somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যপ্রাচ্যঃ যেভাবে রোপিত হয় অন্তহীন সংঘাতের চারাগাছ

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় এক শতাব্দী ধরে যে সহিংসতা দেখছে পৃথিবীর মানুষ, তার শুরু কোথায়? জার্মান ইতিহাসবিদ বার্নহার্ড জান্ড দেখিয়েছেন এর বীজ বপন করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। বর্তমানে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যে আরব বসন্ত লক্ষ কোটি মানুষের মনে ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছে, সেটাও কোনো চূড়ান্ত সমাধান নিয়ে আসবে না এ অঞ্চলের জন্য। প্রকৃতপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে অন্তহীন সঙ্ঘাতের বীজ বোনা হয় এ অঞ্চলে, তারই একটি রূপ এই আরর বসন্ত।



প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯১৮ সালে। কিন্তু ওই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে যে সহিংসতা উসকে দিয়েছিল, আজো তা থামেনি। নিজেদের স্বার্থে ঔপনিবেশিক শক্তি এখানে এমন কৌশলী সীমান্ত এঁকে গেছে, যার ধকল আজো কাটিয়ে উঠতে পারেনি এ অঞ্চলের মানুষ।
তৃতীয় বছরে গড়িয়েছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। দামেস্কের ক্যাসিওন পার্বত্য এলাকায় শক্ত হয়ে বসেছে সিরিয়া সেনাবাহিনীর চতুর্থ ডিভিশন। বলা হয়, এখানটাতেই হাবিলকে হত্যা করেছিল কাবিল। মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞের ভাষ্যÑ ২০১৩ সালে ২১ আগস্ট দামেস্ক শহরতলীর মুয়াদামিয়া ও আইন তার্মা এলাকায় যে গ্যাস রকেট হামলে পড়েছিল সেটা নিক্ষেপ করা হয়েছিল ওই ক্যাসিওন পর্বতেরই কোনো এক জায়গা থেকে। ওই হামলায় নিভে যায় এক হাজার ৪০০ মানুষের জীবন। সঙ্ঘাতের শুরু থেকে এ রকম বহু হামলা কেড়ে নিয়েছে লক্ষাধিক প্রাণ।
বাগদাদ। টাইগ্রিস নদীর তীক্ষè বাঁকে পুরাতন প্রাসাদ এলাকার ঠিক পেছনটাতে তথাকথিত গ্রিন জোন গড়ে তোলে মার্কিন বাহিনী। সেনা প্রত্যাহারের দুই বছরের মাথায় ওই জোনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে ইরাকিদের হাতে। আগ্রাসনের পর ইরাকে যখন বিশৃঙ্খলা-হত্যাযজ্ঞ চরমে, তখন এই গ্রিন জোনে নিরাপদে আশ্রয় নিত মার্কিনিরা। এত দিন পরও পরিস্থিতির সামান্যই উন্নতি হয়েছে। দেয়ালের ওপাশে ‘রেড জোনে’ মৃত্যু হয়ে উঠেছে নৈমিত্তিক। গত বছরও সংখ্যাটা ছিল ৮ হাজার ২ শ’রও বেশি।
সব আরবদেরই খুব প্রিয় জায়গা লেবাননের রাজধানী বৈরুত। সুদীর্ঘ সময় ধরে আরব সংস্কৃতি আর সঙ্ঘাতের মিশ্র প্রতীক হয়ে আছে এই শহর। ধর্মভীরু বা সেকুলার, মুসলিম কী খ্রিষ্টান, শিয়া কিংবা সুন্নিÑ সবই আছে এখানে। লিবিয়া আর সিরিয়ার সঙ্ঘাত, মিসর-ইরাকের চলমান অস্থিরতা বিবেচনায় নিলে একটি প্রশ্নই উঠে আসে : সঙ্ঘাতের আশঙ্কা কি পেরিয়ে এসেছে বৈরুত; নাকি সহিংসতার পরবর্তী কেন্দ্র হয়ে উঠবে সে?
২০১১ সালের বিদ্রোহের দুই বছর পরও মধ্যপ্রাচ্যে হতাশা যত প্রকট, এমনটা আর কখনই ছিল না। এ অঞ্চলে এমন দেশ নেই বললেই চলে যেখানে বিগত কয়েক দশকে যুদ্ধ হয়নি কিংবা অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের মুখোমুখি হয়নি যে দেশ। নিকট ভবিষ্যতেও সহিংসতার কবল থেকে তারা যে মুক্ত হতে পারবে, তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আরব বসন্ত নামে পরিচিতি পেয়েছে যে আন্দোলন সেটাও পাল্টা বিদ্রোহের চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে বসেছে।
এই পাল্টা বিদ্রোহ কেবল তাদেরই চমকে দেবে যারা তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর আর সিরিয়ার বিদ্রোহকে কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক একটা পটপরিবর্তন হিসেবে চিন্তা করেছিলেন। আসলে এটা এক শতাব্দী ধরে বিরতিহীনভাবে চলমান আঞ্চলিক সঙ্ঘাতেরই একটা সাম্প্রতিক অধ্যায় মাত্র। আর সেই অর্থে এটা কখনো শেষও হবে না।

ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের সন্তানেরা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ আর তার ফলাফল এ মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া আর কোনো রঙ্গমঞ্চেই এত চরমভাবে প্রাসঙ্গিক থাকেনি। পৃথিবীর আর কোনো জায়গাতেই বিশ শতকের গোড়াতে ঘটে যাওয়া একটা যুদ্ধ রাজনৈতিক পট বদলে এত প্রবল মাত্রায় প্রভাব ফেলছে না। তথাকথিত ইউরোপীয় গৃহযুদ্ধের শুরু হয় ১৯১৪ সালে, যেটা পুরো ইউরোপকে ক্ষত-বিক্ষত করে শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরব বিশ্বে যে বিষ ছড়িয়েছিল, একই মাত্রায় রয়ে গেছে তার তীব্রতা। ইউরোপের আদিবাসী ও প্রাসঙ্গিক আরো কিছু সত্যকে পিষ্ট করে ১৯১৯ সালে ভার্সেইলিজ চুক্তি হয়। চুক্তির পর একটা বিক্ষত মানচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ইউরোপের যে দশা হয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্য এখন সেই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি।
আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে ইতিহাস যখন যেখানে যেভাবে রাষ্ট্রের মানচিত্র এঁকেছে, সেখানকার মানুষ তা একরকম মেনেই নিয়েছে। ব্যতিক্রম রয়ে গেছে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে। ১৯১৪ সালের পর ওই অঞ্চলে যেসব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, যেভাবে মানচিত্র ভাগ হয়েছে তা ওই অঞ্চলেরই বহু মানুষের কাছে এখনো অবৈধ। আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র আর মানচিত্রের স্বীকৃতি পেতে হলে তা আসতে হবে দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্যের গভীর থেকে, আসতে হবে শাসকগোষ্ঠী আর বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তি ব্যক্তি আর তাদের উত্তরসূরিদের পক্ষ থেকে। তা না হলে এ মানচিত্র অর্থবহ হবে না। ‘এ পিস টু এন্ড অল পিস’ প্রবন্ধে এ মন্তব্যই করেছেন মার্কিন ইতিহাসবিদ ডেভিড ফ্রমকিন।
মিসর ও ইরানÑ মধ্যপ্রাচ্যের এ দু’টি মাত্র দেশের সুদীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। খুব বড় ধরনের সমস্যা হলেও রাষ্ট্র দু’টির ভিত নড়ে যাওয়ার ভয় নেই। দ্বিতীয় দু’টি দেশ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেÑ তুরস্ক আর সৌদি আরব। এ দুটো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা দু’জন ঐতিহাসিক শাসক। তুরস্ক গড়ে ওঠে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের হাতে। আর সৌদি আরবের ভিতটা মজবুত হয় ১৯৩২ সালে, আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের হাত ধরে।
এই চারটি রাষ্ট্র ঘিরে রেখেছে মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রভূমিকে, যেখানে রয়েছে পাঁচটি দেশ আর একটি চিরদিনের ‘অরাষ্ট্র’। লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক, ইসরাইল আর ফিলিস্তিন। ফ্রমকিনের ভাষায় তারা ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের সন্তান।
পৃথিবীর অন্য কোথাও এ ধরনের রাষ্ট্র-সমষ্টি দেখা যাবে না, যারা আকারে ক্ষুদ্র হওয়ার পরও সাম্প্রতিক সময়ে এত যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, ক্ষমতার পালাবদল আর সন্ত্রাসী হামলার সাক্ষী হয়ে আছে। এ দ্বন্দ্ব- সংঘাতের রহস্য বুঝতে গেলে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে এ অঞ্চলের বঞ্চনার ইতিহাস, আরবের সমাজপতি বা শাসক শ্রেণীর ব্যর্থতা, পরাশক্তি শক্তিগুলোর অব্যাহত হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক ইসলামের ভূমিকা, তেলের আবিষ্কার, ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও শীতল যুদ্ধ।

