সোনাদিয়া'র গভীর সমুদ্রবন্দর কিংবা গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের মত কৌশলগত প্রকল্প না হয় বাদই দেয়া যাক। ঢাকা-চট্রগ্রাম রেল কার্গো, ঢাকা-চট্রগ্রাম সরাসরি কডলাইন, স্যামসাং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক এর মত বেশ কিছু প্রপোজাল আছে যা সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে ফিরে গেছে। স্যামসাং এর বিনিয়োগ ভিয়েতনামে গেছে, দক্ষিণ কোরীয় রাষ্ট্রদূতের আক্ষেপ মনে করতে পারি! সচিবালয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষায় রেখে স্যামসাং এর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিকে আবুল মাল আব্দুল মুহিত ১০ মিনিট সময় দিয়ে বিদায় করেছিলেন! (সম্ভবত স্যাংসাং এর ভাইস প্রেসিডেন্ট) মূল বিনিয়োগ ভিয়েতনামে চলে যাবার পরে, ২০১৭ সালে তোফায়েল আহমদের মধ্যস্ততায় স্যামসাং সামান্য কিছু বিনিয়োগ নিয়ে ফিরেছিল। কোরীয় ইপিজেডে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ/সরবারহ নিয়ে সরকার যে ইঁদুর বিড়াল খেলা খেলেছিল, তা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ইতিহাসে একটা কলঙ্ক বটে!
*****************************
তৎকালীন কোরীয় রাষ্ট্রদূতের নিজ মুখেই শুনুন-
*****************************
প্রথম আলো l দক্ষিণ কোরিয়ার খ্যাতনামা অনেক প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু সেভাবে উৎসাহ না পেয়ে অন্য দেশে চলে গেছে বলে শোনা যায়। এটা কতটা সত্য?
লি ইয়ুন–ইয়াং l মুঠোফোন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু সেভাবে এখানে সাড়া না পেয়ে ভিয়েতনামে চলে গেছে। গত বছর শুধু তারা সেখান থেকে ২১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। এ সাফল্যের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এ বছর ভিয়েতনামে নতুন করে অতিরিক্ত পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। (বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরীয় রাষ্ট্রদূত লি ইয়ুন–ইয়াংয়ের সাক্ষাৎকার, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪, প্রথম আলো, সাক্ষাৎকার কোরীয় রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার )
*****************************
আপনি যখন দেশের গণতান্ত্রিক প্রসেসকে বিদেশী প্রভূর হাতে ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকবেন, তখন বহু অভ্যন্তরীণ বিষয়ের বাইরেও অন্য যে সব পেনাল্টি আপনাকে গুণতে হবে তার একটা হচ্ছে এই বৈদেশিক বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক সমঝতা ছাড়া এই সময়ে রাজনীতি পথ হাটে না। ফলে আপনি উন্মুক্তভাবে নিজ ইচ্ছায় সবার বিনিয়োগ গ্রহণ করতে পারবেন না। খোলা মেলা কথায়, ভারতীয় সাউথ ব্লকের ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে কনফ্লিক্ট করে এমন বিনিয়োগ প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশের অনেক সময় লাগে। বঙ্গবন্ধু শিল্প অঞ্চলে মোদি ভক্ত আদানি গ্রুপের কাজ পেতে সময় ক্ষেপণ হয়না, যেমনটা হয় সৌদি, তুর্কি, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লংকান কিংবা পাকিস্তানি জিটুজি কিংবা শিল্প গ্রুপ ভিত্তিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। এমনকি কিছু চীনা বিনিয়োগেও বেশ গদাই লস্করের চাল চালা হয়।
এদিকে ভারতীয় ঋণের অবকাঠামো প্রকল্প গুলোতেও অর্থ সামান্যই ছাড় হচ্ছে। জুন ২০১৮ পর্যন্ত ৯ বছরে প্রথম এলওসির অর্থছাড় মাত্র ৪০ কোটি ডলার, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসিতেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলাদেশের। জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় পর্যায়ক্রমে ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার সমপরিমাণ ঋণে ৪৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) দেরি ও প্রকল্প অনুমোদনে ভারতের গড়িমসি, ভারতীয় ঠিকাদারদের অবহেলা সহ বিভিন্ন কারণে এগুলোর বাস্তবায়ন গতি পাচ্ছে না। মূলত পণ্য বিক্রিই মূলত ভারতের অগ্রাধিকার। অবকাঠামো প্রকল্প বুকিং দিয়ে কিছু কাজ আটকে রাখাও যেন একটা অপকৌশল, এতে একই প্রকল্পে অন্যদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে ।
