somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্নে দেখা "ছেঁড়া দ্বীপ।"

১০ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘড়ির কাটা ছ’টা ছাড়িয়ে। ঘুম ভাঙলো সমুদ্রের গর্জনে। কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করে জানালার কপাটখানা একটু সরিয়ে নিলাম। প্রচন্ড হিম শীতল ঠান্ডায় শরীর কেপে উঠলো। মনে হচ্ছিল ঢেউ গুলো সোজা মিরর জানালায় আছড়ে পরছে।



ভোর ছটা বেজে সাত মিনিট। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে একে একে সবাই ফজরের নামাজ সেরে ফেললাম। হোটেলের ইবাদাত খানায় নামাজ পড়ে অনেকেই রুমে ফিরে কম্বল মূড়ি দেয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কম্বল মূড়ি দেয়ার প্রতিযোগিতায় বাবু ভাই সবার চেয়ে এগিয়ে। অথচ গতকাল রাতে বীচে হেটে হেটে তিনিই গলা উঁচু করে চেচিয়েছেন,- “ফজর পড়ে যারেই ঘুমোতে দেখা যাবে তাকেই ঘুম থেকে তুলে এনে সোজা নোনা জলে চুবানো হবে। কোনো এক্সকিউজ গ্রহণযোগ্য নয়।”

অভি- ভাই গায়ে শাল পেছিয়ে অনেকক্ষণ ধরেই হাত টেনে চলছেন। সকালের সমুদ্র দেখার লোভ তিনি কিছুতেই সামলাতে পারছেননা। রাতের কালিমা কেটে ততক্ষণে সমুদ্রের ওপার প্রান্তে সূর্যোদ্বয়ের লালিমা ভর করতে শুরু করেছে। সমুদ্রের নীল আর আকাশের লাল- এ’দু মিলেমিশে এক আনকোরা প্রকৃতির জন্ম দিয়েছে। গাড় ঘুরিয়ে জানালার বাহিরে সমুদ্রের পাড়ে চোখ পড়লো। বিরক্ত হয়ে অভি ভাই শাল পেছিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। খালি পায়ে হাটছেন তিনি। কী অনবদ্য এক দৃশ্যের অবতারণ! তুমুল হাওয়ায় তার শালটা উড়ছে। আমিও অন্য সবার উপর বিরক্তি থুবড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তারা ঘুমোতে এসেছে, ঘুমোক!

অভি এবং আমি হাটছি। প্রচন্ড হিমশীতল বাতাস বইছে। বাতাসের বেগে পাঞ্জাবী এবং শালের নিয়ন্ত্রণ রাখা দায়। তবুও হাটছি! এই হেটে চলার অনুভূতি অন্য দিন গুলোর মত নয়। ততক্ষণে আমাদের ভবঘুরের দলে যোগ হয়েছে আরো দুজন। ইকবাল ভাই সাধারণত শাল পরেননা। এই মুহূর্তে তাকেও শাল পরিহিত দেখা যাচ্ছে। পেছন ফিরে দেখি মামুন ভাই কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে খালি পায়ে ধেয়ে আসছেন। চারজনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভোরের নীল সমুদ্র দেখে দেখে হাটছি। বাতাসের শাঁ শাঁ আর সমুদ্রের ছলাত ছলাত শব্দ গুলো প্রতিনিয়ত পাগল করে তুলছিল। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে সমুদ্রকে শুনাতে- “খোদা তোমার সৃজনশীলতার তুলনা নেই, সত্যিই নেই!”



পূব আকাশে সূর্যটা পুরোপুরি ভাবে আসন পেতেছে। হোটেলে ফিরে বাকিদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে ফটাফট বেরিয়ে পড়লাম। পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে এই দিনটিকে ‘ছেঁড়া দ্বীপ’ যাত্রার জন্য ঠিক করা হয়েছিল। হোটেলের বাহিরে ছোট্ট একটি খাবারের দোকানে আসন পেতে ওশাইন বোল্ট গতিতে সকালের নাস্তা সেরে ফেললাম। সেন্টমার্টিনে যে বিষয়টা বারবার বিরক্তির সঞ্চার করেছে সেটা হলো খাবারের উচ্চমূল্য। স্বাভাবিকভাবে সকল পর্যটন স্পটেই দ্রব্যমূল্য তুলনামূলক উর্ধ্বগতি হয়। কিন্তু এখানে তা উর্ধ্বগতি বললে ভুল হবে। দ্রব্যের স্বাভাবিক মূল্য হতে কয়েক গুন বেড়ে যায়। যাকগে! আমরা খাদ্য পিপাসার কাতরতা নিয়ে আসিনি এখানে; এসেছি ভ্রমণ পিপাসার কাতরতা নিয়ে। তাই খাবারের অসঙ্গতি গুলো তেমন ব্যাপারনা।