চূড়ান্ত শান্তির খোঁজে

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্ভবত ব্রিটেন আর ফ্রান্সের চুক্তি। এই দুই ইউরোপীয় ঔপনেবেশিক রাষ্ট্র নিজেদের প্রয়োজন আর স্বার্থে আক্ষরিক অর্থেই মধ্যপ্রাচ্য-মরুভূমির বালুতে দাগ কেটে রাষ্ট্রের সীমানা টেনেছে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জেমস বার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লেখা তার বইয়ের নামটাও দেন এ ধারণা থেকেইÑ ‘এ লাইন ইন দ্য স্যান্ড’। বইটা প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে।
এখনো পরিষ্কার বোঝার উপায় নেই, আরব বসন্ত আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে আর মধ্যপ্রাচ্যেরই বা কী হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সীমান্ত আরো সংহত হবে, রাজনৈতিক কাঠামো আরো উন্নত হবে, এরকম আশা করা হলেও একই মাত্রায় উঠে আসছে আরো ভয়াবহ সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কাও। কিন্তু এই বৈধতার সঙ্কট আর পারস্পরিক আস্থার যে অভাবÑ তার উৎসই বা কোথায়? কিভাবে সেই কাক্সিক্ষত শান্তির কাছে পৌঁছানো যাবে যেটাকে ফ্রমকিন বলেছেন অন্য সব শান্তির ইতি।
১৯১৪ সালের গ্রীষ্মকাল। অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুল তখন ইশলের ইম্পেরিয়াল ভিলা থেকে প্রায় অর্ধ-পৃথিবী দূরে যেখানে সম্রাট ফ্রান্স প্রথম জোসেফ তার ‘টু মাই পিপল’ ম্যানিফেস্টোতে স্বাক্ষর করলেন। সাইবেরিয়ার বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে সূচনা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। বহু শতাব্দী অটোম্যানরা রাজত্ব করেছে দক্ষিণ ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরেÑ আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে আরিশ আর মাগরেব থেকে সুয়েজ পর্যন্ত। কিন্তু ১৯১১ সালে ফ্রান্সের অধীনস্থ হলো আলজেরিয়া আর তিউনিসিয়া, ব্রিটিশরা দখল করল মিসর। অন্য দিকে লিবিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে বসল ইতালি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হচ্ছে, তত দিনে সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে অটোম্যান সাম্রাজ্য। তুরস্ক ছাড়া সাম্রাজ্যের মধ্যে তখন মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত আরব উপদ্বীপ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বর্তমান তুরস্কের দক্ষিণাংশের এই অঞ্চলটাই মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রের মূল কেন্দ্র ছিল। ৪০০ বছর ধরে ইতিহাসেই মগ্ন ছিল এ অঞ্চল। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে তারাই হয়ে উঠেছে সঙ্কটের কেন্দ্রভূমি। বসরা, বাগদাদ, আলেপ্পো, দামেস্ক, বৈরুত, গাজা কিংবা সুয়েজÑ এ নামগুলো উচ্চারণ হলেই কয়েক প্রজন্মের সহিংসতা-বিপর্যয়ের চিত্র ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কুশিলবরা তখনো জানতেন না অটোম্যান সাম্রাজ্যের পেছন অংশটা পৃথিবীর বৃহত্তম তেল রিজার্ভের ওপর ভাসছে। জানলে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধটা আরো সহিংস আরো নিষ্ঠুর হয়ে উঠত। সেই সময়টাতে যুদ্ধের লক্ষ্য ঠিক হয়েছিল যে, বিশ্বব্যবস্থার পরিকল্পনায়, সেটা পরবর্তী চার বছর মাত্র টিকে ছিল। বন্ধুদেশ রাশিয়ার সাথে একটা নৌরুট গড়ে তোলাই ছিল গ্রেট ব্রিটেনের লক্ষ্য। সেই সাথে সুয়েজ খাল আর পারস্য উপসাগর দিয়ে ভারতের সাথে যোগাযোগটা ঠিক রাখতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু জার্মানরা চাইছিল ঠিক তার উল্টোটা।

