আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে যখন প্রথম আমার মাথায় সম্পূর্ণ ইসলামপন্থী মুসলমান থেকে অবিশ্বাসী হওয়ার ইচ্ছা জাগে তখন নিজেই খুব অবাক হই। প্রতিনিয়ত ইচ্ছাটা শক্তিশালী হতে থাকে আর আমি পড়ে যাই একটা অস্থির অবস্থার মাঝে। এরপর একদিন ভাবতে বসি।
ভাবতে বসি আমার মনে এমন ইচ্ছা জাগার কারণ খুঁজে বের করতে। প্রথমদিকে শুধু মাথায় আসে ইসলামের মূল বানীর কিছু অসঙ্গতি আর এর কুসংস্কার মিশ্রিত প্রায়োগিক বাস্তবতার কথা। এরপরে খুঁজতে শুরু করি ইসলামের প্রত্যেকটা নীতির জাগতিক যৌক্তিকতা। খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে আমার মনে হয় বা বুঝতে পারি ইসলামের সবগুলি নীতি তৎকালীন সমাজের অসঙ্গতি ঠেকানোর জন্য সম্পূর্ণ উপযোগী ছিলো এবং অবশ্যই যৌক্তিক ছিলো। আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায় ইসলাম যৌক্তিক এবং জাগতিক ধর্ম।
এরপরে আসে তাহলে আমি মানতে পারছি না কেন সেটার ব্যাখ্যা।
আমি কয়েকটি ব্যাখ্যা নিজের মাঝে খুঁজে পাই যার ধারাবাহিকতা ছিলো অনেকটা এমন-
* ইসলাম ধর্ম জাগতিক।
* এটা শুধুই ওই যুগের জন্য।
* মূলত আরব সমাজের উপযোগী।
* উশৃঙ্খল মানুষদের সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসলাম উপযুক্ত।
* নারীদের মানুষ মনে না করা সামাজিক পরিবেশে তাঁদের সম্মান বাড়িয়ে দুনিয়ার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ সামাজিক জীবের স্বীকৃতি দান করা।
* ইসলামকে বিশ্বব্যাপী ছড়ানোর ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুনিয়ার সাধারণ এবং জাগতিক রাজনীতির ব্যবহার।
* ইসলামে উল্লেখিত সকল বাস্তবিক ইতিহাসের কুরআন ছাড়াও বিভিন্ন পুঁথিতে এবং লোকগাথায় ঐতিহাসিক বর্ণনা থাকা।
* পুরাতন ধর্মগুলোকে ইসলামের পূর্বতন হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে সব ধর্মের সংস্কৃত রূপ হিসেবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করে একটা সামগ্রিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করা।
* অন্যান্য শক্তিশালী এবং প্রচুর অনুসারি সম্বলিত ধর্মগুলোর প্রচারকদের মহান বলে স্বীকৃতি দেয়া।
* এই ধর্ম কোনদিন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা সম্ভব নয় বলে স্থায়ী রায় দেয়া।
* পুরাতন ধর্মগুলোর কিছু যাজকদের দ্বারা নতুন কোন ধর্ম প্রচারক ভবিষ্যতে আসবে এমন ঐতিহাসিক সম্ভাবনার স্বীকৃতি প্রদান করানো বা তাঁরা স্বীকৃতি দিয়েছেন এমন বক্তব্য প্রচার করা।
* ইসলামে উল্লেখিত সকল পরকালিন শাস্তি এবং পুরস্কারের বিষয়গুলো আরবদের জন্য উপযুক্ত হওয়া।
* সকল পবিত্র স্থান এবং বিষয়গুলোর আরব কেন্দ্রিক এবং তৎকালীন ধর্ম প্রচারকের হাতের নাগালে হওয়া।
* সর্বোপরি ইসলামের সকল বিষয়গুলির বাস্তবিক হওয়া অথচ এটাকে সরাসরি অলৌকিক বলে প্রচার করা। যদিও অলৌকিক বিষয়গুলোর উপস্থিতি শুধু প্রচারকের একার দৃষ্টি এবং অনুধাবনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকা।
* মূল প্রচারকের কোন কাজ ধর্মের সার্বজনীন হিসেবে প্রচারিত নীতিগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক হলে স্রষ্টার ব্যক্তিগত ইচ্ছা বলে প্রচার করা।
* মূল প্রচারককে ভুলের ঊর্ধ্বে রাখা।
