somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিউম্যান মিল্কব্যাংক : একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

১২ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৯:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





সূচনাকথা

বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাটি বেশ পুরনো। তবে দেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবস্থাটি অতীব নতুন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিল্কব্যাংকের বৈধতা অবৈধতা ও সমস্যা ও উপকারিতা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। সুতরাং এ ব্যবস্থাটিকে বৈজ্ঞানিক ও নৈতিকতার দিক থেকে জটিলতা ও সমস্যামুক্ত স্বচ্ছ একটি ব্যবস্থা ভাবার সুযোগ নেই। বিশ্বটা এখন হাতের মুঠোয়। স্থলগত দিক থেকে যদিও পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো সীমানা প্রাচীরে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তথ্য ও জ্ঞানগত দিক থেকে পৃথিবীটা আজ একটি রাষ্ট্রে পরিণত। এখন কোনো রাষ্ট্রে কোনো কিছু হলে সেটা আর সে দেশে সীমাবদ্ধ থাকে না। মুহূর্তেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায়। তদ্রƒপ বর্তমানে অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুবাদে কোনো কিছু জানার প্রয়োজন হলে সেটাকে নিজের মত করে পেতে বিদেশী তথ্যভাণ্ডারেও ঢু দেয়া হয়। বিশেষত ধর্ম সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর জানার প্রয়োজন হলে এখন আর মানুষ দেশীয় বা স্থানীয় আলেমদের সমাধানে পরিতৃপ্ত হয় না; বরং নিজের মনমত বিধান অনুসন্ধানে বিদেশী আলেমদেরও দ্বারস্থ হয়। এক্ষেত্রে কোনো একজন আলেমের অভিমত পেলেই তাতে আস্থা তৈরি হয়ে যায়। এখানে নিজের পক্ষের হওয়াটাকেই বড় করে দেখা হয়। সে মতামতটা বিচ্ছিন্ন বা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত কিনা তা দেখার গরজবোধ করা হয় না। অথচ পৃথিবীতে যে কোনো ধর্মীয় বিধি নিষেধের ক্ষেত্রেই ভিন্ন মেরুর মত অভিমত পাওয়া যাবে। কারণ ইসলামের নামে প্রতিটি ভ্রান্ত গ্রুপের পক্ষেই আলেম নামের কেউ না কেউ অবস্থান করেই। ভ্রান্ত একটি গ্রুপ দাঁড় করাতে হলে সেখানে অল্প বিস্তর ইসলাম সম্বন্ধে জানা শোনা একজন ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। এটা না হলে ভ্রান্ত গ্রুপটা দাঁড় করানো যায় না। অনলাইনভিত্তিক অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুবাধে যে কোনো ধর্মীয় বিষয়ে ভিনদেশী আলেমের মত গ্রহণের প্রবণতা বর্তমানে অধিক হারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বক্ষ্যমাণ মিল্কব্যাংক বিষয়েও এ প্রবণতাটি লক্ষ করা গেছে। সে মতটি কতোটা যুক্তিগ্রাহ্য ও কুরআন সুন্নাহ নির্ভর তা ভেবে দেখার গরজবোধ করা হয়নি। এ কারণে ধর্মীয় নিরিখে কোনো বিষয়ের আলোচনা করতে হলে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে করতে হয়। নিছক দেশীয় পরিমণ্ডলকে সামনে রেখে আলোচনা করা হলে সেটাকে উড়িয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। বক্ষ্যমাণ মিল্ক ব্যাংকের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকে সামনে রেখে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর দেশীয় পরিমণ্ডলকে সামনে রেখে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে।

গোড়ার কথা

উৎপাদন যিনি করেন উৎপাদিত পণ্য বিষয়ে তিনিই সবচে ভালো জানেন। আরবী ভাষায় একটি প্রবাদ রয়েছে, صاحب البيت ادرى بما فيه । ঘরে কি আছে এ বিষয়ে গৃহকর্তাই সবচে ভালো জানেন। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের গতি প্রকৃতি ও মনোভাব সম্বন্ধে তাঁর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। সুতরাং মানুষের মজ্জাগত স্বভাব প্রকৃতি সম্বন্ধে আল্লাহ যেটা বলবেন সেটাই পরম সত্য ও শিরোধার্য। এক্ষেত্রে কথায় কাজে সংশয় তৈরি হলে মুসলিম হবার কোয়ালিফেকশন হারাতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের মজ্জাগত স্বভাব প্রকৃতি ও রুচি চাহিদা বিষয়ে পরিষ্কার কথা বলেছেন। সূরা বাকারার ১২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ করে বলেন, ইয়াহুদী খ্রিস্টানরা আপনার ব্যাপারে কখনো সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবেন। এখানে সামগ্রিকভাবে মুসলিমদের ব্যাপারে ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের মূল চরিত্রটা ফুটে উঠেছে। ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের এ মনোভাবটা ব্যক্তি বা কালের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের সোনালী যুগ থেকে নিয়ে অদ্যবধি সর্বযুগেই মুসলিমদের ব্যাপারে তাদের চরিত্র এক ও অভিন্ন ছিলো। স্থান কাল পাত্র ভেদে তারা তাদের চরিত্রের রূপ রেখায় পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু মূল চরিত্র তারা সবসময়ই অটুট রেখেছে। ইসলামের শুরু যুগে তারা অস্ত্র যোগে মুসলিমদের কোনঠাসা করে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মুসলিমদের ঈমানী শক্তির সমুখে তাদের অস্ত্র শক্তি বার বার চরমভাবে পরাস্ত হয়েছে। পরিশেষে তারা অস্ত্র বলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে না পেরে যুদ্ধ কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। এবার তারা নানা মাত্রিক ঘৃণিত কৌশলে মুসলিমদের ঈমানী শক্তিকে দুর্বল করার ছায়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। অর্থ, সেবা ও নারীসহ নানা প্রলোভন ও কৌশলে মুসলিমদের একতা ও ঈমানী শক্তিকে দুর্বল করার দীর্ঘ মেয়াদী মিশনে তারা অবতীর্ণ হয়। সুকৌশলে কাটা দিয়ে কাটা তোলার ফর্মুলাটাও ব্যবহার করে এক্ষেত্রে। ধীরে ধীরে তারা এতে সফলতা অর্জনে সক্ষম হতে থাকে। মুসলিমদের শক্তি ও সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হতে থাকে। ঈমানী শক্তি দুর্বল হতে থাকে। মুসলিম সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে থাকে। বৈশ্বিক নেতৃত্ব, জ্ঞান বিজ্ঞান ও অর্থনীতিসহ জাগতিক প্রতিটি অঙ্গন থেকে মুসলিমরা বিতাড়িত হতে থাকে। ফলে আজ সর্বাঙ্গনে সবচে নির্যাতিত ও নিপড়িত জনগোষ্ঠী হলো মুসলিম জাতি। ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের শত বছরের সেই পুরনো মিশন আজো প্রবল বেগে চলমান। কৃষ্টি-কালচার ও আদর্শে মুসলিমদেরকে নতজানু ও অনুগামী ভৃত্যে পরিণত করা কিংবা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে তাদেরকে সমূলে নির্মূল করাই হলো তাদের মূল টার্গেট। আজ ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের সে টার্গেট প্রায় শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে বলা যায়। আজ মুসলিমরা ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের কথা ও নির্দেশ মানতে বাধ্য। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর মুসলিমদের রাজ্য ক্ষমতা নির্ভরশীল। তাদের দেয়া যে কোনো ফর্মুলা বা প্রোডাক্ট মুসলিমগণ গ্রহণে এক প্রকার বাধ্য। ইচ্ছা করলেই মুসলিমরা তাদের দেয়া ফর্মুলা বা প্রোডাক্ট ফিরিয়ে দেয়ার অধিকার বা শক্তি রাখে না। দুই দিক থেকে মুসলিমরা তাদের দেয়া যে কোনো প্রোডাক্টকে গ্রহণ করে নিচ্ছে।

১. ঈমানী দুর্বলতা ও স্বকীয়তাহীনতা হেতু বিধানিক অবিধানিক, নৈতিক অনৈতিক যে কোনো কালচার ও প্রডাক্টকে তারা গ্রহণ করে নিচ্ছে। আরবী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, الناس على دين ملوكهم। যাপিত জীবনে জনগণ রাষ্ট্রপ্রধানদের ধর্ম-আদর্শকেই গ্রহণ করে থাকে। দুর্বল সবলকে অনুসরণ করে চলে- এটি একটি সাধারণ প্রবণতা। তাই কোনো আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সবলতা অর্জন অনেক বড় একটি উপাদান। প্রাথমিক কর্মসূচীতে এটা মূল লক্ষ হিসেবে না থাকলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে এটাকে মূল হিসেবে গ্রহণ করতেই হয়। সুতরাং ইয়াহুদী খ্রিস্টানরা যেহেতু সবল ও বিশ্বপ্রধান তাই দুর্বল মুসলমানরা তাদের আদর্শকে গ্রহণ করে নিচ্ছে।

২. সুপার পাওয়ারদের অঙ্গুলি হেলনে মুসলিম প্রধানগণ নৈতিক অনৈতিক যে কোনো কালচার ও প্রডাক্ট আমদানি করতে বাধ্য। তারা আমদানি করতে না চাইলেও তাদের রফতানি কাজে বাধা দেবার কোনো সুযোগ নেই। মুসলিম দেশের প্রধানগণ অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে অমত হলেও গুরুদের চাপে সে অমতকে বাস্তবায়িত করার কোনো সুযোগ তাদের থাকে না। নিজের জীবন ও রাজ্য ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে তাদেরকে গুরুদের চাহিদা মূল্যায়ন করতেই হয়। তা না হলে জীবন কিংবা রাজ্য ক্ষমতার উপর নেমে আসে অদৃশ্য খড়গ।

আমাদের দুর্বলতা

মিল্কব্যাংক সম্বন্ধে আলোচনাটা আমাদের দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। খ্রিস্টান বিশ্ব এটা তৈরি করেছে তাই নৈতিক কিংবা অনৈতিক যেটাই হোক সেটা আমাদের গ্রহণ করতে হবে-ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই। ইচ্ছা করলেই আমরা বা আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানরা এ ব্যবস্থাটাকে বন্ধ করে দিতে পারবেন- এমনটি বলা যায় না। ‘মাতৃদুগ্ধ ভাণ্ডার’ কালচারটা যেহেতু ভিনদেশী তাই তার পথচলাটা হতে হবে মসৃণ। অমসৃণ হলে উপর থেকে ওয়ার্ডার চলে আসাটা খুব বেশি বিস্ময়ের নয়। আর এসব ওয়ার্ডার ঢাক ঢোল পিটিয়ে আসে না। সন্তর্পণে আসে। সে নির্দেশ ধ্বনি আপামর জনতা অবধি পৌঁছে না। বাহ্যত মনে হবে, এ ছাড়পত্র সরকারের। কিন্তু মূলত সেটা উপরের ছাড়পত্র। চাপে হোক কিংবা ঈমানী দুর্বলতা বা স্বকীয়তাহীনতা থেকে হোক এ জাতীয় বিষয়গুলো সমাজে প্রচলন ঘটে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই ফিকহ বিশেষজ্ঞদের সে ব্যাপারে শিথিল হয়ে যেতে হয়। মৌলিকভাবে অবিধানিক হলেও উরফ, হাজত, জরুরত, উমুমে বালওয়া ও উজর জাতীয় অস্থায়ী ও প্রাসঙ্গিক নীতি বিধানগুলোর আলোকে বিধান বর্ণনা করতে হয়। উপস্থিত এ জাতীয় মাসআলা বলার অবকাশ থাকলেও এর মাঝে পরোক্ষভাবে আমাদের সামগ্রিক দুর্বলতা ফুটে উঠে।

মিল্কব্যাংক এর প্রতিশব্দ

মিল্কব্যাংক হলো সংক্ষিপ্ত রূপ। পূর্ণ রূপ হলো হিউম্যান মিল্কব্যাংক। এটি ইংলিশ শব্দ। ইংলিশ রূপ হলো Human milk bank । বাংলায় মাতৃদুগ্ধ ভাণ্ডার, আরবীতে বুনূকুল হালীব (بنوك الحليب), বানকুল লাবান (بنك اللبن), বুনূকুল লাবান (بنوك اللبن), বুনূকু লাবানির রাযা’ (بنوك لبن الرضاع) বা বানকু হালীবিল আদামিয়্যাত (بنك حليب الادميات), উর্দূ ভাষায় ইনসানী দুধ কা যাখিরাহ (انسانی دودھ کا ذخیرہ) ইত্যাদি।
হিউম্যান মিল্কব্যাংকের আভিধানিক সংজ্ঞা
১. হিউম্যান অর্থ মানব সম্পর্কিত, মানবীয়, মানবিক, মানবোচিত ইত্যাদি।
২. মিল্ক অর্থ দুধ, দুগ্ধ।
৩. ব্যাংকের প্রাচীন শাব্দিক অর্থ বেঞ্চ। মধ্যযুগের ইংরেজি হিসেবে ব্যাংক (Bank) শব্দটি বিভিন্ন ভাষা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে বলে ধারণা করা হয়। তবে শব্দটি কবে, কোথায় এবং কিভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কারণ দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ব্যাংকিং ইতিহাসের কোনো সঠিক ও ধারাবাহিক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। যতটুকু সংগ্রহ করা হয়েছিলো তা অনেকটা অনুমানভিত্তিক। অনেকে মনে করেন প্রাচীন লাতিন ব্যাংকিং, ব্যাংকা, ব্যাংকাস ইত্যাদি শব্দের আধুনিক রূপই হলো আজকের ব্যাংক শব্দটি। ব্যাংক শব্দটির উৎপত্তি স¤পর্কে সর্বাপেক্ষা প্রচলিত মতবাদ হচ্ছে, রেনেসাঁ যুগে ইটালীর লোম্বার্ডী (Lombardy) নামক স্থানে অবস্থিত বাজারের মধ্যে ইহুদী ব্যবসায়ীগণ লম্বা বেঞ্চ পেতে টাকা পয়সার লেনদেন করত। বেঞ্চের উপরি ভাগ সবুজ টেবিলক্লথ দিয়ে ঢাকা থাকতো। এ বেঞ্চকে ইটালীর ভাষায় ব্যাংকো (Banco) বলা হতো। টাকা পয়সা লেনদেনের কাজ যে বেঞ্চে বসে সম্পন্ন করা হতো তার বিভিন্ন আঞ্চলিক নাম ছিলো। যথা, ব্যাংকো, ব্যাংকা, ব্যাংকাস ইত্যাদি। এ শব্দগুলোর মধ্যে ব্যাংকো শব্দটিই সর্বাধিক প্রচলিত ছিলো। পরবর্তীকালে এ ব্যাংকো হতেই ব্যাংক শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। কোনো ব্যবসায়ী তার পাওনাদারদের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ব্যবসায়ীর বেঞ্চ ভেঙে ফেলত। এ বেঞ্চ ভাঙ্গা থেকে দেউলিয়া শব্দের উৎপত্তি হয়। একটি সূত্র মতে ব্যাংক ইংরেজি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ নদীর কূল, তীর বা কিনারা হলেও বর্তমানে ব্যাংককে অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। (উইকিপিডিয়া)

তবে প্রচলিত ব্যাংক শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে আরবী ভাষাবিদগণও কথা বলেছেন। তবে সেখানে ব্যাংক শব্দটির উচ্চারণ দেখানো হয়েছে বুংক (البُنْك আলবুংক)। প্রশিদ্ধ আরবী অভিধান আসসিহাহ ফিল্লুগাহে বলা হয়েছে বুংক শব্দটির অর্থ হলো মূল, শিকড়, উৎস। শব্দটি অন্য ভাষা থেকে আরবীকৃত। তবে ইবনে দুরাইদ রহ. বলেন, শব্দটি আরবী ভাষার। এর অর্থ সুবাস, সুগন্ধি। বুংক শব্দ থেকে ক্রিয়াগত ব্যবহার দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছে, وتَبَنَّكوا في موضع كذا، أي أقاموا به। অর্থ, অমুক জায়গায় তারা বসতি গড়ে তুলেছে বা বসবাস করেছে। (আসসিহাহ ফিললুগাহ, আবূ নাসর ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ আল-জাওহারী ১/৫৫)
মাজদুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন ইয়া’কুব ফিরোযাবাদী রহ. কৃত আলকামূসুল মুহীতে বলা হয়েছে, বুংক অর্থ বস্তুর মূল ও সার, রাতের সময়, সুগন্ধি। (আল-কামূসুল মুহীত, ফিরোযাবাদী ১/১২০৬)

মুহাম্মাদ মুরতাযা যাবিদী রহ. কৃত অভিধান ব্যাখ্যা গ্রন্থ তাজুল আরুসে বুংক সংশ্লিষ্ট উপরোক্ত বক্তব্যগুলোই আলোচিত হয়েছে। ওখানে আযহারী রহ. এর উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, বুংক শব্দটি ফারসী শব্দ। এর অর্থ হলো, মূল বা সারনির্যাস। (তাজুল আরুস, যাবিদী ১/৬৬৫৮)
মুহাম্মা ইবনে আহমাদ আলআযহারী রহ. তার তাহযীবুল লুগাহ গ্রন্থে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে বলেছেন, বুংক শব্দটির মূল হলো ফারসী। এর অর্থ হলো বস্তুর মূল বা সারনির্যাস। (তাহযীবুল লুগাহ, আযহারী ৩/৩৮৮)