কেন্দ্র থেকে সীমান্তে

যুদ্ধ তো ঘোষণা করলেন ফ্রান্স জোসেফ। কিন্তু বেশ কিছুদিন বোঝার উপায় ছিল না অটোম্যান সাম্রাজ্য যুদ্ধে যোগ দেবে কি না। যদি দেয়, তবে কোন পক্ষে? কিন্তু বিভ্রান্তি বেশি দিন থাকল না। সঙ্ঘাত শুরুর কিছু পরই বার্লিন আর ভিয়েনার পক্ষে যোগ দিলো ইস্তাম্বুল। ২ আগস্ট জার্মান আর অটোম্যানরা সই করল গোপন চুক্তিতে। এর অল্প কিছু পরই, দুটো জার্মান যুদ্ধজাহাজ এসএমএস গিবেন আর এসএমএস ব্রিসলাউÑ পশ্চিম ভূমধ্যসাগর থেকে রওনা হলো ইস্তাম্বুলের দিকে। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর অটোম্যান নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হলো জাহাজ দুটো। কাগজে-কলমে অটোম্যান কিন্তু তখনো নিরপেক্ষ। জার্মান জাহাজ দু’টির নাম বদলে রাখা হয় ইয়াভুজ আর মিডিলি। থেকে গেল জাহাজের জার্মান ক্রুরাও। শুধু পোশাক বদল হলো তাদের।
গোল্ডেন হর্ন এলাকায় যুদ্ধজাহাজ দু’টির উপস্থিতি আর ডারডেইনলেস এলাকায় মাইন পাতা শুরু করাটাই ওই এলাকায় যুদ্ধ শুরুর জন্য যথেষ্ট ছিল। অটোম্যান-জার্মান মিলে রাশিয়ার সাথে ফরাসি আর ব্রিটিশদের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। অল্প পরেই কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত বন্দরে বোমা ফেলল অটোম্যান পতাকাবাহী যুদ্ধজাহাজ গিবন। আর দেরি কেন। নভেম্বরের শুরুতেই অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল রাশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স।
পরিকল্পনা চলল লন্ডনে। কিভাবে ডারডেইনলেসে ব্যারিকেড ভেঙে কনস্ট্যান্টিনোপল দখলে নেয়া যায়। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। তিন মাস পর গ্যালিপোলি উপদ্বীপের দক্ষিণে উদয় হলো ব্রিটিশ-ফরাসি নৌবহর। শুরুতে বোমার লক্ষ্য ছিল শুধু নৌবাহিনী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরোমাত্রায় স্থলযুদ্ধে রূপ নিলো সেটা। কিন্তু ফলাফল ব্রিটিশদের পক্ষে গেল না। নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হলো হামলা। অটোম্যানদের বিজয়ের পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন ব্রিটেনের ফার্স্ট লর্ড উইন্সটন চার্চিল। আর উত্থান হলো আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের। অন্য দিকে যুদ্ধটা জাতীয় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠল অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের কাছে। কারণ তাদের হাজার হাজার সৈনিক গ্যালিপোলিতে জীবন দিয়েছিল।
গ্যালিপোলিতে ব্রিটিশ-ফ্রান্সের পরাজয়ের বড় ধরনের কৌশলগত পরিবর্তন আসে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে। অটোম্যান সাম্রাজ্যের নিউক্লিয়াসে হামলা ব্যর্থ হওয়ায় তাদের নজর পড়ল আশপাশের এলাকায় যেখানে আরব রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল। তা ছাড়া আরবদের অনেকের মনে তখন অটোম্যান শাসন থেকে মুক্তির বাসনা উঁকি দিচ্ছে। ইস্তাম্বুলের বিরোধী যুদ্ধে সেটা বরং ভালোই হলো ব্রিটিশ-ফরাসি জোটের জন্য। ১৯১৫ সালের জুলাইয়ে মিসরের হাইকমিশনার স্যার হেনরি ম্যাকমোহান গোপনে হেজাজ আর পবিত্র মক্কার শেরিফ হুসেইন বিন আলীর সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন। হুসেইন আর তিন সন্তান- আলী, ফয়সাল আর আবদুল্লাহÑ দামেস্কের শাসক শ্রেণীর সাথে মিলে বিরাট আরব জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। তাদের স্বপ্নের আরব রাষ্ট্রের সীমান্ত ছিল এক দিকে টাওরাস পর্বতমালা থেকে নিয়ে দক্ষিণ তুরস্কের লোহিত সাগর পর্যন্ত অন্য দিকে ভূমধ্যসাগর থেকে ইরান সীমান্ত পর্যন্ত।
১৯১৫ সালের অক্টোবরে হুসেইনের কাছে চিঠি পাঠালেন ম্যাকমোহান। তিনি লিখলেন, কিছু শর্ত মেনে নিলে মক্কার শেরিফ হুসেইনের পরিকল্পিত এলাকায় আরবদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সমর্থন দিতে প্রস্তুত গ্রেট ব্রিটেন।

