somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

...চোখে জলের সন্তরণ

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৩:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দাদা একটি মুরগীর বাচ্চা পুষতেন বাসায়। তখনো সঞ্জীব’দা ও শিল্পীর কোলজুড়ে আসেনি কিংবদন্তী। সেই মুরগীছানা নিয়ে এই পাগলা দম্পতির কী আনন্দ! ছানাটির নাম দিয়েছিলেন ওঁরা চিঁ চিঁ চৌধুরী।
কিংবদন্তী এল ওদের মেয়ে হয়ে। কিংবদন্তী নামটা নাকি ওর পিসি স্বপ্নে পেয়েছিলেন। ‘আমি বলি, পাইলি পাইলি, এত কঠিন নাম স্বপ্নে পাইলি ক্যান!’Ñ সঞ্জীব’দা বলেন আর হাসেন...। গলার ভেতর বুদবুদের মতো আনন্দময় খটখট হাসি।
এই হলেন ঘরের সঞ্জীব’দা। বাইরের সঞ্জীব চৌধুরী? এই যে আমাদের পাঠক েফারাম, বন্ধুসভা, স্বজন সমাবেশ, সুহৃদ সমাবেশ- এর প্রবর্তক সঞ্জীব চৌধুরী। আমি দুটি কথা সবাইকে বলিÑ এক. আমার লেখালেখি আর সাংবাদিকতার গুরু আনিসুল হক আর সঞ্জীব চৌধুরী। দুই. দৈনিক পত্রিকায় পাঠক সংগঠনের জনক সঞ্জীব চৌধুরী।
প্রায়শই এই দুঃখজনক সত্যির মুখোমুখি হইÑ আমরা ঋণ স্বীকার করতে চাই না আর মুছে ফেলতে চাই পিছনের কথা। দেখি এবং রক্তাক্ত হই। তাই আমি এই কথা দুটো বলে যাব আজীবন। এ আমার জেদি সংকল্প।
‘পাঠক সংগঠনের ভাবনা আপনার মাথায় কী করে এল, দাদা!’ জিজ্ঞেস করলে সঞ্জীব’দা হাসতেন। কাঁটার মতো চোখা গোঁফের নিচে সেই সর্বহৃদয়জয়ী হাসি। তারপর লাজুক লাজুক হয়ে বলতেন, ‘ভোরের কাগজ পত্রিকা হলো। এক জায়গার পাঠকরা ফ্যান ক্লাব করে ফেললÑ ভোরের কাগজ শ্রীনগর ফ্যান ক্লাব (শ্রীনগরই নাকি অন্য কোনো জায়গা!)। এই ভাবনাটা কাজে লাগালাম। ভাবলাম, পাঠকদের জন্য তো একটি পাতা হতে পারে, যেখানে কেবল পাঠকদের লেখা ছাপা হবে। পাতাটি ঘিরে পাঠকদের সংগঠন হতে পারে। সেই থেকে হলো ভোরের কাগজ পাঠক ফোরাম...।’
সমকাল সুহৃদ সমাবেশের বন্ধু-সংগঠকদের এই ইতিহাস জানা দরকার। ভোরের কাগজে মোটে তিন কলামে পাঠক ফোরাম বেরুত শুরুতে। তারপর এক পৃষ্ঠার পাঠক ফোরাম। সঞ্জীব’দা কী মমতায় যে পাতাটি গড়তেন! আমরা তখনকার নবীন কজন ভোরের কাগজে যুক্ত হয়েছি। দেখতাম, দাদার পাঠক ফোরাম গড়া। তখন তো আর এখনকার মতো কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সুবিধা ছিল না। ছবিকে পজেটিভ বানিয়ে, ট্রেসিং কেটে কেটে, স্কচ টেপ দিয়ে পেস্টিং করে পত্রিকার তৈরি হতো। চোখে ভাসেÑ পেস্টিং রুম, দাদা বলছেন, ‘ওইখানে একটা খিচুং দ্যান, শামীম ভাই।’ পাতাটা সুন্দর করার কী নিরন্তর মমতা! একাধিক বোল্ড হেডলাইন করে পাতা ‘কদর্য’ করার বিরোধী ছিলেন দাদা। তাঁর চাই সুসামঞ্জস্য, ব্যালেন্স।
কোন দূর মফস্বলের কোন তরুণ লেখা পাঠিয়েছে ডাকে। সে কোনোদিন জেনেছে, দাদা কী যতœ করে তার লেখা এডিট করতেন, কত মমতা নিয়ে! লিখতে লিখতে, সম্পাদনা করতে করতে টেবিলে তাল তুলে গাইতেন দাদা।
সুমন চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম অ্যালবাম ‘হাল ছেড় না’ যখন ঢাকার বাতাসে ভীষণ ভাসছে। সবাই ধন্য ধন্য করে, দাদার মনে ব্যাথা। এই ধরনের কয়েকটি গান তিনি তৈরি করেছেন। ‘বল তো, এখন আর কেউ বিশ্বাস করবেÑ এইগুলাই আমি করতে চাইছিলাম! বল তো, কেমনে পারিল ব্যাটা জানতে...!’ বলে হো হো করে হেসে উঠতেন দাদা। মুহূর্তে উজ্জ্বল মুখ। এই হলেন সঞ্জীব’দা।
বাইবেলের পৃষ্ঠা থেকে উঠে আসত যেন দাদার বাক্য। ওই বাক্য-কৌশল পূর্ণ করত আমাদের। আমরা শিখতাম তাঁর কাছে। কী ছন্দময় গদ্য তাঁর! অসাধারণ সব হেডলাইন করতেন দাদা, যেন কবিতার শিরোনাম। মাদার তেরেসা মারা গেলেন। মেলায় দাদা হেডলাইন করলেনÑ ‘তাহলে বিদায় বলি, মা’। আজ সেই আমার সঞ্জীব’দা নিয়ে আমার লিখতে হবেÑ ‘তাহলে বিদায় বলি, দাদ!’