* কঠোর এবং সমাজে বহুকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলোকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সময় নেয়া এবং ধাপ পদ্ধতি গ্রহণ করা।
* সহজ ব্যক্তিগত নীতি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত দিকনির্দেশনা প্রদান করা হলেও প্রত্যেক বড় পরিবর্তনের আগে মানুষকে ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ এবং সময় দেয়া।
* অতীতের সকল কাজের ধারাবাহিকতার সুত্র দেখলে যে সকল কাজকে তখনো চলমান পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার অংশ বলে মনে হচ্ছিলো সেগুলোকে সময়ের অভাবে সেখানেই থামিয়ে দেয়া।
* এমনকি ইসলামের শাস্তি এবং উপহারের পুরো বিষয়টা পরকালিন হিসেবে প্রচার করা এবং অনেক শাস্তি এবং পুরস্কারের ব্যাখ্যাগুলোর মাঝে অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া। (যদিও কিছু ইহকালিন শাস্তির কথাও বলা হয়েছে, তবে সেগুলির ব্যাখ্যা খুব সহজ এবং বাকিগুলো অপ্রমাণিত।)
* সেই কাজগুলোকেই পুণ্যের কাজ বলা যা সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা করে এবং উশৃঙ্খল কাজকেই পাপের কাজ হিসেবে প্রচার করা।
* শাস্তির ভয় এবং পুরস্কারের লোভ দুটোকেই সম্পূর্ণ বাস্তবিক স্থানীয় সামাজিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে প্রচার করা। (আগুনে পোড়ানো, সাপের কামড়, হুর দেয়া, মিষ্ট ফল এবং অট্টালিকা দেয়া)
এই সকল বিষয়গুলির কথা মাথায় শক্তভাবে গেথে যাওয়ায় ইসলামকে শুধুই একটা স্বাভাবিক ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের সামগ্রিক নীতিসমুহের সমষ্টি ছাড়া কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো ইসলাম যেহেতু স্বাভাবিক একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম সেহেতু এর পালন করা সমাজের জন্য উপকারি হলেও অলৌকিক নয়, তাই আমি এগুলি মানবো না। হ্যাঁ, যেহেতু এই সংস্কৃতির অনেক অংশই এখনও সমাজে কার্যকর ভুমিকা রাখতে সক্ষম, তাই এর প্রায়োগিক বিষয়গুলোকে আমি পালন করতে রাজী থাকলেও এর শাস্তির আর পুরস্কারের নির্ধারক উপাসনা পদ্ধতি আমি কোনভাবেই পালন করবো না। যদিও আমার ব্যাখ্যায় এই উপাসনা পদ্ধতি রাখা হয়েছে শুধুই মানুষকে ইসলামের নীতি পালনের কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যাতে তাঁরা নিয়ম মেনে চলে এবং সমাজ স্থিতিশীল থাকে। যেহেতু আমি অন্যায় করছি না বা করার ইচ্ছাও মনে নেই, তাই কাল্পনিক শাস্তির ভয়ে নিয়মিত নিজেকে ভীত করে ইসলামের নীতি পালনে আন্তরিক থাকার জন্য এই উপাসনা পদ্ধতি পালনের আমার দরকার নেই।
সংক্ষেপে নিজের তৎকালীন বিশ্বাসের বর্ণনা দিলাম যা এখনও আমার মাঝে স্থায়ীভাবেই গেঁথে আছে। কিন্তু কিছুদিন পরে মাথায় অন্য একটা ভাবনা এলো। আমি না হয় ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করে, অনেক ভাবনা-চিন্তা করে এমন সিধান্তে পৌঁছেছি, কিন্তু আমার দেখা অনেক মানুষ যারা অভিজ্ঞতা থেকে যতই জ্ঞানী হোক- শিক্ষা বা গবেষণার কাছে একটু ঘেঁষেও দেখেনি কোনদিন, তাঁরা কেন ইসলাম থেকে বিচ্যুত হচ্ছে বা নাস্তিক হচ্ছে? যারা না জেনেছে ইসলাম সম্পর্কে, না জেনেছে অন্য ধর্ম সম্পর্কে আবার না জেনেছে ঈশ্বর সম্পর্কে, তাঁরা কেন ইবাদতকে অস্বীকার করছে? তাঁরা তো সামাজিকভাবেই কোন না কোন ধর্মকে গায়ে মেখেই জন্ম নিয়েছে, তবে কেন বিনা কারণে তাঁদের এমন পাল্টে যাওয়া?
