somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত ৩

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সত্যিই কি মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত ?

বর্তমান সমাজ ইচ্ছে করে হোক কিংবা অজ্ঞতাবশত হোক মোল্লা বলতে বুঝে মুখে কটা দাড়ি মাথায় একটা টুপি আর গায়ে একটা লম্বা জামা। মোল্লার দৌড় কথাটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে কি সেটা কোন কাল যুগের মাঝেই সীমাবদ্ধ? নাকি এ সত্যতা সর্বকালেই স্বীকৃত?
মোল্লা বলতে যে চিত্রটা হৃদয়পটে ফুটে উঠে তাতে পৃথিবীর প্রথম মোল্লা ছিলেন আদম আ.। তবে আদম আ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মত কিংবা আমাদের মত টুপি কুর্তা পরতেন কিনা জানা যায় নি। পূর্ববর্তী নবীদের পোষাক পরিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ আমি জানতে পারি নি।

আদম আ. এর পর হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত আগত সব নবীই মোল্লা ছিলেন। সবাই মুখে দাড়ি রাখতেন। নামাজ পড়তেন। খোদার গুণ গান করতেন। দাড়ি রাখা অবশ্য নবীদের একক বৈশিষ্ট ছিল না। কাফের মুশরিকরাও এক যুগে দাড়ি রাখত। স্কুল কলেজের ইতিহাসের পাঠ্য বইগুলোতে মহামানবসহ বিভিন্ন সভ্যতার যে চিত্র দেখা যায় তাতে তো সব পুরুষই দাড়িয়াল। দাড়ি ছাটার ইতিহাস তেমন পুরনো নয়। আধুনিকই বলা চলে। আগের যুগের মানুষ তো দাড়িকে পৌরুষত্বের প্রতীক চিহ্ন মনে করত। কিন্তু সে পুরুষত্বের চিহ্ন তো আর এখন তেমন দেখা যায় না। নারী পুরুষ মিলে একাকার হয়ে গেছে। কিছু কাল পরে হয়তো ব্যবধান করাই মুশকিল হয়ে যাবে। তো নবী উপাধির যুগ শ্রেষ্ঠ মহামানবদের দাপট যোগ্যতা কি শুধু মসজিদ কেন্দ্রিকই ছিল? এর বাইরে পরিবার সমাজ রাষ্ট্র চালাবার মত শক্তি যোগ্যতা কি তাদের ছিল না ? প্রবাদ আমোদী ভাইদের উত্তর কি হবে জানি না। ইতিহাস এবং চির সত্য ইতিহাস কিন্তু বলে এরা মানব নয় অনন্য মাহামানব ছিলেন। বিজ্ঞানী মহা বিজ্ঞানী বলে যাদের আমরা চিনি তাদের অনেক অনেক উপর চূড়ায় তাদের অবস্থান। পৃথিবীর অন্য কারো পক্ষে সে উঁচুতায় আরোহন করা কোন কালেই সম্ভব নয়। এটা তো ঐশ্বরিক পদমর্যাদা। এ তো আর গায়ের জোরে অর্জন করা যায় না।

তো বিশেষ একটা জায়গার সাথে কেন্দ্রিভূত হয়ে এত উঁচোয় তারা কি করে উঠতে পারলেন। এটা তো বিবেকে ধরে না। সুতরাং বলতেই হবে তাদের কর্ম পরিধি যোগ্যতা শক্তি কোন জায়গা বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। জীবন চলার পথে সম্ভাব্য সবরকমের বিষয় আষয়ে তাদের যোগ্যতা শক্তি ছিল পুরো মাত্রায় সমুজ্জ্বল। আর সে যোগ্যতা শক্তির মানদণ্ড ছিল মহান অধিপতি আল্লাহর বিধানের সাথে কেন্দ্রিভূত। অন্য দিকে নবী শ্রেষ্ঠ, অমলীন ব্যক্তিত্ব, গুণ গরিমা ও মান মর্যাদা তথা সবরকমের সৌন্দর্য মাধুর্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মহামানব রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মোল্লা ছিলেন। তিনি জীবনের সবরকমের আনুষাঙ্গিকতায় খোদার অধীনতাকে প্রাধান্য দিতেন। তার সুপ্রিম কোর্ট বঙ্গভবন পার্লামেন্টসহ রাষ্ট্র বিজ্ঞানের যাবতীয় কর্মতৎপরতার মূল কেন্দ্র ছিল সবুজ গম্বুজের নিবিড় ছায়া। যেটা নিছক একটা মসজিদ বৈ কিছুই নয়। এরপর খেলাফতে রাশেদার কীর্তিমান আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক চতুষ্টয় মোল্লা ছিলেন। তাদের পর ১৯১২ শতাব্দি অবধি ধারা পরম্পরায় চলে আসা ইসলামী খেলাফতের ৯৫% রাষ্ট্র্র নায়ক ছিলেন মোল্লা ।