হাসপাতালে বিনিয়োগের একটা উদাহরণ দেই। Click This Link কয়েক মাস হয়ে গেল, চীন, তুরস্ক ও সৌদি আরবের কাছ থেকে আলাদাভাবে হাসপাতাল তৈরির প্রস্তাব এসেছে করোনার পর পরই। তিন দেশই তাদের প্রস্তাবে বলেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যত মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান, তাঁদের কথা মাথায় রেখেই এ দেশে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরির আগ্রহ তাদের। বাংলাদেশের বিভাগ বা জেলা পর্যায়ে একটি করে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল করতে চায় চীন। সব মিলিয়ে চীন মোট ৫০ হাজার শয্যার হাসপাতাল করতে চায় বাংলাদেশে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ ও থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের আদলে হাসপাতাল করার আগ্রহ সিএমইসির। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের তুলনায় তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ অনেক কম হবে বলেও প্রস্তাবনায় তুলে ধরা হয়েছে। চীনের ওই প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত হাসপাতাল হবে পুরোপুরি অনলাইননির্ভর। হাসপাতালে ৭০ শতাংশ চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দেওয়া হবে বাংলাদেশ থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে। (খবর, প্রথম আলো) আপাত দৃষ্টিতে চীনা এই ব্যাপক বিনিয়োগ প্রস্তাব খুবই আকর্ষনীয় যদি স্থানীয় কর্মসংস্থানের পাশাপাশি স্থানীয় ঔষধ শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু যেহেতু এই খাতে ভারতীয় লাভ ক্ষতির বিষয় জড়িত তাই এখানে সিদ্ধান্তে আস্তে বাংলাদেশ সময় ক্ষেপণ করছে। এভাবে সৌদি ও তুর্কি বিনিয়োগেও প্রভাব পড়ছে। তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায়, তারই ধারাবাহিকতায় একটি হাসপাতাল তৈরির আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সিদ্ধান্তে আস্তে পারছে না বলে জমি বরাদ্দ নিয়ে ভাবতে পারছে না।
এর বাইরে, বিদেশি বিনিয়োগ প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবার সবচেয়ে বড় দু-তিনটি বাঁধা হচ্ছে- ১। জমি স্বল্পতা ২। টেকসই, নিরবিচ্ছিন্ন এবং সাশ্রয়ী জ্বালানী নিশ্চয়তা ৩। ইটিপি । দক্ষ মানব সম্পদ প্রাপ্তি, চাঁদাবাজি, জ্বালানী সংযোগ, পরিবেশ ছাড়পত্র সহ নানাবিধ হয়রানি সহ অন্য বেশ কিছু সমস্যা আছে, সেগুলোকে আমি কিছুটা পরোক্ষ বাঁধা মনে করি, যেগুলা কাটিয়ে উঠা যায়।
বিশ্বের ১৯০ টি দেশের মধ্যে বাংলদেশের ডুইং বিজনেস ইন্ডেক্স ২০২০ সালে এসে ১৬৮। আমাদের প্রবৃদ্ধি যে, কর্ম তৈরি করতে পারছে না, বেসরকারি বিনিয়োগ যে আগাচ্ছে না (শ্রমবাজারের ৮৫,১%), তার ভিন্ন কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই। অতি সম্প্রতি বাংলদেশ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীদ্বয় উপ্লভদ্ধি করেছেন যে, জবলেস গ্রোথ থামাতে ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে উন্নতি করা দরকার, দুই অংকে আসা দরকার দ্রুত! কিন্তু বিধি বাম! ১৭৬ থেকে ৯৯ এ ফিরে আসার ৭৭ ধাপের টার্গেট নিয়ে গত ২ বছরে উন্নতি হয়েছে ৮ ধাপ। উল্লেখ্য যে, একদলীয় শাসনের যাত্রা শুরুর বছরে অর্থাৎ নির্বাচনহীন অবৈধ সরকারের যাত্রা শুরুর বছরে ২০১৩ থেকে ২০১৪ঃ মাত্র এক বছরে বাংলাদেশের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকের ৪২ ধাপ অবনমন হয়। বিশ্বের বিনিয়োগ ও ব্যবসার ইতিহাসে এই পতন একটা রেকর্ড বটে। বাংলাদেশের যেসব বিদ্যালয়ে ব্যবসা ও অর্থনীতি শাস্র পড়ানো হয়, সেখানে এই অবনমনের কেইস স্ট্যাডী করা হয়েছে কিনা জানা নাই। ২০১৪ তে বাংলদেশ ঠাস করে নেমে যায় ১৭২ এ। এই ল্যান্ড স্লাইড ধ্বস থেকে আজো বাংলাদেশ দাঁড়াতে পারেনি। এ সময় জাপানী বিনিয়োগ, টয়োটা নকিয়া স্যামসাং সনি কোকাকোলা নেসলে'র মত কোম্পানি বিনিয়োগে প্রবল আগ্রহ নিয়ে এসে খালি হাতে ফেরত গেছে।বিনিয়োগ ফিরে যাচ্ছে!
