যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রে বিদেশী আইনজীবিরা নাকি বাংলাদেশের কোর্টে মামলা লড়তে পারছেন না, এবং তাদের সে সুযোগ নাকি দেয়া হচ্ছে না। এবং এই আইনজীবিদের লড়তে দেয়া হলে নাকি তারা মোটমুটি সব কিছু উল্টিয়ে এবং পালটিয়ে ফেলত বলে ইদানীং শোনা যাচ্ছে জামাত ও বি এন পির সমর্থক ও ব্লগারদের কল্যাণে।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যিনি চাইবেন, তিনিই কি বাংলাদেশের লোয়ার কিংবা আপার কোর্টে প্র্যাক্টিস করতে পারবেন? এটা কি সম্ভব?
আসুন একটু আইন ও নীতিমালা গুলো জানি-
বাংলাদেশে কোনো বিদেশী নাগরিক যদি প্র্যাক্টিস করতে চান কোর্টে সেখানে প্রথম রিকোয়ারমেন্ট-ই হচ্ছে যে সেই ব্যাক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। এই কথাটি বলা রয়েছে বাংলাদেশ লিগাল প্র্যাক্টিশনার্স এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার - ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ২৭(১)(ক) এ।
সেখানে ক্লিয়ারলি বলা আছে একজন ব্যাক্তি বাংলাদেশে প্র্যাক্টিস করতে হলে
ক) বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে
খ) তার বয়স ২১ বছর হয়েছে
গ) তার শিক্ষাগত অর্জন ( এই ধারাটির অধীনে আরো কিছু ধারা আছে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা স্পষ্ট বলা আছে)
ঘ) বার কাউন্সিলের নির্ধারিত পরীক্ষায় উর্তীর্ণ হয়েছে
ঙ) বিধিমালা অনুযায়ী ফিস প্রদান করা হয়েছে।
লক্ষ্য করে দেখুন, এই আইনটি তৈরী হয়েছে ১৯৭২ সালে। কেউ বলতে পারবে না যে এই আইনটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বাধা দেবার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে তৈরী হয়েছে। এই আইন্টি যেমন অপরাধীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ঠিক তেমনি প্রসিকিউশনের বেলাতেও প্রযোজ্য।
এবার আসুন আরো কিছু নিয়ম কানুন দেখে নেই-
বাংলাদেশের বার কাউন্সিলে প্রতি ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারীতে লোয়ার কোর্টে পরীক্ষা হয় এবং তারপরে অনুষ্ঠিত হয় ভাইবা। এসব পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হলেই একজন ব্যাক্তি বাংলাদেশের আদালতে প্র্যাক্টিস করতে পারবেন। এই যে আমি পরীক্ষা আর ভাইবার কথা বললাম, সেটা হোলো লোয়ার কোর্টে প্র্যাক্টিস করবার নিয়ম। এই সার্টিফিকেট পেতেই লেগে যায় এক বছর থেকে দড় বছরের মতন।
প্রথমতঃ লোয়ার কোর্টে আইনজীবি হিসেবে প্র্যাক্টিস করবার নীতিমালা আমাদের জানতে হবে। নীচের এই বর্ণিত ডকুমেন্টস গুলো জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ঠ ব্যাক্তি বা অফিসের কাছে। এগুলো হচ্ছেঃ
ক) এগ্রিমেন্ট লেটার
খ) এফিডেভিট
গ) ব্যাঙ্কের রশিদ
১৯৭২ সালের বার কাউন্সিলের রুলের ৩(১১) ধারা মতে এই এগ্রিমেন্ট লেটারে লেখা থাকবে যে আলোচ্য ব্যাক্তি যে কোর্টে প্র্যাক্টিস করতে চায় সেই কোর্টের নাম, ১০ বছর প্র্যাক্টিসের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন আইঞ্জীবির সাথে আলোচ্য ব্যাক্তির ( যিনি লোয়ার কোর্টে প্র্যাক্টিসের জন্য আবেদন করছেন) একটি চুক্তিপত্র যেখানে উল্লেখ থাকবে যে এই আইনজীবির সাথে তিনি কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ১৫০ টাকার নন-জুডিশিয়াল একটা স্ট্যাম্পে এই চুক্তিপত্র লিখিত থাকতে হবে যেখানে অভিজ্ঞ আইনজীবির তত্ত্বাবধানে উল্লেখিত ব্যাক্তি যে কমের পক্ষে ৬ মাস তার সাথে আইন চর্চা তথা তাঁর সাথে কাজ করবেন সেটি লিখিত থাকবে।
