ট মা স ফু লা র
এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার তার থাইল্যান্ড সংলগ্ন অধিকাংশ সীমানা নিয়ন্ত্রণ করছে। মিয়ানমার যতদিন ধরে স্বাধীন দেশ হিসেবে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে, প্রায় ততদিন ধরেই দেশটির সীমান্তসংলগ্ন পার্বত্য এলাকায় জেনারেলরা কারেন জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন পরিচালিত সাতটি ক্যাম্প দখল করার জন্য শেষ দফা হামলা শুরু করে গত জুনে। বিদ্রোহীদের এ গ্র“পটি এক সময় থাই-মিয়ানমার সীমান্তের ১৮শ’ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করত। এমনকি তারা তাদের নিজেদের চৌকিগুলোতে শুল্ক আদায়ও করত।
জুনের হামলা কারেন বাহিনীকে হতচকিত করে দেয়। এর কারণ অংশত সময়টা কর্দমাক্ত বর্ষা মৌসুম। সাধারণত এ সময়ে আবহাওয়াজনিত যুদ্ধবিরতি পালন করা হয়। সেনাবাহিনীর হামলার কারণে শয়ে শয়ে বিদ্রোহী ম্যালেরিয়া-প্রবণ জঙ্গলের ভেতর পালিয়ে যায়।
কারেন বিদ্রোহ এশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলোর একটি। কারেনরা এক সময় তাদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের কাছে স্বাধীন ‘কারেনিস্তান’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই, নেই তেমন অস্ত্রশস্ত্র এবং তারা এখন বিভক্ত। মিয়ানমারের জাতিগত গোষ্ঠী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বাটি লিন্টনার এ কথা বলেন।
তবে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত যোদ্ধারা নয়Ñ গ্রামবাসী, যাদের অধিকাংশই শিশু। তারা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে একেবারেই অনুন্নত এলাকা ও প্রত্যন্ত কারেন পাহাড়ে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কারেন হিউম্যান রাইটস গ্র“প নামে সংঘাত পর্যবেক্ষণকারী একটি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ৪,৮৬২ জন গ্রামবাসী সীমান্ত পেরিয়ে থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছে, যেখানে ইতিমধ্যেই শরণার্থী শিবিরে এক লাখ ২০ হাজার লোক অবস্থান করছে।
ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের ছয় দশক পরও মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার দেশটির সম্পূর্ণ সীমানার নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে পারেনি। সালুইন নদীসংলগ্ন কিছু ক্যাম্প এখনও কারেন বিদ্রোহীদের দখলে রয়েছে। তাছাড়া চীনসংলগ্ন সীমান্তে কাচিন ও ওয়াসহ আরও কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে সীমান্তরক্ষীর দায়িত্ব পালনের একটি প্রস্তাব মেনে নিতে নারাজ।
তবে জুনে থাই সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় কারেন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাফল্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আগামী বছরের নির্বাচনের আগে জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। সামরিক সরকার বলছে, এ নির্বাচন দেশটিতে প্রায় পাঁচ দশকের মধ্যে প্রথম বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ উš§ুক্ত করবে।
মে মাসে তামিল টাইগারের বিরুদ্ধে শ্রীলংকা সরকারের সাফল্য জুনে কারেন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলাকে অংশত উৎসাহিত করে থাকতে পারে। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে গত জুনে ইয়াঙ্গুন সফর করে গেছেন। উভয় সরকারই সামরিক অভিযানকালে বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি আচরণের জন্য বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও পশ্চিমা দেশের কাছে সমালোচিত হয়েছে।