হিউম্যান মিল্কব্যাংকের পারিভাষিক সংজ্ঞা

পরিভাষায় হিউম্যান মিল্কব্যাংক এমন একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় যেখানে স্তন্যদানকারিণী নারীদের থেকে অর্থের বিনিময়ে কিংবা দান হিসেবে বিশেষ পদ্ধতিতে তরল দুগ্ধ সংগ্র করা হয়। এবং বিশেষ পদ্ধতিতে পাস্তুরিত করতঃ সংরক্ষণ করে অসহায় দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকে অর্থের বিনিময়ে কিংবা দান হিসেবে প্রদান করা হয়।
(জিহাতুল ইসলাম; খণ্ড ১১ (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৭), সংখ্যা ১, মুহাম্মাদ উমাইর ও মুহাম্মাদ খুবাইব কৃত ইনসানী দুধ কা যাখীরা : শরীয়ত আওর কানূন কি নযর মেঁ)

মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

১৯১০ সালে আমেরিকার বোস্টন শহরে প্রফেসর টালবোট সর্বপ্রথম মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। লন্ডনে ১৯৩৫ সালে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর ডা. মারি এলিজ কায়সার জার্মানির ম্যাগডিবুরি শহরে একটি মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৪৭ সালে প্রফেসর লেলংগ পেরিসে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এশিয়া মহাদেশে সর্বপ্রথম ইন্ডিয়ার মোম্বাই শহরে ১৯৪৯ সালে লোকমানিয়া তিলাক মিউনিসিপল জেনারেল হসপিটালে ড. আর্মিদা ফর্নান্দেজ মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। সত্তর দশকে এসে মিল্কব্যাংক ধারণার বিস্তৃতি ঘটে।
বর্তমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে হাজারো মিল্কব্যাংক কাজ করছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাশ্চাত্যে ৩০ মিলিয়নের অধিক মুসলিম বসবাস করে। যাদের বড় একটা অংশ মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। মিশরের সাধারণ মার্কেটগুলোতেও মাতৃদুগ্ধ পাওয়া যায়। (জিহাতুল ইসলাম খণ্ড ১১ (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৭), সংখ্যা ১, মুহাম্মাদ উমাইর ও মুহাম্মাদ খুবাইব কৃত ইনসানী দুধ কা যাখীরা : শরীয়ত আওর কানূন কি নযর মেঁ)

মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

যে কোনো কিছু প্রতিষ্ঠার পেছনে নানা মাতৃক ধারণা ও উদ্দেশ্য কাজ করে থাকে। কোনো কোনোটা হয় মৌলিক আবার কোনো কোনোটা হয় প্রাসঙ্গিক। মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার পেছনেও রয়েছে একাধিক ধারণা ও উদ্দেশ্য।

১. আল্লাহ মাতৃ জাতির মাঝে একটি স্বাভাবিক প্রবণতা তৈরি করে দিয়েছেন যে, তারা নিজ সন্তানদেরকে দুগ্ধ পান করাবে। গর্ভধারিণী মা দুগ্ধদানে অক্ষম হলে অন্য স্তন্যদানকারিণী এসে দুগ্ধদান করবে। দুগ্ধদানের পবিত্র এ ধারা পূর্ব যুগ থেকেই চলমান ছিলো। সুতরাং শিশু কর্তৃক অন্য মায়ের দুগ্ধ পানের ইতিহাস বেশ পুরোনো। প্রতিটি সমাজ ও ধর্মেই প্রয়োজন সাপেক্ষে দুগ্ধপানের এ ধারাটি বিদ্যমান ছিলো। পাশ্চাত্য সমাজে একসময় সমঅধিকারের আওয়াজ উঠে। অধিকার বিষয়ে নারীরা পুরুষের সমকক্ষ হতে চেষ্টা করে। এতে করে চিরাচরিত পারিবারিক ব্যাবস্থা ও বৈবাহিক অবস্থায় ধস নেমে আসে। সন্তান যেহেতু স্বামী স্ত্রী উভয়ের যৌথ সম্পত্তি তাই এক্ষেত্রে দুগ্ধদানে স্ত্রীরা একক দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানাতে চেষ্টা করে। উপরন্তু তারুণ্য ও রূপ লাবণ্য ধরে রাখার নিমিত্ত দুগ্ধদানে অনাগ্রহী হয়ে উঠে নারী সমাজ। তারা দুগ্ধদানকে তারুণ্য সংহারক হিসেবে জ্ঞান করতে থাকে। এতে করে স্বেচ্ছা দুগ্ধদানকারিণী নারীদের সঙ্কট তৈরি হয়। ফলে দুগ্ধপোষ্য শিশুরা মাতৃদুগ্ধ পান থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য আন্দোলনের ফলে নারীরা অফিস আদালতসহ জগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের সমক্ষ হতে শুরু করে। ফলে দিনমান অফিস আদালতে পড়ে থাকার ফলে নারীরা নিজেদের দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকে দুগ্ধদান থেকে বঞ্চিত করতে শুরু করে। সমঅধিকার সৃষ্টির ফলে দুগ্ধবঞ্চিত শিশুদেরকে দুগ্ধদান করার মত অন্য নারীদের খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ে। এ সমস্যা সমাধানে গরু বকরির দুধ ব্যবহার শুরু হয়। ফলে মার্কেটে গরু বকরির প্রস্তুতকৃত গুড়ো দুধ ও তরল দুধ চলে আসে। কিন্তু ধীরে ধীরে ডিব্বা দুধের ক্ষতির দিকগুলো সামনে চলে আসে। ফলে বিকল্প হিসেবে মিল্কব্যাংকের ধারণা সামনে চলে আসে। (জিহাতুল ইসলাম খণ্ড ১১ (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৭), সংখ্যা ১, মুহাম্মাদ উমাইর ও মুহাম্মাদ খুবাইব কৃত ইনসানী দুধ কা যাখীরা : শরীআত আওর কানূন কি নজর মেঁ)

২. প্রচলিত অর্থব্যবস্থাটা পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। এককভাবে যে কোনো মূল্যে অর্থের পাহাড় গড়ে তোলাই হলো এ অর্থব্যবস্থার মূল লক্ষ। এ লক্ষকে সামনে রেখে এ অর্থব্যবস্থায় ব্যবসা, সেবা ও অর্থোপার্জনের নামে নিত্য-নতুন কলা-কৌশল তৈরি হচ্ছে। বক্ষ্যমাণ মিল্কব্যাংক কন্সেপ্টটিও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার একটি সূক্ষ্ম কৌশল। এগুলো সেবা শিরোনামে আত্মপ্রকাশ করলেও একসময় পেশাদার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করে। একটা সময় ছিলো যখন মানুষের বাস্তবিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে পণ্য সামগ্রী আবিষ্কার হতো। এখন আর সে ব্যবস্থা নেই। এখন পণ্যের আবিষ্কার মেকি প্রয়োজন তৈরি করে। এখন পণ্য আগে প্রয়োজন পরে। অল্প কথায় বলতে গেলে এখন প্রয়োজন পণ্য তৈরি করে না; বরং পণ্য প্রয়োজন তৈরি করে। ফলে এখন পণ্যটা আগে এসে নানা রকম কলা কৌশলে মানুষেরে মাঝে অনর্থক ও মেকি প্রয়োজন তৈরি করে। মিল্ক ব্যাংক এধরনেরই একটি আবিস্কার। ব্যাংক শিরোনামে বিশ্বে অনেক কিছুই তৈরি হয়েছে। কিছু আমাদের দেশে আমদানি হয়েছে। কিছু আমদানির অপেক্ষায় আছে। যেমন ব্লাড ব্যাংক, বীর্য ব্যাংক, কর্নিয়া ব্যাংক, মানবাঙ্গ ব্যাংক ইত্যাদি।

৩. অসহায় অনেক শিশু রয়েছে যাদেরকে নানা কারণে গর্ভধারিণী মায়ের দুধ পান করানো সম্ভব হয় না। উপরন্তু বিশ্বে অনেক শিশু নানা ধরনের দৈহিক দুর্বলতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অকালজাত শিশু (Premat babies) এদের অন্যতম। তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজন হয়। অন্য দিকে কর্মজীবী নারীরাও তাদের পেশাগত কাজের কারণে শিশুদেরকে মাতৃদুগ্ধ দিতে পারেন না। এসব শিশুরা দীর্ঘ একটা সময় মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত থাকে। এসব অসহায় ও দুগ্ধ বঞ্চিত শিশুদের বিষয়টিও মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার ধারণাটিকে ত্বরান্বিত করেছে।

স্বাভাবিক স্তন্যদানের গুরুত্ব ও উপকারিতা

কেউ ভাবতে পারেন, আমরা স্তন্যদানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করছি। একারণেই হয়তো মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার বিপক্ষে কথা বলছি। ব্যাপারটি আদৌ এরূপ নয়। স্তন্যদানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ইসলামী শরীয়াতে স্তন্যদানের গুরুত্ব বিষয়ে বিষদ আলোচনা রয়েছে। আমরা মূলত ধর্মীয় কারণে মিল্ক ব্যবস্থার বিপরীতে কথা বলছি। স্তন্যদানের প্রতি আগ্রহ বাড়াতেই আমাদের এ প্রচেষ্টা। কারণ মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার কারণে মায়েরা স্তন্যদানে অনুৎসাহিত হয়ে পড়বে। এবং মিল্কব্যাংক থেকে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ দুধ গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠবে। যেটা শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং মায়েদের জন্যও উভয় জাগতিক অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

বস্তুত স্বাভাবিক স্তন্যদান মা এবং শিশুর মাঝে সোহাগ ভালোবাসা তৈরির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, যে স্তন্য পানকাল পূর্ণ করতে চায় তার জন্য জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু বৎসর স্তন্য পান করাবে। (সূরা বাকারা; আয়াত ২৩২)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা নিজ নিজ দাবিতে অনমনীয় হও তবে অন্য নারী তার পক্ষে স্তন্য দান করবে। (সূরা তালাক; আয়াত ৬)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা যা বিধিমত দিতে চেয়েছিলে তা যদি অর্পণ করো তবে ধাত্রী দ্বারা তোমাদের সন্তানকে স্তন্য পান করাতে চাইলে তোমাদের কোনো অন্যায় হবে না। (সূরা বাকারা; আয়াত ২৩৩)

আবু উমামা বাহিলী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এমতাবস্থায় দুজন ব্যক্তি আসলো।... এরপর আমাকে নিয়ে চললো। আমি দেখতে পেলাম অনেকগুলো সাপ কিছু নারীর স্তনে দংশন করছে। আমি বললাম, এদের এ অবস্থা কেন? বলা হলো, এরা হলো ওই সকল নারী যারা নিজেদের সন্তানদেরকে স্তন্য পান করাতো না।... (মুস্তাদরাকে হাকেম; হাদীস ২৮৩৭, সহীহব ইবনে হিব্বান; হাদীস ৭৪৯১)
এ হাদীস থেকে স্তন্যদান কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়। শিশুকে স্তন্যদান থেকে বঞ্চিত করার দ্বারা শুধু জাগতিক ক্ষতিরই সম্মুখীন হতে হয় তাই নয়; বরং এ কারণে পরকালীন মর্মন্তুদ শাস্তিও বিদ্যমান রয়েছে।

বুকের দুধের উপকারিতা

১. মায়ের দুধে শিশুর প্রয়োজনীয় সব ধরণের পুষ্টি উপাদান থাকে সঠিক মাত্রায়। আর তাই ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট। মায়ের দুধে পুষ্টি উপাদান ছাড়াও আছে শতকরা ৯০ ভাগ পানি। সেজন্য শিশুকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত আলাদা পানি দেয়ার প্রয়োজন নেই।
২. বুকের দুধ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত। বায়ু বা পানি বাহিত জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হবার সুযোগ নেই। মায়ের দুধে আছে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির উপাদান। ফলে শিশুর অসুখ বিসুখ বিশেষ করে ডায়রিয়া, কান পাকা রোগ, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালীর রোগ, হাঁপানী, এলার্জি, চুলকানি ইত্যাদি সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যায়।
৩. শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মায়ের দুধ উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব শিশু কৌটার দুধ খায় তাদের তুলনায় মায়ের দুধ যারা খায় তাদের বুদ্ধির বিকাশ বেশি হয়।
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকার ফলে অসুস্থ হলেও শিশু দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে।
৫. মায়ের দুধ শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে দেয়।
৬. মায়ের দুধ সহজে হজম হয়। প্রাথমিক অবস্থায় শিশুর দেহ জটিল খাবার হজম করতে পারে না। কিন্তু মায়ের বুকের দুধের উপাদান সহজে হজম হয়।
৭. মায়ের দুধে পূর্ণমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ থাকে বলে শিশুর রাতকানা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
৮. মাতৃদুগ্ধপানে পরবর্তীতে শিশুর ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি ভয়াবহ রোগ হওয়ার সম্ভবনা কমে যায়। (https://www.banglanews24. com/health/news/bd/52636.details)

ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা

ইসলামী শরীয়ার আলোকে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা বিধিত নয়। কারণ এখানে যে প্রক্রিয়ায় মাতৃদুগ্ধ সংগ্রহ করা হয় এবং শিশুদের পান করানো হয় তাতে ইসলামী শরীয়ার অন্যতম স্পর্শকাতর বিধান দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়। অথচ পবিত্র কুরআন সুন্নাহে বেশ স্পষ্ট করে দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে।

১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, কন্যা, ভগ্নী, ফুফু, খালা, ভ্রাতুষ্পুত্রী, ভাগিনেয়ী, দুগ্ধ মাতা, দুগ্ধ ভাগিনী...। (সূরা নিসা; আয়াত ২৩)
আয়াতটিতে রক্ত সম্পর্কিত বিবাহ নিষিদ্ধ শ্রেণীর পাশাপাশি দুগ্ধ সম্পর্কিত বিবাহ নিষিদ্ধ শ্রেণীর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। রক্ত সম্পর্কের কারণে যেমন বিবাহ নিষিদ্ধের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় তদ্রƒপ দুগ্ধ সম্পর্কের কারণেও বিবাহ নিষিদ্ধের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

২. আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রক্তগত সম্পর্কের কারণে যেসব বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি হয় দুগ্ধগত সম্পর্কের কারণেও সেসব বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি হয়। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৩৬৫২)
হাদীসটিতে নিঃশর্তভাবে দুগ্ধগত সম্পর্ক প্রসূত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। এখানে কোনো ধরনের শর্ত আরোপিত হয়নি। সুতরাং মিল্কব্যাংকের দুগ্ধপানে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রশিদ্ধ মাজহাব চতুষ্টয়েও এ সিদ্ধান্ত গ্রহীত। (তাবয়ীনুল হাকায়িক ৩/১৮৫, জাওয়াহিরুল ইকলীল ১/৩৯৯, আল-বাহরুর রায়িক ৩/৬৪৫, আশ-শরহুল কাবীর লিদ-দারদীর ২/৫০৩)

৩. ১৯৮৫ সালে ওআইসির ইসলামিক ফিকহ একাডেমিতে মিল্কব্যাংক বিষয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিশ্বের বড় বড় ফিকহ বিশেষজ্ঞগণ অংশগ্রহণ করেন। সেমিনারে বড় বড় আলেমদের উপস্থাপতি মিল্কব্যাংক বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা বৈধ নয়। নি¤েœ সে পর্যালোচনার সারনির্যাস উল্লেখ করা হলো।

