ভিউফোর্ট
বৃটেইনের একটি গ্রাম। ছবির মতো, সাজানো-গোছানো; সুন্দর।
মেঘমুক্ত নীল আকাশের নীচে নরম মিষ্টি রোদে ঝলমল করছে গ্রামখানি।
শরতের বিকেল। কনকনে শীত। মৃদুলয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সাগরছোঁয়া ঠাণ্ডা বাতাস।
অসংখ্য ঝাউগাছ; দাঁড়িয়ে আছে পাইনের সারি। বাতাসের দোলায় দুলছে।
সারা বিশ্বের মধ্যে বৃটেইনের গ্রামগুলা সবচে’ আদর্শ।
আরামদায়ক জ্যাকেটের নিচে সস্থিদায়ক উষ্ণ পরিবেশ।
একটানা ঝিরিঝিরি প্রবাহিত সমীরণের স্পর্শ ভাল লাগছে।
দাঁড়িয়ে আছি বাসস্টপে। এভরি কুয়ার্টার পাস অভ এন আওয়ার নির্দিষ্ট ‘বে’ তে এসে দরজা খুলে দেবে স্টেইজকোচ। এরই অপেক্ষা করছি। এখন বিকেল প্রায় চারটা। ঠিক পনের মিনিট পরে আসবে বাস।
অদুরে পার্কে ফুটবল নিয়ে মেতে আছে কিছু স্থানীয় ছেলেমেয়ে। তবে কোন হই-হুল্লোড় নেই। পারতপক্ষে এরা শব্দ করে না। শীতের কারনেই হোক বা অন্য কোন কারনে এদেশের মানুষ মুখ খুলে না।
অবশ্য পেটে মদ পড়লে ভিন্ন কথা। তখন কি বলছে না বলছে তার আর কোন হুশ থাকে না। কথা বলবে, নাচবে , কুদবে। মদের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকবে।
এমনিতে চুপচাপ থাকলেও মাঝেমধ্যে মুখ খোলে তারা। তবে যা বলে অত্যন্ত হিসেব করে। যত কম শব্দে পারা যায় কথা শেষ করে। হঠাৎ দূর থেকে হাত তুলবে, হাই? উত্তরে আপনি বললেন, হ্যালৌ। ব্যাস এটুকুই। তাছাড়া একেবারে সামনা সামনি পড়ে গেলেও মাটির দিকে চেয়ে চেয়ে চলে যায়।
এই ছোকরাগুলো যদি কখনো পাশে ভিড়ে তাহলে ধরে নিন লক্ষণ ভাল না।
গলা খাঁদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করবে; 'হায়া ডুড! ! হেভিউ গটা ফাগ?'
'দোস্ত ! তোমার কাছে সিগারেট হবে?'
হওয়ার প্রশ্ন-ই আসে না। এদেরকে সিগারেট বা লাইটার দিয়েছেন তো মরেছেন।
এরা আন্ডার এইজড। দোকান থেকে সিগারেট কিনতে পারে না। এলাউড না। যে কোন দোকানে গিয়ে সিগারেট চাইলে সাথে সাথে আইডি চাইবে। ১৮ বৎসর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সিগারেট কিনতে পারবে না। কোন দোকানি দেবে না। দোকানি যে খুব ভাল; এই জন্য না। দেবে না কারন, এরা সিগারেট টানছে দেখলে পুলিশ ধরবে। তারপর জিজ্ঞেস করবে এই সিগারেট তোমাকে কে দিয়েছে বা কোন দোকান থেকে কিনেছ কিংবা কে তোমাকে কিনে দিয়েছে।
পুলিশের কাছে এই বাচ্ছাগুলো সঠিক কথা বলবে। তারপর একজন পুলিশ কনস্টেবল আপনার খেদমতে নিয়োগ হয়ে যাবে। আপনার বাসায় আসবে , ফোন করবে , কাগজপত্র রেডি করবে… ইত্যাদি যা যা প্রয়োজন নিস্টার সাথে আঞ্জাম দেবে। নিশ্চিত থাকতে পারেন; এ ব্যাটা আপনাকে হাইকোর্ট না দেখিয়ে বিশ্রাম নেবে না। কার ঠেকা পড়েছে এই ঝামেলা পোহানোর। এতএব সিগারেট না দিয়ে যেকোন কায়দায় এড়িয়ে যান। কিভাবে এড়াবেন সেটা আপনাকেই বের করতে হবে।
