নারায়ণগঞ্জের খানপুর নদীবন্দর তুলে দেয়া হচ্ছে ভারতের হাতে। দীর্ঘমেয়াদে খানপুর নৌবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব চেয়ে ভারতের দেয়া প্রস্তাবে এরই মধ্যে সম্মতি দিয়েছে বর্তমান সরকার। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে আগামী জুলাইয়ে দু’দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরের মধ্যে চুক্তি সই হবে। খানপুর বন্দরের পাশাপাশি ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌবন্দরটিও পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। তবে এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে দাবি করেছেন নৌপরিবহন সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার।
ভারতের হাতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি নদীবন্দর তুলে দেয়াকে অত্যন্ত দূরভিসন্ধিমূলক ও দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি বলে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহবুব উল্লাহ আমার দেশকে বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে যেভাবে বিনা শুল্কে এদেশে বাণিজ্য করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল, বর্তমানে একই প্রক্রিয়ায় ভারতকে সে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ভারতকে করিডোর দেয়া হবে—এমন ধারণা
আগে কল্পনার বাইরে ছিল; এখন তা বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। তিনি এসব কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, করিডোর ব্যবহার, রেল, নৌ ও স্থলবন্দর ভারতের হাতে তুলে দেয়ার যে পরিকল্পনা একে একে বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ একসময় তার অস্তিত্বই হারাবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার আমার দেশকে জানিয়েছেন, খানপুর নদীবন্দর সম্পূর্ণ নিজেরাই পরিচালনার প্রস্তাব পাঠিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের তরফ থেকে এতে সায় দেয়া হয়েছে। তবে কতদিনের জন্য এবং কি কি শর্তে এই বন্দর তাদের দেয়া হবে, সেটি জানতে চেয়ে আমরা (নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়) চিঠি পাঠিয়েছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খানপুর নদীবন্দর ভারতকে পরিচালনার দায়িত্ব দিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী জুলাই মাসে এ নিয়ে চুক্তি সই হতে পারে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সবকিছু পাকাপোক্ত করে ফেলেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মূলত ভারতীয় কন্টেইনার ও পণ্য পরিবহনে সুবিধার জন্যই ভারতের এ প্রস্তাব মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ। নামমাত্র মাশুলের বিনিময়ে এ গুরুত্বপূর্ণ দুটি নদীবন্দর ভিন্ন দেশের হাতে তুলে দেয়া নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে ব্যবসায়ী মহলেও।
তবে নৌপরিবহন সচিব দাবি করেছেন, চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকবে। তিনি বলেন, ভারতের তরফ থেকে রয়ালটি দিয়েই এ দুটি কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার প্রস্তাব এসেছে। খানপুর টার্মিনাল ব্যবহারের শর্ত জানতে ভারতের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর জবাব পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। তিনি বলেন, ভারত প্রথম ধাপে নারায়ণগঞ্জের খানপুর বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব চেয়েছে। কি শর্তে এবং কীভাবে এ বন্দর পরিচালনা করবে, তা জানাতে বলা হয়েছে। এসব বিষয় জানতে পারলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তিনি জানান, পানগাঁও বন্দর পরিচালনার আগ্রহও তাদের রয়েছে। নৌসচিব আরও জানান, চলতি বছরের শেষদিকে খানপুর বন্দরে কনটেইনার আনা-নেয়ার কাজ শুরু হতে পারে। পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল কার্যক্রম উপযোগী করে তোলা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ দুটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু হলে বাংলাদেশের পানগাঁও, খানপুর ও আশুগঞ্জের সঙ্গে ভারতের কলকাতায় সরাসরি কনটেইনারে পণ্য পরিবহন করা যাবে। কনটেইনার চালুর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি ও টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের প্রস্তুতি নিয়েছে নৌমন্ত্রণালয়। চলতি বছরের শেষদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তঃদেশীয় কনটেইনার চলাচল শুরু হবে। এখন শুধু সমুদ্রপথে ভারত থেকে কনটেইনারে পণ্য আমদানি-রফতানি করা হয়ে থাকে। আন্তঃদেশীয় কনটেইনার পরিচালনার জন্য গঠিত ভারত সরকারের কনটেইনার করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের (কনকর) প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে দেনদরবার করেছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ব্যবসার পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ২শ’ থেকে ৪শ’ ট্রাকে উভয় দেশের পণ্য আনা-নেয়া হয়। আর বছরে সমুদ্রপথে কনটেইনার আসে প্রায় ১১ লাখ। নারায়ণগঞ্জের খানপুর বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ব্যাপারে একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রস্তুতি নিতে কিছুটা সময় লাগবে। আশুগঞ্জে একটি মাল্টিপারপাস কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের কাজ চলছে বলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। পানগাঁও টার্মিনালের কাজ চলতি অর্থবছরে শেষ হওয়ার কথা। খানপুর বন্দর ২০ ফুট কনটেইনার চলাচলের উপযোগী হবে। পুরোদমে এ টার্মিনাল কার্যকর হলে বছরে ৬০ হাজার টিইউ পণ্য আনা-নেয়া করা যাবে। পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালটি হচ্ছে বেশ বড়। এখানে ৪০ ফুট কনটেইনার চলাচলের উপযোগী হবে বলে জানা গেছে। এখানে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টিইউ পণ্য আনা-নেয়া করা যেতে পারে।
এদিকে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গত বছর ৫ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের খানপুর বন্দর পরিদর্শনে এসে জানিয়েছিলেন, অচিরেই এ বন্দরটি ভারতকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে।
দৈনিক পত্রিকাসমূহ থেকে