুর্বিত্ত ব্যবসা তা এই অসুস্থ প্রচারণা দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না কারো। প্রার্থীর পোষ্টার বানানোর দায়িত্বে সমন্বয়কারী থাকুক বা না থাকুক ওয়ার্ড নেতাকর্মীরা ভবিষ্যৎ আয়ের পথ উন্মুক্ত রাখতে নিজেরাই প্রচার পত্র, উন্মুক্ত চিঠি, কাগজ ও প্লাস্টিকের পোষ্টার, ব্যানার ইত্যাদি তৈরিতে বিনিয়োগ করে। এই অর্থের একটা অন্যতম মূল উৎস দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি। পরিবেশ দূষণ ও চাঁদাবাজির বাইরেও এখানে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে প্রপাগান্ডা। অর্থাৎ প্রচার পত্রে পোষ্টারে কিংবা ব্যানারে উল্লিখিত তথ্যের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, অন্যদিকে মানুষকেও দেয়া হচ্ছে বড় বড় ধোঁকা। সর্বশেষ সমস্যাটি হচ্ছে, প্রচার পত্র, উন্মুক্ত চিঠি, কাগজ ও প্লাস্টিকের পোষ্টার, ব্যানার ইত্যাদির কান্ডজ্ঞানহীন সংখ্যা। দেয়াল জুড়ে লাখে লাখে পোষ্টার, রাস্তা জুড়ে হাজারে হাজারে ব্যানার কেন্দ্রিক শো-ডাউন যে নগরের শ্রীহানি করছে এই বোধের অনুপস্থিতিও একধরণের অসভ্যতা। এই নির্বোধ অসভ্যতার লাগাম টানবে কে?
যে কোন নির্বাচনী বিলি পত্র, পরিচয় পত্র, পোষ্টার, ব্যানার এ প্রদত্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনের দ্বারা যাচাইবাছাই কৃত এবং অনুমোদিত হওয়ার দাবী রাখে। এর মাধ্যমে অসত্য তথ্য প্রবাহে একটা নিয়ন্ত্রণ আসবে। প্রার্থীর পরিচিতি মূলক একটা বাধ্যতামূলক বিলিপত্র থাকবে যা নির্বাচন কমিশন তৈরি করে দিবে। এখানে নির্বাচনী হলফ নামায় প্রদত্ত তথ্যকে শ্রেণী বিন্যস্ত করে উপস্থাপন করা হবে- যাতে প্রার্থীর পেশাগত পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পূর্ব্ববর্তী সময়ের নির্বাচনী অঙ্গীকার, সাবেক সময়ে একই প্রার্থীর নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গ, দেওয়ানী ও ফৌজদারি অপরাধ মমলা ও সাজার তথ্য, আয়কর ও সম্পদ সারাংশ, ব্যাংক ঋণ তফসিলিকরণ এবং ঋণ খেলাপি থাকা না থাকার বিষয়াদি সঠিকভাবে উল্লিখিত থাকবে। একইভাবে পত্রিকায় দেয়া বিজ্ঞাপনের তথ্যও যাচাই বাচাইয়ের আওতায় আনতে হবে।
নির্বাচনী বিলি পত্র, পরিচয় পত্র, পোষ্টার, ব্যানার ইত্যাদি ওয়ার্ডের জনসংখ্যা ভিত্তিতে মাথাপিছু হিসেবে তৈরি করার বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় এক বা দুশত মিটার অন্তর অন্তর নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত বিলবোর্ড বা ওয়াল থাকবে যাথে প্রার্থীরা সুনির্দিস্ট সংখ্যক (একটি বা সর্বোচ্চ দুটি) করে পোষ্টার সাঁটাতে পারবে, যেগুলোর প্রকাশিত তথ্যও যাচাই বাছাইকৃত হবে। এই বিল্বোর্ডের বাইরে কোথাও পোষ্টার লাগানো যাবে না। প্রতি একশত মিটার পর পর তথ্য অনুমোদিত ব্যানার লাগানো যাবে, তবে নির্বাচনের ঠিক পর পর সেগুলো সরানো এবং রিসাইকেলের খরচ আগেই বন্দোবস্ত করা থাকবে। নির্বাচনে মাইকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ চাই আমরা। বাচ্চাদের ঘুম এবং লেখাপড়ার বিষয় মাথায় রেখে সন্ধ্যা সাতটার পরে কোন ধরণের শব্দ দূষণ করার আয়োজন করা উচিৎ নয় বলে মনে করি। একই সাথে নির্দিস্ট দূরত্বে অনুমোদিত দেয়াল চিকার ব্যাপারেও প্রার্থী ও মালিক পক্ষের মধ্যে একটা চুক্তির সূচনা করে দিতে হবে। এখানে নাগরের সৌন্দর্য্য রক্ষার বিষয় প্রাধান্য পাবে, জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়াদি আমলে নেয়া হবে, সাথে সাথে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ও।