(ক) মিল্কব্যাংক বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্ব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে তাতে তত্ত্বগত ও প্রযুক্তিগত জটিলতা প্রকাশ পেয়েছে। ফলে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ ও গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে।
(খ) ইসলাম ধাত্রীত্ব সম্পর্ককে রক্তগত সম্পর্কের মত বিবেচনা করে। মুসলিম আইন শাস্ত্রজ্ঞদের ঐকমত্যে রক্তগত সম্পর্কের কারণে যেসব বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি হয় দুগ্ধগত সম্পর্কের কারণেও সেসব বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি হয়। আর বংশগত ধারার সংরক্ষণ ইসলামী শরীয়ার মূল লক্ষবস্তুগুলোর অন্যতম। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা বংশগত সম্পর্কের মাঝে বিশৃঙ্খলা ও সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করে।
(গ) মুসলিম বিশ্বের সামাজিক অবকাঠামোই সবিশেষ ক্ষেত্রসমূহে স্বাভাবিক স্তন্যদানের মাধ্যমেই অকালজাত শিশু, লো বার্থ ওয়েট বেবি তথা জন্মকালীন স্বল্প ওজনের শিশু কিংবা মাতৃদুগ্ধ নির্ভর শিশুদের মাতৃদুগ্ধের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট সক্ষমতা রাখে। সুতরাং এক্ষেত্রে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার আর কোনো প্রয়োজনীয়তাই বাকি থাকে না।
অতএব উপরোক্ত বিবেচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো-
(ক) মুসলিম বিশ্বে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ।
(খ) মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদেরকে দুগ্ধ দান করানো হলে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি হবে। তাই এখান থেকে দুগ্ধপান নিষিদ্ধ।
(আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-বাসসাম, তাওযীহুল আহকাম মিন বুলূগিল মারাম ৬/১৮, ওয়াহবাহ আয-যুহাইলী, আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহ ৭/১০৭, মাজাল্লাতু মাজমায়িল ফিকহিল ইসলামী আদ-দুয়ালী; সংখ্যা ২, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৮৩)
আরবের অন্যান্য উলামায়ে কেরামও মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে অবিধানিক বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, শাইখ মুহাম্মদ ইবনে সালিহ আলউসাইমীন, শাইখ আব্দুর রহমান আননাজ্জার, শাইখ মুহাম্মাদ হুসামুদ্দীন, শাইখ যুহাইর আসসিবায়ী, শাইখ মুহাম্মাদ আলবার, শাইখ মুহাম্মাদ আশ-শাতিরী প্রমুখ উলামায়ে কেরাম।
৪. আরবের নির্ভরযোগ্য ফতওয়া ও ইলমী গবেষণা কমিটি আললাজনাতুদ দায়িমাহ-এ মিল্কব্যাংক বিষয়ে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিলো। সেখানে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাকে অবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নিম্নে উক্ত প্রশ্নোত্তরটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : ক্লিনিকে মায়েরা দুগ্ধ দোহন করে রেখে যায়। এবং সে দুধকে ফ্রিজে রেখে দেয়া হয়। এরপর শিশুদেরকে সেখান থেকে দুধ পান করানো হয়। এখানে কে দুগ্ধদানকারিণী আর কে দুগ্ধপানকারী তা জ্ঞাত থাকে না। এ পদ্ধতি ইসলামী শরীয়াসম্মত কি না?
উত্তর : সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। সালাত ও সালাম ওই নবীর উপর যার পর আর কোনো নবী আসবে না। পরকথা, ২৩.৪.১৪১৩ তারিখে মুহতারাম স্বাস্থ্য মন্ত্রী মহোদয়ের পক্ষ থেকে প্রধান মুফতী বরাবর ও সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল বরাবর যে প্রশ্নটি করা হয়েছে সে সম্বন্ধে ফতওয়া প্রদান ও ইলমী গবেষণার স্থায়ী কমিটি অবগতি লাভ করেছে। মন্ত্রী মহোদয় যে প্রশ্নটি করেছিলেন তা নিম্নরূপ : অনেক ডাক্তার মায়েদের দোহনকৃত মাতৃদুগ্ধ পান করিয়ে থাকে। দুগ্ধকে দোহন করে ফ্রিজে রেখে দেয়া হয়। এরপর অন্য শিশুকে সে দুধ পান করানো হয়। এক্ষেত্রে দুগ্ধদাত্রী মা ও দুগ্ধপানকারিণী শিশু কারো পরিচয় জানা থাকে না। শিশুদেরকে অপরিচিত মায়ের দুগ্ধ পান করানোর কারণ হলো স্বাভাবিক মাতৃদুগ্ধ নানা ধরনের শিশু রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মহোদয় সমীপে আশা করছি, এ বিষয়ে শরয়ী বিধান জানিয়ে আমাদেরকে উপকৃত করবেন। (ফাতওয়া ১৫৯৯০)
গবেষণা শেষে উক্ত কমিটি যে উত্তর প্রদান করেছে তা নিম্নরূপ-
শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে মায়েদের দুগ্ধ দোহন করতঃ তা সংরক্ষণ করে অন্য শিশুদেরকে পান করানো বৈধ নয়। কারণ এ ব্যবস্থার মাঝে অস্পষ্টতা রয়েছে। যাতে দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা পদ্ধতি বিনষ্ট হয়ে যায়। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে উক্ত ব্যবস্থায় দুগ্ধপানের মাধ্যমে দুগ্ধপানকারী শিশু ও দুগ্ধদানকারিণী মায়ের সাথে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা তৈরি হয়ে যায়। কারণ রক্ত সম্পর্কের কারণে বৈবাহিক যে নিষেধাজ্ঞা তৈরি হয় দুগ্ধ সম্পর্কের কারণে ঠিক একই বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা তৈরি হয়। অন্য দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সংশয়-সন্দিহান থেকে বেঁচে থাকলো সে তার দীন ও মান সম্মানকে রক্ষা করতে পারলো। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৫২)
সুতরাং এসব কারণে দুগ্ধনির্ভর শিশুদের দুধ পান করানোর জন্য মাতৃদুগ্ধ ভাণ্ডার তথা মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা বৈধ নয়। একমাত্র আল্লাহর নিকটই কর্মক্ষমতা কামনা। সাল্লাল্লাহু আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ ওয়া আলিহী ওয়া সাহবিহী ওয়া সাল্লাম।- বাকার আবূ যাইদ, আব্দুল আযীয আলুশ শাইখ, সালিহ আলফাউযান, আব্দুল্লাহ বিন গুদইয়ান, আব্দুর রাযযাক আফীফী, আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রহ.। (ফাতাওয়া আল-লাজনাতিদ দায়িমাহ লিল-বুহুসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল-ইফতা ২১/৪৩-৪৪)

মিল্কব্যাংক ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে বংশীয়ধারা

বংশধারা সংরক্ষণ ইসলামী শরীয়াতের অন্যতম একটি লক্ষ ও উদ্দেশ্য। সুতরাং এ লক্ষ বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। এ লক্ষ ও উদ্দেশ্য অর্জনে যেসব জিনিস বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিংবা যেসকল জিনিসের মাধ্যমে তাতে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে সেগুলোকে নিষিদ্ধ করাও আবশ্যক হবে। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে বংশ রক্ষার লক্ষ্যটি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কারণ একে তো সেখানে সকল নারীর দুধকে মিশ্রিত করে ফেলা হয়। দ্বিতীয়ত প্রত্যেক নারীর দুধ আলাদা করে রাখা হলেও তাতে দুগ্ধপানকারী শিশু ও দুগ্ধদানকারিণী নারীর মধ্যকার পরিচিতি রক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে কে কার দুধ পান করেছে তা অজ্ঞাত থেকে যায়। ফলে এ বিষয়টি বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে একটি স্পর্শকাতর সংশয় ও দুর্বোধ্য জটিলতা তৈরি করবে। সুতরাং বংশ রক্ষার মাঝে বিভ্রান্ত সৃষ্টির উপলক্ষ তৈরি করা কিংবা বংশ রক্ষার ধারাকে বিলুপ্ত করার উপায় তৈরি করা স্পষ্ট হারাম ও নিষিদ্ধ। ইসলামী শরীয়াতের একটি মূলনীতি হলো যে উপায় গ্রহণে হারামের মাঝে পতিত হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে সে উপায়কে পরিত্যাগ করা নিশ্চিত এবং সে উপায় গ্রহণ করা হারাম ও নিষিদ্ধ। (ওয়ালীদ সাঈদান, আল-ইফাদাতুশ শারঈয়্যাহ ফী বা’যিল মাসাইলিত তিব্বিয়্যাহ )

মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা অনেককেই নিজের অজান্তেই হারাম কাজে ব্যাপৃত করে দিবে। কেউ এমন এক নারীকে বিবাহ করলো যে এ নারীর দুগ্ধ পান করেছে অথবা তার মেয়ের দুধ পান করেছে কিংবা তার মার দুধ পান করেছে। এটা বড় ধরনের একটি জটিলতা, যেটা বংশ মিশ্রণে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং হারামের ছিদ্রপথ বন্ধ করার স্বার্থে হলেও মিল্কব্যাংকের এ ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করা আবশ্যক।
মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চিকিৎসাগত, সামাজিক ও ধর্মীয় দিক থেকে নানা ধরনের সমস্যা ও অসঙ্গতি রয়েছে। এসব অসঙ্গতির দিক থেকে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার কোনো প্রয়োজনীয়তাই আর অটুট থাকে না। পাশ্চাত্যের যে কোনো আহবানেই সাড়া দেয়া কিংবা যে কোনো ব্যবস্থার সাথে সহমত পোষণ করা তো আমাদের জন্য আবশ্যক নয়; বরং এটা আমাদের জন্য মানহানিকর ও স্বকীয়তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। আমরা কি সে সতর্কবাণীকে ইতিবাচক রূপে গ্রহণ করবো, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিঃসন্দেহে তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি নীতি অনুসরণ করবে বাহুতে বাহুতে, হাতে হাতে এবং বিঘতে বিঘতে। এমনকি তারা যদি শাণ্ডার (মরুচারী গুইসাপ প্রজাতির এক ধরনের জন্তু বিশেষ) গর্তের ভিতরে প্রবেশ করে তাহলে তোমরাও সেখানে প্রবেশ করবে। (বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন,) আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তারা কি ইহুদী নাসারা? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে আর কারা? (সহীহ বুখারী; হাদীস ৩৪৫৬)

পৃথিবীর যেখানেই বিশেষ প্রয়োজনে মানবতার সেবার নামে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছে তা সেবার আবেদনকে অটুট রেখে টিকে থাকতে পারেনি। তারা বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে ব্যবসায়িক রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। যার জ¦লন্ত উদাহরণ ব্লাড ব্যাংক। সুতরাং মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা পেলে ধীরে ধীরে তার সেবার আবেদন হারাবে। এক সময় তা দুগ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত হবে। বাণিজ্যিক পলিসি গ্রহণের ফলে এর পরিধি বৃদ্ধি পাবে। পুঁজিবাদী চিন্তাধারার অন্যান্য মানুষগুলো এতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ফলে বংশ মিশ্রণের ধারা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
ইসলামী শরীয়াতের বিধান হলো, স্ত্রী যে কোনো শিশুকেই দুগ্ধদান করবে না। এবং স্বামীর অনুমতি ছাড়া দুধ পান করাবে না। কাউকে দুগ্ধদানের প্রয়োজন হলে সেটা স্মরণে রাখবে। এবং তার বংশের লোকদের জানিয়ে রাখবে। যাতে দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা রীতি ধ্বংস না হয়ে যায়। ইসলামী শরীয়তে স্তন্যদান একটি গুরুতর স্পর্শকাতর বিষয়। সুতরাং এ সংক্রান্ত বিস্তৃত বিষয়গুলো খুব বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। বংশধারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া এবং অসহায় শিশুদেরকে দুগ্ধদান প্রক্রিয়াকে যৌথভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না দেয়া- এ দু’টি ক্ষতির মাঝে কোনটি গুরুতর তা নির্ণয় করা খুবই প্রয়োজন। বড় ক্ষতি গ্রহণ করে ছোট ক্ষতিকে দূরীভূত করা শরীয়াসঙ্গত নয়।

অনেক নারীই তাদের যৌবন ও ফিগার অটুট রাখার জন্য শিশুদেরকে স্তন্যদান থেকে বিরত থাকেন। মিল্ক ব্যবস্থার ফলে এ ধরনের নারীদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে সন্দেহ নেই। অথচ স্তন্যদানের কারণে যৌবন বা ফিগার নষ্ট তো হয়ই না; বরং এতে নানা ধরনের স্তনব্যধিসহ অন্যান্য সমস্যা থেকে পরিত্রাণ লাভ করা যায়। এগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানীদেরই কথা।
আত-তাবীব : আদাবুহু ওয়া ফিকহুহ-এর গ্রন্থকার বলেন, ১৯৮৩ সনের জানুয়ারি মাসে আমেরিকায় সফরকালে সেখানে কাজ করে এমন একটি শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিষদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারা আমাকে জানায় আমেরিকাতে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা মৃতপ্রায় অবস্থায় উপণীত হয়েছে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে।
১. মিল্কব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা বিরল।
২. এটা নিতান্ত ব্যয়বহুল।
৩. স্বেচ্ছা দুগ্ধদানকারিণী মায়েদের সংখ্যা বিরল।
৪. মেয়াদ উত্তীর্ণের কারণে সংরক্ষিত দুধের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। (আত-তাবীব : আদাবুহু ওয়া ফিকহুহ; পৃষ্ঠা ৩৪৫-৩৫৫)
এ পরিসংখ্যান থেকে খুব সহজেই বের হয়ে এসেছে, উন্নত বিশ্বে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার মাত্রা কতটুকু। সুতরাং আমাদের দেশে যে এর প্রয়োজনীয়তার হার বহুলাংশে কম হবে তা বলাই বাহুল্য।

মিল্কব্যাংক বিষয়ে আরবের সমাজ বিজ্ঞানী ড. আলী ফাহমীর অভিমত

সমাজ বিজ্ঞানী ড. আলী ফাহমী বলেন, যদি মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে তা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হবে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে অসামাজিক একটি ব্যর্থ প্রজন্মের জন্ম হবে, যারা সমাজ ও পরিবেশের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারবে না। উপরন্তু নানা রকম রোগ ব্যধিতে আক্রান্ত একটি প্রজন্ম তৈরি হবে। কারণ যেসব মায়েরা মিল্কব্যাংকে অর্থের বিনিময়ে দুধ বিক্রি করবে তাদের গর্ভজাত শিশুরা স্বাভাবিক মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হবে। সাথে সাথে ব্লাড ব্যবসার মত অনেক নারী বুকের দুধ ব্যবসায় উৎসাহিত হয়ে উঠবে। এবং এ মাতৃদুগ্ধ ব্যবসায় এমন নিম্ন শ্রেণীর নারীরাও এগিয়ে আসবে যারা বহু রোগের ধারক বাহিকা। আমার ভাবতেও অবাক লাগে যে, কী করে এটি একটি মানবিক কাজ হতে পারে। কারণ এ ব্যবস্থা হাজারো নারীকে তাদের গর্ভজাত শিশুকে দুগ্ধদান থেকে বঞ্চিত করতে প্ররোচিত করবে। আর এতে শিশুর মানসিক জটিলতা তো থাকবেই। (আল-ইসলাম ওয়াল-মুশকিলাতুত তিব্যিয়্যাহ আল-মুআসারাহ; পৃষ্ঠা ৪৬৫, ৪৬৬)

মিল্কব্যাংক বিষয়ে মিশরের দুগ্ধ হিমায়ন ও সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ মুহাম্মাদ ফুয়াদ ইসমাঈলের অভিমত

অধ্যাপক মুহাম্মাদ ফুয়াদ ইসমাঈল বলেন, আল্লাহ মানুষকে সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ফলে একজন নারীর মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব অটুট থাকবে না। বরং এতে করে সে দুগ্ধবতী গাভী, মহিষী কিংবা ভেড়ীতে রূপান্তরিত হবে। এদের দুধ সংগ্রহ করা হবে। এরপর হিমায়ন বা শুষ্ককরণসহ নানা উপায়ে তা সংরক্ষণ করা হবে। একজন মানুষ এ ব্যবস্থাকে কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারে না। (আল-ইসলাম ওয়াল-মুশকিলাতুত তিব্যিয়্যাহ আল-মুআসারাহ; পৃষ্ঠা ৪৬৫, ৪৬৬)

মিল্কব্যাংক বিষয়ক ইতিবাচক বক্তব্য ও পর্যালোচনা

আরবের কয়েকজন আলেম মিল্কব্যাংকের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, ড. ইউসুফ কারযাভী, শাইখ আতিয়া সাকর, মিশরের মুফতী আব্দুল লতীফ হামযাহ প্রমুখ উলামায়ে কেরাম।
ড. ইউসুফ কারযাভী সাহেব দু’টি কারণে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাকে বৈধ বলেন- (১) রাযা’ এর সংজ্ঞা, (২) সংশয়।
তাঁর মতে দুগ্ধপ্রসূত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ হলো, স্তন্যদানকারিণী মাতৃত্ব। স্তন্যদানকারিণী মাতৃত্বের কারণেই মূলত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয়। সুতরাং যেখানে এ কারণ উপস্থিত নেই সেখানে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না। আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মিল্কব্যাংক ব্যবস্থায় যেহেতু স্তন্যদানকারিণী মাতৃত্ব থাকে না তাই এখানে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না। কারণ মিল্কব্যাংকগুলোতে দুগ্ধদানকারিণী নারীদের কাছ থেকে বিশেষ মেশিনের মাধ্যমে দুগ্ধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর সে দুধকে বোতলজাত করে ফ্রিজে রেখে দেয়া হয়। এরপর সময় সুযোগে দুগ্ধপোষ্য অনাথ শিশুদেরকে সেখান থেকে দুধ পান করানো হয়। এখানে মাতৃত্ব ও মাতৃস্তন চোষণের কোনোটিই থাকে না। এ কারণে ড. ইউসুফ কারযাভী সাহেব মিল্ক ব্যবস্থায় শরয়ী কোনো সমস্যা দেখেন না। রাযাআর সংজ্ঞার মাঝে যেহেতু মাতৃত্ব ও মাতৃস্তন চোষণ বিষয়টি বিদ্যমান রয়েছে তাই তিনি রাযাআর সংজ্ঞা থেকে এ কার্য কারণ নির্গত করেছেন। (সিলসিলাতু মাতবূআতি মুনাজ্জামাতিত তিব্বিল ইসলামী; পৃষ্ঠা ৫২-৫৫)

শায়খ ইউসুফ কারযাভী সাহেবের অভিমতের পর্যালোচনা

এ পর্যায়ে আমরা শাইখ ইউসুফ কারযাভী গৃহীত মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা বৈধ হওয়ার দু’টি ভিত্তি নিয়ে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করবো।

প্রথম ভিত্তি : রাযাআতের সংজ্ঞা

শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেবের নিকট মিল্কব্যাংক বৈধ হওয়ার প্রথম ভিত্তিটি হলো, স্তন চোষণ। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থায় স্তন চোষে শিশুরা দুগ্ধ পান করে না। সুতরাং দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না। কারণ দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার জন্য চোষণ যোগে মাতৃ দুগ্ধপান আবশ্যকীয় শর্ত। কারণ রাযাআত মানেই স্তন চোষণ যোগে মাতৃদুগ্ধপান। (ইউসুফ কারযাবী, ফাতাওয়া মুআসারা ২/৫৫৫)
আমরা বলবো, দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে চোষণ যোগে মাতৃদুগ্ধ পানের শর্ত দু একজন আলেম ছাড়া কেউ করেননি। মুসলিম উম্মাহর সকল ফকীহ দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার জন্য স্বাভাবিক মাতৃদুগ্ধ পানকেই শর্ত করেছেন।