সর্বসম্মতিক্রমে বরাবরের মত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বর্তানো হলো সকলের আস্থা ভাজন আজিম ভাইয়ের উপর। তিনি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে চলছেন। চট্টগ্রাম থেকে বের হওয়ার পর হতেই তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস। সকালের নাস্তা সারতেই আমাদের ছেঁড়া দ্বীপ যাত্রার ব্যবস্থা করে ফেললেন। নয় জনের জন্য নয়টি সাইকেল। প্রায় দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা সাইকেল রাইড করে পৌঁছোতে হবে বাংলার সর্ব দক্ষিণ প্রান্ত ‘ছেঁড়া দ্বীপ’।

ছেঁড়া দ্বীপ বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু। দক্ষিণ দিকে এর পরে বাংলাদেশের আর কোনো ভূখন্ড নেই। সেখানে সেন্টমার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনবিশিষ্ট কয়েকটি দ্বীপ রয়েছে। যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে 'ছেঁড়াদিয়া' বা 'সিরাদিয়া' বলা হয়ে থাকে। ছেঁড়া অর্থ বিচ্ছিন্ন বা আলাদা, আর মূল দ্বীপ-ভূখন্ড থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন বলেই এ দ্বীপপুঞ্জের নাম ছেঁড়া দ্বীপ। প্রবাল দ্বীপ ইউনিয়ন সেন্ট মার্টিন থেকে ছেঁড়া দ্বীপ প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। দক্ষিণের বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক পাথর। দ্বীপের প্রায় অর্ধেকই জোয়ারের সময় সমুদ্রের পানিতে ডুবে যায়। এই এলাকাটি সরকারের ঘোষিত একটি 'পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’। এরকম এলাকায় ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানায় জমি কেনা, এমনকি কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ আইনত নিষিদ্ধ। সেন্টমার্টিনের একদম শেষে পৌঁছে ভাটার সময় সেখান থেকে হেঁটেই ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়া যায়। অবশ্য জোয়ারের সময় যেতে হয় লঞ্চে করে। (তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

শুরু হলো যাত্রা। সবাই সাইকেল হাতে পেয়ে আর লোভ সামলাতে পারলেননা। তড়িঘড়ি করে ছুটলেন। টিমের একজন যে রয়ে গেলেন এতে কারোই ভূরুক্ষেপ পর্যন্ত নেই। একা দাঁড়িয়ে অভির জন্য অপেক্ষা করছি। দশমিনিট অপেক্ষা শেষে সে ফিরে এলো। দুজন মিলে ছুটলাম। এতক্ষণে বুজি বাকি ছয়জন অনেকদূর চলে গেছে! ঘাটের কাছাকাছি আসতেই চোখে পরলো সবাই আমাদের অপেক্ষায় আছে। শুরু হলো স্বপ্নের যাত্রা।

প্রচুর রোদ। হাজার কিলো পথ পাড়ি দিয়ে বাতাস গুলো সোজা দ্বীপের পাড়ে আছড়ে পরছে। ভাটার সময় ঘনিয়ে আসছে। সকাল ৮টা বেজে ৫৫মিনিট। আজ ভাটার সময় দুপুর ১১টা। ভরা জৌস্নার সময় আকাশে তাকালে দিনের বেলাও চাঁদকে আবছা ভাবে দেখা যায়। এখনো দেখা যাচ্ছে। দিনের বেলা চাঁদ দেখাতে তেমন আনন্দ নেই। চাঁদের সাথে রাতেদের নিবিড় এক সম্পর্ক আছে। চাঁদটা ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে পৃথিবী আর চাঁদের মাঝে যে দূরত্ব রয়েছে; দুপুর ১১টায় সেই দূরত্ব আরো অনেকটা বেড়ে যাবে। চাঁদ আর পৃথিবীর এই কাছে আসা এবং দূরে যাওয়াই জোয়ার-ভাটার জন্ম দেয়। চাঁদের বিরহে পৃথিবী তার এই বিশাল জলরাশি থেকে কিছু পানি তুলে নেয়; আঁখিজলে ভাসাবে বলে। আমি এই নিয়মকে বলি বিরহ; আর বিজ্ঞান বলে চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাব!