পেলাম, সেটার ব্যাখ্যাও নিজের মতো করেই পেলাম। আমি নিজে যখন প্রথম বিচ্যুত হয়েছিলাম সেটার মূল কারণ ছিলো ধর্মীয় শৃঙ্খলে আটকে না থাকার ইচ্ছা এবং শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা। ঠিক এই কারণেই মানুষ প্রথমে না জেনেই বিচ্যুত হয়, পরে হয়ে যায় অভ্যস্ত এবং শেষে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আমার মনে আছে আমার দাদা একটা লাঠি রাখতেন তাঁর কাছে, যেটা মূলত ছিল একটা বাঁশের অগ্রভাগ। তাঁর ভাষ্যমতে নিজের ১৫-১৬ বছর বয়সে একদিন তাঁর এক চাচাকে বাঁশ কাটতে দেখে এই বাঁশের মাথাটা সংগ্রহ করেন। সাধারণ লাঠি, লম্বায় আড়াই হাত হবে, কিন্তু এটা ছিলো তাঁর প্রিয়। লাঠিটা সবসময় তাঁর খাটের কাছেই থাকতো। আমার বয়স যখন ৭-৮ বছর আর দাদার বয়স ৯২-৯৩ বছর, তখন সে আমাকে বলে- ওই লাঠির মাঝে তাঁর প্রাণ আছে। লাঠিটা ভেঙ্গে গেলে সে মারা যাবে। (আমার বাবা আমার দাদার পঞ্চম সন্তান এবং আমি আবার বাবার পঞ্চম এবং শেষ সন্তান)। যাই হোক, এই ঘটনার কিছুদিন পরে (এক-দেড় বছর) দাদা মারা যান। দাদার মৃত্যুর কয়েকদিন পরে কথাটা মনে পড়ায় আমি দৌড়ে দেখতে যাই লাঠিটা ঠিক আছে কি না। দেখি, লাঠিটা ঘুণে ধরেছে এবং আংশিক ভেঙ্গে গেছে। এখন আমি জানি লাঠিটা এতো বছর ঘুণে না ধরলেও হঠাৎ কী কারণে ঘুণে ধরতে পারে বা হঠাৎ লাঠিটা কেনই বা ভেঙ্গে গেলো বা কী কী কারণ এর পিছনে থাকতে পারে। কিন্তু ওই ৮ বছর বয়সে আমি বিশ্বাস করেছিলাম দাদার মৃত্যুর পেছনে রয়েছে ওই লাঠির ভেঙ্গে যাওয়া।
আমি এখন এটাও বলতে পারি, ওই লাঠিটা যদি আরও দশ বছর আগেই ভেঙ্গে যেতো এবং দাদা সেটা দেখতেন, তাহলে তিনি হয়তো তখনই মারা যেতেন। এটা বিশ্বাসের বিষয়। দাদা সাধারণ লাঠিটাকে ব্যবহার করতে করতে ওটাকে নিজের অংশ বলে বিশ্বাস করেছিলেন। এভাবেই প্রথমে যুক্তিবিহীনভাবে নিজের খেয়ালের কারণে অনেকে ধর্মকে অস্বীকার করলেও এক পর্যায়ে তাঁর মাঝে এটা বদ্ধমূল হয় যে- সে নাস্তিক। ঈশ্বর নেই, ধর্ম মিথ্যা। আবার ধার্মিকের বেলায়ও তেমন। তাঁরাও না জেনে এবং সামাজিক নিয়মের জালে আটকে গিয়ে অজান্তেই ধার্মিক হয় এবং এক সময়ে নিজেকে পূর্ণ মূ'মিন ভাবতে শুরু করে- বিশ্বাস করে। এই আলোচনা পরে হবে।
যাই হোক, যেই আলোচনায় ছিলাম তা হলো অজ্ঞভাবে অভ্যস্ত হতে হতে এক সময়ে বিশ্বাসে পরিণত হওয়া। আমার মতে বেশিরভাগ নাস্তিক সেভাবেই নাস্তিক এবং আস্তিকেরাও সেভাবেই পূর্ণ ধার্মিক হয়। এবার আসি এই লেখাটার মূল উদ্দেশ্যর দিকে।
আমার বন্ধু এন রহমান লিমন'র লেখা পোস্ট-
"Friedrich Nietzsche নামক এক জার্মান দার্শনিক একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। বলা যায় বিশ্বের তাবৎ বিখ্যাত উক্তিগুলোর মধে্য এটি একটি।
উক্তিটি এতবেশি জনপ্রিয় যে, এটা নিয়ে উইকিপিডিয়াতে পর্যন্ত একটা বিশাল আর্টিকেল লেখা হয়েছে।
বলা চলে পশ্চিমাবিশ্বে রাতারাতি জ্ঞান একধাপ এগিয়ে গিয়েছে এই উক্তি অন্তরে ধারণের মধ্য দিয়ে। কেননা এই কথাটি সীমানা অতিক্রম করতে সহায়তা করেছিলো। জ্ঞানার্জনের যতসীমানা ছিলো সব চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।
তিনি বলেছিলেন, God is dead.
