somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইন্টারভিউ উইথ আ টাইম ট্রাভেলার

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি যে লোকটার সামনে বসে আছি, তিনি কুখ্যাত একজন মানুষ, মানব ইতিহাসে কুখ্যাত মানুষের লিস্ট করলে তিনি প্রথম তিনজনের একজন হবেন নিশ্চিত।

সময়টা ১৯৪৫, দিন তারিখ আপনারা জানেন, সেগুলো বলে আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না, ইতিহাসের সাল পযন্ত মনে রাখা সোজা, তারিখটা সবসময়ই একটু জটিল। যাই হোক, কাজের কথায় আসি। আমার নাম মারুফ রহমান, ২৫৬০ সালে আমার জন্ম, পঁচিশ বছর বয়সে এই পেশায় যোগ দিয়েছিলাম, এখন সাতাশ চলছে, এই দু’বছরে যে ক’টা ইন্টারভিউ নিয়েছি তার মধ্যে এই ইন্টারভিউটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। সমস্যা হচ্ছিল, ঠিক জায়গা বুঝে, ঠিক সময়ে আমাকে ঢোকানো নিয়ে। অন্তত পঁচিশ বার আমি এসেছি বার্লিনে, কিন্তু যুদ্ধের এই সময়টায় একেবারে ঠিক জায়গামতো আমাকে ঢোকান সত্যিই কঠিন ছিল। আরেকটা সমস্যা ছিল ভাষা, জার্মান ভাষা অল্পস্বল্প বুঝি, কিন্তু ইন্টারভিউ নেয়ার মতো শব্দসংগ্রহ তৈরি করতে দীর্ঘ দেড়টা বছর খুব খাটতে হয়েছে আমাকে।

আপনারা ভাবছেন আমি ২৫৮৭ সাল থেকে কিভাবে ১৯৪৫ সালে এলাম, সে এক লম্বা কাহিনী। লম্বা কাহিনী বলে কাউকে বিরক্ত করতে চাচ্ছি না। আসল ঘটনা হচ্ছে, আমরা টাইমমেশিন আবিষ্কার করে ফেলেছি। এখন টাইমমেশিনের কিছু ব্যাপার-স্যাপার তো আপনারা জানেন। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্যারাডক্স কাজ করে, গ্র্যান্ড ফাদার প্যারাডক্স, প্রিডেস্টিনেশন প্যারাডক্স ইত্যাদি ইত্যাদি। তো, আমাদের বিজ্ঞানীরা দেখলেন, টাইমমেশিন দিয়ে অনেক কিছুই বদলে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু এতে অনেক সমস্যাও আছে, যে টাইমলাইনে আমরা আছি তা নিখুঁত না হলেও, তাতে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ থাকলেও মানবজাতি এখনো টিকে আছে, তারা এসব জায়গায় পরিবর্তন এনে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নন, এতে আরো বড় ধরনের ঝামেলা হতে পারে।
এরচেয়ে টাইমমেশিনের অন্য একটা ব্যবহারের কথা ভাবলেন তারা, ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, বেশ মজাও আছে এতে। ইতিহাসের বিখ্যাত-কুখ্যাত সব ব্যক্তিদের ইন্টারভিউ নেয়ার কথা তাদের মাথায় এলো। সেই ইন্টারভিউ নেয়ার পদ্ধতিও হবে কিছুটা ভিন্ন, যেমন, ইন্টারভিউ নেয়া হবে কোন ব্যক্তির মারা যাওয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে, তাকে জানানো হবে যে সে মারা যাচ্ছে এবং তার যা বলার সে বলতে পারে নির্ধিদ্বায় কারন ভবিষ্যত পৃথিবী তা দেখবে এবং ইন্টারভিউ নেয়ার পর সেই সময়টা ব্যক্তির টাইমলাইন থেকে মুছে ফেলা হবে যাতে ইন্টারভিউ দেয়ার পর মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি তা মনে করতে না পারে, কারন তাহলে সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে এবং তাতে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে যেতে পারে।

উপরে অনেকগুলো কথা বললাম, টাইমমেশিন নিয়ে কথা বলতে হলে এসব বলতেই হতো, যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি।

যে ব্যক্তির ইন্টারভিউ নিতে এসেছি তিনি আজকে দিনের মধ্যে মারা যাবেন। সে তথ্যটা উনাকে জানানো হয়েছে আমার তরফ থেকে এবং এই প্রথমবারের মতো মৃত্যুপথযাত্রী একজনের কাছ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না, চুপ করে বসে আছেন, কোন কথাও বলছেন না, তাকে বারবার বলছি কিছু বলুন, ভবিষ্যতের মানুষ তাকিয়ে আছে আপনার কথা শোনার জন্য, আপনার কর্মের অপব্যাখ্যা শোনার জন্য। তবু তিনি নিশ্চুপ।

লোকটাকে কী আপনারা চিনতে পারছেন?

তিনি অ্যাডলফ হিটলার। জ্বি। অনেক কষ্টে উনার বাংকারে ঢুকতে পেরেছি। উনার স্ত্রী ইভাও আছে তার পাশে বসে। তবে তার সাথে আমার কথা হচ্ছে না, ভদ্রমহিলা গভীর শোকের মধ্যে আছেন বোঝা যাচ্ছে। তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে। তার হাতে সায়নাইডের ক্যাপসুলটা দেখতি পাচ্ছি পরিষ্কার।

হিটলারের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল আমার, প্রশ্নগুলো সাজিয়ে ছিলাম আগে থেকেই, জানা ছিল খুব বেশি সময় পাওয়া যাবে না, আমার হাতে ছোট রেকর্ডার, যেখানে অডিও-ভিডিও রেকর্ডিংসহ লাইভ টেলিকাস্টিং এর ব্যবস্থা আছে। কিছু কিছু চ্যানেলে অনেক দামে আডভান্সড বুকিং করা আছে এই লাইভ টেলিকাস্ট, বাকি জীবন আমাকে তেমন কিছু করে খেতে হবে বলে মনে হয় না, তিন-চারবার ইন্টারভিউ নিয়েই যে পরিমান টাকা রোজগার করেছি, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। এছাড়া, আরেকটা জিনিস যোগ হয়েছে সাথে। খ্যাতি। আমার সময়ের খ্যাতিমানদের তালিকায় প্রথম কয়েকজনের মধ্যে আমার নাম চলে এসেছে এরমধ্যে। আমার ফলোয়ার সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। যাক গে, নিজের এতো প্রশংসা করে আপনাদের আর বিরক্ত করতে চাচ্ছি না।