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আস্থা ফিরে না আসায় বিরোধীদের পুঁজি গুলো বিনিয়োগে আসেনি। এই পুঁজির অনেকটাই সরকারি প্রভাবশালীদের মাধ্যমে লুট, বেদখল, বেহাত কিংবা খরচ হয়ে গেছে। বিনিয়োগ বন্ধ্যার অন্য কারন গুলো খুবই টেকনিক্যাল যা ডুয়িং বিজনেস কান্ট্রি রিপোর্ট ২০২০ তেই বিশদ ব্যাখ্যা করা আছে-
ডুইং বিজনেস ইনডেক্স
ক। ২০২০ এর 'গেটিং ইলেক্ট্রিসিটি' সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১০০ তে মাত্র ৩৪,৯
খ। প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশানে স্কোর মাত্র ২৯
গ। ব্যবসায়িক অঙ্গীকার বা চুক্রি বাস্তবানয়ে স্কোর ২২,২
ঘ। অর্থ ও ব্যবসায়িক মামলা নিষ্পত্তিতে স্কোর মাত্র ২৮,১
এই বিষয় গুলো রাতারাতি সমাধান না করে আপনি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কিভাবে রাতারাতি এগিয়ে নিবেন?
জমির প্রাপ্তি এবং ভূমি রেজিস্ট্রেশান বাংলাদেশের বহু পুরানো সমস্যা। ডিজিটাল ভুমি রেজিস্ট্রেশানে সরকার প্রায় হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে, তথাপি প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশানে ১০০ তে স্কোর মাত্র ২৯। কেন? আমরা যেখানে জানি দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম বড় বাঁধা জমি প্রাপ্তি, সেখানে রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহর গুলোতে টেকসই ভুমি ব্যবস্থার মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে না কেন? প্রভাবশালীদের চাপে ড্যাপে কয়েক দিন পর পরই সংশোধন আসে। এই যে ডিজিটাল ভুমি ব্যবস্থাপনার নামে হাজার কোটি খরচ হল, তার সুফল বিনিয়োগে আসবে কবে?
বিদ্যুৎ খাতে সরকার গত দশ বছরে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিলেও ব্যবসা ও শিল্পের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রাপ্তি সহজ হয়নি। ১০ বছরে বা ১০ বার বিদ্যুৎ ও জ্বলানির মূল্য বৃদ্ধি ব্যবসা সহজীকরনে বড় বাঁধা। কুইক রেন্টালে, ক্যাপাসিটি চার্জে এত ব্যয় আর এত ভর্তুকির পরেও জ্বালানী সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১০০ কেন মাত্র ৩৪,৯?
বাংলাদেশের বেকারত্ব ও জবলেস গ্রোথ থামানোর কোন শর্টকাট পথ নেই। দেশকে গণতান্ত্রিক যাত্রায় যেমন নিতে হবে, যাতে করে নাগরিকের শক্তিতে দাঁড়ানো সরকার স্বাধীনভাবে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। অন্যদিকে, জমি, বিদ্যুৎ ও মানব দক্ষতার মত স্থানীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা গুলোতে চৌকশ হতে হবে, আন্তর্জাতিক মানে যেতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১২:৫৭