যে কোনো উপায়ে শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করলে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয়ে যাবে। এখানে দুগ্ধ চোষণ কিংবা পান মুখ্য কোনো বিষয় নয়। বরং এ দুগ্ধের মাধ্যমে শিশুর খাদ্য চাহিদা পূরণ ও ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে শিশুর দৈহিক প্রবৃদ্ধি ঘটলেই বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আমরা শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেবের মত আরবী الرضاع শব্দের আভিধানিক অর্থটিও লক্ষ করতে পারি। মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব ফিরোযাবাদী কৃত আলকামূসুল মুহীত (১/৯৩২)-এ রিযা’ শব্দের আভিধানিক সংজ্ঞা করা হয়েছে মাতৃস্তন চোষণ। অধিকাংশ অভিধানবিদই এ অর্থটি করেছেন। তবে এখানে চোষণ দ্বারা নিছক চোষণ উদ্দেশ্য নয়; বরং পান করাটা হলো মূল লক্ষ্য। মাতৃস্তন শুধু চোষণ করা হলে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা আদৌ প্রমাণিত হবে না। এ ব্যাপরে সকল ফিকহবিদগণ একমত। বাংলা অভিধানেও (বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ৪৩১) চোষা শব্দের অর্থ করা হয়েছে, মুখ দিয়ে চুষে খাওয়া। ইবনে ফারেস রহ. এ বিষয়টিকেই পরিষ্কার করে বলেছেন। তিনি রিযা’ শব্দের সংজ্ঞা করতে গিয়ে বলেন, রিযা হলো স্তন থেকে দুধ পান করা। (মু’জামু মাকায়ীসিল লুগাহ ২/৩২৯)
ইমাম যাবিদী রহ. রাযা’ শব্দের সংজ্ঞায় নিম্নোক্ত হাদীসটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন। তখন আমার কাছে এক ব্যক্তি বসা ছিলো। ব্যাপারটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বেশ বিরক্তিকর অনুভূত হলো। তাঁর চেহারায় গোস্বা দেখতে পেলাম। তখন আমি বল্লাম, আল্লাহর রাসূল! সে আমার দুধ সম্পর্কীয় ভাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভালো করে ভেবে দেখো দুধ সম্পর্কিত ভাই কে হয়? কারণ ক্ষুৎ-পিপাসা নিবারণের মাধ্যমেই রিযাআহ প্রমাণিত হয়। (মুসনাদে আহমাদ; হাদীস ২৪৬৭৬, সুনানে নাসায়ী মুজতাবা; হাদীস ৩৩১২)
এরপর যাবিদী রহ. রাযাআহ সংশ্লিষ্ট হাদীসটির ব্যাখ্যা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, যে স্তন্যদান বিবাহকে নিষিদ্ধ করে তা প্রমাণিত হবে শৈশবকালে শিশুর ক্ষুধার সময়। (তাজুল আরুস ১/৫২৬০)

ইমাম ইবনে কুতাইবা রহ. হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেন, যে স্তন্যপান শিশুকে ক্ষুৎপিপাসা থেকে মুক্তি দেয় তাই মূলত রাযা’। (তাবীলু মুখতালাফিল হাদীস ১/২৮২)
ইমাম শা’বী রাযি. বলেন, দু বছরের ভিতরে যদি কোনো শিশুকে মুখে অথবা নাকে ঢেলে দেয়ার মাধ্যমে মাতৃদুগ্ধ পান করানো হয় তাহলেও দুগ্ধ সংশ্লিষ্ট বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে। ইমাম আব্দুর রাযযাক রহ. বলেন, মানুষ এ নীতির উপরই চলে আসছে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক; হাদীস ১৩৮৯৪, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা; হাদীস ১৭০৬৪)
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, স্তন্যদানের মাধ্যমে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা তখনই প্রমাণিত হবে যখন তা পাকস্থলীতে গিয়ে পতিত হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ১৯৪৬)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, স্তন্যদানের কারণে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না যতক্ষণ না তার মাধ্যমে অস্থি শক্তিময় হয় এবং গোশত বৃদ্ধি হয়। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ২০৬১)
বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণের জন্য মাতৃদুগ্ধ পাকস্থলীতে পৌঁছাই যথেষ্ট। এর জন্য মাতৃস্তন চোষণ যোগে দুগ্ধপান জরুরী নয়। মাজহাব চতুষ্টয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও এটি। (আল-মাজাল্লাতুল উর্দুনিয়্যাহ ফিদ-দিরাসাতিল ইসলামিয়্যাহ; খণ্ড ৯, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ১৬৯)

শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেব যাদের বক্তব্যের আলোকে প্রচলিত মিল্কব্যাংককে বৈধ বলেন তাদের নিকট বয়স্ক কেউও যদি কোনো নারীর দুধ পান করে তবুও বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, একারণে কি তারা বয়স্কদের জন্য চোষণের মাধ্যমে দুগ্ধ পান করাকে বৈধ বলেন বা বৈধ হবে? এক্ষেত্রে যে হাদীসটিকে তারা প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন তা হলো, আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ হুযাইফা রাযি. এর গোলাম সালেম তাঁর পরিবারের সাথে তাঁদের ঘরে থাকতো। একদা সুহাইল রাযি. এর কন্যা সাহলা রাযি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললো, সালেম তো অন্যান্য পুরুষের ন্যায় প্রাপ্ত বয়সে উপণীত হয়ে গেছে। এবং অন্যান্য পুরুষের মত জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে গেছে। সে আমাদের কাছে যাতায়াত করে। আমার মনে হয় এতে আবূ হুযাইফার মনোকষ্ট সৃষ্টি হচ্ছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, তুমি তাকে দুগ্ধ পান করিয়ে দাও। ফলে এতে তোমার ও তার মাঝে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি হয়ে যাবে। এবং আবূ হুযাইফার যে মনোকষ্ট আছে তাও দূরীভূত হয়ে যাবে। সে ওখান থেকে ফিরে আসে। পরবর্তীতে সে বলে, আমি তাকে দুধ পান করিয়েছি। ফলে আবূ হুযাইফার মনোকষ্ট দূর হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৩৬৭৪)

সালেম রাযি. তখন প্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন। সহীহ মুসলিমের ৩৬৭৭ নম্বর হাদীসে তাকে শ্মশ্রুমণ্ডিত বলা হয়েছে। সহীহ মুসলিমের ৩৬৭৩ নম্বর হাদীসে বলা হয়েছে, সালেম রাযি. ইতিপূর্বে বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলো। এ হাদীসে শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন পুরুষকে দুগ্ধ পান করানোর কথা বলা হয়েছে। এখানে দুগ্ধ পান করানোর পদ্ধতিটা কিরূপ ছিলো? এখানে কি সালেম রাযি. আবূ হুযাইফা রাযি. এর স্ত্রী থেকে চোষণ যোগে দুগ্ধ পান করেছিলেন? উত্তর হলো না। এমনটি কল্পনা করাটাও কষ্টকর। হাদীসের সকল ব্যাখ্যাকারই বলেছেন, এখানে তিনি চোষণ যোগে দুগ্ধ পান করেননি। বরং বিনতে সুহাইল রাযি. দুগ্ধ দোহন করে তাকে দিয়েছেন এবং সালেম রাযি. সে দুগ্ধ পান করেছেন। আবূ উমর ইবনে আব্দুল র্বা রহ. বলেন, প্রাপ্ত বয়স্ককে দুগ্ধদানের পদ্ধতিটা ছিলো এরূপ, তাঁর দুগ্ধ দোহন করা হয়েছে এবং তাকে পান করানো হয়েছে। নারী তার স্তনকে প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো পুরুষের মুখে পুরে দিবে এটা কোনো আলেমের নিকট বিধিত নয়। কাযী ইয়ায রহ. বলেন, সম্ভবত সাহলা রাযি. নিজের দুধ দোহন করেছেন। এরপর স্তনের স্পর্শ ছাড়াই সালেম রাযি. দুগ্ধ পান করেছেন। এক্ষেত্রে দু’জনের ত্বকের মিলন হয়নি। কারণ স্তন দেখা বা স্পর্শ করা জায়েয নেই। ইমাম নববী রহ. বলেন, এটাই সুন্দর ব্যখ্যা। (শরহুয যারকানী আলা মুয়াত্তা মালিক ৯/১৭৯)
তবে এ হাদীস থেকে ঢালাওভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের দুগ্ধপানের ফলে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণের রীতি গ্রহণের সুযোগ নেই। কারণ এ বিষয়টি একান্তভাবে সালেম রাযি. এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যতিক্রম সিদ্ধান্ত ছিলো। সাধারণ সিদ্ধান্ত ওইটাই যা অন্যান্য হাদীস থেকে প্রমাণিত। অর্থাৎ একমাত্র শৈশবকালীন দুগ্ধপানেই বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে। এ বিষয়টি সহীহ মুসলিমের হাদীস থেকেও প্রমাণিত।

যায়নব বিনতে আবূ সালামাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উম্মে সালামা রাযি. বলতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সকল স্ত্রী প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় দুগ্ধ পান করানোর মাধ্যমে কাউকে নিজেদের নিকট আসতে দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন। এবং তাঁরা আয়িশা রাযি. কে বলতেন, আল্লাহর শপথ! আমরা এটাকে একটি বিশেষ অনুমোদন হিসেবে বিশ্বাস করি যে অনুমোদন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালেম রাযি. কে বিশেষভাবে দিয়েছিলেন। সুতরাং এ জাতীয় দুগ্ধপান দ্বারা কেউ আমাদের নিকট আসতে পারবে না এবং আমাদের দেখতেও পারবে না। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৩৬৭৮)

দ্বিতীয় ভিত্তি : সংশয়-সন্দেহ

শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেবের নিকট মিল্কব্যাংক বৈধ হওয়ার দ্বিতীয় ভিত্তি হলো সংশয় ও সন্দেহ। তাঁর বক্তব্য মতে মিল্কব্যাংক ব্যাবস্থাপনায় সকল নারীর দুধকে সংমিশ্রিত করা হয়। বিধানগত দিক থেকে মিশ্রিত দুধ আর অমিশ্রিত দুধ এক পর্যায়ের নয়। তিনি এর সপক্ষে ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. এর অভিমতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, যখন এক নারীর দুধ অন্য নারীর দুধের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায় তখন অধিক দুধের অধিকারী নারীর বিধানই প্রাধান্য পাবে। স্বল্প দুধের অধিকারীর বিষয়টি বিধানগত বিষয়ের পর্যায়ে পড়বে না। কারণ মিশ্রিত দুধের ক্ষেত্রে অধিক দুধের বিপরীতে স্বল্প দুধের কার্যকারিতা প্রকাশ পায় না। আর মিল্কব্যাংক ব্যবস্থায় কোন নারীর দুধ বেশি আর কোন নারীর দুধ কম তা অজ্ঞাত। স্বতঃসিদ্ধ কথা হলো, দুগ্ধপানের বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি হলে তাতে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয় না। কারণ মূল হলো নারী পুরুষের বিবাহ বৈধ হওয়া। সুতরাং স্বাভাবিক এ বৈধতাকে সুনিশ্চিত দুগ্ধপান ছাড়া নাকচ করা যাবে না।
শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেব ইবনে কুদামা রহ. এর নিম্নোবক্তব্য দ্বারা তার বক্তব্যের ইতি টানেন।- যখন দুগ্ধপান প্রমাণে অথবা নিষিদ্ধ দুগ্ধপানের সংখ্যায়নে সংশয় তৈরি হবে তখন বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না। কারণ মূল হলো বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত না হওয়া। সুতরাং নিছক সন্দেহের কারণে সুনিশ্চিত বিষয়কে নাকচ করা যায় না। যেমন তালাক প্রদান ও তার সংখ্যায়নে সংশয় সৃষ্টি হলে মূল তালাক না হওয়া ও ন্যুনতম সংখ্যাকেই আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি।

পর্যালোচনা

প্রথম কথা হলো, শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেব হানাফী মাসলাক থেকে ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেটা এ মাসলাকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কোনো মত কিনা সেটা উল্লেখ করেননি। স্বীকৃত কোনো মাযহাব থেকে বক্তব্য গ্রহণ করা হলে গ্রহণযোগ্য ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বক্তব্যটিই গ্রহণ করা উচিত। বিচ্ছিন্ন বা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নয় এমন বক্তব্য গ্রহণ করা উচিত নয়। অথচ এখানে ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. এর বক্তব্যটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বক্তব্য নয়। হানাফী মাসলাকে এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বক্তব্য হলো, দুই বা ততোধিক নারীর মিশ্রিত দুধ কোনো শিশু পান করলে সকলের সাথে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে। কারণ সকল নারীর দুধ শ্রেণীগত দিক থেকে একজাতীয়। একজাতীয় বস্তু একটির উপর আরেকটি প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। সুতরাং একজাতীয় এক বস্তু অন্য বস্তুর সাথে মিশ্রিত হলে কোনোটির কার্যকারিতাই নিঃশেষ হবে না। অতএব স্বল্প পরিমাণের বস্তু অধিক পরিমাণের বস্তুর মাঝে নিঃশেষিত হয়ে যাবে না। সুতরাং দুই নারীর দুধই অংশ অনুপাতে গোশত বৃদ্ধি, অস্থি দৃঢ়করণ ও ক্ষুধা নিবারণে ভূমিকা রাখবে। কারণ একটি অন্যটির শক্তিকে নিঃশেষ করতে পারে না। এর প্রমাণ হলো, যদি কোনো ছিনতাইকারী কারো থেকে তেল ছিনতাই করে নিয়ে সমজাতীয় অন্য তেলের সাথে মিশ্রিত করে ফেলে তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে এ তেলের মাঝে উভয়ের অংশদারিত্ব প্রমাণিত হবে। (বাদায়িউস সানায়ি’ ৩/৪০৯)

তদ্রূপ কোনো ব্যক্তি যদি শপথ করে বলে যে আমি নির্দিষ্ট এ গাভীর দুধ পান করবো না, পরবর্তীতে সে এ গাভীর দুধের সাথে অন্য গাভীর দুধ মিশ্রিত করে পান করে তাহলে সে শপথ ভঙ্গকারী হিসেবে পরিগণিত হবে। (ফাতহুল কাদীর ৩/৪৩৪)

দ্বিতীয়ত শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেব সংশয় সন্দেহের কথা বলেছেন। কোন শিশু কোন নারীর দুধ পান করেছে তা যেহেতু অজ্ঞাত তাই অজ্ঞতার কারণে সংশয় তৈরি হয়েছে। সুতরাং এ সংশয়ের কারণে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না। এখানে কথা হলো ঘটনাক্রমে সংশয় সৃষ্টি হয়ে যাওয়া আর সংশয় সৃষ্টি করা এক বিষয় নয়। ফিকহের গ্রন্থগুলোতে যে সংশয়ের কারণে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত না হওয়ার কথা বলা হয়েছে সেটা হলো ঘটনাক্রমিক সৃষ্ট সংশয় সন্দেহ। স্বেচ্ছায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঢালাও ঘোষণা দিয়ে সংশয় সৃষ্টি করে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত না হওয়ার কথা সেখানে বলা হয়নি। ইবনে কুদামা রহ. এর যে উদ্ধৃতি তিনি উল্লেখ করেছেন সেখানে আনুষ্ঠানিক সংশয় সৃষ্টি করার কথা বলা হয়নি; বরং সেখানে ঘটনাক্রমিক সংশয় সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কথাই বলা হয়েছে। কি বিস্ময়কর ব্যাপার! স্বেচ্ছায় ঘটা করে হালাল হারামের মাঝে সংশয় সৃষ্টি করছি আর ফতওয়া গ্রহণ করছি, ‘হালাল হারামের মাঝে সংশয় সৃষ্টি হলে তা আর হারাম থাকে না।’ এভাবে বৈধ ফতওয়া সৃষ্টি করার অনুমতি ইসলামী শরীয়াতে দেয়া হয়নি। প্রচলিত মিল্কব্যাংকগুলোতে ইচ্ছা করে মাতৃদুগ্ধ মিশ্রিত করা হচ্ছে। এরপর দুগ্ধদানকারিণী ও দুগ্ধপানকারী কারো ডাটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। এভাবে চরম মাত্রার সংশয় সৃষ্টি করে ইসলামী শরীয়া থেকে তার বৈধতার সার্টিফিকেট কালেকশনের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টা নিতান্তই বেদনাবিধুর। মূলত এ জাতীয় সংশয় সৃষ্টির উদাহরণ হলো, একই ধরনের দু’টি গ্লাসের একটিতে পানি আরেকটিতে মদ রেখে একটি কৃত্রিম সংশয় ও অজ্ঞতা তৈরি করা হলো। কিছুক্ষণ পর এসে অজ্ঞাতসারে মদের গ্লাসকে পানির গ্লাস মনে করে মদ খেয়ে ফেললো। আর ফতওয়া গ্রহণ করলো যে, আমি যেহেতু অজ্ঞাতসারে কিংবা সংশয়বশত মদ পান করেছি তাই এ মদপান হারাম হবে না!

