হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প জানা নেই এই কালে এমন লোক পাওয়া যাবে না। বাল্যকালে সবাই আমরা এই গল্পটি পড়েছি। কিন্তু গল্পটির উৎপত্তি যে জার্মানি থেকে তা আমার জানা ছিলনা। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে এই দেশে আসার পর যখন হ্যানোভার সিটিতে আমার নিবাস স্থির হল তখন শুনলাম এই রুপকথা জার্মানির। আর 'ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া' যাত্রা করলেই অর্থ্যাৎ হ্যানোভারের খুব কাছেই কালোত্তীর্ণ এই মহাকাব্যিক রুপকথার উৎপত্তিস্থল। সেই থেকে অস্থির হয়ে ছিলাম কবে যাব সেই রোমাঞ্চ জাগানিয়া শহরে, কবে দেখব সেই যুগের সযত্নে রাখা ইতিহাসের নুড়ি পাথর। আমার কোর্সের ইরানি বন্ধুকে নিয়ে গত ২রা মে যাত্রার দিন নির্ধারিত হল। ট্রেনে ৪৫ মিনিট লাগে, তবে আমাদের ভাড়া লাগে না। সেমিস্টার কার্ড দিয়েই যাওয়া যায়। শহরের নাম হামেলন, ওই রুপকথার রেশ ধরেই।
——————————————————————–
জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিন – এপ্রিল ২০১৫
ডাউনলোড/পড়তে চাইলেঃ
http://www.germanprobashe.com/archives/5127
——————————————————————–
মেইন স্টেশনে নেমে এক বাসের ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম আমাদের কার্ড দিয়ে বাসে উঠতে পারব কিনা। অত্যন্ত নির্দয় ভঙ্গিতে ধমকের সুরে সে না করে দিল। ইরানি বন্ধু আগেও একবার এখানে আসার কারণে কিছুটা চেনাজানা ছিল। সে বলল শহরটি এতই ছোট যে হেঁটেই পুরোটা দেখে ফেলা যাবে। কথা না বাড়িয়ে হাঁটা শুরু। মিনিট দশেক হাঁটতেই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। প্রাচীন কারুকার্যময় নাটুকে স্থাপনা, বাঘ সিংহ ইত্যাদি শক্তিমান প্রাণির ভাষ্কর্যের মাধ্যমে তৎকালীন শাসকের প্রতাপী ক্ষমতার প্রদর্শন আর উৎসুক মানুষের ভিড়, সব মিলিয়ে আমাদের রোমাঞ্চের কেমল শুরু। এ পর্যায়ে চলুন উইকিপিডিয়ার কল্যাণে জেনে আসি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার আদ্যপান্ত ইতিহাস। আজ থেকে সাতশ বছরেরও আগে গোটা শহরের মানুষ ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ইঁদুরবাহিত রোগ যেমন মহামারির আকার ধারণ করে, ঠিক তেমনি ইঁদুরের অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলছিল। কোনো উপায়ন্তর না দেখে হ্যামলিন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচার জন্য পৌরসভায় মিটিংয়ে বসলেন। মেয়রের নেতৃত্বে সবাই মিলে একজোট হয়ে ঠিক করলেন, শহরকে ইঁদুরের হাত থেকে যে বাঁচাতে পারবে তাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে শহরে এসে হাজির হলো রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালা। সে জানাল তার বাঁশির সুরে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করা সম্ভব। শুনে সবাই অবাক; কিন্তু নিরুপায় হ্যামলিনবাসীর কিছুই করার ছিল