বালিতে রাইড করা যতটা কষ্টকর হওয়ার কথা ছিল; ততটা ঠিক হচ্ছেনা। সমুদ্রের শান্তশিষ্ট ছোট ছোট ঢেউগুলো আমাদের পথটাকে মসৃণ করে দিচ্ছে। ঢেউ গুলো পাড়ের যে রেখায় এসে তাদের বিচরণের সমাপ্তি ঘটাচ্ছে আমরা ঠিক সেই রেখা ধরে আমরা চলছি। জলরাশি গুলো বালি গুলোকে ভিজিয়ে দিয়ে আমাদের জন্য সমতল পথ বানিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতির পিঠে ভর করে সাইকেলের টায়ার তার আপন গতিবেগে ছুটছে।

যোগাযোগ ব্যাবস্থাপনার দায়িত্বরত আজীম ভাই কত করে বললেন- সাগর পাড় ঘেঁষে বালি পথে না গিয়ে যাতে সড়ক পথ ধরে এগুই। কে শোনে কার কথা; সবার কথা হলো- সাগর দেখে ঢেউয়ের ছলাত ছলাত আর বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ কানে ভিড়িয়ে পথ চলবে সবাই। আজীম ভাইয়ের সিদ্ধান্তকে এক প্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বেরিয়ে পরা হলো। ভদ্র ভাবে যাকে বলা যায়- মন্ত্রীত্বের দুগালে চপেটাঘাত। এখন বুজুক মজা! আমরা বেরিয়েছিলাম ৮ঃ৩০ মিনিটে। এখন সময় ৯ঃ১৫ মিনিট। এই সময়তেই একেক জনের অবস্থা সাহারা মরুভূমির বেদুঈনদের মত। সবার শারিরীক বেহাল অবস্থা দেখে কী মায়া ইনা হচ্ছিল। সাগর পাড় ঘেঁষে ইয়া লম্বা লম্বা নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্রামের জন্য আদর্শ বলা চলে। হঠাত চোখ পরলো- টিম মেম্বার একজন কে পাওয়া যাচ্ছেনা। মামুন ভাই! পেছনের খা-খা বালুচরে তাকিয়ে আছি সবাই। কোনো পাত্তা নেই। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর দূর দিগন্তে কী যেনো দেখা যাচ্ছে। মামুন ভাই আসছেন! এত সময় কাটানোর পরও তার ফটোগ্রাফি শেষ হচ্ছেনা। শারিরীক কত অঙ্গভঙ্গিতেই না ছবি তুলছেন। তার ছবির চেয়ে আমার যত আকর্ষণ তার ছবি তোলার নানান স্টাইলের প্রতি। তার ছবিতে আমি আর্ট না পেলেও আমি তার ছবি তোলার স্টাইলে দারুণ আর্ট খুঁজে পাই। উনার ক্যামেরা হাতে নিয়ে বুজলাম ছবির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। ক্যামেরার নির্দিষ্ট shutter- এর অর্ধেকটা বোধহয় এখনই শেষ করে ফেলেছেন।



যাত্রা বিরতি শেষে আবার শুরু হলো সাইকেলের প্যাডেল ঘুরানো। পায়ের অবস্থা জঘন্য রকমের খারাফ। বালির উপর সাইকেল চালানো যে কতটা ভয়াবহ তা কারোই আর বুজার বাকি নেই। ঘড়ির কাটা ১০টা ছুঁই ছুঁই। ইতিমধ্যে দেড় ঘন্টা সময় গত হয়েছে। ছেঁড়া দ্বীপতো দূরের কথা; একটা চর পর্যন্ত চোখে আসছেনা। হঠাত পেছনে তাকিয়ে দেখি টিমের কেউকেই আর দেখা যাচ্ছেনা। বোধহয় তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে! প্যাডেল চাপা ছেড়ে সাইকেল থেকে নেমে দাড়ালাম। ৩/৪ মিনিট অপেক্ষার পরও তাদের ছায়া পর্যন্ত চোখে আসছেনা। আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই। কেউ না আসুক! আমি একাই যাবো!