অন্য দিকে উপমাহাদেশের ইতিহাসখ্যাত গজনী বংশ, ঘুর বংশ, দাস বংশ, খিলজী বংশ, তুঘলক বংশ, সৈয়দ বংশ, লোদী বংশ এবং মোগল বংশের ৯৯% রাষ্ট্র নায়ক মোল্লা ছিলেন। দিগি¦জয়ী বীর সেনানী খ্রীষ্টান জগতের মহা আতঙ্ক সালাহুদ্দীন আইয়ূবী, উপমহাদেশের হিন্দু শাসকদের মৃত্যু দ্যুত সুলতান মাহমুদ গজনবী- যিনি সতের বার ভারত আক্রমণ করে হিন্দু রাজাদের কোমড় ভেঙ্গে দিয়ে ছিলেন- এরা সবাই মোল্লা ছিলেন। তবে কি এদের মসজিদ ছাড়া জ্ঞান বিজ্ঞানের আর কোন শাখা প্রশাখায় শক্তি দাপট ছিল না ?
আজ চার দিকে বিজ্ঞানের জয় জয় ধ্বনি। বিস্ময়কর বিজ্ঞান সাধনার আকর সূত্রগুলো কোথা থেকে এসেছিল তা কি আমরা জানি ? আজকের বিশ্বে উন্নত সভ্যতা সংস্কৃতির দাবিদার ইউরোপ আমেরিকানরা এ সভ্যতা সংস্কৃতি কোথা হতে পেয়ে ছিল ? তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি ? সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস রস এখনো শুকিয়ে যায় নি। এসবি মুসলমানের হাত ধরা ধরি করে উঠে এসেছে। বিজ্ঞানের আকর সূত্রগুলো মুসলিমরাই রচনা করেছে। মূর্খ অসভ্য ইউরোপ আমেরিকানদেরকে মুসলিমরাই সভ্যতা সংস্কৃতির আলোর পথ দেখিয়েছে। যেসব মানুষ বিজ্ঞানের চমক দেখিয়ে পৃথিবীতে আজ কীর্তিমান হয়ে আছেন মুসলিম বিজ্ঞানীদের রচিত সূত্রগুলোর অনুগমন ছাড়া এতদূর উঠে আসা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হত কি না ভেবে দেখার বিষয়। জাবির বিন হাইয়ান, আলবাত্তানী, আলবেরুনী, ইবনে সীনা, ইবনে রুশদ, জাকারিয়া আল রাজি, ইবনে আব্দুল মালেক আলকিন্দী, নাসির আলতুসি, আলী রেজা, আলবাগদাদী, মোল্লা সাদরা, ইবনুল হাইসাম, আন নাজ্জাম, বাকিল্লানী আলী ইবনে রাব্বান সহ অসংখ্য মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানের কথা আজকের বিজ্ঞানী সমাজ অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য।

