একদিন এক পার্থিব 'প্রমিথিউস' প্রশান্ত মহাসাগরের পাড় হতে ডানা মেলে দিলেন শৌলা'র আকাশে। এক বিশাল অংশের বিদ্যুৎ বিহীন এক অবহেলিত জনপদে জ্বেলে দিলেন প্রাণের স্ফুলিঙ্গ - অখ্যাত এক অন্ধকার গ্রামে ছড়িয়ে দিলেন আশার আলো।
শুভার্থীরা বলেন, আমার পায়ের নীচে নাকি সরিষা দানা। আর আমার এক শ্রেণীর উন্নাসিক বন্ধুরা বলেন, দেশে এতো জায়গা থাকতে, কি যে সব বস্তী - ভাগাড়ে ঘুরে বেড়াই! কি করে বোঝায় তাঁদের, মাঝে মধ্যেই এই হৃদয়ের টানে 'প্রাণের উৎসবে' যোগ দিতে না পারলে আমার মনটা যে ছটফট করে ওঠে। এইতো সেদিন 'সমুদ্র বধু' চট্টলা'র পাহাড়ের কোলে পাথরঘাটা চার্চের এতিম শিশুদের "বেনেডিক্ট নার্সারি', গত ডিসেম্বরে গাজীপুর জেলার শ্রী'পু্রের 'টেংরা' গ্রামের সুবিশাল 'শিশু পল্লী প্লাস' - এর পর বেশ কিছুটা দিন তেমন আর কোথাও যেয়ে ওঠা হয়নি। ফেব্রুয়ারীতে "রাইটস্ এন্ড সাইটস্ ফর চিলড্রেন" (আর এস সি ) পরিচালিত ঢাকার কল্যাণপুরের বস্তিবাসীদের "হেলথ কেয়ার ফর আন্ডার প্রিভিলেজ্ড প্রোগ্রাম" এবং মোহাম্মদপুরে তাদেরই কর্মসূচী, চল্লিশাধিক এতিম বাচ্চা নিয়ে "অরফান সাপোর্ট প্রোগ্রাম" দেখে মনটা আবার নেচে উঠলো। সেখানে গিয়েই শুনলাম, পটুয়াখালী'র এক প্রত্যন্ত গ্রামে তাদের নানা কর্মকাণ্ডের কথা। লোভ সম্বরণ করা কঠিন হয়ে পড়লো - তাইতো মার্চের শেষান্তে ভেসে পরলাম আবার দু'জনে 'সাগর কন্যা' পটুয়াখালীর ছোঁয়া নিতে।
পটুয়াখালী জেলার ঐতিহ্যবাহী নন্দিত জনপদ 'বাউফল' উপজেলার 'কালাইয়া' ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত গ্রাম 'শৌলা'। তেঁতুলিয়া নদীর ধার ঘেঁসে যে জনপদের মানুষজনের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র কৃষক, দিনমজুর, জেলে - তেঁতুলিয়া অববাহিকায় মাছ ধরে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকাই যাঁদের নিরন্তর প্রচেষ্টা। অভাবী - নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাঁদের। যাঁদের অধিকাংশই বিদ্যালয়মুখী হননি কখনো। সন্তানদেরও পড়ালেখা করানোর ইচ্ছা বা সামর্থ্য—কোনোটাই তাদের ছিল না। এভাবেই পার হচ্ছিল বছরের পর বছর। একদিন এক পার্থিব 'প্রমিথিউস' প্রশান্ত মহাসাগরের পাড় হতে ডানা মেলে দিলেন শৌলা'র আকাশে। এক বিশাল অংশের বিদ্যুৎ বিহীন এক অবহেলিত জনপদে জ্বেলে দিলেন প্রাণের স্ফুলিঙ্গ - অখ্যাত এক অন্ধকার গ্রামে ছড়িয়ে দিলেন আশার আলো।
ক'টি দিন সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি 'শৌলা' গ্রামের পথে পথে, বঞ্চিতের বসতি'তে ঘুরে ঘুরে আবাল বৃদ্ধ-বণিতা'র সাথে কথা বলে যা বুঝেছি, দেখেছি, শুনেছি - তা শুধুই যেন এক সফলতার কাহিনী - বঞ্চিতের বসতি'তে তাদের এক স্বপ্নের রাজকুমারের অবিস্মরণীয় সব গল্প-গাঁথা --
- নিরক্ষর কে অক্ষর দান
- নিরন্নের অন্নের সংস্থান
- দৃষ্টিহীন কে দৃষ্টি দান
- বিপন্ন কে স্বাবলম্বীকরণ
