somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ বন্ধু

০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বন্ধু

=====

প্লেনটা হালকা একটা ঝাঁকি খেল।

শীলা শক্ত করে কায়েসের হাত চেপে ধরে। “ওরে বাবা।” তার চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে। “আকাশ থেকে পরে যাব না তো?”

“আরে ধুর”, কায়েস হাসিমুখে বলে, “কিস্‌সু হবে না।”

“এরকম প্রায়ই হয়?”

“হ্যাঁ। এরকম জার্কিং কত দেখেছি। এটাই নরম্যাল।”

“তোমার ভয় করে না?”

“আবার জিগায়! ভয় করবে না কেন? ভয় তো করেই।”

কঠিনভাবে বাঁধা সিটবেল্ট যতটুকু অনুমতি দেয় ততটুকু নড়ে শীলা কায়েসের দিকে সরে আসে। মাথা এলিয়ে দেয় কায়েসের কাঁধে। নিশ্চিতবোধ করে।

কায়েস মুচকি মুচকি হাসে। সে সারা বছর ট্যুর করে বেড়ায়। শীলা বহুবার বলেছে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। কায়েসের সাহস হয় না। একটা বিদেশী দাতা সংস্থার প্রকল্পে চাকুরি করে কায়েস। প্রচুর ট্যুর করতে হয়। চিটাগাং, সিলেট, বরিশাল। কিন্তু কাগজের ঠেলাঠেলিতে কখনও ভাবেনি শীলাকে সাথে নিয়ে যাবার কথা। আর সে তো ঘুরতে যায় না কাজে যায়।

প্লেনে করে যাওয়াটা আসলে বিলাসিতার কিছু না, শীলা বোঝে না। এগুলো পয়সার হিসেব করা পদ্ধতি। প্লেনে না গিয়ে বাই রোডে গেলে একদিন আগে যেতে হয়। হোটেল ভাড়াটা লাগে। তা ছাড়া প্লেনের টিকেট এখন এতো সস্তা হয়েছে যে হিসেব করে দেখা যায় প্লেনে করেই সংস্থার পয়সা বাঁচে। এয়ারপোর্টে নেমেই সাথে সাথে কাজে লেগে পরা যায়।

এর ফলে কায়েসকে দুই দিন পর পর আকাশে উড়তে হয়। মাটি ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে মেঘের বুক চিঁড়ে অসীম নীল আকাশে ভেসে যেতে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া কায়েসের প্রথম প্রথম ভাল লাগতো। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। টেক অফ করার পর থেকেই চোখমুখ শক্ত করে ভ্রুঁ কুঁচকে খবরে কাগজ পরে ও।

শীলা বহুদিন ধরেই বলছিল ওকে একবার ট্যুরে সঙ্গে নিয়ে যেতে।

“সারাদিন হোটেলে বসে করবা কী? আমি তো সেই ভোর বেলায় ফিল্ডে বের হয়ে যাই। ফিরতে ফিরতে আবার সেই রাত। টাইট শিডিউল। ঘোরাঘুরির সময়টা পাব না।”

“তাতে কী? সন্ধ্যার পর তোমাকে তো কাছে পাব। জান একা একা রাত কাটাতে আমার একদম ভাল লাগে না। ভয় লাগে।”

বোকা মেয়ে। কায়েস মনে মনে ভাবে। বিয়ে হয়েছে দুই বছরের মতন হল। এর আগে তো একাই থাকতা।

যাই হোক। শীলা যদি এত যুক্তি দিয়ে চিন্তা করত তা’হলে দুনিয়াটাই অন্য রকম হত।

অনেক জোরাজুরির পর এবার কায়েস ভয়ে ভয়ে বসের কাছে কথাটা তোলে। বরিশালে চার দিনের ট্যুর পরেছে, একা একা। শীলাকে সাথে নিয়ে যেতে চায়।

বস জিজ্ঞেস করেন, “বিয়ের কতদিন হল আপনার?” ছোট বাচ্চারা বাবার কাছে চকোলেট কিনে দেবার আবেদন করলে বাবাদের চোখের কোণে যেমন হাসি ফুটে ওঠে ঠিক তেমনি তাঁর চাহনি।

