একটি মধ্যবিত্ত স্বপ্ন......
একটি জীবন...একটি স্বপ্ন যাত্রা......আকাশ-মহাকাশ জয় করার সংগ্রামী অভিযাত্রা।
তারপর একটু একটু করে সেই জীবনের বেড়ে উঠা... হাটি হাটি পা পা করে স্কুল থেকে কলেজ,কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি... তারপর সেই মধ্যবিত্ত চাকুরে জীবন...। আজ কেন জানি স্যারের পড়াতে ইচ্ছে করছিল না...ক্লাস শুরুর পর থেকেই খেয়াল করলাম স্যারের কথার মধ্যে একজন দার্শনিক এসে দণ্ডায়মান হয়েছেন।স্যারের আলোচনায় অনেক ভারিক্কি ও উঁচু চিন্তা-চেতনা সমৃদ্ধ কথার উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম।প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পাঠ্যসূচির বাইরের অনেক ব্যাপার নিয়ে কথা বলছেন বারবার।একটা সময় বলেই ফেললেন ভদ্রলোকের মন ভালো নেই,পড়াতে ইচ্ছে করছে না। পাঠ্যসূচিতে নিয়ে আসলেন স্যারের অতীত জীবনের কিছু কথা......
পড়া বাদ দিয়ে শুরু করলেন তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলাপচারিতা।
স্যার নিজের চাকরীর ইন্টারভিউর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন আমাদের। তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা নেই। পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর তার উপর চাপ ছিল ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেয়ার। বলছিলেন তার অসম্ভব রকমের পরিশ্রমী ছাত্রজীবনের কথা,যেখানে বেঁচে থাকা ছিল একরকম যুদ্ধজয় সেখানে থেকে পড়াশুনা করেছেন,খুব কৃতিত্বের সাথে পরীক্ষাগুলোতে পাশ করতেন। তারপর শুরু হল জীবিকার সন্ধানে চাকুরী নামের সোনার হরিণ খোঁজা । বাবা হারানো একটা ছেলের বেঁচে থাকার কষ্টের কথা বলছিলেন খুব অবলীলায়।অভাব আর নিত্য টানাটানির সংসারে চাকুরী খোঁজাও ছিল তার কাছে একরকমের বিলাসিতা। চাকুরীর প্রয়োজনে বিভিন্ন ব্যাংকের ড্রাফট,যাতায়াতের খরচ, ভালো জামাকাপড়ের অভাবের কথাও বলেছিলেন খুব শান্ত ও সুস্থির মননে।
যখন একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কোথাও কিছু হচ্ছিল না... ঠিক সেই মুহুর্তে উনি শুনতেন এই বন্ধু ওই বন্ধু চাকরী পেয়ে যাচ্ছে...।
মানবিক গুনের কারণে উনার কাছে ব্যাপারটা হতাশার, কারণ একে একে সবার গতি হয়ে যাচ্ছিল তিনি ছাড়া...ইন্টারভিউ বোর্ডের আজাইরা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে যখন বুঝতে পারতেন এখানেও টাকার খেলা চলছে।তখন ইচ্ছে করতো সার্টিফিকেটটা ছিড়ে ফেলতে...। আসলেই জীবনের একটা পর্যায়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কমবেশি সবারই এটার মুখোমুখি হতে হয়। বড়লোকের ছেলেরা সুপারিশের ঠেলায় সহজেই বড় বড় পোস্টে জয়েন করতে পারে। কেউবা বাবার ব্যবসা ধরে।
আমি তন্ময় হয়ে স্যারের কথা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, থার্ড ইয়ার প্রায় শেষ... কয়দিন পরেই ফোর্থ ইয়ারে ...মানে ফাইনাল ইয়ার... দেখতে দেখতে কেটে যাবে... তারপর পৃথিবীর সমস্ত টেনশন মাথার রিসিভারে আঘাত করতে থাকবে একে একে... হঠাত করেই কুয়োর ব্যাঙ যেন সাগরে এসে পড়বে। থাকবেনা আজকের এই বন্ধুত্ব আড্ডা,হাসি... কিংবা গল্প... প্রতিযোগিতার ভিড়ে সম্পর্কগুলো আস্তে আস্তে হারানো শুরু করবে... কারও খবর থাকবে কিংবা কারও থাকবেনা... বাবার হোটেলের ছাদের নিচে আর বসে থাকা যাবেনা... আর ছাদ ছেড়ে বাইরে যাওয়া মানেই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা... ।
সেই ভয়ঙ্কর বাস্তবে কেউ বেঁচে থাকবে খুব আয়েশি ঢঙে, আর কেউ বেঁচে থাকার জন্য প্রাণান্তকর বৃথা চেষ্টা করবে......
কারো জীবনের খেরোপাতার হিসেব মিলবে,কারো মিলবে না, তবু আমরা হিসেব করে যাব জীবনের হিসেব মেলাতে......
সে হিসেব কারো হয়তো মিলবে কারো না............
এভাবেই মধ্যবিত্তের স্বপ্নগুলো হারাবে ঠাশ বুনেটের ভিড়ে.........