এক 'প্রমিথিউস' এর ভালোবাসার আগুনে অবহেলিত 'শৌলা' গ্রামের বঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আত্ম সচেনতা, আত্ম নির্ভরশীল করে গড়ে ওঠার সে এক অভূতপূর্ব সফলতার গল্প - যা এই স্বল্প পরিসরে বলে শেষ করার নয়। তবে আমার বন্ধু, ও শুভার্থীদের সেই সাদা মনের মানব হৈতেষী, 'শৌলা' গ্রামের জন মানুষের স্বপ্নের রাজকুমার ডাঃ এহসান হকের (MBBS, Phd. - প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক "ডিস্ট্রেস চিলড্রেন এন্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল" - ইউ,এস,এ (ডিসিআই ) কর্মযজ্ঞের সামান্য কিছুটার সাথে হলেও পরিচয় করিয়ে দেবার লোভ সম্বরণ করে পারছি না।
ডাঃ এহসান হক তাঁর "ডিস্ট্রেস চিলড্রেন এন্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল" - ইউ,এস,এ (ডিসিআই )‘এর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে তাঁর সহযোগী সংস্থা "রাইটস্ এন্ড সাইটস্ ফর চিলড্রেন" (আর এস সি ) এর কর্ম কুশলতায় রূপায়ন করে চলেছেন একের পর এক নানা প্রকল্পঃ
সান চাইল্ড স্পন্সরশীপ প্রোগ্রাম (SCSP): শিশুদের অকালে স্কুল/লেখাপড়া থেকে ঝড়ে পড়া রোধ কল্পে এই চমৎকার উদ্যোগের সূচনা। এই কর্মসূচীর আওতায় যে সমস্ত শিশুদের বাবা-মাদের তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য নেই বা কয়েক ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়ে নানা কারণে সন্তানদের স্কুল ছাড়িয়ে পারিবারিক কাজে নিয়োজিত করেছেন; সেইসব বাবা মাদের উদ্বুদ্ধ করে তাঁদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অনুপ্রাণিত করা হয়। এই কর্মসূচীর সবচেয়ে কার্যকরী ও প্রশংসনীয় দিক হচ্ছে, এই সমস্ত শিশুদের লেখাপড়ার খরচ বাবদ প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ নিয়মিত ভাবে তাদের বাবা-মায়ের হাতে প্রদান করা হয়। প্রতিটি শিশুকে তাদের স্কুল ড্রেস, জুতো, স্কুল ব্যাগ, বই- খাতা, পেন্সিল-কলম প্রভৃতি সকল শিক্ষা সামগ্রীসহ প্রতি ৬ মাস অন্তর 'সান চাইল্ড স্পন্সরশীপ' প্রতিটি শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথ পেস্ট, টুথ ব্রাশ সহ নানা রকম হাইজিন ম্যাটেরিয়াল নিয়মিত ভাবে সরবরাহ করা হয়। স্কুলগামী শিশুটির লেখাপড়ায় যেন কোন বাধা না পরে তাই কোন 'সান চাইল্ড স্পন্সরশীপ শিশু'র বাবা মা'র আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকলে তাঁদের নানাভাবে সাহায্য করে আত্ম কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা হয়। সর্বোপরি, প্রতি ৬ মাস অন্তর এসমস্ত শিশুদের রুটিন মেডিক্যাল চেক - আপ (চক্ষু ও দন্ত্য সহ), ভিটামিন ও প্রয়জনীয় ঔষধ পত্র প্রদান করা হয়। এমনকি প্রয়োজনে জরুরী অস্ত্রোপচার সহ উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে 'শৌলা' গ্রামের ৮০২ জন শিশুসহ হবিগঞ্জ ও নীলফামারী'র কয়েকটি গ্রামের সর্বমোট ১৫০০ শিশু ও তাদের পরিবারকে এমনভাবে পূর্ণ সহায়তা করে চলেছে "ডিস্ট্রেস চিলড্রেন এন্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল" - ইউ,এস,এ (ডিসিআই )