উত্তর শুনে মুচকি হাসেন বস। “আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদের এজেন্টকে বলে একই ফ্লাইটে সিট করিয়ে নেবেন।”
কায়েস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

সেই শীলা তার সাথে, তার পাশে। তার কাঁধে মাথা গুঁজে বাহুতে হেলান দিয়ে আছে।

লাউডস্পিকারটা ঘরঘর করে ওঠে। প্লেনের চালক ইংরেজিতে কিছু একটা ঘোষণা করেন।

শীলা বোধহয় তদ্রাচ্ছন্ন হয়েছিল। দু’হাতে চোখ মুছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় কায়েসের দিকে।

“কিসের অ্যানাউন্সমেন্ট?”

“সামনে কিছুটা টার্বুলেন্স আছে। ঝাঁকিঝুঁকি হতে পারে।” কায়েসের চেহারায় ভরসা, “ভয়ের কিছু নেই।”

“ও!” শীলাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখায়।

কায়েস চেয়ে থাকে শীলার দিকে। পাশ দিয়ে এয়ার হোস্টেজ একজন জোর পায়ে হেঁটে যায়। আইলের সামনে গিয়ে সিট নামিয়ে বসে পরে।

একটু পরেই শুরু হয় টার্বুলেন্স। হালকা ঝাঁকি চলতে থাকে। খোয়া দিয়ে বানানো রাস্তার গাড়ি চালালে যেমন হয় অনেকটা তেমন। কেবিন জুরে তখন ফিসফাস আরম্ভ হয়েছে।

“কতক্ষণ চলবে এরকম?” শীলার গলায় প্রশ্ন।

“এইতো কিছুক্ষণ। ধরো দুই মিনিট।” আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ে কায়েস।

হঠাৎ প্লেন একটা ঝাঁকি খেয়ে অনেকটা নিচে নেমে আসে। কেবিনের ফিসফাস ততক্ষণে আতংকে বদলে গেছে। কায়েস ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সারি সারি ফ্যাকাশে মুখ। সবাই শক্ত করে সিটের হাতল চেপে ধরে আছে। দু’একজন বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে।
শীলা আরো শক্ত করে কায়েসের হাতটা চেপে ধরে। আতংক ভরা দৃষ্টিতে কায়েসের দিকে সে চেয়ে আছে।

কায়েস কিছু একটা ভরসার কথা বলতে যায়। তার আগেই প্লেন একদিন হেলে পরে। সেই সাথে যাত্রীদের আতংকিত চিৎকার। বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে থাকা কণ্ঠগুলো এবার আর্তনাদে পরিণত হয়েছে।

প্লেন সোজা হয়। হতে না হতেই আবার ঝাঁকি। এবারেরটা ভয়ংকর। প্লেন অনেকখানি নিচে নেমে আসে আবার। কেউ একজন উচ্চস্বরে আজান দিচ্ছে।

“আমরা কি আজকে প্লেন ক্র্যাশ করে মরে যাব?”

শীলার প্রশ্ন শুনে কায়েস হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না।‘

“আরে ধুরো,” কায়েসের বুকের মধ্যে হাজারটা ড্রাম পিটছে, কিন্তু শীলাকে বুঝতে দেয়া যাবে না, “এরকম কত হয়!”

“না, বলো না! যদি ক্র্যাশ করে।”

“করলে করবে।”

“মারা যাব?”

“মারা তো একদিন যেতেই হবে।”

“শীলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।”

মুচকি হেসে বলতে শুরু করে কায়েস। তার গলায় স্বান্তনার ছোঁয়া, “দেখো মারা তো একদিন যেতেই হবে। আজকেই না হয় হল।”

“মানে কী?”

“মানে ধরো আজকে বেঁচে গেলাম কাল বা পরশু বা তার পরের কোন একটা সময় মারা তো যাবই আমরা তাই না?”

“হ্যাঁ, তো?”

“তো ধরো আজকে মারা যাওয়াটাই ভাল, তাই না?”

“কেন আজকে মারা যাওয়াটা ভাল কেন?”