আবার সাইকেলে চেপে শুরু হলো অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা। ভেতরে কিছুটা ভয়ও কাজ করছিলো। তারা না এলে আমার একার পক্ষে এই দ্বীপ ছেড়ে ছেঁড়া দ্বীপে উঠা কোনো ভাবেই সম্ভব না। ১০টা বেজে ১৫মিনিট। ঐ দূরে কী যেনো দেখা যাচ্ছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে আলাদা আরো কয়েকটি খন্ড খন্ড দ্বীপ। বুকে বল এলো। জোরে জোরে প্যাডেল চাপতে লাগলাম। যত কাছে যাচ্ছি দূরের দৃশ্যটা ছবির মত স্পষ্ট হচ্ছে।



১০টা বেজে ২৮মিনিট। সেন্টমার্টিন দ্বীপের একদম শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছি। এই মুহূর্তে এই দ্বীপ থেকে সামনের দ্বীপে শিফট হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। আজো ভাটা নামেনি। পুরো ভাটা আসতে আরো আধা ঘন্টা খানিক সময় লাগবে। একা একা কী করবো! সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আচানক পেছনে তাকিয়ে দেখি ধারণা ভুল। তারাও হাল ছাড়েনি। সবাই দল বেঁধে আসছে। তাৎক্ষনিক চেহারার কলুষতা পুরোপুরি ভাবে কেটে গেলো। মস্তিস্কের ভেতরে একটা গানের লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে। -"আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।"

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে সবার এক বাজে অবস্থা। প্রাকৃতিক নির্জাসই কেবল এর সমাধান দিতে পারে। শুরু হলো ডাব-ভোজ। অপেক্ষা সইছেনা আর। কিন্তু আজো ভাটা পরেনি। দু দ্বীপের সংযোগ স্থলে যে সরু পথ খানা রয়েছে তার উপর আজো গলা সমান পানি। কী করা! সিদ্ধান্ত হলো হেটে পার হবো। তাহলে সাইকেলের কী হবে…? কে শুনে কার কথা! সাইকেল শুদ্ধা নেমে পরা যাক। সবাই মিলে সাইকেল সহ নেমে পরলাম। কিন্তু হলোনা। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসতে হলো। এই ছেলে গুলাই নাকি আবার সাত সমুদ্র তের নদী সাতরে পার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। যত্তসব!



আমরা হাল ছাড়ার পাত্র নই। কিছু দূরে একটা নৌকা দেখা গেলো। মৃদু ঢেউয়ে হেলে দুলে নৌকোটা দুলছে। কী সুন্দরইনা দেখাচ্ছে! আমাদের দেখে মাঝি ভাই নিজেই এলেন। মাঝির সাথে দাম কষাকষি শেষে সিদ্ধান্ত হলো- সাইকেল সহ আমাদের পার করে দিবেন। একে একে সবাইকে পার করা হলো। শুরু হলো অন্য এক স্বপ্ন পথের যাত্রা। সামনে আলতাফ ভাই গান ধরেছেন-

“ওরে নীল দরিয়া,
আমায় দে রে দে ছাড়িয়া।”



স্বপ্নের ছেঁড়া দ্বীপ। স্বপ্নের চেয়েও ভিন্ন কিছু। খন্ড খন্ড কয়েকটা দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত দ্বীপটি। সাইকেলে চড়ে এই দ্বীপের প্রতিটা খন্ড মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছি। আর ভাবছি যে স্রষ্টার রুচিবোধ এত সুন্দর; সেই স্রষ্টা না কত সুন্দর।

ছেঁড়া দ্বীপে উঠেই নতুন এক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বালিতে সাইকেল কিছুতেই হাটছেনা। প্যাডেলে দু চাপ বসাতেই চাকা বালিতে ঢেবে যাচ্ছে। সেন্টমার্টিন থেকে এই পর্যন্ত পথটাতে আমরা সমুদ্রের ঢেউ ধরে ছুটছিলাম। ঢেউ গুলো আমাদের পথটাকে ভিজিয়ে দিয়ে চলার উপযোগী করে দিয়েছিল। কিন্তু এখানে তেমনটা ঘটছেনা। আমরা এখন চলছি দ্বীপের ঠিক মাঝখানটা ধরে। সূর্যের তাপমাত্রা আরবে উপকন্ঠের তাপমাত্রার প্রায় কাছাকাছি। মনে হচ্ছে যেনো সাহারা মরুভূমি তে বিচরণ করছি। বালির চাকচিক্যতায় চোখের দু রেটিনা ধাঁদিয়ে আসছে।