অপার বিস্ময়ে মোহিত হয়ে বিমুগ্ধ নয়নে শুধু অবলোকন করেছি - আর দশটা শিশুদের মত যাদের অকালে ঝরে পরার কথা, একসময়ের অবহেলিত বঞ্চিত এইসব শিশুদের অনেকেই আজ প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি পেড়িয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কৃতিত্বের সাথে অধ্যয়ন করছে। শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ, খেলাধুলো, নির্মল সাংস্কৃতিক চর্চা তথা সার্বিক মেধা-মনন বিকাশে তারাও আজ কারো চেয়ে কম নয়। যেসব পরিবার কূল হারিয়ে তেতুলিয়া'র জলে ভেসে যাওয়ার কথা DCI'এর পরশে তাঁরা আজ আত্ম নির্ভরশীল হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যাঁদের মুখে ছিল ঘোর অমাবস্যা'র অমানিশা - তাঁদের হাসি আজ মধ্য গগনের সূর্যের মত উদ্ভাসিত। সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন এইসব 'সূর্য-শিশু'রা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, আইনজ্ঞ প্রভৃতি নানা পেশায় নিজেদের অলংকৃত করে অখ্যাত 'শৌলা'র আকাশে হাজারো তারা'র বাতি হয়ে জ্বলবে - নিজ পরিবার, গ্রাম, দেশ তথা জাতীর জন্য বয়ে আনবে সুনাম - অনাবিল সমৃদ্ধি।
আসুন আমরাও হই এই মহতী উদ্যোগের একজন গর্বিত অংশীদার। আমাদের অর্জিত রোজগেরের একটি অতি নগণ্য অংশ - প্রতি মাসে মাত্র ১৫ ডলার বা সমপরিমাণ অর্থ (মাত্র ১২০০ টাকা) নিয়মিতভাবে প্রদান করে DCI এর মাধ্যমে এক বঞ্ছিত, অবহেলিত, নিষ্পাপ শিশুকে এক নীতল দিঘীর 'নীল কমল' হয়ে প্রস্ফুটিত হতে দেই - আমাদের শুধু একটু সদিচ্ছা, একটু সামান্য উদ্যোগেই আমরা দারুণ ভাবে বদলে দিতে পারি একটি শিশু তথা একটি পরিবারের পুরো জীবনটাকেই।
আমাদের কর্মক্লান্ত দিনগুলোর কোন এক অবসরে যান্ত্রিক নগর জীবনের মায়াজাল কাটিয়ে - একটি দিন কাটিয়ে আসতে পারি আমাদের স্পন্সরকৃত শিশুটির সাথে - মুঠো ফোন, ই-মেইল, চিঠি'র মাধ্যমে খোঁজ নেই তাঁর অগ্রগতির। সেও হয়তোবা নানা উপলক্ষ্যে তার কচি হাতের লেখা, আঁকা ছবি পাঠিয়ে শ্রদ্ধা, ভালবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করবে - একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিনম্র চিত্তে স্মরণ করবে তার জীবন বদলে দেয়া সেই মহানুভব মানুষটিকে। এভাবেই কখন যে গড়ে উঠবে এক অচেনা - অজানা দেবদূতের সাথে নিবিড় নাড়ির টান - হয়ে উঠবে একে অপরের আত্মার আত্মীয়।