বাচ্ছাদের খেলা দেখা উদ্দেশ্য না। আজ ছুটির দিন। দাঁড়িয়ে আছি বাসস্টপে । আভাগাভানি যাব। এখান থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে। ইউরোপের বিখ্যাত টৌরিস্ট স্পট। দিনরাত ভিড় লেগে আছে, শত শত পর্যটক। ওখানে আরো অনেক কিছুর সাথে আছে চোট্ট একটি পাহাড়ি নদী। টলটলে পানি এত পরিষ্কার যে নদীর নীচ পর্যন্ত দেখা যায়। দেখা যায় খেলারত মাছের ক্রীড়া। খুব-ই সুন্দর মৃদু খরশ্রোতা একটি নদী। নাম ব্লাকওয়াটা'। পারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সরকারি পরিচর্যায় সযত্নে লাগানো দেশি বিদেশি জাতবেজাতের গাছ। এই গাছগাছালির নীচে বসার জন্য আছে মনোরম ব্যবস্থা। মৃদু হিস হিস শব্দের অনুরণন তুলে পাইনের সারি। পাহাড়ি নদীর তীরে বসে বিকেলটা পার করে দেয়ার অনুভবই আলাদা।
দূরে মোড় নিয়েছে বহুরঙ্গা স্টেইজকোচ। অপেক্ষমাণ মানুষেরা কিউ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। স্টপে আসতে না আসতেই খুলে গেল দরজা। লাইন ধরে নামছে মানুষ। সুশৃখল। নিয়ম মানা যেনো ধর্মের মতো। যেখানে যে নিয়ম তা সবাই মানে। আর না মানলে পুলিশে মানায়। ফাইজালামি প্রতিরোধে নিয়োজিত আছে অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা।
আমার সামনের সবাইকে আগে উঠতে সুযোগ দিয়ে সবশেষে উঠলাম আমি। ১০ পাউণ্ডের একটা নৌট বাড়িয়ে ধরলাম ড্রাইভারের দিকে। রিটার্ন টিকেট চাই। একটা রিটার্ন টিকেটের দাম পড়বে সাত পাউণ্ড আশি পেনি। ডেস্টিনেইশান বাটনে চাপ দিলেই টিকিট সহ ভাংতি টাকা ফেরত দেবে মেশিন। টাকাটা হাতে নিয়ে মেশিনে চাপ দিলো ড্রাইভার এবং জীবনে এই প্রথমবারের মতো অবাক হয়ে দেখলাম টিকিট দিতে পারছে না মেশিন। কাজ করছে না এর মেকানিজম। আমারচে’ দ্বিগুণ অবাক হয়েছে ড্রাইভার। কারণ বাটনে চাপ দিলেই ঘটনা ঘটে এটাই সে দেখে এসেছে সচরাচর। সে আবার চেষ্টা করলো কিন্তু না, বিধি বাম। কিছুতেই আর কাজ করবে না এই মেশিন।
একেই বলে প্রকৃত উভয় সংকট। টিকিট ছাড়া সে কিছুতেই যাত্রি নিতে পারে না। আবার অপেক্ষারত কোন যাত্রিকে সে ফেলেও যেতে পারবে না। এই চক্র থেকে ড্রাইভারকে বেরুতে হবে এবং সেটা খুব দ্রুত। কারণ ঠিক সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে ঠিক সময় মতো ছেড়ে যেতে হবে। কোন কারনেই রাস্তায় স্পীড লিমিট ভঙ্গ করা যাবে না। যেখানে তিরিশ মাইল সেখানে তিরিশ মাইল এবং যেখানে চল্লিশ মাইল সেখানে চল্লিশ মাইল স্পিডেই গাড়ি টানতে হবে। অন্যতায় চাকুরি যাবে, ফাইন খাবে এমনকি বছর দুয়েকের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্সটি হারাতে হতে পারে।
ড্রাইভারের নাকে চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে। এই প্রথম দেখালাম ডিউটিরত অবস্থায় ড্রাইভার তার পাইলট কেবিন থেকে নেমে এল। গিয়ে দাঁড়াল ফুটপাতে। সম্ভবত যোগাযোগ করল তার লোকাল অথরিটির সাথে। লোকাল অথরিটি হয়ত যোগাযোগ করল কেন্দ্রীয় অথরিটির সাথে। কেন্দ্রীয় অথরিটি কি করল কে জানে। নির্জন ফুটপাতে কিছুক্ষণ পায়চারি করল বেচারা ড্রাইভার। বেজে উঠল তার হাতের ডিভাইস। কিছুক্ষণ আলাপ সেরে ফিরে এল তার কেবিনে। টেনে বন্ধ করল কাঁচের দরজা। আমারদিকে দূঃখিত চোখে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত জানালোঃ
:তুমি বিনা টিকিটে আমার সাথে যেতে পারবে।
: মানে?!
