Click This Link
২০৩১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী ( ২২ বছর পরের ঘটনা ) :
দু'জনেই কিছুক্ষন চুপচাপ ; অনু হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে , আমাদের বয়স তো কম হোল না , কখন কি হয় , কতদিন ধরে ভাবছি বলব তোমায় একটা কথা , বলা হয়ে উঠছে না ; আমার শেষ ইচ্ছের কথা ।
অমি : বল না , বলে ফেল ।
অনু : আমি তো তোমার আগে চলে যাব , আমার মৃত্যুশয্যায় খুব ইচ্ছে তুমি আমার কাছে থাকবে আর .... ; কন্ঠস্বরের কাঁপুনিটা বেশীই মনে হয় , থেমে যায় সে , শেষ করতে পারেনা কথা ।
অমি চকিতে অনুর চেয়ারের হাতলে রাখা ডান হাতটা চেপে ধরে দু'হাতে !
অনুর সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় ! শিহরিত অনুর মনে হল সে ভূমি পরে কোথাও নেই , হারিয়ে গেছে শূন্যে ; প্রথম ছোঁয়া অমির ! কতদিনের কল্পনার , কাঙ্খিত স্পর্শ। তার অনুভুতিরা অমির হাতের উষ্ণতাকে সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে রাখতে গিয়ে তাকে অবশ করে ফেলে !
সম্বিত ফিরে পায় , তাকিয়ে দেখে অমি কেমন শক্ত করে তার হাত ধরে অপলক তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে , চোখ দুটো যেন তার ব্যাথাকাতর , বেদনায় ভাষাহীন ! হয়তো বলতে চাইছে " চুপ কর , বলো না আর কিছু " ; নিজেকে সামলে নেয় , বুঝতে পারে অমি কতটা কষ্ট পাচ্ছে ; ওতো অমিকে কষ্ট দিতে চায় না । অমিও যেমন কোন কথায় বা কাজে কোনদিন তাকে কষ্ট দেয়নি , আহত করেনি । অনু বলে , তুমি যে আমার হাত ধরে বসে আছো , যা চাইছিলাম তার অনেকটাই পাওয়া হয়ে গেছে আজ । বাদ দাও ওসব , হাতটা ছাড় ; কেউ দেখলে কি মনে করবে ।
অমি হাত ছেড়ে দেয় , বাষ্পরূদ্ধ কন্ঠে বলে , তুমি কেন আমার আগে যাবে , আমি আগে যাব ।
অনু জিদ করে ; বলে , তুমি আর আমাকে হারিয়ে দিও না , সারা জীবন জিতে গেলে আমাকে পরাজিত করে ; শেষ বেলাতে জিততে দাও ।
অমি : জানিনা , বিধাতা জানে কি হবে ; তবে তুমি যদি সত্যি আমার আগে যাও , আমি এ শহর ছেড়ে , দেশ ছেড়ে চলে যাব --আর ফিরবো না । সেটা মনে রেখো , আমার সহ্য ক্ষমতা আর আগের মত নেই , কেন তুমি আমার জীবনে এসেছিলে , কেন ? তাকিয়ে দেখে অনুর চোখে পানি , আর কিছু বলতে পারে না , বলতে চেয়েছিল এখন অনেক কথা , কয়েক যুগের জমে যাওয়া কথা !
তারপরে আবার চুপচাপ দুজনে । উঠে দাড়ায় অমি , বলে মোহনের সাথে খবর দেখি চল ,ও আমার বন্ধু ছিল , আগে বুঝতে পারিনি ও এত অন্যরকম ; ওর জন্য আমার গর্ব হয়। ওর কথা শিপ্রা আমায় প্রায়ই বলে , সে নাকি তোমাকে খুব ভালবাসে , আমারও তাই মনে হয় ।
রাতের খাবারের টেবিলে ওরা চার জন বসে , বুশরা এসে পৌছে নি , তনিমারাও না ; সবাই ব্যস্ত নিজস্ব পরিচিত জগতের আঙিনায় ।
অমি জানায় মোহনের অনুরোধে শিপ্রা মেন্যুতে কতটা কাটছাট করেছে । শিপ্রা যে তাদের খাওয়ানোর ব্যাপারটা একেবারে অত্যাচারের পর্যায়ে নিয়ে যায় , এটা তারা বুঝে ফেলেছে । অনু বলে , অমির সৌভাগ্য যে এমন একটা বউ পেয়েছে , শিপ্রা সুযোগে বলে ফেলে , মোহন ভাইয়ের সৌভাগ্য যে ঈর্ষনীয় সেটা কেন বলছেন না ।
অনু মোহনকে বলে , একটা কিছু বল ।
মোহন : সৌভাগ্য কে বলল ! আমি তো একটা পঁচা মেয়ে বিয়ে করেছি , আমার বড়ই দুর্ভাগ্য ! হোল তো ! বলবার ভঙ্গীতে সবাই হেসে ফেলে ।
খাওয়ার পর্ব শেষ না হতে তনিমা আর ওর মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে কি জরুরী কাজের বাহানায় চলে গেল তনিমার বর । তনিমা এসেই হারমোনিয়াম নামিয়ে নিল , আজ শিপ্রা আন্টির গান শুনবে , শুনেছে এক সময়ে গান গাইতো শিপ্রা । অমি এক ফাঁকে উঠে গিয়ে নিয়ে আসে অনুর জন্য কেনা রূপার চেইন চশমার । একদিন মোহন বলছিল , অনুর চশমা খোঁজা একটা জটিল কাজ ! প্রায়ই খুঁজে পায় না , অসুবিধায় পড়ে যায় । কেনার সময়ে শিপ্রার মত ছিল স্বর্নের চেইন কেনা । সোনালী রঙে চাকচিক্য বেশী মনে হয় অমির কাছে , এটার যে রজতশুভ্র রূপ ঝরছে সেটা অনুকে মানাবে ভাল । অনুকে দিতেই সে বলে , ধাতব কঠিন একটা মালা যদিও বা দিলে গলা পর্যন্ত পৌছুবে না আমার । মাথার কাছে থাকবে বাঁধা !