না। বাঁশিওয়ালাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কারের বিনিময়ে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করার আদেশ দিলেন মেয়র। বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন বাঁশিওয়ালা। বড় অদ্ভুত সেই সুর। তার বাঁশির শব্দ শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো সব ইঁদুর। যেখানে যেরকম ইঁদুর ছিল সবই বেরিয়ে এলো বাঁশিওয়ালার মায়াবী সুরের টানে। একসময় ইঁদুরগুলোকে নিয়ে গিয়ে ওয়েজার নদীতে ফেলে দিলো বাঁশিওয়ালা। এরপর পারিশ্রমিক চাইতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিল শহরের মেয়র ও গণ্যমান্য মানুষরা। রেগে গিয়ে তখনকার মতো শহর ছেড়ে চলে গেল সেই বাঁশিওয়ালা।
কিছুদিন পর এক ধর্মীয় উৎসবের দিনে শহরের বড়রা যখন গির্জায় জমায়েত হয়, তখন আবার ফিরে এলো বাঁশিওয়ালা। এবার তার বাঁশির সুরে বেরিয়ে এলো শহরের ছোট ছোট শিশুরা। তাদের সঙ্গে নিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল সেই বাঁশিওয়ালা। শিশুদের মধ্যে দু'জন দল থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। তারাই নাকি ফিরে এসে এসব কথা জানাল শহরবাসীকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শিশু দু'টির একজন মূক ও অন্যজন দৃষ্টিহীন হওয়ায় বাঁশিওয়ালার গন্তব্য সম্বন্ধে সঠিক তথ্য আর জানা যায়নি। কেউ বলেন, শহরের বাইরে কোপেলবার্গ পাহাড়ের মাথার গুহায় ঢুকে গিয়েছিল সে। কেউ বলেন, ইঁদুরের মতো শিশুদেরও সলিলসমাধি দেয় সেই বাঁশিওয়ালা। সাধাসিধেভাবে বললে মূল গল্পটি এমনই। বলা হয়ে থাকে ১২৮৪ সালের ২২ জুলাই ঘটনাটি ঘটেছে।
——————————————————————–
জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিন – এপ্রিল ২০১৫
ডাউনলোড/পড়তে চাইলেঃ
http://www.germanprobashe.com/archives/5127
——————————————————————–
চাইলে আপনিও লেখা/ছবি পাঠাতে পারেন!
যেকোন বিষয়ে লেখার স্বাধীনতা আপনাদের রইল। ভ্রমণ, কবিতা, গল্প, সাহিত্য বা সিনেমা সমালোচনা, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ সহ দেশ বিদেশের যেকোন স্মরণীয় ঘটনা আপনারা লিখবেন। তাই প্রিয় পাঠক আর দেরি না করে এখনি বসে পড়ুন মনের কথাটি লিখতে। আগামী যেকোন সংখ্যায় সেটি প্রকাশিত হবে আমাদের জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিনে।
লেখা পাঠানঃ [email protected]
অথবা পেজের ইনবক্সে পাঠানঃ Click This Link
ছবির পাঠানোর জন্য বিস্তারিতঃ http://goo.gl/90IVlk
লেখার সাথে নাম ঠিকানা পেশা আর একটি ছবি অবশ্যই পাঠাবেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ শুধু জার্মানি বা বাংলাদেশ থেকেই নয়, যেকোন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাদর আমন্ত্রণ আমাদের ম্যাগাজিনে! তাই আমাদের ম্যাগাজিনে লিখতে হলে আপনাকে বাংলাদেশ বা জার্মানিতেই থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই!