নির্বাচনী পোষ্টারের কাগজ নবায়নোগ্য উৎস থেকে তৈরি করার বাধ্যবাধকতায় আনতে হবে। এই পোষ্টারে পরিবেশ অবান্ধব কালী ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। এইসব পোষ্টার বৃষ্টির সাথে রাস্তা ঘাট ও ড্রেন হয়ে জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। তাই নির্বাচনের সময় এবং পরে এইসব পোষ্টার কিভাবে রিসাইকেলে আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনের পর প্রার্থীর ব্যানার সরায় না এটা একটা অপসংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। এটা ব্যক্তি প্রার্থীর উপর ছেড়ে না দিয়ে রিসাইকেল কোম্পানির দায়িত্বে আনা যায় যেখানে প্রার্থী নির্বাচনী কাগজ, কাপড় ও প্ল্যাস্টিক বর্জ্যের সংগ্রহ এবং রিসাইকেল খরচ বহনে বাধ্য থাকবে। প্রতীক পাবার আগেই এই আর্থিক চুক্তি গুলো সম্পাদন করতে হবে। এলাকাভিত্তিক সংখ্যায় অনুমোদিত ব্যানার, পোষ্টার উৎপাদনের সঠিক সংখ্যার বিপরীতে রিসাইকেল সেন্টারে জমাদানের হেরফের হলে প্রতি ব্যানারের বিপরীতে উচ্চ আর্থিক জরিমানা গুণবে প্রার্থী। নির্বাচনী দূষণে জড়িত প্রার্থীকে পরবর্তি নির্বাচনে অযোগ্য করা কঠিন উদাহরণ সৃষ্টি করলে নির্বাচনী বর্জ্যের বিস্তার কমে আসতে পারে।এই বছর কাগজের পোষ্টার ও প্রচার পত্রের বদলে প্লাস্টিকের পোষ্টার লাগানো হচ্ছে। রিসাইকেল নিশ্চিত করা গেলেই শুধু প্লাস্টিক পোষ্টারকে উৎসাহ দেয়া যায়।
২০১৯-২০ এর শীতকালীন বায়ু দূষণে ঢাকা নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএর ২০১৮ প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের সামগ্রিক পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯ তম স্থানে নেমে এসেছে যেখানে ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম যখন সূচকটি তৈরি করা হয়েছিল তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫ তম। অর্থাৎ মাত্র এক যুগেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫৪ ধাপ নিচে নেমেছে। বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুমান সূচকে (একিউআই) বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের প্রথম তিনটির একটি হচ্ছে ঢাকা। ২০ থেকে ২৫ নভেম্বর ২০১৯ এর কোন কোন দিনে ‘গ্যাস চেম্বার’ আখ্যা পাওয়া দিল্লির বাতাসের চেয়েও বেশি দূষিত হয়ে পড়েছিল ঢাকার বাতাস।
অন্যদিকে বর্ষায় ঢাকার জলাবদ্ধতা খুব ভোগান্তিকর সমস্যা। ০৩ অক্টোবর ২০১৯ প্রথম আলো সম্পদকীয়তে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, ‘এক দশকে জলাবদ্ধতা দূর করতে ওয়াসা অন্তত ৫২৩ কোটি টাকা খরচ করেছে। বিশেষজ্ঞরা নির্দিষ্টভাবে তথ্য হাজির করেছেন যে দু–তিন বছর আগে ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও ঢাকায় জলাবদ্ধতা হতো না। অথচ ০২ অক্টোবর ২০১৯ ৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই ঢাকা ডুবে গেল। অথচ ভারী বৃষ্টি হলেও যাতে জলাবদ্ধতা না হয়, সে জন্য সরকারের কাছ থেকে ওয়াসা বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছিল। গত ১৫ মাসেই তারা এ খাতে ৪৫ কোটি টাকা খরচ করেছে, তারপর খোদ রাজধানীর এত বড় অধঃপতন।‘ ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত এক দশকে সব সংস্থা মিলে খরচ করেছে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা।
এদিকে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছে, ঢাকায় নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুন শব্দ সৃষ্টি হয়, প্রায় এলাকাতেই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি (ডয়চে ভেল, ২রা ডিসেম্বর ২০১৮)৷ ডয়চে ভেলের বরাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে দ্রুতই ঢাকার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ কোনো-না-কোনো ধরনের বধিরতায় আক্রান্ত হবেন৷ তিলোত্তমা ঢাকার গড়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই সব প্রার্থীরা বায়ু ও ধূলি দূষণ, শব্দ দূষণ, জলাবদ্ধতা, জলাশয় ও নদী দূষণে বাংলার জলস্থল বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় আমাদের সরকারি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অতি সচেতন হবার দরকার হয়ে পড়েছে।
নির্বাচনী প্রচারণা পরিবেশ বান্ধব করার দায়িত্ব প্রার্থী ও নির্বাচন কমিশন উভয়ের। তবে পরিবেশ অবান্ধব প্রচারণা বন্ধ করার ও নির্বাচনী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পেশাদার দায়িত্ব অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের। পরিবেশ রক্ষার বোধ নির্বাচন কমিশনে অতি দ্রুত তৈরি হবে বলে আমরা আশা করতে পারি কি?
ভোট যেমন–তেমন, পরিবেশের বারোটা
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৩২