হিটলারকে চরম হতাশ মনে হচ্ছিল, জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষ, সোভিয়েত সৈন্য খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, আজই হয়তো রাইখ চ্যান্সেলরিতে ঢুকে পড়বে, তবে জীবিত অবস্থায় শত্রুর হাতে ধরা পড়ার কোন ইচ্ছে নেই লোকটার।
ছোট রেকর্ডারটার দিকে তাকালাম, সবাই এখন আমার চেহারা দেখতে পাচ্ছে, এবার রেকর্ডারটা ঘুরিয়ে দিলাম জনাব হিটলারের দিকে।
আমিঃ হের ফুয়েরার! পরাজয় সন্নিকটে, আপনার অনুভূতি কী?
আমি জানি দর্শকদের মাঝে প্রশ্নটা শুনে হাসির রোল পড়ে গেছে, তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, এই প্রশ্নটা আপনা-আপনি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, মুদ্রাদোষ বলা যায়।
হিটলারঃ সব ইহুদীদের মেরে যেতে পারলাম না, এটাই আফসোস।
আমিঃ ইতিহাসে কিন্তু আপনি কুখ্যাত একজন মানুষ, নিজের এই পরিচয় আমার কেমন লাগে!
হিটলারঃ কে কী ভাবল তাতে কি যায় আসে! এই যুদ্ধটা জিতে গেলেই পৃথিবী বদলে দিতাম, কেউ বুঝল না।
আমিঃ আপনি কী ওদের হাতে ধরা দেবেন?
হিটলারঃ প্রশ্নই উঠে না। আমার এস্কেপ প্ল্যান তৈরি।
আমিঃ কিন্তু আমরা তো জানি, আপনি সুইসাইড করেছিলেন।
হিটলারঃ ওটাই তো এস্কেপ প্ল্যান।
আমিঃ ঠিক কোন কারনে আপনার পরাজয় হলো বলে আপনার ধারনা।
হিটলারঃ কয়েকটা গাধাকে বিশ্বাস করেছিলাম, মাশুল দিতে হচ্ছে এখন।
সময় শেষ হয়ে আসছিল, আরো অনেক অনেক প্রশ্ন করা বাকি। কিন্তু হিটলার সাহেব খুব বেশি সময় নিচ্ছেন একেকটা প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য।
আমিঃ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য আপনার বার্তা কী?
হিটলারঃ ইহুদীদের বিশ্বাস করো না।
আমিঃ আপনার জন্য একটা দুসংবাদ আছে।
হিটলারঃ জানি, ইহুদীরা সব দখল করে নিয়েছে, তাই তো?
আমিঃ জার্মানি বলে কোন দেশই নেই এখন।
লোকটা মৃত্যুপথযাত্রী, তবু ষাড়ের মতো তেড়ে এলেন আমার দিকে। পাত্তা দিলাম না, আমার গায়ে নখের আঁচড়টি পযন্ত বসাতে পারবেন না এই বদ্ধ উন্মাদ মানুষটি।
রেকর্ডারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম, দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলে কোমরে থাকা পোর্টেবল টাইম ডিভাইসে চাপ দিলাম। এবার নিজ সময়ে ফেরার পালা।


২৫৮৭ সাল।
মহামতি আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ড হচ্ছেন আমাদের সময়ের সেরা বিজ্ঞানী, টাইমমেশিনের উদ্ভাবন তার হাত ধরেই। বিংশ শতাব্দীর আইনস্টাইনের সাথে উনার চেহারা বা আকৃতিতে তেমন কোন তফাত নেই, দেখতে দুজন একইরকম, পুরানো আইনস্টাইন থেকেই ক্লোন করা হয়েছে তাকে, তবে বর্তমান আইনস্টাইন আরো মারাত্মক সব সূত্র আবিষ্কার করে তার পূবসুরীকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমার দিকে ঝুঁকে আছেন এই মুহূর্তে, তার হাতে ছোট লেসার কিট, যা দিয়ে আমার পুরো শরীর স্ক্যান করে নিচ্ছেন। প্রতিবার এই কাজটা করতে হয়, ল্যাবের সাধারন এসিস্ট্যান্টরা যে কাজটা করতে পারে, সে কাজ তিনি নিজ হাতে করেন। যাই হোক, আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম, প্রায় মিনিট দশেকের কাজ। বিরক্তিকর।

ল্যাবের বাইরে এই মুহূর্তে আমার জন্য অপেক্ষা করছে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে প্রায় একশ জন সাংবাদিক। স্ক্যান শেষ হলেই ওদের মুখোমুখি হতে হবে এবং এই ব্যাপারটা আমি উপভোগ করি। পুরো পৃথিবী থেকে পাচ-হাজার প্রতিযোগীর মাঝ থেকে আমাকে জিতে আসতে হয়েছে এই কাজটা করার জন্য, কাজেই মিডিয়া কাভারেজ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

মহামতি আইনস্টাইন আজকে আরো বেশি সময় নিয়ে দেখলেন আমাকে এবং এই প্রথমবারের মতো কোয়ারেন্টাইন রুমে যাওয়ার আদেশ এলো। সাধারনত অতীত থেকে ফেরার সময় কোন কিছুই আমার সাথে আসে না, কিন্তু এবার এসেছে। মিসেস হিটলারের হাতে থাকা সায়ানাইড পিল, ওটা কোন ফাঁকে আমার হাতে চলে এসেছে কে জানে আর এই পিল ছাড়া ঐ ভদ্রমহিলা কিভাবে কী করবেন জানি না। অন্তত ইতিহাসের পাতায় তিনি যে সায়ানাইডের পিল খেয়ে মারা গিয়েছিলেন তা’তো পরিষ্কার লেখা আছে।

কোয়ারেন্টাইন রুমে যেতে হয় নগ্ন হয়ে, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই, শুধু এই রুমের তত্ত্বাবধান করে যে মেয়েটা তার মিচকি হাসিতে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। শরীর শুদ্ধিকরন প্রক্রিয়াটায় খুব জটিল কিছু নেই, গত শতকের আবিষ্কার, শরীরের যে অংশে জীবানু বা ক্ষতিকর কিছু ধরা পড়বে সে অংশটা কেটে তা প্রতিস্থাপন করা হবে। কিডনি, হৃদপিন্ড, হাত-পা, যাই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন তা প্রতিস্থাপন করতে শুদ্ধিকরন যন্ত্রের মিনিট দশেকের বেশি সময় লাগে না। আমি শুধু চাচ্ছিলাম, কোন কিছু প্রতিস্থাপন করার ঝামেলা পোহাতে না হয় যেন। অনেক সময় দেখা যায়, কারো পায়ে সমস্যা, পা পালটানো হলো, কিন্তু নতুন পা’টা হয়তো একটু বড় বা ছোট, তাতে পুরো দেহের আকৃতিই বদলে যায়, কিন্তু অভিযোগ করার উপায় নেই, কারন স্টকে থাকলে সবচেয়ে ভালো জিনিসটাই দেয়া হয়। যাই হোক, রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়েটা আমার দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিল, আমি মারুফ রহমান, যে সে লোক নই, একজন সেলিব্রেটি, তাকাতেই পারে, আমিও হাসলাম, চোখ টিপে দিলাম। তাতে কিছুটা হলেও মেয়েটার বেহায়াপনা কমল।

শুদ্ধিকরন যন্ত্রটা একটা খোপের মতো, স্বচ্ছ কাঁচে তৈরি, আমাকে একটা বৃত্তের উপর দাড়াতে ইশারা করল মেয়েটা, আমি দাঁড়ালাম, ছাদ থেকে স্বচ্ছ কাচের গোলাকার জিনিসটা এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে নিলো, পেঁজা তুলোর মতো একধরনের বুদ্বুদ ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল না তবে চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না। ঘুম আসছে, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম কিছুক্ষনের মধ্যে। চমৎকার কিছু স্বপ্ন দেখলাম, বুঝতে পারছিলাম, আমার শরীরের উপর দিয়ে কিছু একটা হচ্ছে, তবে মহামতি আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ডের বুদ্ধির তারিফ না করে উপায় নেই, স্বপ্নগুলো তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছে করে, যাতে সময়টা ভালো কাটে।