আফটার স্কুল টিউটোরিয়াল সাপোর্ট প্রোগ্রামঃ স্কুল শেষে শিশুদের স্কুলের লেখাপড়া তৈরি করে দেবার জন্য সান চাইল্ড স্পন্সরশীপ প্রোগ্রামের আওতায় শুধু মাত্র 'শৌলা' গ্রামেই মোট ৭২ টি টিউটোরিয়াল সাপোর্ট গ্রুপ বা কোচিং গ্রুপ কাজ করছে। এক একটি গ্রুপে ১০ থেকে ১৫ জন একই শ্রেণীর শিশু একজন 'গৃহ শিক্ষকের' তত্ত্বাবধানে তাদের স্কুলের লেখাপড়া পরবর্তী দিন স্কুলে যাবার পূর্বেই সম্পন্ন করে নিচ্ছে। শুধু লেখাপড়া নয়, টিউটর'গণ শিশুদের 'ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিধি', আচার-আচরণ, খেলাধুলো, নাচ-গান, ছবি আঁকা, গল্প বলা, সাধারণ জ্ঞান, 'বিতর্ক প্রতিযোগিতা', প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষাসহ সার্বিক মেধা-মনন বিকাশে দারুণ ভূমিকা রাখছেন। কোথাও খোলা আকাশের নীচে পলিথিনের চাদর বিছিয়ে, কোথাওবা কোন গৃহস্থের দাওয়ায় এক ঝাঁক শিশুর সমস্বরে সুর করে পাঠ মুখস্থ - সে এক অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করে।
রীতিমত পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে অনেকের মধ্য থেকে এইসব টিউটরদের নির্বাচন করা হয়। DCI নিয়মিতভাবে মাসিক একটা অংকের সম্মানী এইসব টিউটরদের প্রদান করে থাকে। গ্রামের SSC, HSC অধ্যয়নরত বহু দরিদ্র মেধাবী ছেলে-মেয়ে টিউটর হিসেবে কাজ করে, তাঁদের এই উপার্জিত অর্থে অনেকেই তাঁরা নিজ পরিবার কে সামান্য হলেও সহায়তা করার পাশাপাশি নিজেদের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে চলেছেন। সবচেয়ে আনন্দ ও গর্বের বিষয় যে, DCI কর্তৃক স্পন্সরশীপকৃত একসময়ের সেইসব খুদে শিশুদের অনেকেই আজ PSC, JSC, SSC, HSC'র বেড়া ডিঙ্গিয়ে কৃতিত্বের সাথে টিউটর হিসেবে কাজ করছেন।
আসুন আমরাও এই অভূতপূর্ব উদ্যোগের একজন গর্বিত অংশীদার হই । আমাদের নিজ নিজ সামর্থ্যের মধ্যে থেকেই মাসিক অতি নগণ্য অংকের অর্থের নিয়মিতভাবে যোগান দিয়ে অন্তত একজন 'টিউটর'কে হলেও আমরা স্পন্সর করে DCI'র এই কর্মসূচীকে আরও বেগবান করে তুলি। আর আমরা যারা ছাত্র-ছাত্রী - চলুননা নিজেদের পাঠ অবসরে অন্তত একটি সপ্তাহের জন্য হলেও 'স্বেচ্ছা শ্রম' দিয়ে আসি শিশুদের টিউটর হিসেবে - আলোকিত করে আসি অবহেলিত বঞ্ছিত শিশুদের সেই ছোট্ট আকাশটিকে।
ফ্যামিলি সাপোর্ট প্রোগ্রামঃ শিশুদের নিরবিচ্ছিন্ন লেখাপড়া নিশ্চিত করণে তথা তাদের সুষ্ঠ বিকাশে পরিবার থেকে যথাযথ সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যে প্রতিটি 'সূর্য -শিশু'দের মা'দের নিয়ে একটি করে 'ফ্যামিলি সাপোর্ট গ্রুপ' গড়ে তোলা হয়েছে। শুধু মাত্র 'শৌলা' গ্রামেই এমন মোট ৩০ টি 'ফ্যামিলি সাপোর্ট গ্রুপ' রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে রয়েছেন ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য। DCI'র সহযোগী প্রতিষ্ঠান "রাইটস্ এন্ড সাইটস্ ফর চিলড্রেন" (আর এস সি ) এর সমাজকর্মী, মাঠকর্মীগণ প্রতি সপ্তাহে একবার এক সাপ্তাহিক মিটিং'এ বসেন তাঁদের সাথে। এই মিটিং'এ গ্রামীণ মা'দের স্বাস্থ্য সচেতনতা, মাতৃত্ব, শিশুর