ঔপনিবেশিক দরদাম

চুক্তিতে নিজেদের অংশটুকু পূরণ করে আরবরা। ১৯১৬ সালের জুনে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে আরবরা। সিনাই থেকে জেরুসালেম হয়ে ব্রিটিশদের দামেস্ক পৌঁছানোর জন্য সেটা ছিল খুবই সহায়ক। বিদ্রোহ আরেকটি উসকে দেয় সে সময়কার ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স। পরে যিনি বিখ্যাত হন লরেন্স অব অ্যারাবিয়া নামে। ব্রিটেন যদিও চুক্তির তাদের অংশটুকু পুরো পূরণ করেনি। ১৯১৬ সালের শুরুর দিকে এক বার্তায় লরেন্স লেখেন, আরব বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য সহায়ক হবে কারণ, এটা আমাদের ইসলামি বিশ্বকে ভেঙে দেয়া আর অটোম্যানদের পরাজিত করা এবং তাদের শাসনের অবসান ঘটাতে সহায়ক হবে। কিন্তু কোনোভাবেই ব্রিটিশরা অখণ্ড আরব রাষ্ট্র চায়নি যেমনটা স্বপ্ন দেখেছিলেন হুসেইন আর তার ছেলেরা। লরেন্স অএরা লেখেন, শেরিফের আকাক্সক্ষার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে সেটা তুরস্কের উত্তরাধিকার হবে কিন্তু ব্রিটেনের জন্য হবে অক্ষতিকর। তুরস্কের চেয়ে আরবদের স্থিতিশীলতাও কম। ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তাদের বাহ্যিকভাবে রাজনৈতিক রূপ নেবে, কিন্তু পরস্পরের হিংসাবৃত্তি তাদের একত্র হতে দেবে না।
আরব বন্ধুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার চেয়েও ব্রিটিশদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ফ্রান্স। কারণ পশ্চিমা যুদ্ধক্ষেত্রে তখন ফরাসি সেনাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে আর প্রাণ দিচ্ছে ব্রিটিশ সেনা। পরে এক সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ তার ফরাসি বন্ধু জর্জেস ক্লিমেনচিউকে বলেছিলেন, ‘ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্ব ব্রিটেনের কাছে দশটা সিরিয়ার সমতুল্য।’ ফ্রান্স তখন ছিল ঔপনিবেশিক শক্তিধর দেশ অটোম্যান সাম্রাজ্যের খ্রিষ্টান অংশের দিকে যার দীর্ঘ দিনের নজর ছিল।
গ্রেট ব্রিটেন পুরো অঞ্চলটা একাই শাসন করতে পারত জার্মানির মতো শক্তির মোকাবেলায় ফ্রান্সের সাথে গণিমতের মাল ভাগাভাগিতে সম্মত হয়। এমনকি শরীফ হুসেনের সাথে যখন ম্যাকমাহোনের কথাবার্তা চলছে, তখনো ঠিক উল্টো ইস্যুতে ফরাসি কূটনীতিক ফ্রাঞ্চিস জর্জেস-পিকোটের সাথে দেনদরবার করছিলেন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য স্যার মার্ক সাইকস। তারা আরব রাজ্যগুলোকে ভাগবাটোয়ারার হিসাব কষছিলেন যেগুলো তখনো অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন। তাদের হিসাব মতে, উত্তরাংশের অঞ্চলগুলোর কর্তৃত্ব থাকবে ফ্রান্সের আর দক্ষিণের অংশগুলো থাকবে ব্রিটেনের অধীন। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সাইকস যখন ডাউনিং স্ট্রিটে এই পুরো বিষয়টা নিয়ে ব্রিফ করছিলেন তখন মন্তব্যটা করেছিলেন তিনি : ‘আক্রার আ থেকে কিরকুকের ক পর্যন্ত রেখা টানতে চাই আমি। তথাকথিত এই সাইকস-পিকোট চুক্তিটা ছিল নির্লজ্জ ঔপনিবেশিক মানসিকতার দলিল। যাদের জমি নিয়ে আঁক কষাকষি, চুক্তিতে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার পাত্তা নেই, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যারা বসবাস করছে, তাদের স্বার্থের বালাই নেই। সেই থেকে আরব কুর্দিশ অঞ্চলটাতে যে সংঘর্ষ শুরু হলো এক শ’ বছর পর এসেও তার তীব্রতা রয়ে গেছে একই মাত্রায়। জেমস বার যেমনটা লিখেছিলেন : ‘এমনকি সেই সময়ের বিবেচনাতেও এটা ছিল নির্লজ্জ স্বার্থপর একটা চুক্তি।’