স্বপ্ন শেষ হলে চোখ খুলে দেখলাম আমি মেঝেতে শুয়ে আছি, কুন্ডলি পাকিয়ে, মেয়েটা সাদা একটা চাদরে ঢেকে দিল আমাকে, ওর মুখের হাসিটা ভালো লাগল দেখে, যেন বলতে চাইছে কিছু হয় নি। কিছু হয়েছে কী হয় নি সেটা একটু পরে বুঝতে পারবো। উঠে দাড়াতে গিয়ে পড়ে গেলাম। মেয়েটা আমাকে হাঁটিয়ে বাইরে নিয়ে এসে পোশাক পরিয়ে দিল।

মাথাটা ঝরঝরে লাগছে, চোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার, শরীরটায় কেমন আলাদা বল পাচ্ছি।

মহামতি আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, এই দৃশ্যটা বিরল একটা দৃশ্য, এগিয়ে গেলাম।
“মারুফ, তুমি আসলেই একটা জিনিস,” বললেন তিনি, এ ধরনের ভাষাও তার মুখ থেকে কখনো শুনি নি।
“কীরকম? বুঝলাম না,” অস্বস্তি নিয়ে বললাম আমি।
“পরের মিশনের জন্য তোমাকে তৈরি করা হবে, তার আগে দেখলাম তোমার শরীরে কোন ঝামেলা আছে কি না।”
“তো?”
“কোন ঝামেলা নেই, এরকম পার্ফেক্টলি অলরাইট মানবদেহ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, তোমাকে তো জিনিস বলতেই হয়,” বলে আমার কাধে রীতিমতো চাপড় দিলেন তিনি।
মুখ বাঁকিয়ে হাসলাম, স্বস্তি লাগছিল যে কোন কিছু বদলাতে হয় নি। এরপরের মিশনটা যে খুব চ্যালেঞ্জিং হবে আগেই জানতাম, তবে কার সাথে দেখা হবে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে কিছু জানি না এখনো।



১৯৬৩/১১/২১ রাত একটা কুড়ি, টেক্সাস হোটেল, টেক্সাস
তিনি ক্লান্ত। সকাল থেকে একের পর এক জায়গায় যাওয়া, লোকজনের সাথে কথা বলা, বক্তৃতা দেয়া এসব তার কাজের মধ্যে পড়ে। স্মরনকালের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট তিনি, সাথে আছে তার স্ত্রী, রীতিমতো ফ্যাশন আইকন জ্যাকুলিন।
টেক্সাস হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে আছেন, জ্যাকি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, আগামীকালের মিটিং আর অন্যান্য এজেন্ডা নিয়ে ডেপুটি জনসনের সাথে একটু আগে কথাবার্তা শেষ হয়েছে, এবার ঘুমানো যেতে পারে। বেডরুমে হাল্কা সুরে তার প্রিয় বন্ধুর রেকর্ডিং চলছে, ঠিক এই সময়ে অদ্ভুত একটা কিছু চোখে পড়ল।
একজন অপরিচিত ব্যক্তি, মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, পোশাক-আশাকের ধরন অপরিচিত, লোকটা এশিয়ান, সম্ভবত ভারতীয়, স্বাস্থ্য ভালো, উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয়ের বেশি হবে না। সিকিউরিটির এতো কড়াকড়ির মধ্যে এই লোকটা বেডরুমে ঢুকে গেল কেন ভেবে পাচ্ছেন না। তবে লোকটার চেহারা কিংবা হাসি দেখে ভয় পাওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না।
“কে আপনি? কী চান?” তিনি বললেন।
“আমি মারুফ রহমান, আপনার সাক্ষাৎকার প্রার্থী।”
“প্রটোকল ভেঙে কিভাবে এখানে এলেন?”
“আমি এসেছি ২৫৮৯ সাল থেকে, মিঃ কেনেডি। ভয়ের কিছু নেই, আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েই চলে যাবো।”
হাসলেন তিনি। ২৫৮৯! বললেই হলো। বেডরুমের একপাশে ছোট একটা আলার্ম সুইচ আছে, সেখানে কোনমতে চাপ দিতে পারলেই হবে, এই পাগলটাকে নিয়ে যাবে ওরা।
“আমাদের সময়ের কোটি কোটি মানুষ আপনার এই সাক্ষাৎকার লাইভ দেখছে,” মারুফ রহমান বলল, “আপনি তাদের উদ্দেশ্যে ‘হাই’ বলতে পারেন।”
তিনি ‘হাই’ বললেন, মারুফের হাতে ছোট একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছেন, জিনিসটা ক্যামেরা না, তার অনেক অনেক অনেক আধুনিক সংস্করন। মারুফ এগিয়ে এলো তার দিকে, হাত বাড়াল। হাত মেলালেন তিনি, বুঝতে পারছেন বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন, কারন হাত মেলানোর সাথে সাথে শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন, মনে হচ্ছে শরীরে একধরনের বিদ্যুতিক তরঙ্গ বয়ে গেছে।
মুখোমুখি বসলেন তিনি, মুখে সবসময়ের সেই মনভুলানো হাসি। আমেরিকার জনগন এই হাসি ভালোবাসে, ভবিষ্যত পৃথিবীর মানুষও নিশ্চয়ই ভালোবাসবে।
“মিঃ কেনেডি, আপনাকে একটা তথ্য দিতে চাই,” বলল মারুফ রহমান, “আগামীকাল দুপুর বারোটায় আপনি মারা যাবেন, খুব কাছ থেকে গুলি করা হবে।”
“আচ্ছা,” হাসিমুখে শুনলেন তিনি, “এই চমৎকার তথ্য দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”
“খুব জটিল কোন প্রশ্ন করে আপনাকে বিব্রত করতে চাই না, শুধু একটা কথা বলবেন...”
“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করুন,” বললেন তিনি।
“প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার সফলতা কোনটি?”
“ভবিষ্যতের মানুষ হলে ইতিহাস আপনি জানেন, সফলতা-ব্যথর্তা সবই আপনাদের জানা,” হাসি মুখে বললেন।
“তা জানি, তবে আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
“আমি একটা মুক্ত, স্বাধীন, স্বাস্থ্যকর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্নের পথে সবার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ...”
“মিঃ কেনেডি, আপনি রাজনীতিবিদ হিসেবে কথা না বলে একজন সাধারন মানুষ হিসেবে আপনার সফলতাগুলো বলুন।”
“কোন সফলতা নেই, সফল হওয়ার কোন পথও নেই কারন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় যার কোনটাই ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দ নয়, যেমনঃ কিউবাতে আক্রমন, ইজরায়েলকে সমর্থন।”
“আপনার আমলেই ইজরায়েল বেশি ফুলে ফেঁপে উঠেছে।”
“ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করবে একসময়,” বললেন তিনি, “কিন্তু আমার কিছু করার নেই। এখানে ইহুদী লবিষ্ট গ্রুপ খুব শক্তিশালী।”
“আপনার স্ত্রী?”
“ঘুমাচ্ছে। আমি কিভাবে মারা যাবো?”
“খুব কাছ থেকে গুলি করা হবে, এরবেশি কিছু বলা সম্ভব নয়,” মারুফ বলল।
“আমার স্ত্রী’র কিছু হবে না তো?”
“না, উনি সুস্থ থাকবেন।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। মারুফ নামের লোকটার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ব্যবস্থা নিতে হবে। খুব কাছ থেকে গুলি ছোঁড়ার মতো অবস্থায় যাওয়ার আগেই, সিকিউরিটিকে জানিয়ে রাখতে হবে।
“মিঃ কেনেডি, আপনাকে একটা কথা বলা হয় নি,” মারুফ বলল।
“কি?”
“আপনার সাথে আমার কথোপকথনের অংশটা আপনার স্মৃতিশক্তি থেকে মুছে যাবে, আমি চলে যাওয়ার সাথে সাথে, কাজেই প্রান বাঁচানোর প্ল্যান করে লাভ নেই।”
এই প্রথম রেগে গেলেন তিনি। দৌড়ে গিয়ে বেডরুমের একপাশের আলার্মে চাপ দিলেন। এই পাগলটাকে ধরা দরকার, সত্যি বলছে না মিথ্যে বলছে তা ইন্টিলিজেন্স ইউনিট একসেকেন্ডেই বের করে ফেলতে পারবে। তবে তাতে কাজ হলো না।
নিজেকে আবিষ্কার করলেন বেডরুমে, দাঁড়িয়ে আছেন স্থির হয়েছে, একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে চিরতরে, হাল্কা সুর ভাসছে চারদিকে, জ্যাকির ঘুমন্ত চেহারাটা দেখে ভালো লাগল খুব। আগামীকাল আরেকটা ব্যস্ত দিন আসছে।