খুব সম্ভবত বাংলাদেশে সবচাইতে অনিরাপদ কথা এটি।"
আমিও এই লেখাকে বা ওই জার্মান দার্শনিক সাহেবের উক্তিটিকে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ মনে করি। কেন করি বিশ্লেষণ করছি-
কিছুদিন আগে আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত ছুটি কাটাতে। তখন আমার বাবা আমাকে টাকা-পয়সা দেয়া নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম আপনি শুধু একবার বলেন আমি তোমাকে আর টাকা দিতে পারবো না। আমি এতে মোটেই মনে কষ্ট পাবো না। কিন্তু আপনার এই কথা যদি কাজে পরিণত করতে পারেন, তাহলে দেখবেন কিছুদিনের মাঝেই আমি স্বাবলম্বী হয়ে গেছি। যেহেতু এই দেশে খাবারের বা টাকার অভাব নেই, সেহেতু আমি কোনভাবেই না খেয়ে মরবো না। তবে আমি যেহেতু কাজ করছি না বা করার স্বদিচ্ছা মনে নেই, সেহেতু আমি আপনার থেকে প্রাপ্ত টাকার আশায় বসে থাকি এবং অলস সময় কাটাই। আপনি টাকা দেয়া বন্ধ করে দিলে আমার বিশ্বাস হবে আমার বসে বসে টাকা পাওয়ার আর কোন উৎস নেই, তখন আমি বাধ্য হয়ে কাজ খুঁজে নেবো। সবথেকে ভালো হয় আপনি আমাকে ত্যাজ্য করলে। সেক্ষেত্রে আমি বুঝতে পারবো আমার মাথার উপরে যেহেতু কেউ নেই, সেহেতু আমার যা করার নিজেকেই করতে হবে। বাবা আমার কথায় রাজী হয়নি বলেই আজও আমি বেকার বসে আছি বাবার থেকে টাকা প্রাপ্তির আশায়। অনাহারে থাকলে বাড়িতে ফোনে খবর দেই, ভর্তির টাকার জন্যও তাই।
আজ যদি আসলেই আমার বাবা আমাকে ত্যাজ্য করেন বা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন, তাহলে আমি যেমন নিশ্চিতভাবেই নিজের ক্ষুধা মেটাতে কাজে নামবো, তেমনি আমার বাবা মারা গেলেও একই ঘটনা ঘটবে। কারণ, আমার পরিবারের কোন নির্দিষ্ট আয়ের উৎস নেই বা জমানো টাকাও নেই যে বাবার মৃত্যুর পরে সেগুলোর মালিকানা পেয়ে খরচে নেমে পড়বো। হ্যাঁ, আর একটা উপায় আছে- বউ ঘরে থাকলে বাড়তি খরচ পোষানোর জন্য আমাকে আয়ের পথে নামতে হবে। আবার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে সব বন্ধুরা কাজে নেমে গিয়ে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা পরিবর্তন করে ফেললে তখনও আমাকে কাজ খুঁজে নিতে হবে। মোটকথা, পেট বাঁচানো এবং সম্মান বাঁচানোর জন্য আমাকে আয় করার পথে একদিন নামতে হবে। কিন্তু মাথার উপরে ছায়া যদি শক্তভাবে থাকে, তাহলে সেই সম্ভাবনা অনেক কম। (যদিও অতিমানব ধরণের কিছু মানুষ থাকেন যারা বিনা কারণেই বা তাঁদের অন্তর্নিহিত কোন প্রয়োজনেই দৃশ্যমান প্রয়োজন ছাড়াই ছাত্র অবস্থায় পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। তবে আমি সেই গোত্রীয় নই এবং আমার ধারণা বেশিরভাগ মানুষ-ই নয়।)
একইরকমভাবে যখন মানুষ বিশ্বাস করে তাঁর মাথার উপরে ঈশ্বর আছেন তাঁর সকল প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য, তাঁর বিপদে সাহায্য করার জন্য ঈশ্বর বসে আছেন উপরে, তখন তাঁর চেষ্টা স্বাভাবিক দৌর-ঝাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সে অসুস্থ রোগীর পাশে বসে কিছুটা লৌকিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে উপাসনায় ব্যস্ত হয় ঈশ্বরের সাহায্য প্রাপ্তির আশায়। ঈশ্বর না থাকলে কিন্তু মানুষটি উপাসনায় সময় ব্যয় না করে আরও বেশি যত্ন এবং চেষ্টা ব্যয় করতেন রোগীর জন্য।