পূর্ণ ভাটা চলে এসেছে। ভাটার সময় এই তিনটে দ্বীপের একে অপরের মধ্যে আঁকাবাঁকা সরু পথের সৃষ্টি হয়। তখন একটি হতে অন্যটিতে অনায়াসেই যাত্রা করা যায়। এই মুহূর্তে আমরা অবস্থান করছি দ্বীপের তিন খন্ডের ঠিক মাঝের খন্ডে। সুন্দর দেখতে দেখতে ক্লান্ত সবাই। সুন্দর দেখে ক্লান্ত হতে পারার অভিজ্ঞতা টা আগে কখনো ছিলনা। এবারই প্রথম। ক্লান্তিতা সারাতে হবে। সমাধান একটাই। ডাব! আমাদের সবার দেহের অঙ্গ গুলো একে একে দুর্বল হয়ে পরছে। এক গ্লাস ডাবের পানি নেতিয়ে পরা দেহের অঙ্গগুলোকে পুনরায় সচল করতে যথেষ্ট।

বসতিহীন এক দ্বীপ। টিন আর বাঁশের তৈরি কয়েকটি দোকান ছাড়া কোনো স্থাপনারই চিহ্ন নেই। স্থানীয়রা পর্যটকদের সুবিধার্থ্যেই দোকান গুলো বেধেছে। দোকান গুলোতে কেবল মিনারেল ওয়াটার, ডাব এবং সামান্য কিছু শুকনো খাবারই পাওয়া যায়। প্লাস্টিকের চেয়ারে আসন পেতে আমাদের বিশ্রাম এবং ডাব-ভোজ চলছে। সবাই ডাবের মুখে চুমুক দিচ্ছে এবং নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দিগন্তে তাকিয়ে আছে। আমি সবার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছি। তাদের চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা এবং ভয় ভর করেছে। এই অনবদ্য প্রকৃতি দেখে স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ভয়! ভয় কেনো? এই ভয়ের পেছনের রহস্য কী?

মাথার ভেতর মহা প্রলয়ংকারী সেই দিবসের একটি চিত্র ভেসে উঠছে। মস্তিষ্কের কুঠোরে নিউটনের তৃতীয় সূত্রখানা ঘুরপাক খাচ্ছে। “প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে৷“ মৃত্যু নামক বিপরীত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি জন্মেরই সমাপ্তি ঘটে। জন্ম লগ্নের আয়োজন খানা যতটা আনন্দের হয় ঠিক ততখানা বেদনা বিদূর হয় মৃত্যুলগ্ন। এটাই নিউটনের সূত্র।

স্রষ্টার এই সু-নিপুণ সৃষ্টি কর্মের বিপরিত প্রতিক্রিয়াটা কতটা ভয়ঙ্কর হবে; ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। এই বিশাল সমুদ্রের তলদেশ কে সেদিন ফাটিয়ে দেয়া হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচ দিয়ে নির্গত হচ্ছে ভয়াবহ লাভা স্রোত। সেদিন সমুদ্রের অথৈ জলরাশি ও ভয়ঙ্কর লাভা স্রোত এক হয়ে তাদের মাঝে বিচরণ করা অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের মিলন ঘটাবে। শুরু হবে বিষ্ফোরণ। সমুদ্র গুলো একে একে ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠবে। উপরের আকাশ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে ঝরে পরবে। ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর এবং ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য!

ঘড়ির কাটা সাড়ে এগারটা ছুঁই ছুঁই। সবার মাথায় হাত। ঠিক ১২টায় হোটেল ‘চ্যাক আউট’ করতে হবে। হাতে সময় মাত্র ত্রিশ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে হোটেলে ফেরা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তবুও যত দ্রুত সম্ভব পৌছোতে হবে। দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলোকে সতেজ করে আবার শুরু হলো সাইকেলের প্যাডেল চাপা। আসার সময় যেই পথটা আমাদের নৌকো করে পার হতে হয়েছিল সেই পথটাতে এখন আর পানি নেই। ভাটার দরুণ সেখানটায় ভেজা সরু বালি পথ তৈরী হয়েছে। কী সুন্দরইনা দেখাচ্ছে! বারবার অবাক হচ্ছি। আমার স্রষ্টার রুচিশীলতা কতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলে এই নিদারুণ সৃষ্টিকর্মের জন্ম দেয়া যায়।