২৫৮৯ সাল।
নিজের সময়ে ফিরে স্বস্তি লাগছে, আলার্মে চাপ দেয়ার সেকেন্ডের একশোভাগের একভাগ সময়ের মধ্যে ফিরতে হয়েছে, তা না হলে টাইমলাইনে গন্ডগোল হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল, তবে মিঃ কেনেডি’র হঠাৎ এই আচরনে একটা কাজ হয়েছে, আমাদের সময়ের দর্শকদের মাঝে এযাবতকালের সবচেয়ে বিনোদনমূলক পর্ব হিসেবে আজকের পর্বটা সবচেয়ে বেশি শেয়ার হয়েছে। বুঝতে পারছি, আরো বেশি পারিশ্রমিক দাবি করা উচিত আমার।
এবারও মহামতি আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ড আমাকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখলেন, নিকোলাই টেসলা দ্য থার্ড আমার দিকে তাকালেন বাঁকা চোখে, বুঝতে পারছি, মিঃ কেনেডি’র হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে আলার্ম চেপে দেয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আরো বেশি সাবধান হওয়া দরকার ছিল। অথচ গত দু’বছর এই ট্রাভেলের ব্যাপারে বিস্তর কাজ করেছি আমি, রীতিমতো গবেষনা করা যাকে বলে, মিঃ কেনেডি ইউএস আর্মিতে ছিলেন, কিন্তু প্রত্যুৎপন্নমতি হিসেবে তার তেমন সুখ্যাতি ছিল না। তার এমন রিফ্লেক্স আশা করি নি। যাই হোক, আরো সাবধান হতে আমাকে।
টাইমলাইনে যাতে কোন পরিবর্তন না হয় এজন্য ইন্টারভিউয়ের অংশটা আমরা ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি থেকে মুছে দেই, এটা আপনাদের আগেই বলেছি, তবে এখানে আরেকটা কথা আপনাদের বলা হয় নি, এই মুছে দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হয় মিঃ টমাস আলডা এডিসন দ্য ফিফথের তৈরি করা মেমোরি ল্যাপস সল্যুশন, যা ছোট একটা সিরিঞ্জে বহন করি আমি, হাতের তালুর মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়, হ্যান্ডশেক করার সাথে সাথে জিনিসটা পুশ করি।
এবার আর কোয়ারেন্টাইন রুমে যেতে হলো না। দুই মাসের ছুটি দেয়া হলো আমাকে। এই দুই মাসে আমি পৃথিবী ঘুরে দেখতে পারি, তবে সেসবের কোন প্রয়োজন অনুভব করলাম না। আগামী দুই মাস বাসায় বসে থাকবো, নতুন নতুন অনেক লেখকের লেখা বের হচ্ছে সেগুলো পড়বো, টিভি সিরিয়াল আর মুভি দেখবো। এরচেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।


তবে সেভাবে সময় নষ্ট করলাম না, বেশ কিছু টাকা জমেছে হাতে, সেগুলো সদ্বব্যবহার করলাম বলা যায়। নিজের ভবিষ্যত তো নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে, এখনকার জনপ্রিয়তা সবসময় থাকবে না, কাজেই এমন কিছু করে রাখা দরকার যাতে বাজে কিছু হয়ে যাওয়ার আগে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারি।
পরপর কয়েকবছর একটানা ইন্টারভিউ নিলাম, মাও সে তুং এর জন্য শিখতে হলো চাইনীজ ভাষা, গ্যালিলিও গ্যালিলি, কলম্বাসের সাথে কথা বলার জন্য শিখলাম ইটালিয়ার আর স্প্যানিশ ভাষা, নিউটনকে ইন্টারভিউ করাটা কঠিন ছিল, যদিও ইংরেজি জানতাম, কিন্তু সেসময়ের ইংরেজি বোঝা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছিল আমার জন্য, দর্শকদের কাছে সেজন্য ক্ষমাও চাইতে হয়েছে আমাকে।
একের এক সফল ইন্টারভিউ আমাকে রীতিমতো মিডিয়া আইকন বানিয়ে ফেলল, কয়েক বিলিয়ন ইউনিট জমা পড়ল আমার ইউনিভার্সেল অ্যাকাউন্টে। আমার জন্য আলাদা সেক্রেটারি রাখতে হলো, বডিগার্ড চারপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল।
তারপর একরাতে বদলে গেল সবকিছু।

২৫৯৪ সালের ৭ই মে, রাত বারোটার উপর বাজে, পয়ত্রিশতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা আসছিল, একের পর এক, স্রোতের মতো। বিভিন্ন দেশের রাস্ট্রপতি থেকে শুরু করে সাধারন জনগন, সাইন্টেফিক সোসাইটির বিজ্ঞানী থেকে অনলাইন গেমসের তারকারা শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, সবাইকে উত্তর দিচ্ছি, ভালো লাগছে। তবে সমস্যা একটাই, এই বয়সেও আমি একা। বাসায় বার্থডে কেক কেটেছি একটু আগে, একা একাই, সেটা লাইভ সম্প্রচার করেছে বেশ কয়েকটি মিডিয়া এবং সেজন্যও যথেষ্ট পরিমান ইউনিট জমা হয়েছে আমার ইউনিভার্সেল অ্যাকাউন্টে। তবে, সবকিছুর পরও যথেষ্ট একা অনুভব করছি। এই ইন্টারভিউ ইন্টারভিউ খেলা এখন বিরক্তিকর ঠেকছে আমার কাছে, তবে সাইন্টেফিক সোসাইটির চিন্তাভাবনা অন্যরকম, শুরুতে তারা প্রথাগত ইন্টারভিউয়ের দিকে ঝুঁকে ছিল, এখন নতুন নতুন কিছু জিনিস যোগ করতে চাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাকে সরাসরি কিছু জানানো হয় নি, তবে তাদের ভেতরে কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাথে খুব দহরম মহরম আমার, কাজেই তথ্য পেতে খুব একটা সমস্যা হয় নি। কিছু কিছু ব্যক্তির টাইমলাইনে তারা খানিক রদবদল করার চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন, এক্ষেত্রে দারুন ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন তারা, কারন, হিটলার কিংবা নেতাজি সুভাষ বসুর মৃত্যুকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা মানে পুরো মানবসভ্যতার ইতিহাস বদলে দেয়ার সামিল, তাতে আজকে যে আমরা ভালো আছি, যুদ্ধ-বিগ্রহহীন শান্তিময় জীবন যাপন করছি তা একদম বদলে যেতে পারে।