অনেকে শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেবের পক্ষ গ্রহণ করে হানাফী মাসলাকের বক্তব্য দ্বারাও প্রমাণ করতে চান, দুগ্ধপানে সংশয় সন্দেহ তৈরি হলে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না। সে বক্তব্যটি হলো, ‘কোনো নারী যদি স্তনবোটা শিশুর মুখে প্রবেশ করায় এবং জানা না যায় যে শিশুর কণ্ঠনালীতে দুধ প্রবেশ করেছে কি না তাহলে এতে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না। তদ্রƒপ গ্রামের কোনো নারী যদি কোনো মেয়ে শিশুকে দুধ পান করায় এবং কোন নারী দুধ পান করিয়েছে তা নির্দিষ্ট করে জানা না যায় এবং পরবর্তীতে এ গ্রামের কোনো পুরুষ এ মেয়েকে বিবাহ করে তাহলে তা বৈধ হবে।’ (আল-বাহরুর রায়িক ৯/৪৫)
কারণ বৈবাহিক বৈধতা হলো মূল। সুতরাং এ মৌলিক বৈধতা নিছক সংশয়ের কারণে বিলুপ্ত হবে না।

এখানেও আমাদের সে একই বক্তব্য প্রযোজ্য। আকস্মিক বা ঘটনাক্রমে অনিচ্ছায় সংশয় সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিধান প্রযোজ্য হবে- এটা আমরাও স্বীকার করি। উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে যদি ইচ্ছা করে সংশয় ও অজ্ঞতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে স্তন্যদান করানো হয় তাহলে কোনো ফকীহই এ কার্যক্রমকে বৈধ বলবেন না। এবং এ ধরনের অনাচারের ছিদ্রপথ রোধ কল্পে এজাতীয় ক্ষেত্রেও বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞার বিধানই জারি করবেন। এ ধরনের বিধান ইসলামী শরীয়তে অনেক রয়েছে। ইসলামী শরীয়া মতে যৌথ সম্পদ ওয়াকফ করা বিধিত নয়। তবে ওয়াকফের যাবতীয় শর্ত সাপেক্ষে ওয়াকফ করার পর যদি ওয়াকফ সম্পদে অংশীদার বেরিয়ে আসার কারণে তা যৌথ সম্পদ হিসেবে গণ্য হয় তাহলে তাতে ওয়াকফের বিধান বিলুপ্ত হবে না। কারণ এখানে ঘটা করে স্বেচ্ছায় যৌথ সম্পদ করা হয়নি। অনিচ্ছা ও ঘটনাক্রমে অংশীদার বেরিয়ে আসার কারণে সম্পদটি যৌথ সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে। সুতরাং সংশয় ও অজ্ঞতা সৃষ্টি হওয়া আর সৃষ্টি করা এক জিনিস নয়। হাদীসের ভাষ্য থেকে সংশয়ের কারণে বিবাহ বিলুপ্তির ঘোষণা পাওয়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুগ্ধপানের ক্ষেত্রে সৃষ্ট সংশয়ের কারণে এক সাহাবীর বিবাহ বিলুপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। উকবাহ ইবনুল হারিস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ ইহাব বিন আযীয এর কন্যাকে বিবাহ করেন। এক মহিলা এসে বলে, আমি উকবা এবং তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে স্তন্যদান করেছি। তখন উকবা রাযি. বললেন, আপনি আমাকে স্তন্যদান করেছেন বলে আমার জানা নেই এবং আমাকে এ ব্যাপারে কেউ সংবাদও দেয়নি। এরপর উকবা রাযি. বাহনে চড়ে মদীনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে চলে গেলেন। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কি করে এখনো বিবাহ অটুট রয়েছে। অথচ বলা হলো তোমাদের দুজনকে দুধ পান করানো হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলার পর নতুন এ বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করে দেন। ফলে উকবা রাযি. অন্য নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৮৮)

এখানে দুগ্ধদানের বিষয়টি কিন্তু প্রমাণিত হয়নি। কারণ বিষয়টি প্রমাণের পক্ষে যথেষ্ট সাক্ষপ্রমাণ উপস্থিত নেই। তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিবাহকে নাকচ করে দিলেন। কারণ বিষয়টি সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটা বিবাহ বৈধ হওয়া না হওয়ার মত স্পর্শকাতর বিষয়। বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রে মহিলার বক্তব্যের কারণে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিবাহকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। দুগ্ধপানের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার জন্যও একাধিক সাক্ষীর প্রয়োজন রয়েছে। ইমাম মালেক ও ইমাম শাফী রাহ.ও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। (সুবুলুস সালাম শরহু বুলুগিল মারাম ১২/৫৮)
সুতরাং সংশয়টা যেহেতু হালাল হারাম সংশ্লিষ্ট তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক্ষেত্রে হারাম থেকে নিবৃত্ত রাখার জন্য সতর্কমূলক পন্থা গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়টিই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য হাদীসে এভাবে ব্যক্ত করেছেন, যে বিষয়টি তোমাকে সংশয়ে ফেলে দেয় সে বিষয়টি পরিত্যাগ করে এমন বিষয় গ্রহণ করো যেটা তোমাকে সংশয়ে ফেলবে না। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ২৫১৮)

শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেবের একটি আপত্তি ও তার পর্যালোচনা

আপত্তি

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, স্তন্যদানের কারণে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না যতক্ষণ না তার মাধ্যমে অস্থি শক্তিময় হয় এবং গোস্ত বৃদ্ধি পায়। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ২০৬১)
এখানে দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার জন্য গোশত বৃদ্ধি ও অস্থি দৃঢ় হওয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মুহতারাম শাইখ ইউসুফ কারযাভী সাহেব দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার এ কার্যকারণকে বেশ শক্তিমত্তার সাথে অস্বীকার করেছেন। তাঁর অস্বীকৃতির পক্ষে তিনি যুক্তির অবতারণাও করেছেন। যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেন, অস্থি দৃঢ় হওয়া ও গোশত বৃদ্ধি পাওয়াই যদি বিবাহ নিষিদ্ধের কারণ হয় তাহলে বলবো শিশুকে নারীর রক্তদানও বিবাহ নিষিদ্ধের কারণ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। কারণ গোশত বৃদ্ধি ও অস্থি দৃঢ় হওয়ার ক্ষেত্রে রক্তদান দুগ্ধপানের চেয়েও বেশি ভূমিকা রাখে।

পর্যালোচনা

এখানে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. যে কোনো উপায়ে গোশত বৃদ্ধি ও অস্থি দৃঢ় হওয়ার কথা বলেননি; বরং এখানে দু’টি শর্তের কথা বলা হয়েছে। (১) মাতৃদুগ্ধ হতে হবে। (২) সেটা খাবার হিসেবে পাকস্থলিতে যেতে হবে। এ দু’টি শর্ত রক্ষার মাধ্যমে যদি গোশত বৃদ্ধি ও অস্থি দৃঢ় হয় তাহলেই বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে। এখানে ইউসুফ কারযাভী সাহেব কেন রক্তের প্রসঙ্গ আনলেন তা বোধগম্য নয়। এখানে দু’টি শর্তের কোনোটিই নেই। এটি কোনো খাদ্য নয় এবং খাদ্যনালী দিয়ে পাকস্থলীতে প্রবেশও করে না। রক্তের মাধ্যমে আসলে গোশত বৃদ্ধি ও অস্থি দৃঢ় হয় কিনা সেটা অবশ্য দেহ বিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন। এখানে আমাদের মূল প্রসঙ্গটা হলো খাদ্য হিসেবে উদরে গিয়ে তাতে গোশতের প্রবৃদ্ধি ঘটা এবং অস্থি দৃঢ় হওয়া। মূলত রক্তটা খাদ্য থেকে তৈরি হয়। মৌলিকভাবে রক্ত কোনো কিছুর প্রবৃদ্ধি ঘটায় না। হ্যা, প্রবৃদ্ধিতে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। তো খাদ্য থেকে প্রস্তুত হওয়া সে রক্তের বিষয়টি তো এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে খাদ্য হিসেবে উদরে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। এবং সেটা খাদ্যের কাজ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। রক্তটা খাদ্য হিসেবে প্রবেশও করে না এবং খাদ্যের কাজও দেয় না। নতুবা রক্তের সাথে অন্যান্য জিনিসেরও তো তুলনা হতে পারে। নারীর গোশত কেটে শিশুর দেহে লাগিয়ে দেয়া হলো। কিংবা হাড় কেটে লাগিয়ে দেয়া হলো। তো এক্ষেত্রেও তো বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার কথা।

মিশরের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার ফতওয়া ও তার পর্যালোচনা

মিশরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দারুল ইফতায় মিল্ক ব্যাংক বিষয়ে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিলো। প্রশ্নটি নিম্নরূপ-
মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা কি হালাল না হারাম? মিল্কব্যাংক ব্যবস্থায় স্বেচ্ছা পদ্ধতিতে কিংবা ক্রয়ের মাধ্যমে মাতৃদুগ্ধ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এরপর তিন মাস পর্যন্ত ফ্রিজে রেখে কিংবা শুকনো করে মাতৃদুগ্ধ নির্ভর শিশুদেরকে পান করানো হয়। এখানে সম্ভাব্য সমস্যাটা হলো, যদি ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু এ দুধ পান করে বড় হয় এবং উভয়ে পারস্পরিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে কি দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞার কারণে এ বিবাহ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে?

দারুল ইফতার উত্তর

মিল্কব্যাংক থেকে কোনো শিশুর দুগ্ধপান ওই মায়ের কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনকে নিষিদ্ধ করবে না যে মা মিল্কব্যাংকে দুগ্ধ দান করেছে। হানাফী মাযহাবে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না যতক্ষণ না তার শর্তগুলো পাওয়া যাবে। সেসব শর্তের অন্যতম হলো, শিশুটি যে দুধ পান করবে তা মাতৃদুগ্ধ হতে হবে। এবং তা মুখ যোগে পেটে পৌঁছতে হবে। উপরন্তু তা পানি, ওষুধ, বকরীর দুধ, ঘনীভূত খাদ্য কিংবা অন্য নারীর দুধের সাথে মিশ্রিত না হতে হবে। যদি এ দুধ কোনো খাদ্যের সাথে মিশ্রিত হয় এবং আগুন তাপে ফুটানো হয় তাহলে মাযহাব চতুষ্টয়ের সর্বসম্মতিক্রমে এর মাধ্যমে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে ন।... আর যদি দুজন নারীর দুধ মিশ্রিত হয়ে যায় তাহলে যার দুধ বেশি হবে তার সাথে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে; অন্যজনের সাথে নয়।

দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা সন্দেহের কারণে প্রমাণিত হয় না। ...মিল্কব্যাংকগুলোতে অসংখ্য ও অনির্দিষ্ট নারীদের দুধ মিশ্রিত করে সংরক্ষণ করা হয়। এক্ষেত্রে ফিকহী বক্তব্য স্পষ্ট যে, যে দুই শিশু এ দুধ পান করবে তাদের মাঝে বৈবাহিক বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্রে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। কারণ এক্ষেত্রে দুগ্ধদানকারিণী নারী অসংখ্য ও অনির্দিষ্ট হওয়ার কারণে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। (জারিদাতুল আহরাম আল-মিসরিয়্যাহ [মিশরের প্রখ্যাত আরবী দৈনিক আল-আহরাম]; ২৯.০৮.১৯৮৩)

পর্যালোচনা

দারুল ইফতার উত্তরটিতে কয়েকটি পর্যালোচনার বিষয় রয়েছে। (১) বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার জন্য মুখ যোগে দুধ পেটে প্রবেশ করতে হবে। (২) অন্য নারীর দুধের সাথে দুধ মিশ্রিত না হতে হবে। (৩) দুধ মিশ্রিত হওয়া এবং দুগ্ধপানকারী এবং দুগ্ধদানকারিণী অজ্ঞাত হওয়ার কারণে সংশয় সৃষ্টি হওয়ার ফলে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না।

১. আমাদের অধ্যয়ন মতে হানাফী মাযহাবে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার জন্য একমাত্র মুখ যোগে দুধপানের শর্ত করা হয়নি। ইমাম কাসানী রহ. বলেন, বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে স্তন থেকে দুধ পান করা, নাক যোগে পান করানো এবং কণ্ঠনালীতে দুধ ঢেলে পান করানো বরাবর। কারণ বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার মূল কার্যকারণ হলো, দুধের মাধ্যমে খাদ্য চাহিদা পূরণ হওয়া, গোশত উৎপন্ন হওয়া, অস্থি দৃঢ় হওয়া এবং ক্ষুধা নিবারণ হওয়া। এসব নাসিকা যোগে এবং কণ্ঠনালীতে ঢেলে দুধ পান করানোর মাধ্যমে অর্জিত হয়। কারণ নাসিকা যোগে দুধ পান করানো হলে তা মস্তিস্কে ও কণ্ঠনালীতে প্রবেশ করে। এবং তাতে ক্ষুধা নিবারণ হয়ে খাদ্য চাহিদা পূরণ হয়। তদ্রƒপ কণ্ঠনালীতে দুধ ঢালার দ্বারাও ক্ষুধা নিবারিত হয়ে খাদ্যচাহিদা পূরণ হয়। (বাদায়িউস সানায়ি’ ৩/৪০৭-৪০৮)

এক্ষেত্রে আমরা আরবী الرضاع শব্দের আভিধানিক অর্থটি লক্ষ করতে পারি। ইমাম যাবিদী রহ. রাযা’ শব্দের সংজ্ঞায় নিম্নোহাদীসটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন। তখন আমার কাছে এক ব্যক্তি বসা ছিলো। ব্যাপারটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বেশ বিরক্তিকর অনুভূত হলো। তাঁর চেহারায় গোস্বা দেখতে পেলাম। তখন আমি বল্লাম, আল্লাহর রাসূল! সে আমার দুধ সম্পর্কীয় ভাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভালো করে ভেবে দেখো দুধ সম্পর্কিত ভাই কে হয়? কারণ ক্ষুৎ-পিপাসা নিবারণের মাধ্যমেই রিযাআহ প্রমাণিত হয়। (মুসনাদে আহমাদ; হাদীস ২৪৬৭৬, সুনানে নাসায়ী মুজতাবা; হাদীস ৩৩১২)
এরপর যাবিদী রহ. রাযাআহ এর হাদীস বিষয়ক ব্যাখ্যা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, যে স্তন্যদান বিবাহকে নিষিদ্ধ করে তা প্রমাণিত হবে শৈশব কালে শিশুর ক্ষুধার সময়। (তাজুল আরুস ১/৫২৬০)

ইমাম ইবনে কুতাইবা রহ. হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেন, যে স্তন্যপান শিশুকে ক্ষুৎপিপাসা থেকে মুক্তি দেয় তাই মূলত রাযা’। (তাবীলু মুখতালাফিল হাদীস ১/২৮২)
ইমাম শা’বী রাযি. বলেন, দু বছরের ভিতরে যদি কোনো শিশুকে মুখে অথবা নাকে ঢেলে দেয়ার মাধ্যমে মাতৃদুগ্ধ পান করানো হয় তাহলেও দুগ্ধ সংশ্লিষ্ট বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে। ইমাম আব্দুর রাযযাক রহ. বলেন, মানুষ এ নীতির উপরই চলে আসছে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক; হাদীস ১৩৮৯৪, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা; হাদীস ১৭০৬৪)

আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, স্তন্যদানের মাধ্যমে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা তখনই প্রমাণিত হবে যখন তা পাকস্থলীতে গিয়ে পতিত হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ১৯৪৬)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, স্তন্যদানের কারণে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না যতক্ষণ না তার মাধ্যমে অস্থি শক্তিময় হয় এবং গোস্ত বৃদ্ধি পায়। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ২০৬১)

বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণের জন্য মাতৃদুগ্ধ পাকস্থলীতে পৌঁছাই যথেষ্ট। এর জন্য মুখ যোগে দুগ্ধপান জরুরী নয়। মাজহাব চতুষ্টয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও এটি। (আল-মাজাল্লাতুল উর্দুনিয়্যাহ ফিদ-দিরাসাতিল ইসলামিয়্যাহ; খণ্ড ৯, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ১৬৯)
অভিধান, হাদীস ও আসারের উপরোক্ত ভাষ্যগুলো থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার জন্য মুখ যোগে দুগ্ধপান আবশ্যক নয়।

২. আমাদের অধ্যয়ন মতে হানাফী মাযহাবে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হওয়ার জন্য মাতৃদুগ্ধ অন্য মায়ের দুধের সাথে মিশ্রিত না হতে হবে এমন কোনো শর্তের কথা উল্লিখিত হয়নি। হ্যাঁ, ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. বলেছেন, দুই নারীর দুধ মিশ্রিত হলে যার দুধ অধিক হবে একমাত্র তার সাথেই বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে। অন্যজনের সাথে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে না। কিন্তু দুধ মিশ্রিত হলেই তা দ্বারা বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞাপ্রমাণিত হবে না এমন একচেটিয়া শর্ত কোথাও আরোপ করা হয়নি। ইমাম কাসানী রাহ. বলেন, এক নারীর দুধ যদি অন্য নারীর দুধের সাথে মিশে যায় তাহলে ইমাম আবূ ইউসুফ রহ., এক বর্ণনা মতে ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মতানুসারে যে নারীর দুধ অধিক হবে তার সাথেই বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে। ইমাম মুহাম্মাদ এবং ইমাম যুফার রহ. এর নিকট উভয় নারীর সাথেই বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হবে। (বাদায়িউস সানায়ি’ ৩/৪০৯)
যদিও ফতওয়াটিতে একটু পরে গিয়ে ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করে চূড়ান্ত বক্তব্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে একে তো বিপরীতমুখী দু’টি বক্তব্য এনে চরম সংঘর্ষ তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত হানাফী মাযহাবের অপ্রাধান্য বক্তব্যটিকে প্রাধান্য ও অগ্রগণ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

৩. মিশরের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা মিল্ক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সংশয় সৃষ্টি হওয়ার ফলে দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত না হওয়ার ফতওয়া দিয়েছে। এখানে আমাদের সে পূর্বোক্ত কথাই প্রযোজ্য যে, মিল্কব্যাংক ব্যবস্থায় সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে না বরং ঘটা করে সংশয় সৃষ্টি করা হচ্ছে। সুতরাং আনুষ্ঠানিক সংশয় সৃষ্টি করে বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত না হওয়ার কথা ইসলামী শরীয়তের কোথাও বলা হয়নি।