দুপুর তিনটেয় আবার শিপ ধরতে হবে। হাতে সময় যথেষ্ট অল্প। সমুদ্র তীর ধরে কিছুটা পথ আসা হলো। যতদ্রুত সম্ভব হোটেলে ফিরতে হবে। এই বালি পথ ধরে চললে খুব মসিবত পোহাতে হবে। অবশেষে কিছুদূর চলার পর সড়ক পথের সন্ধান মিললো। চিকন আঁকাবাঁকা গ্রাম্য মেঠো পথ। শক্ত মাটির রাস্তা পেয়ে সবার পায়ের জোর যেনো কয়েক গুন বেড়েছে। পেছনে তাকানোর সময় নেই। দে ছুট! আচানক সামনে তাকিয়ে দেখি কেউই সামনে নেই। আমাকে ছাড়িয়ে তারা অনেক পথ এগিয়ে। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মামুন ভাই ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আসছেন। বরাবরের মত গলায় ক্যামেরা ঝুলছে। দুজন মিলে কিছুটা পথ আসার পর নতুন এক দৃশ্যের অবতারণ হলো। সারি সারি তরমুজের ফলন। তাজা ফলের বিশাল ফলন দেখে কিছুতেই আর লোভ সামলানো গেলোনা। মামুন ভাইতো এক প্রকার হাতে পায়ে ধরে বসলেন। সাইকেল রেখে ঝটপট নেমে বসলাম। ততক্ষণে তরমুজ ক্ষেতের মালিক এসে হাজির।

দুজনের স্বাদ মিটিয়ে তরমুজ-ভোজ হলো। দেহের প্রতি অঙ্গে এক স্বর্গীয় সুখ বয়ে যাচ্ছে। বাকিরা বোধহয় এতক্ষণে হোটেলে পৌছে গিয়েছে। চ্যাক আউট-ও বোধহয় সেরে ফেলেছেন। দুজনের সাইকেল নিয়ে আবারো যাত্রা শুরু হলো। ভেতরে কত অলিক ভাবনাদের উড্ডয়ন হচ্ছে। মনে হচ্ছিল- এই যাত্রার কোনো উদ্দেশ্য নেই। নেই কোনো তাড়া। এই ত্রিমাত্রিক জগত থেকে অবসর নিয়ে আমি আরোহণ করছি এক শূন্য জগতে। পৃথিবিটা এত সুন্দর!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:২১
৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামপন্থী রাজনীতির বয়ান এবং জামাতের গাজওয়াতুল হিন্দ-এর প্রস্তুতি

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০


গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও, ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শের বিপরীতে "গোরা" নামে একটি চরিত্র তৈরি করেন। গোরা খুব কট্টরপন্থী হিন্দু যুবক। হিন্দু পরিচয়ে বড় হলেও, আসলে সে আইরিশ পিতা-মাতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তুমি নেই, তাই শূন্য লাগে

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪৬

তোমার চলে যাওয়ার পর
ঘরে আর আলো জ্বালাই না,
অন্ধকারে নিজের মতো করে
সবকিছু চিনে নেই।

জানো, আজ সকালে চা বানাতে গিয়ে দেখলাম
চিনি শেষ,
ভাবলাম ঠিক আছে,
মিষ্টি না থাকলেও চা হয়।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ
তোমার মতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫ আগস্টের পর তো কিছুই বদলায়নি

লিখেছেন মুনতাসির, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৯

অনেকেই বলেন, ৫ আগস্টের পর তো কিছুই বদলায়নি। এই কথাটার সূত্র ধরেই এগোনো যায়। ৫ আগস্টের পর আমাদের কোন কোন পরিবর্তন এসেছে, সেটাই আগে দেখা দরকার। হিসাব করে দেখলাম, বলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে উড়ে গেল মাদ্রাসার দেয়াল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৯



ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছেন।

বিস্ফোরণে মাদ্রাসার একতলা ভবনের পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষের দেয়াল উড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তেল আর জল কখনো এক হয় না......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩৫



জুলাই ছিলো সাধারণ মানুষের আন্দোলন, কোন লিডার আমারে ডাইকা ২৪'এর আন্দোলনে নেয় নাই। কোন নেতার ডাকে আমি রাস্তায় যাই নাই। অথচ আন্দোলনের পর শুনি আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড নাকি মাহফুজ। জুলাই বিপ্লবের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×