সবার সাথে কথা বলা শেষ করে বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহারথি ডঃ হেইনরিখ শুলজের সাথে কথা বললাম। তিনি আমার কাছ থেকে তিন লক্ষ ইউনিট নিয়েছেন, তিন লক্ষ ইউনিট একজন মানুষ সারাজীবন পরিশ্রম করেও রোজগার করতে পারে না, আমি সেই তিন লক্ষ ইউনিট তাকে দিয়ে দিয়েছি, বদলে খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা কাজ তিনি করে দিয়েছেন, ছোট একটা ডিভাইস বানিয়ে দিয়েছেন, সেটা কাজে লাগবে কি না জানি না, তবে সাবধানতার মার নেই, প্রাচীন এই তত্ত্বটা আমি ভুলি নি।

টমাস আলভা এডিসন দ্য ফিফথের ফোন এলো আরেকটু পর, আমি ঘুমানোর প্ল্যান করছিলাম পড়েছিলাম, ভদ্রলোককে এক লক্ষ ইউনিট দেয়ার কথা, উনার কাছ থেকে ডেলিভারি পেয়ে গেছি আগেই, তাই ফোনটা রেখেই ইউনিট ট্রান্সফার করে দিলাম।

এবার ঘুমানোর পালা, তবে জন্মদিনের রাত। আরেকটু রাত জাগতে কেউ আমাকে বারন করছে না, আমি ডাটাবেজ নিয়ে বসলাম। আমার একজন সঙ্গী দরকার, প্রাচীনকাল, বর্তমান সব ঘুরে দেখছি আমার কম্পুনেটে, দেখতে দেখতে একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। প্রায় ছয়শ বছর আগের কিছু ছবি, ভিডিও দেখে মনে হলো, ঠিক আমাকেই যেন দেখছি আমি, লোকটার স্বাস্থ্য আমার মতো, হাসিটাও, এমনকি কথাবার্তাও বলে খুব কম, যেন কষ্ট হয় কথা বলতে। একদম অমিশুক একজন মানুষ, তবে তার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে কথা শোনার চমৎকার একজন সঙ্গী আছে তার, দেখতেও সুন্দরী। স্বীকার করতেই হচ্ছে, আমার চেয়ে লক্ষগুন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে লোকটা।

ডঃ শুলজের ডিভাইসটা হাতে নিলাম। ব্যাপারটা একদম অনুচিত, অমানবিক একটা কাজ। নিজের প্রতি করুনা হতে থাকল আমার। রেখে দিলাম যেখানে ছিল।
এক গ্লাস পানি নিয়ে বেডরুমে ঢুকলাম, চমকে গেলাম সাথে সাথে।


