বাংলাদেশে আমার রান্না ঈদের কোনো বিশেষ রেসিপি বা কোনো অতিথির আগমন উপলক্ষ্যে জর্দা, সেমাই, পায়েস এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জার্মানি আসার প্রথম সপ্তাহেই ঈদ। আমাদের ডরমিটরিতে প্রায় ১০/১২ জন বাংলাদেশি আর অন্য ডর্মগুলো থেকেও চলে এর। আমি বাংলাদেশি মেয়ে ঈদের দিন হাত গুটিয়ে থাকলে চলে! বিপুল আগ্রহে রান্নাঘরে চলে গেলাম। প্রথম দিনেই বুঝে গেলাম এখানকার প্রতিটি বাংলাদেশি ছেলেদের রান্নার দক্ষতা আমার চেয়ে বেশি। গরুর মাংসে এত ঝাল দিয়েছি যে পরে ঝোল ফেলে দিয়ে অনেক টমেটো দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষে। বাংলাদেশ থেকে আসার সময় মনে করে ব্যাগে একটি বই এনেছিলাম সিদ্দিকা কবিরের "রান্না খাদ্য পুষ্টি"। এই বই দেখে তো সবাই হাসাহাসি করত। তরকারিতে জিরা কেন দেয়, রসুন বা আদা কেন দেয়া লাগে আর কেন দেয়া লাগে না কিছুই বুঝিনা।
এর পরে আমার ফুড টেকনোলজি এন্ড রেসিডিউ ক্লাস শুরু হলো। ফারমেনটেড খাওয়ার, খাওয়ার সংরক্ষণে এসিড কিভাবে কাজ করে জানলাম। ইন্টারকালচারাল ডিনারের আয়োজন হল। আমি সিঙ্গারা আর মোগলাই পরোটা করলাম বই দেখে সবার হাসাহাসি উপেক্ষা করে। আমাদের রান্নাঘরে পাকিস্তানী ক্লাসমেটদের সাথে রান্না শুরু করলাম। ওরা দেখলাম মাংস বিরিয়ানি সবটাতেই টকদই, টমেটো আর সিরকা দেয়। টমেটো, টারটারিক এসিড, আর সিরকা হল সাইট্রিক এসিড। এটা রান্নার সময় মাংস নরম করে স্বাদ বাড়ায় আবার স্বাস্থ্যের জন্যও ভাল। আমার প্রেজেন্টেশন ছিল টকদই নিয়ে। টকদই খাবার আগে বা পড়ে হজমে খুব উপকারী এটাও জানলাম ক্লাসে। এর পরে আমি আর আমার এক বাংলাদেশি বন্ধু মাংস নিয়ে যখন খুব যন্ত্রণা সিদ্ধ হতে দেরি, সিরকা আর টমেটো দিয়ে দেখলাম ম্যাজিকের মত কাজ হয়েছিলো। এরপর সবজি রান্না করতে যেয়ে কিছুতেই ঠিক মাথায় আসেনা রান্নাটা কিভাবে করে। প্রথমে আমি সব সবজি আর পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে সিদ্ধ করে লবণ ঝাল চেখে দেখি। খেতে গেলে কান্না পায়।
আমার নেপালি আর ভারতীয় বন্ধুদের দাওয়াতে কেবল সবজি খেয়ে তাক লেগে গেল। অনেক নেপালি আর ভারতীয়রা ভেজিটেরিয়ান। মাছ মাংস বাদে সবজির যে এত পদ করা যায় আর এত ভাল খেতে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সবজি রান্নাতে ওরা মেথি, পাঁচফোড়ন, জিরা, সরিষা তেলে দিয়ে ভেজে নেয়। আর শুকনো মরিচ ভেজে নিয়ে পরে ছিটিয়ে দিলেও খুব একটা আসাধারণ ঘ্রাণ আসে। আমরা যেটা চটপটি রান্নায় দেই। আমার মাংস রান্না শেখা পাকিস্তানীদের কাছে আর মাছ, সবজি নেপালি আর ভারতীয়দের কাছে। জার্মানি আসার আট মাস পরে পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজু, বেগুন ভাজি আর গরু মাংস করেছিলাম আমার ঢাকা ভার্সিটি আর বুয়েটের এক বন্ধু খেয়েছিল আমার প্রথম রান্না। ওরা সবাইকে গল্প করে বেড়াচ্ছিল এত ভাল রান্না অনেকদিন খায়নি। আমি টেংরা মাছ করেছিলাম টমেটো আর মটরশুটি দিয়ে নিজেই বার বার চেখে চেখে দেখছিলাম। জার্মানি আসার পরে ইদানিং একটু ওজন বেড়ে যাচ্ছে। আমি খাওয়া কামানোর চেষ্টা করছি। সেদিন রাতে আমি আর আমার এক বাংলাদেশি বন্ধু রান্না করেছিলাম রুই মাছ টমেটো দিয়ে সাথে পটল ভাজি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না রান্না খুব ভাল নাকি মাছ খুব স্বাদের ছিল নাকি আমরাই খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম।
লিখেছেন রাশা বিনতে মহিউদ্দীন, মাস্টার্স ইন ইনভাইরনমেন্ট প্রটেকশন এন্ড এগ্রিকালচারাল ফুড প্রডাকশন, হোয়েনহেইম বিশ্ববিদ্যালয়, স্টুটগার্ট, জার্মানি!
লেখাটি জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিনের জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হ্য়।
আরো পড়তে/ডাউনলোড করতে চাইলেঃ
জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিন – জুন ২০১৫ - ''রন্ধন বিভ্রাট''
www.GermanProbashe.com/archives/5443
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৫ ভোর ৬:৪৭