somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কনস্টান্টিনোপল জয় যেভাবে

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানব ইতিহাসে অসংখ্য বীরগাঁথা দেখা যায়। তবে এর মধ্যে বিশেষ কিছু ঘটনা অন্য অনেকগুলোকে ম্লান করে দেয়। ইতিহাসকে এসব কিছু ঘটনা নতুন দিকে পরিবর্তিত করে দেয়। এধরনেরই একটি বিজয় হলো কনস্টান্টিনোপল জয়। সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ এই জয়ের মাধ্যেমে তার নামের সাথে স্থায়ীভাবে ‘আল ফাতিহ’ বা মহাবিজয়ী পদবিটি লাগিয়ে নিতে পেরেছেন। বিশ্ব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো তিনি আরো অনেককাজ করেছেন, তবে কনস্টান্টিনোপল বিজয় তাকে সবচেয়ে স্মরণীয় করে রেখেছে।



ইসলামের ইতিহাসে একেবারে শুরু থেকেই কনস্টান্টিনোপল জয়ে মুসলমানরা প্রলুব্ধ হয়েছে। ১৪৫৩ সালে শহরটি জয়ের আগে আরো অন্তুত ৩টি অভিযান চলেছিল। এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে সেনাবাহিনী বিজয়ীর বেশে সকলের আগে এই নগরীর (কনস্টান্টিনোপল) সিংহদ্বারে উপনীত হবে, তারা আল্লাহর অসীম রহমতের অধিকারী হবে।’ ওই সৌভাগ্য লাভের জন্য আমির মোয়াবিয়ার আমলে তার পুত্র ইয়াজিদ মুসলিম বাহিনী অভিযান শুরু করেছিল। নগর প্রাচীরের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল মুসলিম বাহিনী। কিন্তু তারপর আর ভাগ্য অনুকূল হয়নি। উসমানিয়া সুলতান বায়েজিদও অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বিজয়ের মুখ দেখতে পারেননি।



কনস্টান্টিনোপল জয়ের আগে থেকেই তুর্কিরা শহরটিকে নিজেদের বলে ভাবতো। এটিকে রাজধানীতে পরিণত করার দুর্বার আকাক্সক্ষা তাদের ছিল। উপরোন্ত মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ঘোষিত রহমত লাভের আগ্রহও কম ছিল না। কনস্টান্টিনোপলকে তারা বলতো ‘লাল আপেল’ (কিজিল এলমা)। সব উসমানিয়া সুলতানই অভিষেক গ্রহণের পরপরই জাননেসারিদের সাথে প্রথম সভাতেই কনস্টান্টিনোপল জয়ের কথা বলতেন।



সিংহাসনে আরোহণের দুই বছরের মধ্যেই মোহাম্মদ নগরীটি দখলের চূড়ান্ত অভিযান সম্পূর্ণ করেন। পিতা সুলতান মুরাদের ইন্তেকালের পর মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি তুর্কি সালতানাতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।



কনস্টানটিনোপল শহরটি জয়ের প্রধার সমস্যা ছিল তার অবস্থান। ত্রিভুজাকৃতির শহরটি প্রাকৃতিকভাবেই এতো সুরক্ষিত ছিল, কারো পক্ষেই সে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করা সহজসাধ্য ছিল না। শহরটির ঐতিহ্য ছিল আরো মহান। ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। নাম দেন ‘নোভারোমা’ বা নতুন রোম। তবে কালের পরিক্রমায় তা হয়ে দাঁড়ায় কনস্টান্টিনোপলে। ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট থিউডোসিয়াস তার দুই পুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। ফলে পশ্চিম রোম এবং পূর্ব রোম সাম্রাজ্য নামে দুইটি সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নাম হয় বায়জান্টাইন। কনস্টান্টিনোপল হয় তার রাজধানী। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের প্রধান কেন্দ্রে হিসেবেও এর পরিচিতি পায়। দ্বিতীয় মোহাম্মদের আমলে কনস্টান্টিনোপলের সিংহাসনে ছিলেন কনস্ট্যান্টইন। প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত শহরটিকে অজেয় করার জন্য খ্রিস্টীয় বাহিনী তদের নৌযানগুলোকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে যাতে কেবল একদিকে থেকে আক্রমণ হানা যায়। অন্যদিকে একটি সৈন্য মোতায়েন না করেও শহরটি রক্ষা করা যায়। এই কৌশল তাদেরকে দীর্ঘদিন অজেয় করে রেখেছিল।



সুলতানের রাজ্যের সাথে সংযুক্ত দিকটিও কম সুরক্ষিত ছিল না। সেখানে ১৪ মাইল দীর্ঘ ৪০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু তিন স্তর বিশিষ্ট দেওয়াল। বাইরের মসৃণ দেয়ালের সাথেই ছিল ৭০ ফুট চওড়া ও ৪০ ফুট গভীর পরিখা। বহিরাক্রমণের সময় পানি দিয়ে এটিকে ভরে ফেলা হতো। অন্যদিকে দেওয়ালে ওপরে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হতো। ফলে যেকোনো আক্রমণই ৭০ ফুট দূরে থমকে যেতো। নগরীর দেয়ালেও অনেক সময় আঁচড় লাগতো না।