এসব মুসলিম বিজ্ঞানীরা সবাই কিন্তু মোল্লা ছিলেন। তারা জুব্বা পাগড়ি পরতেন। খোদার গুণ গান করতেন।
ভাষা বিজ্ঞানীদের মাথার মুকুট ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা সাহিত্যের অনন্য পুরোধা মাওলানা আকরাম আলী খাঁ, ইসলামী রেনেসার কবি ফররুখ আহমদ, ভারতের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা ভাসানীসহ দাড়ি টুপিঅলা আরো খ্যাতিমান যারা রয়েছেন সবাই কিন্তু মোল্লা ছিলেন। জানি না তাদের যোগ্যতা শক্তি চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল কি না।
আশির দশকে তৎকালীন পৃথিবীর সুপ্রিম পাওয়ার রাশিয়ার তখত তাউসকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে ছিল আফগানিস্তানের যে যুদ্ধবাজ বাহিনী তারা কিন্তু সবাই দাড়িয়াল মোল্লা ছিলেন। খোদার বিধানের সামনে এক বিন্দু ছাড়ও তারা দিতেন না। কাফের মুশরিক নাস্তিক মুরতাদদের জন্য যমদ্যুত হিসেবে তারা আবির্ভুত হতেন। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাপী হৈচৈ ফেলে দেয়া আফগানের মাদরাসা পড়ুয়া তালেবান বাহিনীর সবাই মোল্লা হুযুর ছিলেন। নিষ্ঠা ও দাপটের সাথে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে বিশ্ববাসীকে তারা দেখিয়ে দিয়েছেনÑ হাম ভি কুছ হেঁ।
এদের শক্তি মসজিদের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়। তো মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত কথাটা আপামর সব টুপি ধারীদের ক্ষেত্রে তাচ্ছিল্যের স্বার্থেও কি প্রযোজ্য ?
শাহজালাল শাহপরান খান জাহান রহ. সহ আরো যত মহমনীষী এ বঙ্গভূমিতে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন তারা সবাই মোল্লা ছিলেন। কিন্তু সেই মোল্লা মৌলভীদের মাজারে গিয়ে এ দেশের হর্তা কর্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। গণতন্ত্রের অভিযাত্রাও শুর হয় শাহজালাল রহ. নামের একজন মোল্লার সমাধি হতে।

মুন্সি হুযুর প্রসঙ্গ

মুন্সী
মুন্সি অর্থ লেখক, প্রতিবেদক, প্রবন্ধকার, বিদ্বান, সেক্রেটারি। এ মুন্সি হতেই মুন্সিয়ানা। মানে পাণ্ডিত্ব, লিখন কার্যে বা রচনায় পটুত্ব, রচনা কৌশল।
মুন্সি শব্দটি শহর বন্দরে তেমন একটা শোনা যায় না। তবে গ্রাম গঞ্জে মুন্সি শব্দটি বিদ্রƒপ অর্থের প্রতিনিধিত্ব করে। এক সময় এ মহাদেশে মুসলমানদের রাজত্ব ছিল। তখন অফিস আদালত সচিবালয় মন্ত্রণালয়ে যারা কাজ করতেন সবার মাথায় মুখে টুপি দাড়ি শোভা পেত। একজন অফিসিয়াল মানুষ মানেই তার হাতে কলম শোভা পাওয়া। কারণ কলম ছাড়া তো অফিস আদালত অচল। বর্তমানে অবশ্য উন্নত প্রযুক্তির দৌলতে অফিস আদালত কলমশূন্য হতে বসেছে। কাগজ কলম যাদুঘরে ঢুকতে বোধ হয় আর বেশি সময় বাকি নেই। উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে যাদুঘরের খোরাক বাড়ছে। এবং তা বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। সে যাক। মুসলিম আমলের একজন অফিসার মানেই একজন মুন্সি। একজন সচিব মানেই একজন মুন্সি। এখন আর সেই মুন্সি শব্দের অর্থগত সার্থকতা নেই। মুন্সি শব্দের মূল অর্থ বিলুপ্ত হয়ে এখন সে টুপি দাড়িটাই মুন্সি রয়ে গেছে। সাথে সাথে ইংরেজ বাবুদের সুপ্ত সাধনায় সেটা একটা বিদ্রƒপাত্মক শব্দের রূপ নিয়েছে। তবে মুন্সি শব্দ হতে নিঃসৃত মুন্সিয়ানা শব্দটি এখনো শব্দ সাহিত্যে বেশ গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
মুন্সি শব্দটি মূলত আরবী মূল ক্রিয়া انشاء (ইনশা) এর কর্তাবাচক বিশেষ্য। আর ইনশা অর্থ গঠন, রচনা, প্রতিষ্ঠা, স্থাপন, প্রবর্তন, সূচনা, লিখন ইত্যাদি। সুতরাং মিন্সী অর্থ রচয়িতা, লেখক ইত্যাদি।