শরয়ী জরুরত (প্রয়োজন) এবং মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা

অনেকেই বলেন, মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শরীয়াগত জটিলতা থাকলেও তা জরুরত ও প্রয়োজনের কারণে বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
আমাদের কথা হলো, কখনো কখনো কিছু কারণে শরয়ী নিষেধাজ্ঞায় সাময়িক শিথিলতা চলে আসে। এগুলো মূলত শরয়ী নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ার মৌলিক কোনো কার্যকারণ নয়; সাময়িক ও অস্থায়ী প্রাসঙ্গিক কার্যকারণ। তন্মধ্য হতে অন্যতম হলো হাজত এবং জরুরত। বাংলা ভাষায় শব্দ দু’টির মাঝে তেমন ব্যবধান লক্ষ করা যায় না। দু’টির অর্থই প্রয়োজন, আবশ্যক ও দরকার করা হয়। কিন্তু আরবী ভাষায় শব্দদু’টির মাঝে বড় ধরনের ব্যবধান রয়েছে।
জরুরত বা জরুরী শব্দটি মূলত এসেছে আরবী যরর (ضرر) শব্দ থেকে। যরর (ضرر) অর্থ ক্ষতি, অনিষ্ট। সুতরাং জরুরত ও জরুরী শব্দের পারিভাষিক অর্থের মাঝেও আবিধানিক অর্থটি সমহিমায় বিদ্যমান। আর ফিকহের পরিভাষায় জরুরত বলা হয়, কোনো ব্যক্তির এমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া যে পরিস্থিতিতে সে নিষিদ্ধ বস্তু গ্রহণ না করলে নির্ঘাত মৃত্যু মুখে পতিত হবে কিংবা মৃত্যুর খুব কাছে চলে যাবে। এমন ক্ষতিকর পরিস্থিতিতে উপণীত হলে ইসলামী শরীয়াত তাকে ওই নিষিদ্ধ বস্তু গ্রহণের অনুমতি দিবে।

পক্ষান্তরে ফিকহের পরিভাষায় হাজত হলো, কোনো ব্যক্তির এমন পরিস্থিতিতে উপণীত হওয়া যে পরিস্থিতিতে সে নিষিদ্ধ বস্তু গ্রহণ না করলে মৃত্যু মুখে পতিত হবে না। তবে কষ্টের সম্মুখীন হবে। ইসলামী শরীয়াত হাজতের ক্ষেত্রে হারাম বস্তু গ্রহণের অনুমতি দিবে না। সারকথা, জীবন কিংবা দেহের কোনো অঙ্গ হানি হবার সম্ভাব্য নয়; বাস্তবিক আশঙ্কা সৃষ্টি হলে হারাম ও নিষিদ্ধ উপায় গ্রহণ করে সে আশঙ্কা থেকে উত্তোরণের পথ গ্রহণ করার সুযোগ ইসলামী শরীয়াতে আছে। তবে এর জন্য চারটি শর্ত প্রযোজ্য।
১. জীবন বা অঙ্গের উপর সুনিশ্চিত আশঙ্কা সৃষ্টি হতে হবে।
২. ক্ষতির আশঙ্কাটা উপস্থিত ও বাস্তবিক হতে হবে; সম্ভাব্য নয়।
৩. ক্ষতি দূর করার বৈধ কোনো পন্থা না থাকতে হবে।
৪. এ ক্ষতি দূর করতে গিয়ে অন্য কোনো ক্ষতি সৃষ্টি না করতে হবে। (আল্লামা তাকী উসমানী, উসূলুল ইফতা; পৃষ্ঠা ২৬৮-২৬৯)

যারা মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে বৈধ বলেন, তারা তাদের বক্তব্যের সপক্ষে জরুরতের প্রমাণটাকে বেশ জোড়ালোভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে থাকেন। জরুরতের এ প্রমাণ গ্রহণ থেকে বেশ পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়, তারা পরোক্ষভাবে হলেও বিশ্বাস করেন, মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার মাঝে শরীয়াগত দিক থেকে আপত্তি ও অসঙ্গতি রয়েছে। জরুরত বা সবিশেষ সমস্যার কারণে সে আপত্তি ও অসঙ্গতিগুলো দূরীভূত হবে। কারণ জরুরতের কারণে বৈধ জিনিস তো বৈধ হয় না; বরং জরুরতের কারণে একমাত্র অবৈধ ও হারাম জিনিসই অনুমোদিত ও বৈধ হয়। বৈধ জিনিসের ক্ষেত্রে জরুরত বা হাজতের অবতারণা করা বড়ই অপ্রাসঙ্গিক। এখন দেখার বিষয় হলো, মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে জরুরতের প্রয়োগটা কতটুকু যথার্থ। একমাত্র মাতৃদুগ্ধের অভাবে শিশু মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে বিশ্বে এমন ঘটনার হার কত পার্সেন্ট? বাস্তবতা হলো সে হারটা গোণায় আসার মত নয়। কালে ভদ্রেকার এমন ঘটনার জন্য ঘটা করে দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা রীতিকে উঠিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা ও অনুমতি কোথাও নেই। এমন এক দু’টি সমস্যাকে সামাজিকভাবেই সমাধান করা সম্ভব। কারণ একটি পরিবারের আত্মীয়তার চেইন একেবারে ছোট নয়। সে চেইনে কি এক দুজন স্তন্যদানকারিণী মা পাওয়া যাবে না যারা মাতৃদুগ্ধের অভাবে মৃত্যু মুখে পতিত শিশুটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে? অসহায় পথ শিশু কিংবা কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদের ক্ষেত্রেও সামাজিকভাবে এ পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব। এ জাতীয় শিশুদের সংখ্যা এতটাই নগণ্য যে সামাজিকভাবে তা সমাধান করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। মুসলিম সমাজে তো বিষয়টি আরো সাহজিক। জরুরতের কারণে কোনো হারাম পন্থাকে হালালে রূপান্তরিত করতে হলে চারটি ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উপরোক্ত চারটি শর্ত পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার। সুতরাং জরুরতকে কেন্দ্র করে ঢালাওভাবে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা শরীয়াগত দিক থেকে বিধিসম্মত নয়। এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহণ করা যাক।

এমেরিক্যান গোপন রোগ বিশেষজ্ঞ ড. মাহের হাতহুত বলেন, মাতৃদুগ্ধের অভাবে শিশু স্বাস্থ্যের সমস্যার পরিমাণ খুবই অল্প। সে সমস্যা উৎপাদিত কৌটা বা প্যাকেট দুধের মাধ্যমেই সমাধা করা সম্ভব। স্বল্প ওজনের ওই সব শিশুই মাতৃদুগ্ধের মুখাপেক্ষী যারা উৎপাদিত দুধে সবিশেষ সংবেদনশীল কিংবা তা হজম করতে পারে না। মেয়াদপূর্ব ভূমিষ্ঠ নবজাতক শিশুদের বার্ষিক জন্ম হার শতকরা ৭%। সে ৭% এর মধ্য হতে ১% এরও কম সংখ্যক শিশুর মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজন হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মিল্কব্যাংকগুলোর সাথে যোগাযোগ করেছি। তাতে দেখা গেছে আমেরিকাতে সে হার এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এরপর মিল্কব্যাংক ব্যবহার করে এমন শিশুদের সংখ্যা জানতে লস এঞ্জেলসের শিশু ক্লিনিকগুলোতে যোগাযোগ করি। তাতে দেখা যায় এ জাতীয় শিশুদের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। সুতরাং মাতৃদুগ্ধ জনিত দুর্বলতায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা খুবই স্বল্প। (কিতাবু মাজাল্লাতিল মাজমায়িল ফিকহিল ইসলামী ২/২৬৩, সিলসিলাতু মাতবূআতি মুনাজ্জামাতিত তিব্বিল ইসলামী; পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬)

বাস্তবেও যেসব উলামায়ে কেরাম মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে বৈধ বলেন, তাদের অনেকেই তার জন্য উপরোক্ত শর্তগুলোর মত চারটি শর্ত আরোপ করে থাকেন।
১. প্রয়োজনটা চূড়ান্ত পর্যায়ের হতে হবে। অর্থাৎ মিল্কব্যাংকের দুধ ছাড়া শিশুর মৃত্যু হওয়া বা আশঙ্কাজনক হারে রোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হতে হবে।
২. প্রয়োজনটা উপস্থিত হতে হবে; প্রতীক্ষিত বা সম্ভাব্য হলে হবে না।
৩. প্রয়োজন পূরণে এ ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যম না থাকতে হবে।
৪. নিষিদ্ধ কাজ করার কারণে যে ক্ষতিটা হয় তার মাত্রা ওই ক্ষতির তুলনায় কম হতে হবে যে ক্ষতিকে লাঘভ করার জন্য নিষিদ্ধ কাজটা করা হবে। কারণ ইমাম সুয়ূতী রহ. বলেছেন, জরুরত বা প্রয়োজন নিষিদ্ধ জিনিসকে বৈধ করে দিবে। তবে শর্ত হলো নিষিদ্ধ জিনিস করার ক্ষতিটা জরুরতের ক্ষতি থেকে কম হতে হবে। (ইমাম সুয়ূতী, আল-আশবাহ ওয়ান-নাযায়ির; পৃষ্ঠা ৮৪, ড. আব্দুত তাওয়াব মুস্তাফা খালিদ মুআওয়ায, বুনুকুল হালীব ফী যাওইশ শারীআতিল ইসলামিয়্যাহ দিরাসাতান ফিকহিয়্যাতান মুকারানাতান [নিবন্ধ])
সুতরাং তাদের উপরোক্ত শর্ত মতে প্রচলিত মিল্কব্যাংকগুলো বৈধতার পর্যায়ে পড়ে না। কারণ এসব ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে উপরোক্ত শর্তগুলো প্রযোজ্য হয় না।

মাতৃদুগ্ধ বিক্রয় ও ইসলামী শরীয়াত

ব্লাড ব্যাংকের সূচনা একান্ত মানবিক সেবার শিরোনামে হয়েছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে তা অর্থকরি বিজনেসে রূপান্তরিত হয়। বহির্বিশ্বে মিল্কব্যাংকগুলোও মানবিক সেবার শিরোনামে আবির্ভূত হয়ে এখন মাতৃদুগ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে নিয়মিত দুগ্ধ ক্রয় বিক্রয় হয়। বাংলাদেশে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা শুরু হলে কথিত সেবা বাণিজ্যে রূপান্তরিত হতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়বে না। এখানে নিয়মিত মাতৃদুগ্ধ ক্রয় বিক্রয় হবে। এক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিধি নিষেধের কোনো পরওয়া করা হবে না-এ কথা বলা যায়। যেমনটি ব্লাড ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। অথচ ইসলামী শরীয়াতে মাতৃদুগ্ধের ক্রয় বিক্রয় বৈধ নয়। কারণ দুগ্ধ মানুষের দেহের একটি উপাদান। মানুষের দেহের কোনো অংশ বা উপাদানের ক্রয় বিক্রয় বৈধ নয়। এখানে ভিন্ন মাযহাবের মতামতকে টেনে আনার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হানাফী মাসলাকের নীতি অনুসরণ করে চলে। ভিন্ন মাসলাকের বক্তব্য টেনে আনার সবিশেষ ক্ষেত্র রয়েছে। সব ক্ষেত্রে ভিন্ন মাজহাবের নীতি অনুসৃত হয় না। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা বা মাতৃদুগ্ধ ক্রয় বিক্রয়ের ব্যাপারটি এমন কোনো গুরুতর বিষয় নয় যে তার জন্য ভিন্ন মাসলাকের রীতি বা বক্তব্য অনুসরণ করতে হবে। অনেকেই মাতৃদুগ্ধ বিক্রির বৈধতার পক্ষে যুক্তি দেখান, ইসলামী শরীয়াতে দুগ্ধদাত্রী নারীর জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ। সুতরাং স্তন্যদানকারিণী নারীর জন্য দুধ বিক্রি করে তার বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ হবে। কিন্তু এ যুক্তিটি নিতান্তই ভঙ্গুর। কারণ ক্রয় বিক্রয় আর ইজারা (শ্রমদান) স্বতন্ত্র দু’টি বিষয়। দুধ পান করানো একটি শ্রম। এ শ্রমের বিনিময় স্তন্যদানকারিণী গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু দুধের বিনিময় সে গ্রহণ করতে পারবে না। সুতরাং স্তন্যদানের বিনিময় গ্রহণ মানে দুগ্ধ বিক্রি নয়; বরং দুগ্ধপানের শ্রম বিক্রি। শ্রম বিক্রি তথা নিজেকে ইজারা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ ইসলামী শরীয়াতে বৈধ। কিন্তু মানুষের দেহের কোনো অংশ বিক্রি করা বৈধ নয়। সুতরাং মিল্কব্যাংক প্রথা চালু করে মাতৃদুগ্ধ বিক্রির মত হারাম পথ উন্মুক্ত করা আদৌ বৈধ হতে পারে না।

যদি কোনো শিশুর পক্ষে মায়ের দুধপান সম্ভব না হয় তাহলে স্বেচ্ছা স্তন্যদানকারিণী নারীদের সংখ্যা অনেক রয়েছে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা পারস্পরিক সৌহার্দ সম্প্রীতি ও পারস্পরিক নিবিড় বন্ধনের উপর প্রতিষ্ঠিত। একটি পরিবারে চাচী, ফুফু ও খালাসহ অনেক স্তন্যদানকারিণী আত্মীয়াদের উপস্থিতি বিদ্যমান থাকে। এদের কেউ যদি স্তন্যদানে অক্ষম হয়ে পড়ে তবে অনেক আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী বা বন্ধবী থাকে যারা স্তন্যদানের কাজটি স্বাচ্ছন্দে আঞ্জাম দিতে আগ্রহী হবে। যদি কালে ভদ্রে স্বেচ্ছা স্তন্যদানকারিণী কাউকে না পাওয়া যায় তবে সে ক্ষেত্রে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে স্তন্যদানকারিণীদের ব্যবস্থা তো আছেই। সুতরাং বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে মিল্কব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। মাতৃদুগ্ধের পারিবারিক ও সামাজিক এত সহজ ব্যবস্থাপনা থাকতে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার মত বংশধারা বিনষ্ট ও মাতৃদুগ্ধ ক্রয় বিক্রয়ের পথ উন্মুক্ত করা উত্তম পদ্ধতির পরিবর্তে অনুত্তম ও আপত্তিকর পদ্ধতি গ্রহণ করার নামান্তর।
ভারতের বিশিষ্ট ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ মুফতী খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানী মিল্কব্যাংকের ব্যাপারে বলেন,
ইসলাম নীতিগতভাবে নারীকে অন্যের শিশু সন্তানকে স্তন্যদানের অনুমতি প্রদান করে। হাদীসের গ্রন্থগুলোতে এর ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞার যাবতীয় বিধান এ নীতির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রচলিত এ ধরনের মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দু’টি সমস্যা চলে আসে। একে তো মাতৃদুগ্ধ ক্রয়, দ্বিতীয় হলো মাতৃদুগ্ধ বিক্রয়। ফিকহ বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে একমত যে, দুগ্ধদানকারিণী দুগ্ধদানের পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারে। বিষয়টি পবিত্র কুরআনেও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। তবে বিক্রয় এবং ইজারার মধ্যে পার্থক্য আছে। হানাফী মাসলাকে দুধ মানুষের অংশ হওয়ার কারণে তার বিক্রি বৈধ নয়। (জাদীদ ফিকহী মাসাইল ১/৩৭৯-৩৮০)

মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাপনায় মাতৃস্বাস্থ্যের ঝুঁকি

যদি মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়ে যায় তাহলে সুস্থ সক্ষম স্তন্যদানকারিণী মায়েরা স্তন্যদানে অবহেলা করতে শুরু করবে। বিশেষ করে বিত্তশালী পরিবারে মায়েরা এবং চাকুরীজীবী মায়েরা স্তন্যদান রীতি থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিবে। তারা মিল্কব্যাংক থেকে দুধ সংগ্রহ করে শিশু সন্তানকে পান করাতে শুরু করবে। তখন স্তন্যদানকে তারা একটা ঝামেলার বিষয় মনে করবে।
এতে করে বেশ কিছু ক্ষতিকর আশঙ্কা তৈরি হবে। কারণ স্তন্যদানের ফলে মায়েরা নানা দিক থেকে উপকৃত হন। সুতরাং যদি তারা শিশুকে স্তন্যদান থেকে বিরত রাখেন তবে তারা নানা ধরনের মাতৃব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নিচে স্তন্যদানের কিছু উপকারিতা উল্লেখ করা হলো।

১. জন্মের পরপরই শিশুকে বুকের দুধ দিলে মায়ের প্রসবজনিত রক্তপাত বন্ধ হয়। পরবর্তীতে রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি হয় না। গর্ভজনিত স্ফীত জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
২. শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
৩. যেসব মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের স্তন, জরায়ু এবং ডিম্বকোষে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা কম থাকে।
৪. ৫ মাস বয়স পর্যন্ত স্তন্যদান স্বাভাবিক জন্মনিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে এবং ২ বৎসর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ালে ঘন ঘন গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
৫. বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। শিশুর সাথে মায়ের আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়।
৬. মায়ের দুধ নিরাপদ, ঝামেলামুক্ত। ফলে মায়ের বাড়তি খাটুনি ও সময় বাঁচায় এবং অর্থের সাশ্রয় হয়। (https://www.banglanews24.com/health/ news/bd/52636.details)