: মানে তোমার টিকিট লাগবে না।
: যদি টিকিট চেকার উঠে?
উত্তরে কিছুই বলল না। ভাবলেশহীন চোখে একবার তাকালো টাকার দিকে আরেকবার বিগড়ে যাওয়া মেশিনের দিকে তারপর ছেড়ে দিল গাড়ি।
আসলে টিকিট চেকার উঠলে ড্রাইভারের করার কিছুই থাকেনা। ড্রাইভারের সাথে টিকিট চেকারের কোনো কথাই হয় না। টিকিট ছাড়া যাকে পাবে তার ছবি তুলে লেমিনেটিং করে ঐ গাড়ির দরজায় সেটে দেবে। ছবির নিচে লিখা থাকবে কোনদিন কবে কোথায় ইনি এই অপকর্মটি করেছিলেন আর তার কত ফাইন হয়েছিলো আর কয়দিন জেল খেটেছিলেন ইত্যাদির বিস্তারিত ফিরিস্তি। আপনি রাতারাতি ক্রিমিনাল খ্যাতি পেয়ে যাবেন। মাফ চাই; টিকেট ছাড়া গাড়ি চড়ার দরকার নাই।
পিঠে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বৃদ্ধা এক মহিলা। যথাসাধ্য লিপ্সটিক ঘষেছে ঠোঁটে। বেমানান লাগছে দেখতে তবে মিটিমিটি হাসছে।
: কি ব্যাপার?
: হ্যাপি ডেইজ বাছা।
:
: May God bless you, my son.
এদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অদ্ভুত। পথেঘাটে যদি টাকা বা অন্যকিছু পড়ে থাকতে দেখে ভীষণ খুশি হয় তারা। মনে করে গড আজ তার প্রতি প্রসন্ন। টাকাটা তুলে নিয়ে মুছকি হাসবে। তারপর পকেটে রেখে দিয়ে গডকে ধন্যবাদ দিবে। 'হ্যাপি ডেইজ' বলে নিজেকে নিজেই চাপড়ে দিয়ে গন্তব্যের দিকে হাটা ধরবে। এই মহিলা ভেবেছে আজকে আমার 'হ্যাপি ডেইজ!' যেহেতু টিকেট লাগছে না। গড নিশ্চই আমার প্রতি আজকে অতি সুপ্রসন্ন।
ছুটছে স্টেইজকোচ- X-31. ডুয়াল ক্যারিজওয়ে পেরিয়ে মোটরউয়েতে পড়ল। সিটে বসেই মূর্তি বনে গেছে একেকটি মানুষ। কমলা রঙয়ের সিটের সাথে শাদা রংয়ের নিশ্চল মূর্তিগুলো যেন আসলে আলাদা কিছু না। সিটেরই একটা অংশ। অধিকাংশই কানে গুজে দিয়েছে এয়ার ফোন, বাকীরা কেউ বই বা পত্রিকা বা ম্যাগাজিন পড়ছে কেউ বা তাকিয়ে আছে কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে আর না হয় এমনিতে ঝিম ধরে আছে। গাড়ি চুটছে কি ছুটছে না বুঝা যায় না। বাইরের দিকে না তাকালে মনে হয় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আসলে যতক্ষন মোটরয়েতে থাকবে ততক্ষণ ছুটতেই হবে। ব্রেইক করার নিয়ম নেই। আপনি ব্রেইক করতে পারেন না।
একসময় মোটরউয়ে ছেড়ে দিল X-31. বিশাল জংগল পেরুল কিছুক্ষণ। তারপর পড়ল খোলা মাঠ। খোলা মাঠের দুই ধারে ভেড়ার খামার। ছোট খাট কয়েকটি গ্রাম ও গ্রাম্য বাজার পেরিয়ে... অবশেষে খনিজ সম্পদরে অফুরন্ত উৎস আভাগাভানি।
না কোন টিকিট চেকার উঠেনি। তারপরেও নেমে যাবার আগে ড্রাইভারের
সামনে বাড়িয়ে ধরলাম টাকাটা। দেখ কিছু করতে পার কিনা। বেচারা পাংশু মুখে একবার তাকালো টাকার দিকে আরেকবার বিগড়ে যাওয়া মেশিনের দিকে তারপর চোখ মেলে দিলো সামনে। কিছুই বলল না।
টিকিট দিতে না পারলে টাকা নেয়ার অধিকার তার নেই। এটাই আইন।
পা রাখলাম মাটিতে।
আহ্ আভাগাভানি। ইউরোপের বিখ্যাত টৌরিস্ট স্পট!
*** // ***
Written by and © Baab Ul Habib
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৩