হুযুর
হুযুর শব্দটি আরবী حضور শব্দের প্রতিরূপ। আর আরবী হুযুর শব্দটি হল মূলভার্ব তথা মূল ক্রিয়া। অর্থ উপস্থিত হওয়া, হাজির হওয়া। কিন্তু এক সময় এ শব্দটি উর্দু বাংলায় এসে মহা সম্মানসূচক শব্দের প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করে। বাংলা অভিধানে হুযুর শব্দের অর্থ করা হয়েছে এ ভাবে : হুযুর- বি. নৃপতি বিচারপতি মনিব প্রভৃতিকে সম্মানসূচক সম্বোধন, প্রভু, প্রভুর নিকট (হুযুরে হাজির), [আ. হুযুর], যো হুযুর- হুযুর যাহা বলেন তাহাই ঠিক বা তাহাই হইবে; মোসাহেবি বা গোলামি; মোসাহেব বা গোলাম। (সংসদ বাংলা অভিধান- ৬২০)
শব্দটির অর্থগত দিকে তাকালে এতে শ্লেষাত্মক বিষয় হওয়ার কোন অবকাশ নেই। তবু অনেক হিতাকাঙ্ক্ষী মহোদয় কখনো সখনো ‘এ হুযুর বলে’ মুখে শ্লেষের হাসি ফোঁটান। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বন্ধু যা বলে হাসলেন তার অর্থটা কি জানেন? আমি নিশ্চিত তাকে হুযূর শব্দের মারপ্যাঁচে ফেলে গণ্ডমূর্খ, বোকা এবং অট্টহাসির পাত্র বানিয়ে দেয়া যাবে।

এক সময় আধোমোল্লাদের বেশ দাপট ছিল। দাড়ি, টুপি, জুব্বা আর কখান সূরা-কিরাতই ছিল তাদের মূল পুঁজি। এসব বেচেই তারা আহার জোগাতেন। এক দুটি সূরা আর ইয়া নবী ও সাল্লাল্লাহ দিয়ে যদি সুস্বাদু গোস্ত মুরগি আর রসালো মিষ্টি পোলাও মিলে যায় তো মন্দ কি। এদের নিমন্তন্ন খাবারের আলাদা ছাতা হারিকেন ঘরের বারান্দায় ঝুলানো থাকতো। কারো তিরোধান হলে এদের মুখে হাসি ফুটতো। কথাগুলো আমাদের পক্ষের না বিপক্ষের জানি না। তবে কথাগুলো সত্য। তাই বলতে দ্বিধা হলো না। এক সময়ের সংস্কৃতি এমনি ছিল। এরা ইসলাম, দেশ, জাতির জন্য ক্ষতিকর ছিল। এদের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি বৈ কোন উন্নতি হয় নি।
এখনো আদালত পাড়ায় হুজুর শব্দটি সম্মানসূচক শব্দ রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি বরাবর আপিল কিংবা এ্যাপলিকেশন করতে হলে হুযুর বলে সম্বোধন করতেই হয়। তবে সার্বিক দিক বিবেচনায় আমাদের দেশে এই শব্দটির বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ কোন পরিবেশে এই শব্দটি সম্মানের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পথে-ঘাটে, গাড়ি-ঘোড়ায় কিছু মানুষের মুখে ‘এ হুযূর, এ হুযূর’ প্রকৃতির শ্লেষাত্মক ধ্বনি শোনা যায়। শব্দটি উচ্চারণের বেলায় তাদের মুখে বিদ্রƒপাত্মক মিটি মিটি হাসির রেখাও ফুটে ওঠে। শব্দটি বলে তারা খুব আনন্দ পান।

আমার এক বন্ধু আছে। বন্ধুটি আর যাই হোক হুযূর মোল্লা টাইপের সম্বোধন সইতে পারেন না। কোথাও এমন সম্বোধনের সম্মুখীন হলে বিষম চটে যান। মাথার টুপি হাতে নিয়ে গোল বাধিয়ে দেন। বন্ধুটি সচারচর কোথাও বের হলে মাথার টুপি খুলে ফেলেন। এতে নাকি তাকে কেউ শ্লেষাত্মক শব্দ ছুড়তে সাহস করে না।