হিউম্যান মিল্কব্যাংক : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বাংলাদেশে গত ১ ডিসেম্বর ’১৯ প্রথমবারের মত যাত্রা শুরু করে হিউম্যান মিল্কব্যাংক। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন এখনো শুরু হয়নি। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাপনাটি মূলত ঢাকা জেলার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইসিএমএইচ) নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্ক্যানো) এবং নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ) এর নিজস্ব উদ্যোগ। ২০১৬ সালের একটি প্রকল্পের আওতায় বিপন্ন শিশুদের জীবন বাঁচাতে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটটি ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা ব্যয়ের ৪২ শতাংশ বাংলাদেশ সরকার এবং ৫৮ শতাংশ বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করে। এর আনুমানিক ব্যয় ছিলো ৬৫৮ মিলিয়ন বাংলাদেশী টাকা।

মিল্কব্যাংকটি বেসরকারী আর্থিক সহায়তা নিয়ে স্থাপন করা হয়। অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়া, অসুস্থ, স্বজন পরিত্যাক্ত, আইসিএমএইচ ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারে থাকা এবং অন্যান্য মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত নবজাতকদের দুগ্ধদানের জন্যই মূলত মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৩৭ সপ্তাহ আগে জন্ম নেয়া ২ হাজার গ্রামের কম ওজনের নবজাতকদের মা বা অন্য অভিভাবকদের ত্বকের সংস্পর্শে রেখে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করাকে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার বলা হয়। মায়েদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ ও বিতরণে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা নেয়া হবে না বলেও প্রকল্পটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ইনস্টিটিউটের দোতলায় মিল্কব্যাংকের জন্য দস্তুরমত পাস্তুরাইজিং মেশিন, অত্যাধুনিক ফ্রিজসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। খাদ্যপণ্য, বিশেষত পানীয় জীবাণুমুক্ত করার পদ্ধতিই হচ্ছে পাস্তুরাইজেশন। বিশেষ পদ্ধতিতে উচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োগ করে এ কাজটি করা হয়। ১৮৬৫ সালে ফরাসী রসায়নবিদ লুই পাস্তুর এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন বলে তার নামানুসারে এ পদ্ধতিকে পাস্তুরাইজেশন বলা হয়। দুধ এবং মদ সংরক্ষণে এ পদ্ধতি উদ্ভাবিত হলেও এখন অনেক পণ্য সংরক্ষণেই এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে।

মিল্কব্যাংকের জনবলকে প্রশিক্ষণ দেয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রমও সম্পন্ন করা হয়েছে। আইসিএমএইচের সযযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান হিউম্যান মিল্কব্যাংকের সন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ ব্যাংক চালু করার আগে তিনি নিজে স্পেন ও ভারতের দু’টি হিউম্যান মিল্কব্যাংক পরিদর্শন করে এসেছেন। মিল্কব্যাংক চালু হলে মিল্কব্যাংক ভ্যান সার্ভিস চালু করে বাড়ি বাড়ি থেকে দুধ আনা এবং তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়ার সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করারও পরিকল্পনা মাথায় আছে প্রকল্পটির। আইসিএমএইচের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, মায়ের বুকের দুধ সংগ্রহ এবং অন্য নবজাতকদের খাওয়ানোর ক্ষেত্রে যাতে ইসলামী শরীয়াহর কোনো লঙ্ঘন না হয় সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। মুসলিম দেশের মধ্যে কুয়েতে প্রথম হিউম্যান মিল্কব্যাংক স্থপন করা হয়। এ ছাড়া ইরান, ইরাক, আরব অমিরাত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশ হিউম্যান মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। ওই দেশগুলো কিভাবে ব্যাংক পরিচালনা করছে তার বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের মতামত নেয়া হচ্ছে। ব্যক্তি উদ্যোগ এবং বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় মিল্কব্যাংকটি স্থাপনে এখন পর্যন্ত এক কোটি টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। (সূত্র, প্রথম আলো ১৯.১২.১৯ ও অন্যান্য)

আইসিএমএইচের দাবি মতে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক জটিলতার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সে আশঙ্কা এখানে নেই। বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই তারা এটা স্থাপন করেছেন। এখানে যে মা দুধ দেবেন তার প্রয়োজনীয় ডাটা সংরক্ষণ করা হবে। তাকে আইডি কার্ড দেয়া হবে। সংরক্ষিত দুধ যে শিশুকে দেয়া হবে তার পরিচিতি সংরক্ষণ করা হবে। তাকেও কার্ড দেয়া হবে। রেফারেন্স নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, খাতা ও ভলিউম, এন্ট্রি পৃষ্ঠার নম্বর, সবই তাদের দেয়া হবে। একজন মায়ের দুধের সঙ্গে আরেকজন মায়ের দুধ মিশে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে মায়ের ছেলে সন্তান আছে তার দুধ ছেলে শিশুকে দেয়া হবে। আর যে মায়ের মেয়ে শিশু আছে তার দুধ মেয়ে শিশুকে দেয়া হবে। এবং দুধ দানের ব্যাপারে মা ও তার স্বামীর লিখিত সম্মতি নেয়া হবে। এ কারণে তারা ছক করে পাস্তুরিত মেশিন তৈরি করেছেন, যেখানে প্রত্যেক মায়ের বুকের দুধ আলাদা কৌটায় রাখা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সরকার পক্ষের বড় একজন আলেম বলেন, ‘শুনেছি মাতুয়াইল শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ‘মিল্কব্যাংকের উদ্যোক্তারা’ দুধদাতা গ্রহণকারীদের প্রত্যেককে যেভাবে আলাদা আইডিকার্ড দিবে, তাতে তাদের সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য থাকবে উদ্যোক্তাদের কাছে। একজন মেয়ে শিশুর মা একজন মেয়ে শিশুকে এবং একজন ছেলে শিশুর মা ছেলে শিশুকেই দুধ দেবেন। যদি এমন পদ্ধতিতে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দুধ ভাই-বোনের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনও জটিলতা হবে না। কারণ, বিয়ের আগে সংশ্লিষ্টরা খোঁজ নেবেন, তারা এতিম ছিলেন কি না, তারা মিল্কব্যাংক থেকে দুধ গ্রহণ করেছেন কিনা। তখন তাদের সম্পর্কিত তথ্য যাচাই করলেই বিষয়টি ধরা পড়বে। প্রকৃত তথ্যও জানা যাবে। ফলে যারা দুধ ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা করছেন, তারা ভুল করছেন।’ (www. banglatribune.com/others/news/)

‘হিউম্যান মিল্কব্যাংকের’ সমন্বয়ক ও ইনস্টিটিউটের নবজাতক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান বলেন, ‘সম্পূর্ণভাবে ইসলামী বিধিবিধান মেনেই এই ‘মিল্কব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুধদাতা ও গ্রহীতাদের প্রত্যেককে আলাদা আইডিকার্ড দেয়া হবে। একজন মেয়ে শিশুর মা একজন মেয়ে শিশুকে এবং একজন ছেলে শিশুর মা ছেলে শিশুকেই দুধ দেবেন। যে কারণে যারা দুধ ভাই- বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে মনে করে বিরোধিতা করছেন, সে আশঙ্কা এখানে নেই। যারা বিরোধিতা করছেন, তারা যদি পুরো বিষয়টি সঠিকভাবে জানেন, তাহলে এখানে বিরোধিতা করার কিছু নেই।’ (http://www.banglatribune.com/others/news/)

মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পক্ষের যুক্তি ও পর্যালোচনা

ইসলামী শরীয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বংশ সম্পর্কের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা এ ধারাকে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ করবে। সমাজে অপরিচিত অনেক ভাই বোনের জন্ম হবে। এক সময় এদের সংখ্যা নিরূপণ করা আদৌ সম্ভব হবে না। অজ্ঞাতসারে দুধ ভাই বোনের মধ্যে বিবাহের নামে যে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে তার দায় কে নিবে? কর্তৃপক্ষ যে বিষয়গুলো পরিপালনের কথা বলেছেন, তা বেশ জটিল ও দীর্ঘ মেয়াদি। এসব তদারকি করা অত্যন্ত দুরূহ ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রথম দিকে এ প্রক্রিয়া পালন করা সম্ভব হলেও অবকাঠামো বেড়ে গেলে তা হযবরল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। ইসলামী মূল্যবোধ ও শরীয়া অনুশাসনে হিউম্যান মিল্কব্যাংক একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। অনেক নারী আপন স্বাস্থ্য ও দৈহিক গঠন অটুট রাখার ঠুনকো অযুহাতে নিজ সন্তানকে দুধ পান না করিয়ে মিল্কব্যাংকের শরণাপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমনটি বহির্বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা বালাদেশে হিউম্যান মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা বিষয়ক উপরোক্ত বক্তব্যগুলোকে কয়েকটি পয়েন্টে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করবো।

(ক) ‘মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দুগ্ধ সম্পর্কিত বৈবাহিক জটিলতার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সে আশঙ্কা এখানে নেই। বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই তারা এটা স্থাপন করেছেন। সম্পূর্ণভাবে ইসলামি বিধিবিধান মেনেই এই ‘মিল্কব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’

পর্যালোচনা

ধর্মীয় বিষয়টিকে মাথায় রেখে তারা যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন তাতে সহজেই ধর্মীয় জটিলতা সমাধান হয়ে যাবে না। কারণ দুগ্ধ সম্পর্কটা শুধু দুগ্ধপানকারী শিশু আর দুগ্ধদানকারিণী মায়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এ সম্পর্ক আরো অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। দুগ্ধ সম্পর্কিত আলোচনাগুলোও বেশ জটিলতার দাবি রাখে। মাতৃদুগ্ধ সংশ্লিষ্ট সেসব বিষয়গুলো সাধারণের সহজে বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। যেমন একজন নারী একটি মেয়ে শিশুকে দুগ্ধপান করালো। অন্যদিকে স্তন্যদানকারিণী এ নারীর একজন শিশু দেবর রয়েছে। উভয়ে বড় হলো। ঘটনাক্রমে উভয়ের মাঝে বিবাহ বন্ধনের আয়োজন হলো। তো দেবরের বাবা মা তো ওই শিশুর আইডি কার্ড সংরক্ষণ করেনি। ওই শিশু বা শিশুর পরিবারও জানে না যে তার ও এ শিশুর মাঝে দুগ্ধ সম্পর্ক তৈরি হয়ে তারা পরস্পরে দুগ্ধ সম্পর্কিত চাচা ভাতিজি হয়ে পড়েছে। এখন যে বিবাহটা হবে সেটা তো স্পষ্ট হারাম হবে। অর্থাৎ বিবাহই সম্পন্ন হবে না। এদের মাঝে যে দৈহিক সম্পর্ক হবে তা ঘৃণিত ও নিকৃষ্টতম ব্যভিচার হিসেবে গণ্য হবে। যে সন্তান হবে তাও হবে অবৈধ ও জারয সন্তান। এ সন্তানগুলো এ বাবার ত্যাজ্য সম্পত্তি পাবে না। যদি গ্রহণ করে তবে তা তাদের জন্য বিধিত হবে না।

(খ) ‘এখানে যে মা দুধ দেবেন তার প্রয়োজনীয় ডাটা সংরক্ষণ করা হবে। তাকে আইডি কার্ড দেয়া হবে। সংরক্ষিত দুধ যে শিশুকে দেয়া হবে তার পরিচিতি সংরক্ষণ করা হবে। তাকেও কার্ড দেয়া হবে। রেফারেন্স নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, খাতা ও ভলিউম, এন্ট্রি পৃষ্ঠার নম্বর, সবই তাদের দেয়া হবে। একজন মায়ের দুধের সঙ্গে আরেকজন মায়ের দুধ মিশে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।’

পর্যালোচনা

বেশ চমৎকার সতর্ক ব্যবস্থা। বাহ্যত এভাবনা লালনের জন্য কর্তৃপক্ষ সাধুবাদ পাবার যোগ্য। তারা আইডি কার্ড দিবেন ভালো কথা। কিন্তু কাকে কাকে দিবেন এ আইডি কার্ড ? তাদের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় তারা শুধু দুগ্ধদানকারিণী এবং দুগ্ধপানকারী- এ দু পক্ষের মাঝে কার্ড সরবরাহ করবেন। কিন্তু একজন নারীর দুধ তো একাধিক শিশু পান করতে পারে। তারা তো পরস্পরে ভাই বোনে পরিণত হবে। দুগ্ধপানকারী এসব শিশুদের পরস্পরের মাঝে কি তারা কার্ড সরবরাহ করবেন? সরবরাহ করলে কয়জন শিশু পরিবার বা স্তন্যদানকারিণী সে কার্ডকে সংরক্ষণ করবে? এবং যথা নিয়মে বিবাহের সময় সে কার্ড চেক করে করে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করবেন বা সম্পন্ন করতে পারবেন? পুরো প্রক্রিয়াটিকে কার্ডময় বা কর্ডসর্বস্ব করাটা কি আদৌ সম্ভব হবে? সম্ভব হলে কয়দিন তা চালু রাখা যাবে? কর্তৃপক্ষ কতোটা ধর্মীয় অনুশাসন প্রিয় বা ধার্মিক যে তারা প্রতিটি পর্বে কার্ড কার্য সম্পন্ন করবেন? তাদের সদিচ্ছা থাকলেও যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করবেন তারা কতোটা কার্ড কার্যক্রমে যতœবান হবেন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আশাব্যঞ্জক হবে না। হয়তো মৌখিকভাবে ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সে উত্তরগুলো বাস্তবায়িত হবে না-এ কথা বলাই যায়।

বস্তুত দুগ্ধ সম্পর্কিত আলোচনাগুলো বেশ জটিল ও সূক্ষ্ম প্রকৃতির। এদেশের সাধারণ মানুষের ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়াবলির জানা শোনার মাত্রা নিতান্তই কম। যার ফলে দেখা যায়, যাদের মাঝে রক্ত সম্পর্কিত কারণে বিবাহ নিষিদ্ধ তাদের মাঝেও কখনো কখনো বিবাহ সংঘটিত হয়ে যায়। অথচ এ রক্ত সম্পর্কিত বিষয়গুলো সাধারণত সবার জানা থাকার কথা। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় জানা শোনার চিত্রই যখন এতোটা দুঃখজনক তাহলে কি করে বলা যায় যে শুধু আইডি কার্ড প্রদানের মাধ্যমেই বৈবাহিক জটিলতা ও নিষিদ্ধতা দূর হয়ে যাবে।

মিল্কব্যাংক কর্তৃপক্ষের প্রধানতম একটি সদিচ্ছা হলো, স্বজন পরিত্যাক্ত ছিন্নমূল নবজাতকদের দুগ্ধদান করা। এক্ষেত্রে তাদের দেয়া কার্ড কে রক্ষা করবে? তাদেরকে রক্ষা করার মত মানুষ পাওয়াই তো দুষ্কর। এখানে কার্ড সংরক্ষণটা বড় কথা; কার্ড দেয়াটাই বড় কথা নয়।
মিল্কব্যাংক কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গেছে, এ দুধ আঠারো মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। মা তো দুধ দিয়ে তার পরিচিতি রেখে চলে যাবে। এখন তার দুধ কয়জন শিশু পান করবে সে সম্পর্কে তার কোনো কিছুই জানা থাকবে না। ব্যাপারটি কি এরকম হবে যে যখনই তার দুধ কোনো শিশুকে পান করানো হবে তখন তাকে কল করে শিশুর আইডি কার্ড নিয়ে যেতে বলা হবে বা তাকে পৌঁছে দেয়া হবে? প্রলম্বিত এ প্রক্রিয়াগুলো কি তারা সম্পন্ন করবেন? ভাষাগত উত্তর প্রদান সহজ হলেও কার্যগত উত্তর প্রদান বড়ই জটিল।

(গ) ‘একজন মেয়ে শিশুর মা মেয়ে শিশুকে এবং একজন ছেলে শিশুর মা ছেলে শিশুকেই দুধ দেবেন। যে কারণে যারা দুধ ভাই- বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে মনে করে বিরোধিতা করছেন, সে আশঙ্কা এখানে নেই। যারা বিরোধিতা করছেন, তারা যদি পুরো বিষয়টি সঠিকভাবে জানেন, তাহলে এখানে বিরোধিতা করার কিছু নেই।’

পর্যালোচনা

মিল্কব্যাংক কর্তৃপক্ষ একথাটিকে বার বার বলার চেষ্টা করছেন। প্রথমত আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হচ্ছে এগুলো মূলত শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রবণতা। সাময়িক এসব অগভীর ও যুক্তিহীন কথা বলে সাধারণ মানুষ ও সরকারকে অবুঝ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো উপায়ে এ ব্যবস্থাটা প্রতিষ্ঠা করা গেলে কোথায় যাবে এসব নীতি কথার ফুলঝুরি তা বলা মুশকিল। এগুলো উড়ো কথা নয়; এগুলো বাস্তবতা। নীতিমালা শতভাগ স্বচ্ছ রেখে মাঠে ময়দানে তার উল্টো চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা এদেশের মানুষের আছে। এসব উল্টো চিত্রে আমাদের দেশটা ভরে গেছে। সুতরাং মিল্কব্যাংক কর্তৃপক্ষ মাঠে নেমে যেতে পারলে যে এর কিছুই রক্ষা করার গরজবোধ করবেন না এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং মেয়ে শিশুর মা মেয়ে শিশুকে এবং ছেলে শিশুর মা ছেলে শিশুকে দুধ পান করানোর নীতি তারা রক্ষা করবেন না বা রক্ষা করতে পারবেন না-এমনটি বলা যেতে পারে। বাধাটা ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ও কাজের পরিসর বৃদ্ধিসহ নানামাত্রিক জটিলতা হতে সৃষ্টি হতে পারে। আঠারো মাস পর্যন্ত রক্ষিত দুধকে এ প্রক্রিয়া মেইন্টন করে পান করানোটা বেশ জটিল ও দুরূহ ব্যাপার। এত দীর্ঘসূত্রতা কি তারা পরিপালন করবেন? উত্তরটা তারাই দিক।