বেলফোর পুনর্বিন্যাস

দলিলটা সে সময় গোপনই রাখা হয়েছিল। ১৯১৭ সালে মস্কোতে অভ্যুত্থান ঘটাল বলশেভিকরা। তারাই প্রকাশ করে দিলো সাইকস-পিকোট চুক্তির বিষয়। কিন্তু ব্রিটিশ তত দিনে আরেকটি গোপন চুক্তি সেরে ফেলেছে, যার খবর আরবরা তো জানতই না, ফ্রান্সও এমনকি ছিল অন্ধকারে।
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর গ্রেট ব্রিটেনের জায়োনিস্ট ফেডারেশনকে প্রতিশ্রুতি দেন ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য জাতীয় আবাস গড়ে তোলা হবে। বেশ কিছু কারণ ছিল যেগুলোর কারণে অবহেলিত ইহুদিদের জন্য অটোম্যান সাম্রাজ্যের এক টুকরো বরাদ্দ করতে রাজি হয়েছিল ব্রিটেন। একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল যুদ্ধ বিস্তারের সাথে সাথে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক আচরণের অভিযোগ বাড়ছিল। ব্রিটিশ ক্যাবিনেটে এ বিষয়ে উদ্বেগ ছিল না ঠিক। তবে বিষয়টা তাদের বিবেচনায় ছিল। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে উড্র উইলসনের আবার বিজয়ের পর তাদের উদ্বেগ আরো বাড়ে।
যুদ্ধে আমেরিকা যোগ দেয়ার আগে ১৯১৭ সালের জানুয়ারিতে উড্র উইলসন ঘোষণা দেন, ‘প্রত্যেক জনগোষ্ঠীরই নিজস্ব উন্নয়ন, বাধাহীন, হুমকিমুক্ত ও ভয়ভীতিহীনভাবে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা থাকা উচিত। উইলসন তখনো সাইকস-পিকোট চুক্তি সম্পর্কে জানতেন না। কিন্তু ব্রিটিশরা ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত নতুন দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি থাকা উচিত। সে বিবেচনা থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের নগ্ন ঔপনিবেশিক চেহারা আমেরিকার কাছ থেকে আড়াল করতেই বেলফোর ঘোষণা দেয়া হয়।