জ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। মানুষ (হাতে গোনা কিছু মানুষ বাদে) সেই পর্যন্ত জেনে ক্ষান্ত হয়ে যায় যেখানে ঈশ্বরের নাম যুক্ত। মহাকাশ নিয়ে জানতে গিয়ে তাঁরা মহাকাশ কীভাবে সৃষ্টি হলো বা কীভাবে চলছে জানার আগেই থেমে যায়। তাঁরা জানেন সবকিছু ঈশ্বর পরিচালন করেন। তাঁরা জানেন সব ঈশ্বরের সৃষ্টি।
অথচ এই মানুষগুলি যদি প্রথমে ভাবতেন ঈশ্বর নেই বা মারা গেছেন, তাহলে এক পর্যায়ে এই ভাবনাই তাঁদের বিশ্বাসে পরিণত হতো এবং তাঁরা অভাবের সময় ঈশ্বরের সাহায্য প্রাপ্তির আশায় বসে থাকতেন না। তাঁরা বিপদে অলৌকিক সাহায্য আশা করতেন না। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতেন শেষ দেখার জন্য। তাঁরা মহাকাশের সকল রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করতেন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। এতে হয়তো এখন মহাকাশ নিয়ে আমাদের সীমিত জ্ঞানের বদলে বাসোপযোগী কয়েকশ গ্রহ খুঁজে পেতাম বা পেতাম অজানা কোন শক্তির সন্ধান যা আমাদের কাজে লাগতো।
ঈশ্বরের মৃত্যুর ধারণা এই সকল কারণেই সমাজের জন্য অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
সবার শেষে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি-
আমার এক কাছের বন্ধু এখন হাসপাতালে ভর্তি। জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থান করছে। হয়তো মৃত্যুটাই একটু কাছে আছে এখন। মাঝে মাঝেই ওর শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যায়। কৃত্রিম অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হয় মাঝে মাঝে। কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যায় ওর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে দেখি অক্সিজেন চলছে কিন্তু কষ্ট কমছে না। ডাক্তারকে খুঁজে বের করে অবস্থা বর্ণনা করার পরে সে অক্সিজেনের সাথে নির্দিষ্ট একটা গ্যাসের কথা বলে দেন। গ্যাসটা ব্যবহার করার পরে ওর কষ্টটা কমতে শুরু করে। ওকে মাথায় হাত বুলিয়ে যখন ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি আর ও কিছুটা ঘুমের ঘোরেও চলে গেছে, তখন পাশের কোন এক রোগীর বেশ বয়স্ক এক মহিলা আত্মীয় এসে জিজ্ঞেস করলেন রোগীর অবস্থা কী? জানালাম এখন বেশ ভালো। তিনি জানালেন আমি যাওয়ার আগে যখন ওর খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তখন তিনি নাকি ওর পাশে বসে সুরা ইয়াসিন পাঠ করেছিলেন। উনি পুরোটা পারেন না বলে কিছু অংশ পাঠ করেন আর সেই পাঠের কারণেই নাকি ও এখন সুস্থ। মেজাজ সহজে গরম করি না, কিন্তু ওনার এমন জোরে জোরে গলায় আনন্দ নিয়ে বলা কথার কারণে ওর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে বলে ওনাকে চুপ করতে বললেও উনি ওনার আনন্দ প্রকাশ করেই যাচ্ছিলেন। শেষে বললাম- এখানে যেহেতু সব বিছানায় একজন করে রোগী আছেন, আর রোগীরা সবাই বেশ বেশি-ই অসুস্থ, আপনি বরং সব বিছানার পাশে গিয়ে সুরা ইয়াসিন পুরোটা পাঠ করে করে সবাইকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। আপনি পুরোটা না পারলে বলেন আমার মুখস্ত আছে। আমি শিখিয়ে দেবো। আর পড়তে চাইলে বলেন আমার ফোনে আছে। বলার পরে সে যেন কী বলতে যাচ্ছিলেন দেখে আমি ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে কিচ্ছুক্ষণ বাইরে থেকে আবার আমার বন্ধুর কাছে যাই।
