জাতি ধর্ম-বর্ণ, গরিব-ধনী, শিক্ষিত-মূর্খ জ্ঞানী নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষই শান্তি চায়। কিন্তু খুব কম মানুষই শান্তি পায়। তাই যুগে যুগে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে স্ব স্ব জাতির মধ্যে শান্তির পথ প্রদর্শক আবির্ভূত হয়েছেন। বাংলার বুকে অন্য জাতি, অন্য ভাষা ও অপসংস্কৃতি যখন বারবার হানা দিচ্ছিল সেই সময় লালন সাঁইজীর আবির্ভাব ঘটে। বাংলা ১২৯৭ সালের ১লা কার্তিক, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর ১১৬ বৎসর বয়সে লালন সাঁইজী দেহত্যাগ করেন।
সাঁইজীর দর্শনে রয়েছে- সবার উপরে মানুষ সত্য, মানুষ মানুষের জন্য। মানুষ হওয়ার জন্যে দরকার সত-স্বভাব যার পরিচয় মেলে কথা ও কাজে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অমূল্য বাণী- সত্য বল সুপথে চল - বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে বাঙালি জাতিকে দিয়ে আসছে দিক নির্দেশনা। গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে সাঁইজীর দর্শন বাংলার মানুষকে দেখালো নতুন দিগন্ত, নতুন প্রাণ যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান।
লালন সাঁইজী একজন বাঙালি। এই বাংলায় বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষায় শান্তি-ধর্ম প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন বদ্ধ পরিকর। শান্তি-ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে দর্শন দিয়েছেন তা বাঙালি জাতিকে একটি উন্নত জীবনধারার সন্ধান দিয়েছে। সহজ সরল সাধারনের ভাষায় কবিতার ছন্দে, গানের মরমী সুরে তিনি যে 'লালন সংস্কৃতি' সৃষ্টি করে গেছেন, তা বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্য। পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, ততদিন লালনও হয়ে থাকবেন স্মরণীয় এবং বরণীয়।
পূজিত হবেন একজন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার উর্ধেব 'শান্তি ধর্ম' প্রচারক হিসেবে। তাঁর সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে মনসুর উদ্দীন বলেছেন, 'লালন ছিলেন ভোরের কোকিল, আটপৌরে ভাষার প্রাণবান কবি। হৃদয়ের অনুভুতি, দার্শনিক তত্ত্ব এমন সরল করে বাংলায় আর কোন কবি বা গীতিকার প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই।' একথা অনস্বীকার্য যে, তৎকালীন সময়ে বাংলার বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষদের মন্দির মসজিদের প্রচলিত সংকীর্ণ ধর্মীয় উগ্রতার রুদ্ধ কক্ষে বন্দি না করে উদার, উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে বসে দেশ মাটি প্রকৃতির নিবিড় পরশে পরম স্রষ্টার সাথে এক প্রত্যক্ষ মধুর ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রেমময় সম্পর্ক সৃষ্টির শাশ্বত শান্তির ধর্মে আহ্বান জানিয়েছেন ভোরের কোকিলের মতই। আত্মদর্শনের লালনীয় তত্ত্বাদর্শে বাংলার মানুষ খুঁজে পেয়েছিল মুক্তির পথ।
সাধকদের মতে বাঙ্গালী জাতির প্রাণপুরুষ এই মহান দার্শনিকের দর্শন জেনে-বুঝে চর্চা করে নিষ্ঠার সঙ্গে চিন্তা চেতনায় ধারণ করলে সুস্থ সুন্দর সত্য স্বসংস্কৃতি সম্পন্ন একটি অসাম্প্রদায়িক মানব গোষ্ঠী গড়ে উঠতে বাধ্য। তাই লালন সাঁইজী বাঙালির ঐতিহ্যের লালন, ইতিহাসের লালন, সংস্কৃতির লালন। সাঁইজী বাঙালির পরিচিতি। তিনি শেকড়ের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর প্রেরনাতেই বাংলার বুকে বহু সাধক আজও নিয়োজিত নিরবিচ্ছিন্ন কর্ম সাধনায়। সাধন-ভজনের পদ্ধতির বীজমন্ত্রও তিনি দিলেন-
“ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার।”
সমাজের প্রতিটি স্তরে সাঁইজীর দর্শন অনুসারী রয়েছে, যারা প্রকৃতই চিন্তা-চেতনায় লালন পূজারী। বাউল সাধকদের কাছে লালন সাঁইজী তাদের ধর্মগুরু। তাঁর সমাধিস্থল তাদের কাছে তীর্থভূমি। কোনো আঙ্গিকেই সাঁইজীর সামান্যতম অবমাননা, বাঙালি জাতি সহ্য করবেনা – হোক তা লালন নামের গায়ে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়ানোর কসরত অথবা তাঁকে ব্যাক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবসায়িক হাতিয়ার বানানোর কূটচাল অথবা শুধুমাত্র কবি, বাউল ফকির বানানোর অপচেষ্টা। অপরদিকে নিছক সাংবিধানিক অধিকার আদায় অথবা প্রত্নতাত্ত্বিক পূরাকীর্তি নিদর্শন সুরক্ষা জাতীয় মানবিক বিষয় মনে করলেও আমাদের ভুল হবে। আমদানিকৃত অপসংস্কৃতির হাত ধরে নগরায়ণ ও উন্নতির নামে বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থানগুলোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে .........
সাঁইজীর ভাব দর্শন ও মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার একটি ছোট্ট প্রচেষ্টা ......... এইখানে ক্লিক করেন
সকলের নিকট শান্তির বার্তা পৌঁছে দেয়ায় আমার মূল উদ্দেশ্য