ইতোমধ্যে আরবদের সহায়তা নিয়ে ব্রিটিশরা সামরিক প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। অটোম্যান আর জার্মান প্রতিরোধের বিরুদ্ধে সিনাই ও ফিলিস্তিন থেকে দামেস্ক পর্যন্ত এলাকা দিয়ে অগ্রসর হলো। একই সাথে ইউফ্রেটিসের দিকেও এগোলো তারা। দখলে নিলো ইরাক। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ করেছে দেড় মিলিয়নেরও বেশি সেনা। হতাহত হয় শত শত। অটোম্যান সাম্রাজ্যে আমেরিকার যে এক মিলিয়ন সেনা নিহত হয় বা না খেয়ে মারা যায়, সে হিসাব তো রয়েছেই।
১৯১৮ সালের অক্টোবরে অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতি ঘটে। পরাজিত হয় অটোম্যান সাম্রাজ্য। আনাতোলিয়া বাদে সাম্রাজ্যের পুরো অংশটাই নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করে নেয় ব্রিটেন আর তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলো। সেই সাথে সব শান্তি বিনাশ করে একটা অদ্ভুত ধরনের শান্তিপ্রক্রিয়া চেপে বসে মধ্যপ্রাচ্যের পর যেটার রেশ চলছে শতাব্দী ধরে।
১৯১৯ সালের শুরুর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসন যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ও ফরাসি নেতা ক্লেমেনচিউয়ের সাথে শান্তি আলোচনার জন্য প্যারিস এলেন তখন কতগুলো বিষয়ের সাক্ষী হলেন তিনি যেটা তার প্রত্যাশায় ছিল না। বিজয়ী দুই পরাশক্তি ছিল চরমভাবে বিভক্ত এবং তীব্র বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয় তারা। ফ্রান্সের দাবি ছিল সিরিয়াসহ টাইগ্রিস পর্যন্ত বিস্তৃত বর্তমানের লেবাননের নিয়ন্ত্রণ তাদের দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত সাইকস-পিকোট চুক্তিতে সেটা রাখা হয়।

জনতার কাছে জিজ্ঞাসা

বিরোধিতার মুখোমুখি হলো ব্রিটেন যারা ফিলিস্তিনে নিজেদের কৃতকর্ম নিয়ে তখনো বুঁদ হয়ে আছে। অন্য দিকে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে তেল সম্পদের প্রকৃত চিত্র তখন সবে আসতে শুরু করেছে। যুদ্ধের শুরুতে আরবদের প্রতি ব্রিটেনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল, সিরিয়াকে ফ্রান্সের অধীন করে দেয়া মানে সেই প্রতিশ্রুতির পরিষ্কার লঙ্ঘন। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেনকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল বলতে গেলে একাই। প্রায় ১১ লাখ ২৫ হাজার সেনা সেখানে হতাহত হয়েছে। লয়েড জর্জের বক্তব্য ছিল তাই, সিরিয়া হবে ইংল্যান্ডের, এখানে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই।
পথ একটা বাতলালেন উইলসন। সিরিয়ার জনগণ কি ফ্রান্সের অধীন থাকবে, ফিলিস্তিন আর মেসোপটেমিয়াই বা ব্রিটিশ শাসন মানবে কি না, তা জানতে হলে সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে হবে ওই অঞ্চলের মানুষদের। আইডিয়াটা খুব সহজ আর পরিষ্কার। দুই মাস ধরে, শিকাগোর ব্যবসায়ী চার্লস ক্রেইন আর আমেরিকান তাত্ত্বিক হেনরি কিং ঘুরলেন মধ্যপ্রাচ্যের পথে পথে। শত শত আরব এলিটদের সাথে কথা বললেন তারা। ব্রিটেন আর ফ্রান্স যদিও তাদের প্রভাবিত করার কোনো পথই বাকি রাখেনি তবু তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল ছিল পরিষ্কার। সিরিয়ার ফ্রান্সের অধীন থাকার ইচ্ছা নেই। আর ফিলিস্তিনিরাও ব্রিটিশদের ইচ্ছার অধীন থাকাটা পছন্দ করেনি। বাকি থাকল মেসোপটেমিয়া। সেখানে যেভাবেই হোক, জনমত যাচাই থেকে আমেরিকানদের নিরস্ত থাকতে সক্ষম হলো ব্রিটেন।
আগস্টে কিং আর ক্রেইন তাদের রিপোর্ট তুলে ধরলেন। তারা সুপারিশ করল, সিরিয়া আর ফিলিস্তিনের ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি থেকে বাইরে এসে সম্মিলিতভাবে তৃতীয় নিরপেক্ষ শক্তি আমেরিকার অধীন থাকা উচিত। হুসেনের পুত্র ফয়সাল যাকে তারা সহিষ্ণু ও প্রজ্ঞাবান মনে করেছে, তাকে আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রধান করা হবে। কিং-ক্রেইন রিপোর্টের খবর হয়তো এখন শুধু মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞরাই জানেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে স্বস্তি ফেরানোর সবচেয়ে বড় হারানো সুযোগ। কিন্তু এক দিকে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের চাপ, অন্য দিকে ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে উইলসন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওই রিপোর্ট হিমাগারে ঢুকে পড়ে। যেটা আলোর মুখ দেখে আরো বছর তিনেক পর। তত দিনে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র আঁকার কাজ সেরে ফেলেছে লন্ডন আর প্যারিস। যেখানে কিং আর ক্রেইনের সুপারিশের কোনো স্থানই ছিল না। ফ্রান্স তাদের ভাগের জায়গাটুকু ভাগ করল লেবানন আর সিরিয়া নামে। অন্য দিকে গ্রেট ব্রিটেনের ভাগে পড়ল মেসোপটেমিয়া যেটাকে পরে তারা নাম দিলো ইরাক। তত দিনে অবশ্য তেলসমৃদ্ধ মসুল গিলে ফেলেছে ব্রিটেন। সিরিয়া, ইরাক আর ফিলিস্তিনের মাঝামাঝি একটা বাফার রাষ্ট্র গড়া হলো। নাম দেয়া হলো ট্রান্সজর্ডান।
শরীফ হুসেনকে যে আরব জাতিরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটেন, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বিজয়ী শক্তি মধ্যপ্রাচ্যকে যে চারটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করল, ভৌগোলিক বিভাজন, জাতিগত এবং মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল রাষ্ট্রে রূপ নিলো দেশ চারটি যেগুলো শাসন করা আজ অবধি রীতিমতো দুষ্করই রয়ে গেল।