“হাই,” বলল ছেলেটা, চকচকে একটা ছেলে, ফর্সা, সুদর্শন, বেডরুমের বিছানার পাশে আমার পড়ার চেয়ারটেবিল, সেখানে একটা চেয়ার দখল করে বসে আছে। এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মেলাল।
বৈদ্যুতিক একটা তরঙ্গ খেলে গেল শরীরে।
“স্যার, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,” ছেলেটা বলল।
“তোমার নাম কি?”
“রিচার্ড হেফনার,” ছেলেটা বলল।
“তো, মিঃ রিচার্ড, তুমি কি বলবে আমি ঠিক কিভাবে মারা যাবো?”
“স্যার,” হাসল ছেলেটা, “আপনি মারা যাবেন বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে, আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে।”
“গুড, সত্যি কথাটা জেনে ভালো লাগল। এখন তোমার প্রশ্ন করো,” বললাম আমি, যথেষ্ট রিলাক্সড বোধ করছি। যদিও এইসব মুহূর্তে অন্য অনেকেই ভয় পায়, নিউটন সাহেব তো রীতিমতো কাকুতিমিনতি শুরু করেছিলেন। তবে আমি ভয় পাচ্ছি না, লক্ষ লক্ষ দর্শকরা এখন আমাকে দেখছে, লাইভ, একসময় তাদের কাছে আমি আইডল ছিলাম, এখন ভয় পেলে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবো।
“আপনি কোন জীবনসঙ্গী বেছে নেন নি কেন?” রিচার্ড হেফনার জিজ্ঞেস করল, “এই প্রশ্নটা আমার নয়, আপনার লক্ষ লক্ষ ভক্তের।”
“সময়ই তো পেলাম না, সঙ্গী খোঁজার, এছাড়া উপযুক্ত সঙ্গী পাওয়াও খুব মুশকিল,” বলে হাসলাম আমি, “আপনারা কেউ কিছু মনে করবেন না আবার,” জানি অনেক মেয়ে ফ্যান আছে আমার, তারা আবার মন খারাপ করতে পারে।
“আরেকটা প্রশ্ন, আপনি ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসেন, ঠিক কোন সময়টাকে আপনি বেশি উপভোগ করেছেন?”
“ইন্টারনেট আবিষ্কার হওয়ার আগ পযন্ত মানুষের জীবনটাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, সেটা সম্ভবত ১৯৮০ সালের কথা হবে।”
“আপনি তো জানেন, আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যে আপনি মারা যাবেন, এ নিয়ে আপনার অনুভূতি কি?”
হাসলাম আমি, রিচার্ডের হাতে থাকা ডিভাইসটার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ালাম, আমার বেডরুমটায় ছোটখাট একটা সিগন্যাল লকার আছে, চেয়ারে থাকা ছোট বোতামে চাপ দিয়ে লকারটা অন করে দিলাম, এখন আর দর্শকরা আমাদের লাইভ শো দেখতে পারবে না, যদিও রিচার্ড টের পাবে না সেটা, কারন সব ধরনের সিগন্যালের এখন এই রুমে প্রবেশ নিষেধ।
“রিচার্ড, আমি যাচ্ছি, তোমার সাথে কথা বলার সময় নেই আমার,” বলে উঠে দাঁড়ালাম, রিচার্ডকে অসহায় দেখাচ্ছিল।
“কিন্তু আপনি সেটা করতে পারেন না, টাইমলাইন বদলে দেবার কোন সুযোগ আপনার নেই।”
উঠে এলো রিচার্ড, আমার দিকে, ভেবেছে আমাকে ধরে ফেলবে, কিন্তু তার আগেই আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলাম। বাকি কাজ করতে একটু কষ্ট হলেও এছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। রিচার্ড চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করল আমার চেয়ারে বসা অবস্থায়, লেসার রে ওর চারপাশ ঘিরে রেখেছে, একটু নড়লেই মরবে।
“রিচার্ড,” বললাম আমি, “জানতাম, এমন দিন আসবে, যেদিন আমার ইন্টারভিউ নিতে আসবে কেউ। তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল। আর এক ঘন্টা পর বৈদ্যুতিক শটসার্কিটে পুরো বাড়ি স্রেফ ছাই হয়ে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না চেয়ারে মরে থাকা লোকটা কে? তুমি না আমি? সেটা বের করতে করতে আমি অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো।”
“কিন্তু আপনি টাইমলাইনে কোন পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখেন না, আমি নিজের হাতে আপনার হাতে মেমোরি ল্যাপস সল্যশুন পুশ করেছি,” রিচার্ড বলল।
“আমি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম, বেটা,” হেসে ওর মাথার সোনালী চুলগুলো এলোমেলো করে দিলাম, “মিঃ এডিসন দ্য ফিফথ আমাকে এর প্রতিষেধক তৈরি করে দিয়েছেন, কাজেই তোমার ঐ সল্যুশনের কোন ক্রিয়া হয় নি আমার উপর।”
“ওহ! কি জঘন্য! লোকটা টাকার জন্য সবকিছু করতে পারে,” রিচার্ড বলল মুখ বাঁকিয়ে।
“হু, ইউনিট খরচ করলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়, কথাটা একেবারে ফেলনা নয়,” বললাম আমি, তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
রিচার্ডের হাত থেকে ওর ট্রাভেল ডিভাইসটা কেড়ে নিয়েছি, আমার কম্পুনেটটা সেলফ ডিস্টাক্ট মোডে আছে, কোন সময়ে যাচ্ছি সেটা বের করতে পারলেও আমাক খুঁজে পাবে না আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ড আর উনার সাঙ্গপাঙ্গরা।
“কিন্তু তোমাকে খুঁজে বের করবে সোসাইটির বিজ্ঞানীরা, তারপর...” রিচার্ড হাসল, “তোমার কী যে করবে সেটা চিন্তাও করতে পারবে না।”
“সোসাইটির নিয়ম ভাঙলে উনবিংশ স্তবকের খ ধারা অনুযায়ী আমার শাস্তি হবে মৃত্যুহীন প্রান। আমার শরীরকে বাঁচিয়ে রাখা হবে বছরের পর পর, শুধু শাস্তি দেয়ার জন্য, তাই তো?”
“হ্যা, তাই,” চিৎকার করে বলল রিচার্ড, তাকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই।
“তুমি ভেবো না, সে ব্যবস্থাও করা আছে,” ডঃ শুলজের ডিভাইসটা দেখালাম রিচার্ডকে, “এটা কি জানো?”
“জানি না, জানার প্রয়োজনও বোধ করছি না।”
“এটা দিয়ে আমার ডিএনএ রি-অর্ডার করা হবে, ঠিক যেমন হতে চাই, তেমনটা হয়ে যাবো দশ মিনিটের মধ্যে। তুমি দেখবে এর কেরামতি?”
“সব বিজ্ঞানীগুলো দেখছি বেঈমান!”
অনেকক্ষন সময় পার হয়ে গেছে, দর্শকদের সাথে রিচার্ডের অনলাইন স্ট্রিমিং বন্ধ, এমনকি রিচার্ডের সাথে সোসাইটির বিজ্ঞানীরা যোগাযোগও করতে পারছে না, কাজেই যে কোন সময় পুলিশ ফোর্স চলে আসবে। রুমের সিগন্যাল চালু করে দেয়ার আগে, ডঃ শুলজের ডিভাইসটার ছোট সবুজ বোতামে চাপ দিলাম।
নিজের মধ্যে পরিবর্তনটা টের পাচ্ছি।
আমি বদলে যাচ্ছি, কম্পুনেটে দেখা সেই লোকটার আদলে তৈরি হচ্ছে আমার মুখমন্ডল, আমার শারীরিক গঠন, এগুলো কাছাকাছি থাকায় পাচ মিনিটের কম সময়ে নতুন একজন মানুষ হিসেবে রিচার্ডের সামনে আবিভূত হলাম।
রিচার্ড বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, বিশ্বাস করতে পারছে না একটু আগে যা দেখেছে।
“ডঃ শুলজকে তিন লক্ষ ইউনিট দিয়েছি! তো, কেরামতি কেমন দেখলে?”
উত্তর দিলো না রিচার্ড। বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিটের আলামত শুরু হয়ে গেছে, বেডরুম, বারান্দার বাতি জ্বলছে, নিভছে, যেকোন সময় আগুন লেগে যেতে পারে।
চারদিকে শেষবারের মতো তাকালাম। বিদায় ২৫৯৪। রিচার্ডের ট্রাভেল ডিভাইসে সাল, তারিখ সব ঠিক করে রেখেছিলাম, এবার চেপে দিলাম। মূহূর্তেই পায়ের নীচে মেঝে কেপে উঠলো, রিচার্ডের আর্তচিৎকারে ভরে উঠলো চারদিক। তবে সেসব দেখার সময় নেই আমার।

২০১৪ সাল।
প্যাচপ্যাচে গরমে লেখক সাহেব বসুন্ধরা সিটি মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে সিগারেট, মুখ সবসময়ের মতো গম্ভীর। বয়স পয়ত্রিশের কাছাকাছি, স্বাস্থ্য বেশ ভালো, মোটাসোটাই বলা যায়, গতকয়েক বছরে একটা ট্রিলোজি লিখে একটু-আধটু নাম করেছেন। চমৎকার সঙ্গী পেয়েছেন, তবে সমস্যা একটাই, একবার শপিং মলে ঢুকলে বেরুনোর নাম নিতে চায় না। আগের লোকটাকে সরাতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি, একই চেহারার আরেকজনকে দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠেছিল লোকটা, সে সুযোগে একদম গায়েব করে দিয়েছেন ডিসাস্টার গান দিয়ে। একদম ধুলো হয়ে মিশে গেছে মাটির সাথে। মেয়েটাও কিছু টের পায় নি, কথা কম বলার এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় সুবিধা।
মারুফ রহমান নামটা ব্যবহার করেন না এখন আর। তবে এখনো কেউ কাউকে মারুফ বলে ডাকলে চমকে উঠেন, তার নতুন নামটাও খারাপ না, বইয়ের মলাটে বেশ ভালোই মানিয়ে যায়।
আমি যে লোকটার সামনে বসে আছি, তিনি কুখ্যাত একজন মানুষ, মানব ইতিহাসে কুখ্যাত মানুষের লিস্ট করলে তিনি প্রথম তিনজনের একজন হবেন নিশ্চিত।