এক রমজানে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানা সদরে ছিলাম। সেখানে ভয়ংকর একটি গ্যাং ছিল। গ্যাংটির ভয়ে পুরো এলাকা ভয়ে থর থর করে কাঁপত। শহরের ভিতরেই একটা বাড়ি ছিল। সে বাড়িতে তাদের মদ অস্ত্রের বিশাল বড় একটি মজুদ ছিল। এ বাড়িটিই ছিল তাদের মূল আস্তানা। শহরের যে কোন দোকান হতে যখন তখন যা ইচ্ছে তাই নিয়ে নিত। কেউ টাকা চেতে সাহস করত না। পুরো গ্যাংটি এখন সত্যের কাফেলায় পরিণত হয়েছে। একদিন সকাল বেলা এ কাফেলার এক সদস্য তার দোকানে বসে নিজের অতীত জীবনের স্মৃতি চারণ করছিল। এক পর্যায়ে বলল, ‘এযে রাস্তাটি দেখছেন; সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যত মানুষ এ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে তাদের ভিতর এমন কেউ নেই যে আমার হাতে চড় থাপ্পড় খায় নি।’ বুঝতেই পারছেন গ্যাংটা কত ড্যাঞ্জারাস এবং ভয়ংকর ছিল।

একদিন এ গ্যাং-এর এক বন্ধুর সাথে খুলনা শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে বাসের ভিতরে ভাড়া নিয়ে একটু ঝামেলা হল। অবিবেচক হেল্পার আমনি হুযুর শব্দে একটি শ্লেষাত্মক ভাষা ব্যবহার করল। সাথে সাথে বন্ধুটির মাথায় রক্ত চড়ে গেল। মাথা হতে টুপিটা নামিয়ে হুংকার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। বন্ধুটি আমাকে খুব সমীহ করত। ভালও বাসত হৃদয় দিয়ে। আমি ভাবলাম পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিবে। মোল্লা গ্যাং আগের রূপে ফিরে গেলে বড় সড় একটা ঝামেলা বেধে যাবে। বাসের হাড্ডি গুড্ডি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি সাথে সাথে বন্ধুটির হাত চেপে ধরলাম। বললাম বসুন। শান্ত হোন। আপনারা গরম হলে ঠাণ্ডা করবে কে। বন্ধুটি বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি সইতে পারছি না। অনেক কষ্টে বন্ধুটিকে ঠাণ্ডা করলাম। এ যাত্রায় বাসটি বেঁচে গেল। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে বন্ধুটি বলল, আজ আগের মত হলে কিয়ামত ঘটে যেত। আমি বুঝালাম কুকুরে কামড়ালে কুকুরকে কামড়াতে নেই। বস্তুত বন্ধুটির আগের অবস্থা হলে ওরা টু শব্দটিও করার সাহস পেত না। কারণ তাদের বেশ ভূষাই ওদের কাবু করে ফেলত। কথায় বলে ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’।
কিছু দিনের সঙ্গতায় এক এগ্রিকালচার অফিসারের সাথে পরিচয় হয়েছিল। বিশাল দেহের এক যুবক মানুষ। সব সময় পাগড়ি জুব্বা পরে থাকত। অফিসারটি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন আমাকে খুব দুঃখ করে বলছিলেন, পথে ঘাটে মানুষ আমাদের সাথে যেরূপ আচরণ করে তাতে মনটা বিষিয়ে উঠে। অথচ যখন এ পাগড়ি জুব্বা ছিল না তখন সবাই স্যার স্যার করত। এখন আমাদের একজন সাধারণ মানুষও মনে করে না। টুপি দাড়িকে অবজ্ঞা করা মানেই তো ইসলামকে অবজ্ঞা করা। মুসলমানের সন্তান হয়ে এভাবে ইসলামকে অবজ্ঞা করবে এটা তো মেনে নেয়া যায় না। আমি তাকে বিভিন্নভঅবে বুঝাতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু বুঝাতে পারতাম না। উপরন্তু যতটুকু বুঝ তাকে দিতাম তাতে নিজেও পরিতৃপ্ত হতে পারতাম না।

হুযুর শব্দের রূপের শেষ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানসূচক শব্দ হিসেবে আমরা হুযূর শব্দ ব্যবহার করি। অশিক্ষিত দাড়ি টুপিঅলা একজন সাধারণ মানুষকেও আমরা হুযূর বলি। একজন বিজ্ঞ শাস্ত্রীয় আলেমকেও হুযূর বলি। ছোট্ট একটা মাদরাসার ছেলেকেও হুযূর বলি। মাদরাসার ছেলেরা তাদের টিচারদের হুযূর বলে সম্বোধন করে। কলেজ ভার্সিটির ছেলেরা যেমন স্যার বলে। সে মাদরাসার ছাত্রটিই যখন মাদরাসার দেয়াল পেরিয়ে বাহিরে বেরিয়ে আসে তখন সে নিজেই হুযূর বনে যায়। হুযূর শব্দের কত রূপ!