তারপরে কপালের টিপটা খুলে শিপ্রার কপালে পরিয়ে দেয় । ভারী সুন্দর দেখায় ওর মুখটা । বলে , খুলো না , পরে থাকো , বেশ মানিয়েছে তোমায় ।
শিপ্রা আবেগ আপ্লুত হয় ; বলে , টিপ টা দিয়েছো কপাল থেকে খুলে , ভালই হোল ; তোমার যে কপাল তার ছোঁয়া থাক আমার কপালে , তাতে করে যদি কিছু মেলে ! আগে তোমার কারনে ওর উপরে রাগ করতাম , প্রকাশও করতাম সে রাগ । এখন রাগ করি না , ওকে হিংসা করি , কেন করি সেটা প্রকাশ করতে পারিনা ; আজ তোমাকে বলি ; সে হিংসা তোমার কারনে , তোমাদের ভালবাসার কারনে । এসব কথায় কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অনু , কি করবে বুঝতে পারে না । মোহন বুঝতে পারে সেটা ; বলে দেরীতে হলেও বুঝেছো শিপ্রা , সেও ভালো । যেতে দাও , বাড়ি যেতে হবে , রাত বেশী হয়ে যায় না যেন ।
এরপরে অমি কাঁচের বয়ামে ভরা হারবাল টি আনে সাথে দেবে বলে ; যষ্টিমধু , লবঙ্গ , নিম পাতা আরো কি কি দিয়ে নিজে বানিয়েছে অনুর জন্য । অনু বলে , জীবনের বেশীরভাগ সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জ্ঞান অর্জন করে , অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে শেষে এটা বানালে ! সবাই হেসে দেয় , অমিও হাসে ; মনে ভাবে , অনু কি বোঝে তার সুখের জন্য , শান্তির জন্য অমি কতটা উদগ্রীব হয়ে থাকে ! অমির আজ কেবলই কান্না পাচ্ছে ,
কেন পাচ্ছে সে জানে না ! পুরুষ মানুষের কি কান্না মানায় !
অনুর চোখেই বা কেন বারবার পানি চলে আসছে , কি হোল আজ !
গানের আসর শুরু হয় , শিপ্রা গায় , "তুমি কোন কাননের ফুল , কোন গগনের তারা , তোমায় কোথায় দেখেছি......" , "বঁধূ কোন আলো লাগলো চোখে... " , শেষে গাইল , " তুমি জান না আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে ,আমি তোমারই সঙ্গে বেঁধেছি আমারো প্রান ..." । তনিমা শোনায় , " জানি তোমার অজানা নাহি গো কি আছে আমার মনে... "--তার মায়ের প্রিয় গান । গান শেষ হতে ঘরে ঢোকে বুশরা সাথে তনিমার বর ; দুজনের হাতে অনেক ফুল , তনিমা বুশরার পরিকল্পনার কথা কিছু বুঝতে পারেনা এরা । আজ তো কারো জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী নয় ! শুক্রবারে বেড়াতে আসা শুধু । ভুল ভাঙে যখন তনিমা আর বুশরা বলে ওঠে , " হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে , আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী শুক্রবার ভ্যালেন্টাইন ডে ; সবার জন্য ভালবাসার বিশেষ দিন ", তনিমার বরও গলা মেলায় ওদের সাথে ।
প্রাপ্ত বয়স্ক , প্রৌঢ় কজন নারী পুরুষের মিলন মেলায় অমি আর অনুকে মনে হল অনিন্দ্য সুন্দর , সে সৌন্দর্য্য অপার্থিব , স্বর্গের আলোয় আলোকিত ! ওদের চোখের কোণায় জমাট হীরে ঝরে পড়ে না , তার উজ্জল দ্যুতি বলে দেয় -- বয়স ওদের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিতে পারেনি ; মনে হোল ভাল লাগা পূর্ণ করে দিয়েছে ওদের সকল অপ্রাপ্তি । জীবনে আজই প্রথম ওদের ভ্যলেন্টাইন ডে এল !
( এমন একটা কাল্পনিক ঘটনা নিয়ে লিখতে বসে , লেখিকার চোখে পানি চলে আসছে , মানুষ মূলত: অনুভুতিপ্রবন ; আমার আগে কখনো এমন হয় নি যে লিখতে বসে কাঁদতে হয়েছে , বুঝতে পারছি -- আমার এত দিনের সকল লেখার মধ্যে এটি প্রিয়তম ) !
ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা : রানা