“এই যে তুমি আমার পাশে আছো। আমার হাত ধরে আছো। বিয়েরদিন বলেছিলাম না মারা যাবার আগ পর্যন্ত তোমার হাত শক্ত করে ধরে রাখব। এই সময়ে আমরা দু’জন পাশাপাশি আছি এই বা কম কিসে?”

“ধুর তোমার ফাজলামো!” শীলা গলায় উষ্মা।

“আরে সিরিয়াস কথা বলতেসি,” কায়েস গলায় একটা কপট গাম্ভীর্য্য টানে, “এখন মারা যাওয়ার অনেক সুবিধা।”

“কী কী সুবিধা শুনি?”

টার্বুলেন্স চলছে। কিন্তু শীলার মনোযোগ ঘুরে গেছে। কায়েসকে এখন এই মনোযোগ ধরে রাখতে হবে।

“এই যে ধরো, আমার বয়স উনত্রিশ, আর তোমার সাতাশ। ভরপুর যৌবন আমাদের। এরচে’ শক্তিশালী আমরা আর কখনই হবো না। যত বয়স যাবে শরীর তত বুড়ো হবে। আস্তে আস্তে শারীরিক সামর্থ্য কমবে। জীবনের চূঁড়োয় চলে এসেছি আমরা।”

শীলা শুনে যাচ্ছে।

কায়েস বলে যায় “আমাদের বাচ্চা নাই। বাচ্চা থাকলে একটা চিন্তা থেকে যেত, আমরা যাওয়ার পর বাচ্চাকে দেখবে কে। এখন আর ঐ চিন্তাও নাই।

“তার ওপর ধরো, আমি ভাল চাকুরি করি। এরকম চাকুরি আর না-ও থাকতে পারে। অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে। আমাদেরকে খারাপ দিন আর দেখে যেতে হচ্ছে না।
“তার ওপর ধরো এই বয়সে খুব বেশি পাপ-ও করিনি। মরে টরে গেলে জাহান্নামে বেশিদিন থাকতে হবে না বোধহয়”
শীলার হেসে ফেলে “বাহ, মরে যাবার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে রেখেছো দেখছি...”
“আর তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমার পাশে তুমি আছো।”

“সেটা একবার বলেছো...”

“তুমি আমার সবচে’ কাছের বন্ধু। তুমি আমাকে সবচে’ ভাল চেন। তুমি সাথে থাকলে আমি সব ধরণের বিপদের মধ্যে দিয়ে যেতে পারি। তোমার মত কাছের বন্ধুর হাত ধরে জীবনের শেষ কয়েকটা মুহুর্ত কাটিয়ে যেতে পারা কি কম সৌভাগ্যের? তুমিই বলো?”

শীলা জবাব দেয় না। আলতো করে গা এলিয়ে দেয় কায়েসের বাহুর ওপর। শক্ত করে ধরে রাখা হাতটা শিথিল হয়ে আসে, কিন্তু হাত সে ছাড়ে না।

একটু পরেই ক্যাপ্টেনের ঘোষণা ভেসে আসে লাউড স্পিকারে। প্লেন বিপদমুক্ত।

কেবিনে স্বস্তি ফিরে আসে। চিৎকার করতে থাকা যাত্রীরা স্বাভাবিক হয়ে আসেন।

*****

গাড়িতে উঠে বসে কায়েসের পাশে উঠে বসে শীলা। গাড়িতে উঠেই সে আবার কায়েসের হাত ধরে। সেই টার্বুলেন্সের সময়ের পর থেকে আর কথা হয়নি। কেমন যেন একটা মোহতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে দু’জনে। কথা না হলেও ভাবের আদানপ্রদান হচ্ছে।

হাতে হাত রেখে দু’জন দু’জনের মাথার ভেতরে চলতে থাকা ভাবনাটা ধরতে পারে।

তারা ভাবতে থাকে, এ-ই তো জীবন। ছোট হোক, তবু সুন্দর হোক। পাশাপাশি হাত ধরে কাটিয়ে দেবে তারা। বন্ধুর মতন।
---
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×