এরপর এফিডিভিট করতে হবে ৫০ টাকা দামের নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে । একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে এই ক্ষেত্রে যে, এই কাগজ পত্র জমা দিতে হবে প্রথমে এবং পরে যখন প্রার্থী ৬ মাসের তার প্র্যাক্টিস বা পিউপোলেজ (ইন্টার্নির মতন) শেষ করবেন ১০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আইনজীবির সাথে তখনই তিনি লিখিত পরীক্ষার জন্য বিবেচ্য হবেন। এই লিখিত পরীক্ষার পর তার ভাইভা অনুষ্ঠিত হবে। এবং এই সবগুলো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ও উত্তীর্ণ হলেই তিনি আমাদের লোয়ার কোর্ট/ জজ কোর্টে প্র্যাক্টিসের সুযোগ পাবেন।
উল্লেখ্য যে, এই লিখিত পরীক্ষা দেবার জন্যও আবার অনেক ডকুমেন্টস সাবমিট করতে হবে। যেমন-
১) এপ্লিকেশন ফর্ম
২) ক্যারেক্টার রেফারেন্স (ফার্স্ট ক্লাস অফিসার থেকে)
৩) এফিডেভিট
৪) এল এল বি'র সার্টিফিকেট
৫) মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট
৬) ফি প্রদানের রিসিট
৭) একটা পাস্পোর্ট সাইজ ফটোগ্রাফ
৮) ৫ টা সিভিল মামলা ও ৫টা ক্রিমিনাল মামলাতে অংশ নিয়েছেন আলোচ্য ব্যাক্তি, সেটার প্রমান ও লিস্ট
এই লোয়ার কোর্টে আবার দুই বছর প্র্যাক্টিস করে আসতে হবে আপার কোর্টে। সেখানকার আমাদের এই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালকে যেহেতু আপার কোর্টের একটি ডিভিশানের মানে হাইকোর্ট বিভাগের সম মানের বলে সূচিত করা হয়েছে, সুতরাং এই আদালতে মামলা লড়তে হলে কি কি যোগ্যতা থাকা লাগবে একজন আইনজীবির? সেখানেও রয়েছে কিছু রুল এবং প্রসিডিওর। ১৯৭২ সালের বার কাউন্সিলের ৬০ নাম্বার রুল অনুযায়ী এখানেও সাবমিট করতে হবে কিছু কাগজ পত্রঃ
যেমন-
১) আবেদন পত্র
২) ৫,৫০০ তাকার ব্যাঙ্ক ড্রাফট
৩) যেই কোর্টে প্র্যাক্টিস করেছেন প্রার্থী সেই বারের প্রেসিডেন্ট/স্ক্রেটারীর থেকে প্রত্যয়ন পত্র
৪) কমের পক্ষে ২৫ টা সিভিল ও ক্রিমিনাল মামলা প্রার্থী পরিচালনা করেছেন তার প্রমান ও লিস্ট
৫) লোয়ার কোর্টের এনরোলমেন্টের সনদ
৬) দুইটা পাস্পোর্ট সাইজ ছবি
৭) এল এল এম এর সত্যায়িত নম্বর পত্র ইত্যাদি
এইসব নিয়ম কানুন ফলো করেই বাংলাদেশের লোয়ার কোর্ট এবং আপার কোর্টে একজন ব্যাক্তিকে প্র্যাক্টিস করবার লাইসেন্স নিতে হয়। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আমি একজন বিদেশী, আমার চামড়া সাদা, তাই স্যার স্যার করতে করতে আমাকে প্র্যাক্টিস করতে দেয়া হবে দেশের আদালতে। নিয়ম সবার জন্যই সমান ও এক।
কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য যে জামাত ও বি এন পি'র এক্টিভিস্টরা বলে বেড়াচ্ছে যে, সরকার নাকি বিদেশী আইনজীবিদের মামলা পরিচালনা করতে সুযোগ দিচ্ছেন না। কিন্তু তারা এক্টিবারও এই নিয়ম বা নীতির কথা ভুলেও মুখে আনছেন না।
এ বিষয়ে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন,
একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে বার কাউন্সিলের কিছু বিধিবিধান রয়েছে। এ দেশে কারা আইনি প্র্যাকটিস করবে, কারা করবে না তা আইনে লেখা আছে। বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের বিষয়টি বার কাউন্সিলের আইন সমর্থন করে করে না। এ অবস্থায় আমরা বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি দিতে পারি না। তাই আজ কাউন্সিলের সভায় সর্বসম্মভাবে আবেদনটি নাকচ করা হয়েছে।
এই নিয়ম যে আমাদের দেশে শুধু তা না। এই নিয়ম সব দেশেই রয়েছে। যেমন -
স্কটল্যান্ডে
ইংল্যান্ডে
ভারতে
পাকিস্তানে
শ্রীলংকায়
সাউথ আফ্রিকায়
আমরা হতে পারি একটি অর্থনৈতিক ভাবে একটি দরিদ্র দেশ কিংবা অবকাঠামোগত ভাবে একটি উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু তাই বলে কি আমাদের দেশে বিদ্যমান নিয়ম নীতি ভেঙ্গে কাউকে সুযোগ করে কোর্টে প্র্যাক্টিস করবার অনুমতি দিতে হবে? যদি তাই হয় তাহলে দেশে-বিদেশে যে লক্ষ লক্ষ এল এল বি পাশ করা বাংলাদেশী ভাই-বোনেরা রয়েছেন তাদেরকেও সমান সুযোগ করে দিতে হবে।
ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টার রয়েছেন ভুরি ভুরি। দয়া করে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তারা মেইন স্ট্রিমে প্র্যাক্টিস তো দূরের কথা, নিজের নামের শেষে ব্যারিস্টার পর্যন্ত ব্যাবহার করতে পারে না। আর যারা ২০০০ সালের আগে ব্যারিস্টার হয়েছেন তারা শুধু ব্যারিস্টার লিখলেও বাধ্যতা মূলক ভাবে নট প্র্যাক্টিসিং শব্দটি লিখেন। এই ইংলিশ কোর্টে প্র্যাক্টিস করতে হলেও অনেক নিয়ম কানুন মেনে তা করতে হয় যা মোটামুটি একজন বিদেশী নাগরিকের জন্য অসম্ভব ব্যাপার।
বি এন পি আর জামাত শুধুমাত্র নিজের সুবিধার জন্য দেশের বিদ্যমান আইন কানুনকে যে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে দ্বিধা করেনা এই বিদেশী আইনজীবি নিয়োগের দাবী তার বড় একটি প্রমাণ।
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন তাহলে আগরতলা মামলা তে কিভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিদেশী আইনজীবি এসেছিলেন এবং শেখ হাসিনার পক্ষে ২০০৭ সালে কিভাবে চেরী ব্লেয়ার মামলা লড়েছিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে বলতে হওয় আগরতলা মামলা হয়েছিলো ৬৭-৬৮ সালের দিকে। সেই সময় তৎকালীন পাকিস্তান বার কাউন্সিল আইনের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে এই ব্যাপারে আইন হয়েছে ১৯৭২ সালে (বাংলাদেশ লিগাল প্র্যাক্টিশনার্স এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার - ১৯৭২)।
এইখানে বিদেশী আইনজীবি আসতে হলে তাকে প্রথমেই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। কথা সিম্পল এন্ড ক্লিয়ার। আর শেখ হাসিনার পক্ষে চেরী ব্লেয়ার কোনোদিন কোর্টে লড়েনি। উনি শুধু হাসিনার পরামর্শক হিসেবে দেশে এসেছিলেন উনার আইনজীবিদের সাথে দেখা করতে। কখনই ফর্মালি কোর্টে জাননি।
আশা করি এই লেখার মাধ্যমে আমি বুঝাতে পেরেছি যে, যে কেউ চাইলেই বাংলাদেশের কোর্টে নিয়ম আর নীতি ব্যাতিরেকে প্র্যাক্টিস করবার আলাদা সুযোগ পায় না। যদি তা পেতে হয় তবে সঠিক নিয়ম কানুন মেনেই তা করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৩ ভোর ৪:০৬