আজকের কত সাংবাদিক কত লেখক যে দাদার হাতে পড়ে দাদার হাত ধরে হলো। আহা, কত কিছু যে শিখেছি আত্মভোলা এই সাদামনের মানুষটির কাছ থেকে! দাদা হাতে ধরে ধরে শেখাতেন আমাদের। যেমন বাবা তার শিশুকে হাঁটতে শেখান।
সম্ভবত ’৯৫। ভোরের কাগজের পাঠক ফোরাম আর পরামর্শ নামের দুটি পাতা আমাকে ধরিয়ে দেয়া হলো। দাদা নিলেন সে সময়ের ভীষণ পাঠকপ্রিয় মেলার দায়িত্ব।
মনে পড়ে, আজ কথা মনে পড়ে...। ’৯৮-এর একদিন পাঠক ফোরামের সাবেক সম্পাদক সঞ্জীব’দাকে নিয়ে চললাম ময়মনসিংহে। মতি ভাই (সম্পাদক মতিউর রহমান) ছিলেন, অনেকেই ছিলেন সে যাত্রায়। পাঠক ফোরামের অনুষ্ঠান হলো ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে। শেষে দাদাকে নিয়ে গেলাম সংগঠক অভিজিৎ রাজুর বাসায়। ওখানে দাদাকে নিয়ে যাওয়ার পিছনে আমার ‘একটু গোপন হাত’ ছিল। রাজুর মা কল্পনা মাসিমণি অমৃত রাঁধেন। দাদা খেতে ভালোবাসেন। মাসিমণির রান্না দাদাকে খাওয়ানোই ছিল অভিলাষ। প্রকৃত রাঁধুনী সেদিন প্রকৃত খাদক (আসলে খাদ্যসমঝদার) পেয়ে তৃপ্তি করে খাইয়েছিলেন। মনে পড়ে, দাদাকে সেইদিন অপরাহ্নে আমরা দুই-তিনজনে হাত ধরিয়া টানিয়া তুলিয়াছিলাম।
এর পরপরই আমি এলাম প্রথম আলোয়। করলাম বন্ধুসভা। দাদা রইলেন ভোরের কাগজেই। বন্ধুসভা ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে। বন্ধুসভার সেরা বন্ধু পুরস্কার উৎসব হবে। মনে হলো, সঞ্জীব’দার চেয়ে সেরা বন্ধু কে আছে পাঠক সংগঠনের? দাদাকে আমন্ত্রণ জানালাম বন্ধু উৎসবে। ২০০১ সালের ২৬ জানুয়ারির কথা বলছি। দাদা বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। গান করলেন। তারপরই বন্ধুসভার সবচেয়ে ওই বড় সম্মিলনে শ্রদ্ধায় নত হয়ে সঞ্জীব চৌধুরীর হাতে ‘পাঠক সংগঠনের জনক’ পদক তুলে দিলাম। এই পরিকল্পনার কথা দুজনের কাছে লুকিয়েছিলাম আমি। এক. সঞ্জীব’দার কাছে। আমার মনে হয়েছিল, জানলে দাদা রাজি হবেন না। দুই. সম্পাদক মতিউর রহমান সাহেবের কাছে। আমার মনে হয়েছিল, জানলে প্রথম আলো রাজি হবে না।
দাদা বলতেন, ‘তুই যে আমারে পাঠক সংগঠনের বাপ বানালি, তোর বন্ধুসভা তো এখন আরো বড়!’
আমি ঝগড়া লাগিয়ে দিতাম। যায়যায়দিন দৈনিক হলে দাদা ফিচার সম্পাদক হলেন। আবার তাঁর সহকর্মী হলাম। সেখানে প্রতিদিনই ঝড়গাঝাঁটি হতো আমাদের। সারাজীবনই দাদার সঙ্গে ঝগড়া করেছি আমিÑ এটা নিয়ে সেটা নিয়ে ওটা নিয়ে। ছোট ছোট ঝগড়া। অধিকারমাখা ঝগড়া। আজ সেইসব ঝগড়াঝাঁটিই বেশি মনে পড়ছে। কত ঘটনা এত স্মৃতি, তবু সব ছাপিয়ে দাদার সঙ্গে কেবল ঝগড়ালোই মনে আসছে। কেন! আর একবার ঝগড়া করার জন্য আমার সঞ্জীব’দাকে আর পাব না কেন!
* লেখাটি ৪ ডিসেম্বর ২০০৭-এ সমকাল ‘সুহৃদ সমাবেশ’-এ ছাপা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৫:২১
২৪টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×