সময়টা ১৯৪৫, দিন তারিখ আপনারা জানেন, সেগুলো বলে আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না, ইতিহাসের সাল পযন্ত মনে রাখা সোজা, তারিখটা সবসময়ই একটু জটিল। যাই হোক, কাজের কথায় আসি। আমার নাম মারুফ রহমান, ২৫৬০ সালে আমার জন্ম, পঁচিশ বছর বয়সে এই পেশায় যোগ দিয়েছিলাম, এখন সাতাশ চলছে, এই দু’বছরে যে ক’টা ইন্টারভিউ নিয়েছি তার মধ্যে এই ইন্টারভিউটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। সমস্যা হচ্ছিল, ঠিক জায়গা বুঝে, ঠিক সময়ে আমাকে ঢোকানো নিয়ে। অন্তত পঁচিশ বার আমি এসেছি বার্লিনে, কিন্তু যুদ্ধের এই সময়টায় একেবারে ঠিক জায়গামতো আমাকে ঢোকান সত্যিই কঠিন ছিল। আরেকটা সমস্যা ছিল ভাষা, জার্মান ভাষা অল্পস্বল্প বুঝি, কিন্তু ইন্টারভিউ নেয়ার মতো শব্দসংগ্রহ তৈরি করতে দীর্ঘ দেড়টা বছর খুব খাটতে হয়েছে আমাকে।

আপনারা ভাবছেন আমি ২৫৮৭ সাল থেকে কিভাবে ১৯৪৫ সালে এলাম, সে এক লম্বা কাহিনী। লম্বা কাহিনী বলে কাউকে বিরক্ত করতে চাচ্ছি না। আসল ঘটনা হচ্ছে, আমরা টাইমমেশিন আবিষ্কার করে ফেলেছি। এখন টাইমমেশিনের কিছু ব্যাপার-স্যাপার তো আপনারা জানেন। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্যারাডক্স কাজ করে, গ্র্যান্ড ফাদার প্যারাডক্স, প্রিডেস্টিনেশন প্যারাডক্স ইত্যাদি ইত্যাদি। তো, আমাদের বিজ্ঞানীরা দেখলেন, টাইমমেশিন দিয়ে অনেক কিছুই বদলে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু এতে অনেক সমস্যাও আছে, যে টাইমলাইনে আমরা আছি তা নিখুঁত না হলেও, তাতে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ থাকলেও মানবজাতি এখনো টিকে আছে, তারা এসব জায়গায় পরিবর্তন এনে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নন, এতে আরো বড় ধরনের ঝামেলা হতে পারে।
এরচেয়ে টাইমমেশিনের অন্য একটা ব্যবহারের কথা ভাবলেন তারা, ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, বেশ মজাও আছে এতে। ইতিহাসের বিখ্যাত-কুখ্যাত সব ব্যক্তিদের ইন্টারভিউ নেয়ার কথা তাদের মাথায় এলো। সেই ইন্টারভিউ নেয়ার পদ্ধতিও হবে কিছুটা ভিন্ন, যেমন, ইন্টারভিউ নেয়া হবে কোন ব্যক্তির মারা যাওয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে, তাকে জানানো হবে যে সে মারা যাচ্ছে এবং তার যা বলার সে বলতে পারে নির্ধিদ্বায় কারন ভবিষ্যত পৃথিবী তা দেখবে এবং ইন্টারভিউ নেয়ার পর সেই সময়টা ব্যক্তির টাইমলাইন থেকে মুছে ফেলা হবে যাতে ইন্টারভিউ দেয়ার পর মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি তা মনে করতে না পারে, কারন তাহলে সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে এবং তাতে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে যেতে পারে।

উপরে অনেকগুলো কথা বললাম, টাইমমেশিন নিয়ে কথা বলতে হলে এসব বলতেই হতো, যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি।

যে ব্যক্তির ইন্টারভিউ নিতে এসেছি তিনি আজকে দিনের মধ্যে মারা যাবেন। সে তথ্যটা উনাকে জানানো হয়েছে আমার তরফ থেকে এবং এই প্রথমবারের মতো মৃত্যুপথযাত্রী একজনের কাছ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না, চুপ করে বসে আছেন, কোন কথাও বলছেন না, তাকে বারবার বলছি কিছু বলুন, ভবিষ্যতের মানুষ তাকিয়ে আছে আপনার কথা শোনার জন্য, আপনার কর্মের অপব্যাখ্যা শোনার জন্য। তবু তিনি নিশ্চুপ।

লোকটাকে কী আপনারা চিনতে পারছেন?

তিনি অ্যাডলফ হিটলার। জ্বি। অনেক কষ্টে উনার বাংকারে ঢুকতে পেরেছি। উনার স্ত্রী ইভাও আছে তার পাশে বসে। তবে তার সাথে আমার কথা হচ্ছে না, ভদ্রমহিলা গভীর শোকের মধ্যে আছেন বোঝা যাচ্ছে। তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে। তার হাতে সায়নাইডের ক্যাপসুলটা দেখতি পাচ্ছি পরিষ্কার।

হিটলারের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল আমার, প্রশ্নগুলো সাজিয়ে ছিলাম আগে থেকেই, জানা ছিল খুব বেশি সময় পাওয়া যাবে না, আমার হাতে ছোট রেকর্ডার, যেখানে অডিও-ভিডিও রেকর্ডিংসহ লাইভ টেলিকাস্টিং এর ব্যবস্থা আছে। কিছু কিছু চ্যানেলে অনেক দামে আডভান্সড বুকিং করা আছে এই লাইভ টেলিকাস্ট, বাকি জীবন আমাকে তেমন কিছু করে খেতে হবে বলে মনে হয় না, তিন-চারবার ইন্টারভিউ নিয়েই যে পরিমান টাকা রোজগার করেছি, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। এছাড়া, আরেকটা জিনিস যোগ হয়েছে সাথে। খ্যাতি। আমার সময়ের খ্যাতিমানদের তালিকায় প্রথম কয়েকজনের মধ্যে আমার নাম চলে এসেছে এরমধ্যে। আমার ফলোয়ার সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। যাক গে, নিজের এতো প্রশংসা করে আপনাদের আর বিরক্ত করতে চাচ্ছি না।

হিটলারকে চরম হতাশ মনে হচ্ছিল, জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষ, সোভিয়েত সৈন্য খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, আজই হয়তো রাইখ চ্যান্সেলরিতে ঢুকে পড়বে, তবে জীবিত অবস্থায় শত্রুর হাতে ধরা পড়ার কোন ইচ্ছে নেই লোকটার।
ছোট রেকর্ডারটার দিকে তাকালাম, সবাই এখন আমার চেহারা দেখতে পাচ্ছে, এবার রেকর্ডারটা ঘুরিয়ে দিলাম জনাব হিটলারের দিকে।
আমিঃ হের ফুয়েরার! পরাজয় সন্নিকটে, আপনার অনুভূতি কী?
আমি জানি দর্শকদের মাঝে প্রশ্নটা শুনে হাসির রোল পড়ে গেছে, তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, এই প্রশ্নটা আপনা-আপনি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, মুদ্রাদোষ বলা যায়।
হিটলারঃ সব ইহুদীদের মেরে যেতে পারলাম না, এটাই আফসোস।
আমিঃ ইতিহাসে কিন্তু আপনি কুখ্যাত একজন মানুষ, নিজের এই পরিচয় আমার কেমন লাগে!
হিটলারঃ কে কী ভাবল তাতে কি যায় আসে! এই যুদ্ধটা জিতে গেলেই পৃথিবী বদলে দিতাম, কেউ বুঝল না।
আমিঃ আপনি কী ওদের হাতে ধরা দেবেন?
হিটলারঃ প্রশ্নই উঠে না। আমার এস্কেপ প্ল্যান তৈরি।
আমিঃ কিন্তু আমরা তো জানি, আপনি সুইসাইড করেছিলেন।
হিটলারঃ ওটাই তো এস্কেপ প্ল্যান।
আমিঃ ঠিক কোন কারনে আপনার পরাজয় হলো বলে আপনার ধারনা।
হিটলারঃ কয়েকটা গাধাকে বিশ্বাস করেছিলাম, মাশুল দিতে হচ্ছে এখন।
সময় শেষ হয়ে আসছিল, আরো অনেক অনেক প্রশ্ন করা বাকি। কিন্তু হিটলার সাহেব খুব বেশি সময় নিচ্ছেন একেকটা প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য।
আমিঃ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য আপনার বার্তা কী?
হিটলারঃ ইহুদীদের বিশ্বাস করো না।
আমিঃ আপনার জন্য একটা দুসংবাদ আছে।
হিটলারঃ জানি, ইহুদীরা সব দখল করে নিয়েছে, তাই তো?
আমিঃ জার্মানি বলে কোন দেশই নেই এখন।
লোকটা মৃত্যুপথযাত্রী, তবু ষাড়ের মতো তেড়ে এলেন আমার দিকে। পাত্তা দিলাম না, আমার গায়ে নখের আঁচড়টি পযন্ত বসাতে পারবেন না এই বদ্ধ উন্মাদ মানুষটি।
রেকর্ডারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম, দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলে কোমরে থাকা পোর্টেবল টাইম ডিভাইসে চাপ দিলাম। এবার নিজ সময়ে ফেরার পালা।


