বিয়ের আগে রান্না বলতে আমার দৌড় ডিমভাজি আর চা তে সীমাবদ্ধ ছিল। মনে পড়ে জীবনে প্রথমবার ডিম ভাজার কাহিনি। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আম্মু বাসায় ছিল না সেদিন। ডিম ভাজতে গেলে যদি তেল গায়ে ছিটে এসে পড়ে তাই ঠিক করলাম কড়াইয়ে ডিম ঢেলেই দৌড় দিব। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ডিমের বাটি সহ পড়ল কড়াইতে আর কড়াই উলটে মেঝেতে। বিয়ের পর প্রথম যেদিন রান্না ঘরে ঢুকলাম শশুর মশাই শখ করে কই মাছ কিনে আনলেন। বউমার হাতের রান্না খাবেন। আমি পড়লাম মহা বিপদে। আমি এর আগে কোনদিন মাছ কাটা তো দূরের কথা রান্নাও করিনি। কিন্তু এই কথা কেমন করে বলি? আধা ঘণ্টা চলে গেল শুধু মাছের দিকে তাকিয়ে। তারপর অনেক সাহস করে মাছ কাটা শুরু করলাম। যতই ধরি মাছ পিছলে যায়। মাকে দেখতাম ছাই দিয়ে ধরে কাটত। কিন্তু ছাই পাব কোথায়? অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে ময়দার ভেতর মাছ গড়িয়ে নিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মাছের আরও বেহাল অবস্থা! অবশেষে লজ্জা শরম শিকেয় তুলে কাঁদো কাঁদো মুখে স্বীকার করলাম আমি মাছ কাটতে পারিনা, রান্নাও নয়।
সেই আমি আজ একটু একটু রান্না শিখে ফেলেছি, শখের বশে ফেসবুকে একটা রান্নার পেজ খুলেছি, জার্মান ভাষায় আমার রান্নার একটা বইও ছাপা হয়েছে। কিন্তু মাছ কাটা আজও রপ্ত করতে পারিনি। জার্মানি তে আসার পর আমার বন্ধুত্ব হয় কারমেন লাইথহাউজার নামে এক জার্মান মহিলার সাথে। বয়সে যদিও সে আমার থেকে ২৩ বছরের বড় তারপরেও সম্পর্কটা আমাদের বন্ধুর মত। একদিন ওকে আমাদের কিছু বাংলাদেশি খাবার রান্না করে খাওয়ালাম। আমাদের খাবার ও এতটাই পছন্দ হল যে ও আমাকে পরিচয় করে দিল ওর বস হেনিং হফম্যান এর সাথে। এই ভদ্রলোক পরদিন আমাকে ইমেইল করে জানতে চাইলেন প্রতি বছর রোডারব্রুখে যে ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল পার্টি হয় সেটাতে আমি আমার দেশকে উপস্থাপন করতে চাই কিনা? এবং ওই পার্টিতে তারা আমার রান্নার একটা বই ছাপতে চায়। আমি তাতে রাজি আছি কিনা? রাজি হলাম, সেদিন অনেকেই চিনল প্রথমবারের মত বাংলাদেশকে, জানল বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভীষণ পছন্দ করল বাংলাদেশি খাবার। বইও ছাপা হল।
একসময় দেখলাম রান্নাটা আমি বেশ উপভোগ করছি। সময় পেলেই নতুন কিছু খাবার তৈরি করার চেষ্টা করছি। নিতান্তই শখের বশে "Amar Rannaghor" নামে একটি ফেসবুক পেইজ ওপেন করি ১৫.০৯.২০১৪ তে। প্রথম কয়েক দিন বেশি গুরুত্ব দেইনি, কিন্তু কখন যেন আস্তে আস্তে ভাল লাগতে শুরু করল। হাজার বাস্ততার মাঝেও এটা ওটা রান্না করি, মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে নিজেই ছবি তুলি, রেসিপি লিখি এবং পোস্ট করি। দু'চারটে করে লাইকও পড়ে। আমার বেশ ভাল লাগে। একদম অজানা-অচেনা মানুষেরা যখন আমার রান্না দেখে পছন্দ করে, মন্তব্য করে আমি খুব মজা পাই। এভাবেই আমার রান্নাঘরের পথচলা শুরু। আজ আমার পেজের মেম্বার ৫০০০ এর উপরে। সারাদিন যে আমার রান্না নিয়েই দিন কাটে এমনটি নয়। যেটা করি ভাললাগা থেকে করি। সংসারের নানা দায়িত্ব ও তালহার মত মহাদুষ্টু ছেলেকে সামলে রান্না থেকে ১০০ হাত দূরে থাকা সেই আমি মাঝে মাঝে রান্না করে আনন্দ পাই।
লিখেছেন আয়শা ছিদ্দিকা, জার্মানি!
লেখাটি জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিনের জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হ্য়।
আরো পড়তে/ডাউনলোড করতে চাইলেঃ view this link
জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিন – জুন ২০১৫ - ''রন্ধন বিভ্রাট''
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:২৭