যত্ন, নিরাপদ প্রসব, প্রাথমিক চিকিৎসা, ঘরে স্যালাইন তৈরি, হাঁস-মুরগী, গরু পালন, ঘরের আঙ্গিনায় সব্জী ফলানো প্রভৃতি নানা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে আর্থ - সামাজিকভাবে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা হয়। গ্রামীণ মা'দের তাঁদের কাজের অবসরে কি অপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত এক প্রাণ চাঞ্চল্য দেখলে মনটা জুড়িয়ে যায়।
আত্ম কর্মসংস্থান ও আত্ম উপার্জনে সয়াহতাঃ DCI 'সান চাইল্ড স্পন্সরশীপ শিশু'র বাবা মা'দের নানাভাবে সাহায্য করে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে চলেছে। ক্ষুদ্র কৃষককে এককালীন কিছু অর্থ প্রদান করে তা দিয়ে মৌসুমি সব্জী চাষ, কোন গ্রামীণ গৃহিণী কে গরু কিনে দিয়ে গরু প্রতিপালন, কাওকেবা ক্ষুদ্র ব্যবসার পুঁজির যোগান ও তার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে চলেছে।
জীবন সংগ্রামে হাল ভাঙ্গা নাবিকের মতো অকূল পাথারে ভেসে যেতে থাকা এই সব মানুষের পায়ের তলায় ডাঙার সন্ধান পেয়ে আজ মুখে ফুটে উঠেছে ষোলকলা পূর্ণ শশীর হাসি - যা দেখলে বাস্তবিক অর্থেই প্রাণটা ভরে ওঠে।
আসুন আমরাও হই এই মহতী উদ্যোগের একজন গর্বিত অংশীদার। যে কোন অসংগঠিত দান, ভিক্ষা বৃত্তিকে উৎসাহিত না করে আমরাও তেতুলিয়া পাড়ের বঞ্ছিত, অবহেলিত মানুষদের DCI' এর মাধ্যমে কাউকে গরু কিনে দিয়ে, কাউকেবা কোন এক ক্ষুদ্র ব্যবসার পুঁজির যোগান দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলে এক অভাগা পরিবারের মুখে সূর্যের হাসি এনে দেই। আমাদের যাকাত সঠিক কাজে দান করে অশেষ সোয়াবের ভাগীদার হই।
প্রি-প্রাইমারী স্কুল প্রোগ্রামঃ প্রি-প্রাইমারী স্কুল কর্মসূচী DCI'এর চমৎকার এক সফল উদ্যোগ। একজন চৌকস শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে এক একটি প্রি-প্রাইমারী স্কুলে ৫ -৬ বছরের ২৫-৩০ জন শিশুরা তাদের অক্ষর জ্ঞান, হাতে খড়ি, শরীরচর্চা, শপথ বাক্য, ছবি আঁকা, গল্প বলা, সাধারণ জ্ঞান, 'ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিধি' শিক্ষা, প্রতিদিনের খবর, নাচ-গান প্রভৃতি নানা সৃজনশীল কাজসহ বাংলা, ইংরেজি, গণিত বিষয়গুলো নানা রকম আকর্ষণীয় শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে দ্রুত শিক্ষা লাভ করে থাকে। এসব স্কুলে শিশুদের জন্য চমৎকার এক সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৮.৩০ থেকে ১১.৩০ পর্যন্ত (মাঝে ১০ মিনিটের বিশ্রাম বিরতি) ৩ ঘণ্টা একটা রুটিন অনুযায়ী ভবিষ্যতের এই নাগরিকরা নিজেদের ব্যাপৃত রাখে। এই প্রি-প্রাইমারী স্কুলগুলোতে শিশুদের উপস্থিতির হার অভূতপূর্ব। 'শৌলা' গ্রামে DCI'এর উদ্যোগে মোট ১০টি এধরণের স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়।। DCI'এর প্রি- প্রাইমারী স্কুল প্রোগ্রামের ঈর্ষণীয় সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বর্তমানে ৪ টি স্কুল সরকার নিয়ে সরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করছে।