আমি অনেক দেখেছি অনেক মানুষ বুকে ব্যথায় পড়াপানি খেয়ে সুস্থ হতে গিয়ে মরে গেছে। হয়তো তাঁদের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো। আবার দেখেছি অনেক মেধাবী এবং চিন্তা ও গবেষণায় পারদর্শী অনেক শিক্ষার্থীকে শুধুই ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং বিশ্ব পরিচালনা তত্ত্বে বিশ্বাস করে বিজ্ঞানকে ও বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে আরও কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু তাঁদের বিশ্বাসে যদি ঈশ্বর না থেকে বরং তাঁরা নিজেদেরকেই নিজেদের একমাত্র অবলম্বন ভাবতো, তাহলে হয়তো অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, অনেক অপরাধ, অনেক অভাব পৃথিবীতে স্থান পেতো না। হয়তো বিজ্ঞান আজ অনেক এগিয়ে যেতো, হয়তো মানুষ পেতো আরও সমৃদ্ধশালী কোন সমাজ। ওই জার্মান ভদ্রলোকের তত্ত্বকে পশ্চিমারা কিছুটা হলেও বিশ্বাস করেছে এবং বাস্তবিক জীবনে প্রয়োগ করেছে বলেই হয়তো আজ ওরা অনেক এগিয়েছে। আজ ওরা আমাদের পৃথিবীর মতো গ্রহ খুঁজে বেড়ায়। আমাদের বসবাসের জন্য আর একটু সুবিধা ওরা নিয়মিত খুঁজে পেতে চায়। মানুষের শারীরিক দুর্বলতা ও অসুখের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ওরা উন্নত চিকিৎসা ও শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কৃত্রিম যোগান দেয়ার চেষ্টা করে যায় এবং ওরা ক্রমাগত সফল হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে আমরা এখনও ওই তত্ত্বে বিশ্বাস করি না বলে এখনও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকা মানুষটির জন্য বাঁচার পথ তৈরি করার বদলে, তাঁর জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার বদলে পাশে বসে সুরা ইয়াসিন পাঠ করি। বিজ্ঞানের ছাত্র এখনও এখানে বিগ ব্যাং এর আগে কী হয়েছিলো খুঁজতে গিয়ে বলে বসে এটা মনে হয় আমাদের না জানলেও চলবে। কারণ, ঈশ্বর সব পরিচালনা করেন এবং তিনি সব জানেন।
হ্যাঁ, নিজের দরকারে এবং আমাদের সমাজের অগ্রগতির জন্যই আমিও Friedrich Nietzsche সাহেবের সেই মহাতাৎপর্যপূর্ণ উক্তিটির সাথে সুর মিলিয়ে বলছি- God is Dead! হয়তো ঈশ্বর আছেন, হয়তো তিনি-ই সব পরিচালন করেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তিনি নেই। তিনি মারা গেছেন। আমি মাথার উপরে ছায়া আছে এমন বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসতে চাই নিজের প্রয়োজনে- সমাজের প্রয়োজনে। নয়তো নিজের চেষ্টা তো নিজের করা হবে না! শত হলেও সেই বিনা কারণেই বা ব্যক্তিগত অজানা কারণে ছাত্রাবস্থায় পেশাগত জীবনে প্রবেশ করার মতো অতিমানব তো সবাই নয়
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:১৫