আমার এক ঘনিষ্টজন বলতেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কাউকে হুযূর বলি না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান এবং অন্যদের সম্মান এক হতে পারে না। হোক না সে যত বড় আলেম, পীর, বুযুর্গ, আবদাল। একই শব্দ দিয়ে উভয়কে সম্মান দেখাবো এ কি করে হয়? এতে তো উভয়ই সমসম্মানের পাত্র হয়ে যায়। অথচ উভয়ের মাঝে আকাশ-পাতাল বরং তার চেয়ে আরো শত কোটি গুণ ব্যবধান। নবী আর অনবীর মাঝে তো কোন সমতা চলে না। ইত্যাদি ইত্যাদি...।
বন্ধুটির যুক্তি অনুভূতি এবং নবী-প্রম ফেলে দেয়ার মতো নয়। সে যাক, এমন বিতর্ক প্রসংশার দাবী রাখে। কথা হল, আমরা এ সম্মানজনক শব্দটাকেই আবার কাউকে হেয়, ছোট ও বিদ্রƒপ করার জন্য ব্যবহার করি। এটা আর যাই হোক জ্ঞান গভীরতা ও সুবিবেচনার পরিচয় নয়। এমন বিদ্রƒপকারী নিজেই বিপদসঙ্কুল ঝুঁকিতে পড়ে যান। তার বিশ্বাসের উপর আঘাত এসে যাওটাও বিচিত্র কিছু নয়। তবে হুযুর শব্দ নিয়ে আরেকটি লজিকও বিশেষ এক পরিবেশে চালু আছে। তারা বলেন হুযুর শব্দটি হাজির নাজির শব্দ হতে উদগত। আর হাজির নাজির সংক্রান্ত বিশ্বাস একটি ঈমান বিধ্বংসী বিশ্বাস। সুতরাং হুযুর শব্দটি ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। ঈমান বিধ্বংসী শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী শব্দ ব্যবহার করা মানে এ বিশ্বাসের স্বীকৃতি দান করা।
জানি না তাদের এ সূক্ষ্ন তত্ত্বের বাস্তবতা কতটুকু। আরব বিশ্বে কিন্তু হুযুর শব্দের সমধাতুর শব্দ হাযরাতা.. (বাংলায় হযরত) শব্দটি একটি সম্মানজনক বহুল ব্যবহৃত শব্দ। হাজির হুযুর এবং হযরত একি ধাতুর শব্দ। তবে কি হাযরত কিংবা হযরত শব্দটিও ব্যবহার করা যাবে না? আরেকটি ব্যাপার হল, হাজির হতে হুযুর উদগত হতে পারে না। বরং হুযুর শব্দ হতেই হাযির শব্দটি নির্গত হয়েছে। কারণ হুযুর শব্দটি হল মূল ক্রিয়া। আর হাজির হল ক্রিয়া উদগত শব্দ। হাজির হতে হুযুর শব্দটি নির্গত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সারকথা হাজির হতে হযুর শব্দের প্রচলন হয়েছে এটা বলা যায় না। বরং আরবী ব্যকরণ মতে তার উল্টোটাই এখানে সত্য এবং বাস্তব।

ধর্মের প্রতীক ব্যবহারকারী কোন রেলিজাসকে দেখে উপহাস করা তো অবিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট। কুরআনের ভাষায়, যারা অপরাধী তারা বিশ্বাসীদের উপহাস করতো এবং তারা যখন তাদের কাছ দিয়ে গমন করতো তখন পরস্পরে চোখ টিপে ইশারা করতো। তারা যখন তাদের পরিবার পরিজনদের কাছে ফিরতো তখনও হাসাহাসি করে ফিরতো। আর যখন তারা বিশ্বাসীদের দেখতো তখন বলত নিশ্চয় এরা বিভ্রান্ত।” (আল-মুতাফফিফূন, ২৯-৩২)
একজন মুসলমান তো এরূপ আচরণ করতে পারে না। যদি কোন টুপিধারী ব্যক্তি ব্যতিক্রম কিছু করে থাকে তবে তার শোধ এসব শব্দ ব্যবহার করে বিদ্রƒপ করে নয়, বিধানিক অন্য আরো হাজারো পন্থা এর জন্য রয়েছে তা প্রয়োগ করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:৫৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×