DCI'এর প্রি- প্রাইমারী স্কুলের এক ঝাঁক ফুটফুটে শিশুদের ছোট ছোট পায়ে ছুটে বেড়ানো, তাদের কলকাকলি 'তে মুখরিত প্রাঙ্গনে আসলে মনে হয় কোন স্বর্গীয় উদ্যানে ক্ষুদে দেবদূতদের মাঝে এসে পরেছি।
আসুন আমরাও হই এই অভূতপূর্ব উদ্যোগের একজন গর্বিত অংশীদার। নিজের বা আমাদের স্বর্গীয় পিতা-মাতা বা প্রিয়জনের নামে DCI এর মাধ্যমে একটি প্রি- প্রাইমারী স্কুল স্পন্সর করে তাঁদের অমরত্ব দান করি। ভবিষ্যতের এই নাগরিকদের নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে আমাদের প্রিয়জনকে চির অম্লান চির ভাস্বর করে রাখি। কিম্বা একটি প্রি- প্রাইমারী স্কুলের শিশুদের কচি মুখে সামান্য জলখাবার (টিফিন) তুলে দিয়ে (স্পন্সর করে) এক নির্মল আনন্দে নিজেদের ভরিয়ে তুলি।
DCI লাইব্রেরী ও কম্পিউটার সেন্টারঃ শৌলা' গ্রামে DCI শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য একটি লাইব্রেরী এবং তাদের আধুনিক তথ্য- প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার লক্ষ্যে কম্পিউটার সেন্টার স্থাপন করেছে।
আমরাও আমাদের খুব ছোট্ট ছোট্ট সামর্থ্য নিয়ে DCI'এর পাশে এসে দাঁড়াতে পারি। নিদেন পক্ষে কয়েকটি শিশু - কিশোর পাঠ্য শিক্ষামূলক বা গল্পের বই, একটি দুটি PSC/JSC/SSC/HSC'র টেষ্টপেপার, গাইড বই কিনে দিয়ে বা আমাদের ব্যবহৃত পুরোনো সচল ল্যাপটপ বা ডেস্কটপটি শিশুদের ব্যবহারের জন্য প্রদান করে অতি সহজেই DCI লাইব্রেরী ও কম্পিউটার সেন্টারটিকে আরও সমৃদ্ধ করতে আমরা আমাদের অবদান রাখতে পারি।
DCI বয়স্ক শিক্ষা ও বিনোদন কেন্দ্রঃ গ্রামীন জনগোষ্ঠীর অবসর সময়টিকে কিছুটা হলেও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে শৌলা' গ্রামে DCI বয়স্ক শিক্ষা ও বিনোদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
আমরাও DCI বয়স্ক শিক্ষা ও বিনোদন কেন্দ্রটিতে নিজেদের সামর্থ্য মত ক্যারম বোর্ড, বাগাডুলি, লুডু প্রভৃতি নানা ছোট খাটো খেলাধুলা সামগ্রী কিনে দিয়ে এই অবহেলিত বঞ্ছিত মানুষগুলোর অবসর সময়টুকুকে আরও রঙিন করে তুলতে পারি।
চক্ষু ও চিকিৎসা ক্যাম্পঃ DCI তার সহযোগী "রাইটস্ এন্ড সাইটস্ ফর চিলড্রেন" (আর এস সি ) এর মাধ্যমে মাঝে মধ্যেই চক্ষু ও চিকিৎসা শিবির পরিচালনা করে থাকে। 'শৌলা' ও এর আশেপাশের অসংখ্য গ্রামবাসী যারা দৃষ্টি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। কেওবা মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট করে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন, DCI তাঁদের স্থানীয় ভাবে/কাউকেবা জেলা শহর / কাউকেবা ঢাকায় নিয়ে এসে উপযুক্ত চিকিৎসা করিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ্য করে/ দৃষ্টি দানের ব্যবস্থা করে নানা ভাবে পুনর্বাসিত করেছে।