——————————————————————–
জার্মান প্রবাসে আড্ডা দিতে চাইলেঃ Click This Link মেম্বার্স)
——————————————————————–
ইতিহাসবিখ্যাত এ ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেকে যেমন ঘটনাটিকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, তেমনি যুক্তি দেখিয়ে অনেকেই চেষ্টা করেন ঘটনাটির সত্যতা প্রমাণের জন্য। আবার একে নেহাতই গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়ার লোকের সংখ্যাও কম নয়।
হ্যামিলিন শহরে এ সংক্রান্ত একটি জাদুঘর রয়েছে। ওই জাদুঘরে সঞ্চিত পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা কয়েকটি বইয়ে এ রহস্যময় কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। সেখানে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেওয়া আছে। ফ্রাউ ভন লিউড নামের এক ১৩ বছরের বালক বলেছে, বাঁশিওয়ালার বয়স আনুমানিক ছিল ৩০। দেখতে ছিল অস্বাভাবিক রকম সুদর্শন। তার বাঁশিটি ছিল রুপার তৈরি। অন্য এক নথিতে পাওয়া যায় ১৩০০ শতাব্দীতে হ্যামিলিনের বাজারে এক কাঠের ফলক ছিল। সেখানে এক বংশীবাদক ও অনেক শিশুর ছবি ছিল। সেটা ১৭০০ সালে ঝড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে হ্যামিলিনে যে পৌরসভা রয়েছে তার নামের অর্থ হলো 'ইঁদুর ধরা লোকের বাড়ি'। এটি নির্মিত হয় ১৬০২ সালে। এর দেয়ালে বিশ্ববিখ্যাত কাহিনীটির ছবি চমৎকারভাবে আঁকা আছে। যাহোক, এখানেই রয়েছে বিশাল আকারে পুরনো এক গির্জা। আমরা দু'জন ঢুকবো কি ঢুকবো না করে ঢুকেই গেলাম। গির্জার পুরোহিত আমাদের স্বাগত জানিয়ে পরিচয় জানতে চাইল। উভয়েই পরিচয় দেয়ার পর জানতে চাইল কে কোন ধর্মের মানুষ। আমার ইরানি বন্ধুর কোন ধর্মে বিশ্বাস নেই। আমি বললাম জন্মসূত্রে আমি মুসলিম। এরপর সে আমাদের তাঁর ধর্ম গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে বলল, আমাদের নবী এমন দয়ালু যে তুমি যতই পাপ কর না কেন, সেসব ধ্বংস করে স্বর্গে তোমাকে প্রবেশ করিয়েই কেবল তার নিস্তার। তিনি খোঁচা মেরে এটাও বললেন যে, অন্য ধর্মের মত আমাদের ধর্মে কোন খুনোখুনি মারামারি নেই। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনলাম।
এরপর তিনি এই গির্জার মাথায় উঁচু টাওয়ারে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমরা আনন্দের সাথে উর্ধ্বযাত্রা শুরু করলাম সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে। যতই উঠছি ততই যেন মনে হচ্ছিল এই পথ শেষ হওয়ার হয়। এও মনে হচ্ছিল যে ঠাকুর মশাইয়ের ধর্মের দাওয়াত গ্রহণ করিনি বিধায় শাস্তিস্বরুপ এই সিঁড়ি ভাঙ্গার কাজ দিয়েছে আমাদের। এই নিয়ে দুই বন্ধুর সে কী হাসাহাসি। টাওয়ার থেকে পুরো শহরটি দেখা যায়। লাললে রঙের ঘরের চাল, মাঝে মাঝে ঘন সবুজের সমাহার, দূরে পাহাড় দিয়ে ঘেরা পুরো শহর, চিক চিক করা নদীর পানি সব দেখে যেন মনে হল পরিশ্রম সার্থক। জার্মানিতে এই সময়ে প্রকৃতি পরিবেশ অসম্ভব সুন্দর রুপ ধারণ করে। বেলাও ডোবে প্রায় ৯ টার পর। আমরা বিকেল ৩টার দিকেই ফেরা শুরু করেছিলাম। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মৃদু স্রোতের নদীর পাড় ঘেঁষে ফিরতে ফিরতে কয়েক শতাব্দী আগের সেই বাঁশিওয়ালার কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম এই কি সেই নদী যেখানে ইঁদুর ও কোমলমতি শিশুদের সলিলসমাধি ঘটেছিল যা বিশ্ব ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে! কে জানে!
০৫.০৫.২০১৫
জাহিদ কবীর হিমন মাস্টার্স ইন ইন্টারনেট টেকনোলজি এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস
হ্যানোভার, জার্মানি
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৯