দ্বিতীয়ত তারা বলেছেন, এ পদ্ধতি রক্ষায় বৈবাহিক জটিলতার সমাধান হয়ে যাবে। দুগ্ধ সম্পর্কিত সূক্ষ্ম আলোচনা বিষয়ে অধ্যয়ন থাকলে হয়তো তারা এতোটা হালকা কথা বলতেন না। অথচ দুগ্ধ সম্পর্কটা রক্ত সম্পর্কের মতই। এখানে সম্পর্কটা শুধু দুগ্ধপানকারী শিশুদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এটা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এখানে যে ছেলে শিশুর মা ছেলে শিশুকে দুধ পান করালো এ মায়ের কি কন্যা সন্তান থাকতে পারে না কিংবা ভবিষ্যতে তার কন্য সন্তান জন্ম গ্রহণ করতে পারে না? এ মায়ের স্বামীর কি বোন থাকতে পারে না? এ মায়ের কি নিজের কোনো বোন থাকতে পারে না? এ জাতীয় উপর নীচের অনেকেই আছেন। এদের সবার সাথেই তো দুগ্ধপানকারী ওই শিশুর বিবাহ নিষিদ্ধ? সমাধান কোথায় হলো? সমস্যা তো রয়েই গেলো। বিষয়টিকে এতোটা সহজ করে দেখলে তো হবে না।

সবিশেষ উল্লেখ্য, উপরোক্ত যুক্তিটি সরকার পক্ষের বড় মাপের একজন আলেম থেকেও শোনা গেছে। বিষয়টি মিডিয়ায় এসেছে বলে জানা গেছে। বিষয়টি যদি বাস্তব হয় তাহলে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। পাবলিকের মুখ থেকে এ জাতীয় অগভীর যুক্তির অবতারণা তেমন বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। কিন্তু সর্বমহলে পরিচিত একজন আলেমের মুখ থেকে এ জাতীয় যুক্তি নিতান্তই বেদনাদায়ক।

(ঘ) ‘মুসলিম দেশের মধ্যে কুয়েতে প্রথম হিউম্যান মিল্কব্যাংক স্থপন করা হয়। এ ছাড়া ইরান, ইরাক, আরব অমিরাত, মালেয়েশিয়া ও পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশ হিউম্যান মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং আমাদের দেশে মিল্কব্যাংক করতে কোনো সমস্যা নেই।’

পর্যালোচনা

আমরা ইসলামী আইনের ভিত্তিতে মিল্কব্যাংকের ব্যাপারে কথা বলছি। কোনো দেশীয় আইনের ভিত্তিতে নয়। সুতরাং এখানে কোনো দেশের বিষয়টা খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ পৃথিবীতে অনেক মুসলিম রাষ্ট্র আছে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র নেই। এখানে ইরানের কথা আসবে না। কারণ তারা শিয়া ধার্মিক। শিয়া আর মুসলিমের মাঝে বড় সড় ব্যবধান রয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইন শত ভাগ কুরআন সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হলে সেটা ইসলামী রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়। সুতরাং মুসলিম রাষ্ট্রে প্রচলিত কোনো বিষয় দিয়ে ইসলামী আইনকে পরিমাপ করা যায় না। অতএব ওই সব মুসলিম দেশে মিল্কব্যাংক থাকলেও সে দেশের উলামায়ে কেরাম এ ব্যবস্থাকে বৈধ বলেন কি না সেটা হলো দেখার বিষয়। রাষ্ট্রপ্রধানরা কোনটা অনুমোদন করলেন কোনটা অনুমোদন করলেন না সেটা এক্ষেত্রে ধর্তব্য বিষয় বলে পরিগণিত হবে না। কারণ তারা যাচ্ছে তাই করতে পারেন এবং করেনও বটে। উপরোক্ত মুসলিম রাষ্ট্রে যদি বাস্তবে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থা কার্যকর হয়েও থাকে তবু সেটা গ্রহণীয় নয়। কারণ এ ব্যবস্থার পক্ষে মুসলিম দেশগুলোর বিশিষ্ট ফিকহ বিশেষজ্ঞ ও মুফতীদের অনুমোদন নেই। ওআইসির ফিকহ একাডেমিতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বড় বড় ফকীহ মুফতীগণ রয়েছেন। তারা মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাকে শরীয়ত পরিপন্থী বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কুয়েতে এ নিয়ে সম্মিলিত গবেষণা হয়েছে। সেখানে উলামায়ে কেরাম ও বিজ্ঞজনেরা মিল্কব্যাংকের বিপক্ষে অভিমত দিয়েছেন। সেখানে একথাও বলা হয়েছে, যদি ক্ষেত্র বিশেষে মিল্কব্যাংক প্রতিষ্ঠার মারাত্মক ধরনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তাহলে সে ক্ষেত্রে কঠিন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তন্মধ্য হতে অন্যতম হলো, প্রতিটি বোতলে দুগ্ধদানকারিণীর নাম লেখা থাকবে এবং রেজিষ্ট্রেশন করা হবে। তদ্রƒপ এ বোতল থেকে যে শিশু দুধ পান করবে তার নামও লেখা হবে এবং রেজিষ্ট্রেশন করা হবে। এবং দুগ্ধপানকারী শিশুর পরিবারকে স্তন্যদানকারিণী নারীর নাম জানিয়ে দেয়া হবে। এতে করে শরীয়াগত সমস্যার সমাধান হতে পারে। (আত-তাবীব আদবুহু ওয়া ফিকহুহ; পৃষ্ঠা ৩৬৪-৩৬৫)

২০১১ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার জাতীয় ফতওয়া কমিটির ৯৭তম বৈঠকে মিল্কব্যাংক বিষয়ে অবিধানিক ফতওয়া এসেছে। বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম ইলমী ব্যক্তিত্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট ফকীহ জাস্টিস মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহকে বাংলাদেশে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এক অডিও বার্তায় বলেছেন যে, তা কোনোভাবেই জায়েয নয়। এ ব্যাংক চালু হলে নানান ফেতনা সৃষ্টি হবে। (আলকাউসার; ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ০৮)

মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার পক্ষের আরো কিছু যুক্তি ও তার পর্যালোচনা

(ক) ‘দুগ্ধপানকারী শিশু ও দুগ্ধদানকারিণী নারীদের পরিচয় ও ডাটা সংরক্ষণে সফটওয়্যার ও আর্কাইভ সিস্টেম চালুর মাধ্যমে পারস্পরিক ডাটা সংরক্ষণের জটিলতা খুব সহজেই কাটিয়ে উঠা সম্ভব।’

পর্যালোচনা

আমাদের কথা হলো, এটা বাংলাদেশ। অভিমত দিতে হলে সমগ্র বাংলাদেশকে সামনে রেখে দিতে হবে। এখানকার স্বাক্ষরতা হার সম্বন্ধে সকলেই অবগত। সফটওয়্যার পদ্ধতির মাধ্যমে কত পার্সেন্ট পরিবার পারস্পরিক পরিচিতির বিষয়টাকে সংরক্ষণ করতে পারবে কিংবা এ পদ্ধতির মাধ্যমে উপকৃত হতে পারবে সেটা নির্ণয় করা প্রয়োজন। সবাই কি এ সফটয়্যার গ্রহণ করবে? গ্রহণ করলেও কি সকলে এ সফটওয়্যারকে বিবাহের সময় কাজে লাগাবে? তারা ধর্মীয় অনুশাসন পালনে কতোটা যতœবান যে তারা এ সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিবাহের পথে আগাবে? এটা সাধারণ কথা, এদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় রীতি পালনের মান এতোটা উন্নত নয় যে তারা পরিচিতি কার্ড কিংবা সফটওয়ার বা অর্কাইভ ব্যবস্থাকে ফলো করে ছেলে সন্তানের বিবাহের পথে অগ্রসর হবে। মিল্কব্যাংকের মাধ্যমে এ যে তারা হারাম ও অবৈধ সম্পর্কের পথে অগ্রসর হবে এর দায় কি কর্তৃপক্ষ নিবে না? তারা হারামের উন্মুক্ত পথ তৈরি করে দিয়ে নিজেদেরকে দায়মুক্ত ভাববে এর তো কোনো সুযোগ নেই। উপরন্তু তাদের মূল এজেন্ডাই হলো স্বজন পরিত্যাক্ত, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া, ছিন্নমূল অভিভাবকহীন পথশিশুকে দুগ্ধদান করা। তো এসব শিশুদের ক্ষেত্রে সফটওয়্যার ব্যবস্থা কি কাজে আসবে? কে সংরক্ষণ করবে এ সফটওয়্যার? কে দেখবে এ ডাটা সংরক্ষণের উন্নত ব্যবস্থা? আর সফটওয়ার হ্যাক হয়ে যাওয়া তো খুব বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। তো এসব ডাটাবেজ কতোটা আস্থার কাজ দিবে তা নিয়ে আমাদের ভাবার প্রয়োজন আছে।

(খ) ‘আরবে তো স্তন্যদানের প্রথা ব্যাপকভাবে চালু ছিলো। বর্তমান মিল্কব্যাংক তো আরবের সে প্রথারই উন্নত সংস্করণ। সুতরাং সেটা বৈধ হলে এটা বৈধ হবে না কেন?’

পর্যালোচনা

মিল্কব্যাংক বৈধতায় আরবের স্তন্যদান প্রথাকে টেনে আনার কোনো প্রয়োজন নেই। স্তন্যদান তো বৈধ। এর জন্য আরব্য রীতিকে টেনে আনতে হবে কেন? স্বয়ং কুরআনেই এর বৈধতা বিদ্যমান। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থায় পারস্পরিক পরিচয় সঙ্কটের যে প্রবল আশঙ্কা রয়েছে তা আরব্য রীতিতে ছিলো না। কারণ সে রীতিতে দুগ্ধ সম্পর্কের কারণে পারস্পরিক আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতো। পরস্পরের মাঝে যাতায়াতও হতো। ফলে পরিচয় সঙ্কটের কোনো সুযোগ ছিলো না। আরব্য রীতিকে টেনে এনে প্রচলিত মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ দুই ব্যবস্থার মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান বিদ্যমান।

(গ) ‘দেশে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে বছরে হাজার হাজার মায়ের মৃত্যু হয়। এসব মায়েদের সন্তান ও কুড়িয়ে পাওয়া পথ শিশুদের জীবন বাঁচাতে মাতৃদুগ্ধের ভাণ্ডার গড়ে তোলা তো একটি মানবিকতার কাজ। কোনো কোনো দেশে মিল্কব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে হাজার হাজার শিশু প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। এত বড় একটি মানবিক কাজকে ইসলাম কিভাবে নেতিবাচক হিসেবে দেখতে পারে?’

পর্যালোচনা

ইসলাম কোনো ধরনের মানবিকতাকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে না। ইসলামিক বিধি বিধানের চেয়ে বড় কোনো মানবিকতা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। এর চেয়ে বড় কোনো মানবিকতা কেউ দেখাতেও পারবে না। সত্যিকার মানবিকতা ইসলামী বিধি বিধানের মাঝেই বিদ্যমান। ইসলামী শরীয়াতে দুগ্ধদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি মাতৃদুগ্ধের অভাবে যদি কোনো শিশু ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা হয় তাহলে নিকটবর্তী দুগ্ধবতী নারীর উপর আবশ্যক হয়ে যায় উক্ত শিশুকে দুগ্ধদান করা। আর এ যে পরিসংখ্যান টানা হয়েছে যে, একমাত্র মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমেই হাজার হাজার শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে- এ পরিসংখ্যান সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবসম্মত নয়। মায়ের দুধ অবশ্যই অশেষ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। পুষ্টিগুণের দিক থেকে এর কোনো বিকল্প হয় না। তাই বলে কি শিশুখাদ্য হিসেবে এর কোনো বিকল্প নেই? অবশ্যই আছে। হয়তো মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে হাজার হাজার শিশুকে বাঁচানো গেছে। এর অর্থ এই নয় যে মাতৃদুগ্ধ না থাকলে বিকল্প শিশুখাদ্যের মাধ্যমে ওই সকল শিশুকে বাঁচানো যেতো না। সুতরাং পরিসংখ্যানের একচেটিয়া বক্তব্য বাস্তবতা পরিপন্থী। অশুস্থ শিশুদের দুগ্ধদান অবশ্যই একটি মহৎ ও মানবিক কাজ। কিন্তু এ মানবিক কাজের নীতিমালাও ইসলামী শরীয়াতে বলে দেয়া হয়েছে। এ মানবিক কাজটা হলো ব্যক্তি পর্যায়ের। এটা আনুষ্ঠানিক যৌথ কোনো কাজ নয়। মানবিক কাজ করতে হবে বৈধ ও রীতিসম্মত পন্থায়। এ ধরনের মানবিক কাজ করতে গিয়ে অবৈধ ও হারাম কোন কর্ম সৃষ্টি হয় এমন পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ ইসলামী শরীয়াতে নেই। ইসলাম ভালো কাজ করতে গিয়ে হারাম ও নিষিদ্ধ পথ উন্মুক্ত করাকে সমর্থন করে না। সুতরাং ইসলামী রীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগী হোন। সকল মানবিকতা অটোমেটিক তৈরি হয়ে যাবে।

(ঘ) মিল্কব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলেছেন, ‘গার্মেন্টসে কর্মরত মায়েরা ও অন্যান্য চাকুরীজীবী মায়েরাও মিল্কব্যাংকে দুধ জমা করতে পারবেন।’

পর্যালোচনা

মিল্কব্যাংক কর্তৃপক্ষ মূলত মানবিকতার বিষয়টিকে বিস্তৃত করতে গিয়ে কর্মরত নারীদের প্রসঙ্গ এনেছেন। প্রশ্ন হলো, তারা কেন দুধ জমা রাখবে? সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য? সন্তানকে দুধ পান করানোর সময়ই তো তাদের নেই। তারা কখন আবার মিল্কব্যাংকে যাবে দুধ সংরক্ষণ করতে? শিশুকে খাওয়াতে হলে মিল্কব্যাংকে তাদের যাতায়াতের প্রয়োজন পড়বে। এত সময় তাদের কোথায়? এ জটিল ব্যবস্থায় না গিয়ে বরং কর্মস্থলে বেবি কেয়ারের ব্যবস্থা করলেই না ভালো হতো। মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মা আব্দুল্লাহ হাফিযাহুল্লাহ কত চমৎকারই না বলেছেন, ‘আমরা আগে সমস্যা তৈরি করে পরে উল্টো পথে তার সমাধান তৈরি করি।’ আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা এরকম হলো কেন যে এখানে মায়েরা চাকুরীজীবী হওয়ার কারণে তাদের সন্তানকে দুগ্ধদান করতে পারে না। কোনোভাবে কি চাকুরীজীবী মায়েদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করা যায় না যেখানে তারা মাতৃত্বকালীন শিশুকে স্তন্যদানের পূর্ণ সুযোগ পাবে? মিল্কব্যাংক কর্তৃপক্ষের এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে তার সমাধান করা উচিত। মাঝে হাত দিলে তো মৌলিক সমাধান হবে না। মূল সমাধানের জন্য গোড়ায় হাত দিতে হবে। স্বজন পরিত্যাক্ত শিশু কেন তৈরি হচ্ছে? মায়েরা কেন স্তন্যদানে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে? এসব মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধান করা প্রয়োজন।

শেষকথা

একজন এ্যারাবিয়ান গবেষক মিল্কব্যাংক বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, মিল্কব্যাংক ব্যবস্থাপনা এমন একটি নব উদ্যোগ যা কুমারী নারীকে দুগ্ধবতী গাভীতে রূপান্তরিত করে দিবে! আরেকজন গবেষক একটু রসিকতার ছলে লিখেছেন, যেসব নারী মিল্কব্যাংকে দুগ্ধ দান করে তাদের পরিচয়পত্রে লেখা উচিত, ‘পেশা : গাভী!’ গবেষকদ্বয়ের বক্তব্যকে বাহ্য দৃষ্টিতে একটু বকা ঝকা জাতীয় মনে হলেও তার বাস্তবতা রয়েছে। কারণ মানুষ সৃষ্টির সেরা। মিল্কব্যাংক ব্যবস্থায় বংশীয় ধারা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বও চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়। একজন মানুষ নেমে আসে প্রাণীর কাতারে। মানুষের যাবতীয় আচরণ পাশবিকতা মুক্ত হওয়া চাই। আমরা অনেক দিক থেকেই পাশবিকতাকে বরণ করে নিচ্ছি। মিল্কব্যাংকের ক্ষেত্রে পাশবিকতাকে একটু বেশি বরণ করে নেয়া হয়ে যাচ্ছে। কারণ একটি দুগ্ধবতী গাভীর দুধকে যে প্রক্রিয়ায় দোহন করে তা বাজারজাত করা হয় তদ্রƒপ একজন নারীর দুধকেও বিশেষ প্রক্রিয়ায় দোহন করে বাজারজাত করার মত করে ব্যবহার করা হয়। এ ধারা চলমান হলে একসময় প্যাকেটজাত মাতৃদুগ্ধও মার্কেটে চলে আসবে। যেমনটি কোনো কোনো রাষ্ট্রে চলে এসেছে। এগুলো একজন মানুষের মনুষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের সাথে যায় না। আল্লাহ আমাদের সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছ নীতি বিধান মেনে চলার তাওফীক দান করুন।


সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৯:১২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×