আসুন আমরাও হই এমন মানবিক উদ্যোগের একজন গর্বিত অংশীদার। DCI'এর সাথে একটি 'আই ক্যাম্প' বা 'হেলথ ক্যাম্প' স্পন্সর করে বা কোন একজন দুস্থ রোগীর ঔষধ বা চিকিৎসা খরচ স্পন্সর করে আর্ত মানবতার পাশে এসে দাঁড়াই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসনঃ ঘূর্ণিঝড়, জ্বলোচ্ছাস, বন্যা, মহামারী, শৈত্য প্রবাহ প্রভৃতি বিভিন্ন মানবিক বিপর্যয়ে DCI খাদ্য, কম্বল, শীত বস্ত্র বিতরণ, ঘর তৈরি করে দেয়া সহ নানা রকম ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধুমাত্র সাগর সাগর কন্যা পটুয়াখালী জেলার তেতুলিয়া অবিবাহিকার 'শৌলা' গ্রামই নয় এদেশের হবিগঞ্জ, নীলফামারী এবং দেশ ছাড়িয়ে ভারত, নেপাল, নিকারাগুয়ার প্রত্যন্ত এলাকার অবহেলিত, বঞ্ছিত শিশু ও তাদের পরিবারের শিক্ষা তথা আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এই আলোর দিশারী - ডাঃ এহসান হক ও তাঁর স্বপ্নের সংস্থা "ডিস্ট্রেস চিলড্রেন এন্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল" - ইউ,এস,এ (ডিসিআই )
রাজধানী ঢাকাতেও ৪০ জন এতিম শিশু কিশোরদের থাকা-খাওয়া, ভরণপোষণ,শিক্ষা-দীক্ষা সহ তাদের সামগ্রিক দায়ভার বহন করছে, ডাঃ এহসানের "অরফান সাপোর্ট প্রোগ্রাম"। কল্যাণপুরের স্বাস্থ্য সুবিধা বঞ্ছিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর (৯ সহস্রাধিক বস্তিবাসীর) মাতৃত্ব, শিশু স্বাস্থ্যসহ সার্বিক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এই মহাপ্রাণ মানুষটির "হেলথ কেয়ার ফর আন্ডার প্রিভিলেজ্ড প্রোগ্রাম" (HUP).
এমন সব নানা মানব হৈতেষীমূলক কর্মকাণ্ড দেখলে শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে আসে। ভাবি - ডাঃ এহসানের মত আমাদেরই এমন কত প্রবাসী ভাই-বোনেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের জন্য যেমন একদিকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছেন - নানা ক্ষেত্রে দেশের জন্য বয়ে আনছেন সুনাম। ঠিক তেমনি তাঁরাই তাঁদের বুকের ভেতর জ্বলে থাকা ধিকি ধিকি ভালবাসার আগুনে সুদূর প্রবাস থেকেও এদেশের দুঃস্থ, বঞ্ছিত, অবহেলিত মানুষদের যুগিয়ে চলেছেন উত্তাপ - উষ্ণতা। তাঁদের চেতনার রঙেই যেন পান্না হয়েছে সবুজ - চুনি হয়ে উঠেছে রাঙা হয়ে।
আসুননা - আমরাও হই এমন সব মহতী মানবিক উদ্যোগের একজন গর্বিত অংশীদার। যে কোন অসংগঠিত দান, ভিক্ষা বৃত্তিকে উৎসাহিত না করে বরং আমাদের যার যেমন সামর্থ্য রয়েছে সে অনুযায়ী আর্ত মানবতার সেবায় নিজেদের পছন্দমত যে কোন একটি প্রকল্পে সাধ্যমত সহায়তা করে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দেই কোন এক ছোট্ট আকাশ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৮