দীর্ঘস্থায়ী সর্বনাশার কুপ্রভাব

কী সর্বনাশ করছে তারা তা জানত। চুক্তির ঠিক আগ মুহূর্তেই প্রশ্ন উঠল ফিলিস্তিন আর ইসরাইলের উত্তর সীমানা কোথায় হবে? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জকে লন্ডনে চিঠি লিখলেন তার এক উপদেষ্টা : ‘সত্যি হলো আলেপ্পো থেকে মক্কা পর্যন্ত যেকোনো ধরনের বিভাজন হবে অস্বাভাবিক। তাই যেভাবেই ভাগ করা হোক না কেন, বাস্তব প্রয়োজনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কৌশলই পথ দেখাবে।’ শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এলো এক ব্রিটিশ জেনারেলের মাথা থেকে। আর তার সহায়তায় ছিলেন ইঙ্গো-পারস্য তেল কোম্পানির এক পরিচালক।
অবশ্য আরব বিশ্বই একমাত্র জায়গা নয়, যেখানে স্থানীয় জনতার মতামত উপেক্ষা করে সীমানা আঁকা হয়েছে। ইউরোপেও এরকম কাজ হয়েছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিভাজন সেখানে মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী পরিণতির কারণ হয়ে উঠল।
প্রথমত, ইউরোপ যেখানে ১৯ শতকের গোড়ার দিকে তাদের জাতীয় ও রাজনৈতিক শ্রেণী পরিচয় বিনির্মাণে ব্যস্ত, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরব বিশ্বকে তাদের ইতিহাসের ঘোর থেকে ছিটকে ফেলল। মধ্যপ্রাচ্যের অঞ্চলগুলোতে অটোম্যানদের শাসন ছিল ঢিলেঢালা। তা ছাড়া ওই এলাকাগুলোতে কোন ধরনের রাজনৈতিক কাঠামো, বুদ্ধিবৃত্তিক বা অর্থনৈতিক শ্রেণী গড়ে তোলারও চেষ্টা ছিল না তাদের।

উৎসঃ অন্য এক দিগন্ত
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×