তবে থাইল্যান্ডের চিয়াং মাইয়ের পায়াপ ইউনিভার্সিটির মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ উইন মিনের মতে, কারেনদের অবস্থা তামিল বিদ্রোহীদের মতো নয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া এবং মনোবল দুর্বল হয়ে পড়া সত্ত্বেও এখনও যোদ্ধা হিসেবে তাদের শক্তি রয়েছে। কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি নাও জিপোরাহ সেইন বলেন, তাদের গ্র“পের অন্তত চার হাজার সদস্যের হাতে অস্ত্র রয়েছে। তাদের অধিকাংশই লুকিয়ে আছে প্রত্যন্ত এলাকায়। তবে সংখ্যাটির সত্যতা নির্ণয় করা কঠিন।
এলাকাটি বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তা কারেন বিদ্রোহীদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। সেখান থেকে তারা সামরিক বাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চালাতে এবং স্থলমাইন পুঁতে রাখতে পারে। কারেন পাহাড়ে চলাচলের পথও কম। অনেক গ্রামেই বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ নেই। যাতায়াত ও মালামাল বহনের জন্য অনেক পরিবার হাতি ব্যবহার করে।
কারেনরা বেশির ভাগই খ্রিস্টান। তারা ব্রিটিশ আমলে সরকারের শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসকদের আনুকূল্য পেত। অন্যান্য কারণের মধ্যে এটিও সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মীদের সঙ্গে কারেনদের বিরোধের একটি কারণ। বর্মীদের অধিকাংশই বৌদ্ধ এবং বর্তমান মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সদস্যরাও বর্মী।
কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সংঘাত শুরু হয় ১৯৪৯ সালে অর্থাৎ ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের এক বছর পর। সে সময় দেশটি পরিচিত ছিল বার্মা নামে।
কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের সামরিক শাখা কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির কর্নেল বোথিয়েন থিয়েনথা বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গত ২ জুন মর্টারসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তাদের ওপর হামলা শুরু করে। সরকারের স্থানীয় মিত্র ডেমোক্রেটিক কায়িন বুদ্ধিস্ট আর্মি হামলা চালালে কর্নেল থিয়েনথা একটি রকেট চালিত গ্রেনেড ছোড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা ব্যাকফায়ার করলে তিনি ঘাড়ে আঘাত পান এবং তার বাঁ-হাতের চারটি আঙুল উড়ে যায়। তিনি ও আরও ৯০ জন যোদ্ধা ক্যাম্প পরিত্যাগ করেন।
কর্নেল থিয়েনথার আহত হলে তা কারেন বিদ্রোহীদের একটি বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের অস্ত্রের মজুদও ফুরিয়ে আসছিল। কর্নেল থিয়েনথা বলেন, তার বাহিনী অস্ত্রগুলো একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে রাখে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বেশি অস্ত্র নেই, আমরা সেগুলো পরিমিতভাবে ব্যবহার করি।’ তার বাহিনীর সদস্যরা এখন জঙ্গলে লুকিয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
যে সময়টিতে সামরিক অভিযন চালানো হয়েছে, সেটা বিশেষ করে লে ক্লো ইয়াও এলিমেনটারি অ্যান্ড মিডল স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য খারাপ ছিল। একটি আমেরিকান মিশনারি পরিবারের অর্থায়নে সবে ১ জুন স্কুলটির উদ্বোধন হয়। আর পরদিনই শুরু হয় মর্টারশেল হামলা। স্কুলের ১২৫ জন ছাত্রছাত্রী মোয়েই নদী পেরিয়ে থাইল্যান্ড চলে যায় তাদের বিছানাপত্র, কম্বল ও বইখাতা নিয়ে।
তাদের সঙ্গে আসা স্কুলের একজন শিক্ষক বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে পান, সরকারপন্থী বুদ্ধিস্ট মিলিশিয়া বাহিনীর সৈন্যরা নদীতীরে অবস্থান নিয়েছে এবং স্কুলভবন ও গীর্জা থেকে একটির পর একটি তক্তা খুলে নিচ্ছে। নদীর দিকে মুখ করা একজন রিপোর্টারের টেলিফটোলেন্সে অর্ধনিমীলিত চোখে তিনি বলেন, ‘তারা সব কাঠ খুলে নিয়েছে। গীর্জাটিও আর নেই!’
আইএইচটি থেকে ভাষান্তরিত
লিংকঃ
Click This Link