সুলতান‘ মোহাম্মদ জানতেন, কনস্টান্টিনোপল জয়ের এটাই সবচেয়ে ভাল সময়ে। ‘আপেল পেঁকে আছে, কেবল একটি ঝাঁকুনি দিতে হবে’- সেই ঝাকুনিটা কে না দেয়! তাছাড়া ক্রুসেডারদের পরবর্তী কোনো অভিযান যাতে এদিক থেকে পরিচালিত হতে না পারে, তার ব্যবস্থার করার জন্যও কনস্টান্টিনোপল জয় ছিল অপরিহার্য। তবে যুদ্ধের আগে তিনি নিজের অবস্থান আরো মজবুত করে নেন। কনস্টানটিনোল থেকে ৫ মাইল দূরে রুমেলিয়ায় এক দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন। আদ্রিয়ানোপলে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করেন। সাইবেরিয়া ও ওয়ালেসের সাথে চুক্তি নবায়ন করে নেন। ১৪৫৩ সালের মার্চে অভিযান শুরু হয়। তবে অবরোধ চলে ৬ এপ্রিল থেকে। ২৯ মে বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।



মোহাম্মদ তার অভিযানে তখনকার প্রচলিত সব উন্নতমানের প্রযুক্তির ব্যবহার করেন। তার বাহিনী প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট না থেকে ইউরোপ থেকেও বিশেষজ্ঞদের যোগাড় করেছিলেন অভিযানের বিভিন্ন বিষয় আঞ্জাম দেয়ার জন্য। এছাড়াও তিনি এমন কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যা ছিল সকলের কাছে অকল্পনীয়। এগুলোর মধ্যে ছিল চাকার সাহায্যে টেনে নেয়া যায় এমন যুদ্ধ জাহাজ এবং তিনতলা বিশিষ্ট চলন্ত মিনার।



১৪৫৩ সালের ৬ই এপ্রিল তিনি অভিযান শুরু করেন। ৫৩ দিনের অক্লান্ত যুদ্ধের পর ২৯শে মে শুক্রবার অভিযান সম্পন্ন করেন। সুলতান তার অভিযানে ১২ হাজার ‘জাননেসারি’, ২০ হাজার অশ্বারোহী, একলাখ পদাতিক, সৈন্য ব্যবহার করেন। জাননেসারি সৈন্য ছিল অপ্রতিরোধ্য। বিশেষ অভিযানের জন্যই তুর্কিরা এই বাহিনী গঠন করেছিল। জাননেসারি শব্দের অর্থ ‘আত্মনিবেদিত’ বা ‘জানবাজ’। সেনাবাহিনী থেকে বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত। বিদ্যুৎগতিতে আক্রমণ হানতে সক্ষম জাননেসারি বাহিনীর উপস্থিতিতেই প্রতিপক্ষ সৈন্য ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো। প্রথম দিকের প্রচণ্ড আক্রমণ সত্ত্বেও যখন কনস্টন্টিনোপলের প্রতিরক্ষা দেয়ালকে ধ্বংস করা গেলনা, তখন সুলতান তার চাকায় টানা যুদ্ধজাহাজ ব্যবহারের পরিকল্পনা করেন। ৮০টি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে সেগুলোকে চাকার সাহয্যে কয়েক মাইল দূরের সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে নগরীটি একদিকের বদলে তিন দিকে থেকেই আক্রান্ত হয়। সুলতান এতো গোপনীয়তার সাথে তার পরিকল্পনা কার্যকর করেন যে, সাধারণ লোকতো দূরের কথা, তার উজিরে আযম পর্যন্ত তা জানতে পারেননি। জাহাজ নির্মাণের সময় একদিন উজিয়ে আযম তার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে সুলতান শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, আমার একটা দাঁড়িও সেকথা জানলে, তা উপড়ে আগুনে ফেলে দিতাম। ৭০ ফুট দীর্ঘ পানিরাশিকে পাড়ি দেয়ার জন্য তিনি ৩ তলা বিশিষ্ট একটি মিনার ব্যবহার করেন। উপরে দুটি তলা থেকে গোলা বর্ষণের ফাঁকে নিচের তলার সৈন্যরা যাতে খন্দাটি পাড়ি দিতে পারে সেজন্য তিনি মিনারটি উদ্ভাবন করেন।



খ্রিস্টানবাহিনীও তাদের দৃঢ়তা নিয়ে মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত ২৯শে মে চূড়ান্ত আক্রমণ হানার নির্দেশ দেওয়া হয়। সবদিক থেকে পরিচালিত আক্রমণের ফলে নগরীর পতন ঘটে। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ নগরী মুসলমনদের হাতে আসে। তুর্কি তথা ইসলামের ইতিহাসে কনস্টান্টিনোপল জয় একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ফলে ইউরোপে মুসলমানদের স্থায়ী আবাসন গড়ে উঠে। তাছাড়া মুসলমানরা এই প্রথম ইউরোপীয় কোনো সাম্রাজ্যের রাজধানী জয় করতে সক্ষম হলো। মুহাম্মদ আদ্রিয়ানোপল থেকে সরিয়ে এটাকেই তার রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন।

নয়া দিগন্‌ত
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×