২৫৮৭ সাল।
মহামতি আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ড হচ্ছেন আমাদের সময়ের সেরা বিজ্ঞানী, টাইমমেশিনের উদ্ভাবন তার হাত ধরেই। বিংশ শতাব্দীর আইনস্টাইনের সাথে উনার চেহারা বা আকৃতিতে তেমন কোন তফাত নেই, দেখতে দুজন একইরকম, পুরানো আইনস্টাইন থেকেই ক্লোন করা হয়েছে তাকে, তবে বর্তমান আইনস্টাইন আরো মারাত্মক সব সূত্র আবিষ্কার করে তার পূবসুরীকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমার দিকে ঝুঁকে আছেন এই মুহূর্তে, তার হাতে ছোট লেসার কিট, যা দিয়ে আমার পুরো শরীর স্ক্যান করে নিচ্ছেন। প্রতিবার এই কাজটা করতে হয়, ল্যাবের সাধারন এসিস্ট্যান্টরা যে কাজটা করতে পারে, সে কাজ তিনি নিজ হাতে করেন। যাই হোক, আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম, প্রায় মিনিট দশেকের কাজ। বিরক্তিকর।

ল্যাবের বাইরে এই মুহূর্তে আমার জন্য অপেক্ষা করছে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে প্রায় একশ জন সাংবাদিক। স্ক্যান শেষ হলেই ওদের মুখোমুখি হতে হবে এবং এই ব্যাপারটা আমি উপভোগ করি। পুরো পৃথিবী থেকে পাচ-হাজার প্রতিযোগীর মাঝ থেকে আমাকে জিতে আসতে হয়েছে এই কাজটা করার জন্য, কাজেই মিডিয়া কাভারেজ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

মহামতি আইনস্টাইন আজকে আরো বেশি সময় নিয়ে দেখলেন আমাকে এবং এই প্রথমবারের মতো কোয়ারেন্টাইন রুমে যাওয়ার আদেশ এলো। সাধারনত অতীত থেকে ফেরার সময় কোন কিছুই আমার সাথে আসে না, কিন্তু এবার এসেছে। মিসেস হিটলারের হাতে থাকা সায়ানাইড পিল, ওটা কোন ফাঁকে আমার হাতে চলে এসেছে কে জানে আর এই পিল ছাড়া ঐ ভদ্রমহিলা কিভাবে কী করবেন জানি না। অন্তত ইতিহাসের পাতায় তিনি যে সায়ানাইডের পিল খেয়ে মারা গিয়েছিলেন তা’তো পরিষ্কার লেখা আছে।

কোয়ারেন্টাইন রুমে যেতে হয় নগ্ন হয়ে, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই, শুধু এই রুমের তত্ত্বাবধান করে যে মেয়েটা তার মিচকি হাসিতে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। শরীর শুদ্ধিকরন প্রক্রিয়াটায় খুব জটিল কিছু নেই, গত শতকের আবিষ্কার, শরীরের যে অংশে জীবানু বা ক্ষতিকর কিছু ধরা পড়বে সে অংশটা কেটে তা প্রতিস্থাপন করা হবে। কিডনি, হৃদপিন্ড, হাত-পা, যাই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন তা প্রতিস্থাপন করতে শুদ্ধিকরন যন্ত্রের মিনিট দশেকের বেশি সময় লাগে না। আমি শুধু চাচ্ছিলাম, কোন কিছু প্রতিস্থাপন করার ঝামেলা পোহাতে না হয় যেন। অনেক সময় দেখা যায়, কারো পায়ে সমস্যা, পা পালটানো হলো, কিন্তু নতুন পা’টা হয়তো একটু বড় বা ছোট, তাতে পুরো দেহের আকৃতিই বদলে যায়, কিন্তু অভিযোগ করার উপায় নেই, কারন স্টকে থাকলে সবচেয়ে ভালো জিনিসটাই দেয়া হয়। যাই হোক, রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়েটা আমার দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিল, আমি মারুফ রহমান, যে সে লোক নই, একজন সেলিব্রেটি, তাকাতেই পারে, আমিও হাসলাম, চোখ টিপে দিলাম। তাতে কিছুটা হলেও মেয়েটার বেহায়াপনা কমল।

শুদ্ধিকরন যন্ত্রটা একটা খোপের মতো, স্বচ্ছ কাঁচে তৈরি, আমাকে একটা বৃত্তের উপর দাড়াতে ইশারা করল মেয়েটা, আমি দাঁড়ালাম, ছাদ থেকে স্বচ্ছ কাচের গোলাকার জিনিসটা এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে নিলো, পেঁজা তুলোর মতো একধরনের বুদ্বুদ ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল না তবে চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না। ঘুম আসছে, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম কিছুক্ষনের মধ্যে। চমৎকার কিছু স্বপ্ন দেখলাম, বুঝতে পারছিলাম, আমার শরীরের উপর দিয়ে কিছু একটা হচ্ছে, তবে মহামতি আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ডের বুদ্ধির তারিফ না করে উপায় নেই, স্বপ্নগুলো তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছে করে, যাতে সময়টা ভালো কাটে।

স্বপ্ন শেষ হলে চোখ খুলে দেখলাম আমি মেঝেতে শুয়ে আছি, কুন্ডলি পাকিয়ে, মেয়েটা সাদা একটা চাদরে ঢেকে দিল আমাকে, ওর মুখের হাসিটা ভালো লাগল দেখে, যেন বলতে চাইছে কিছু হয় নি। কিছু হয়েছে কী হয় নি সেটা একটু পরে বুঝতে পারবো। উঠে দাড়াতে গিয়ে পড়ে গেলাম। মেয়েটা আমাকে হাঁটিয়ে বাইরে নিয়ে এসে পোশাক পরিয়ে দিল।

মাথাটা ঝরঝরে লাগছে, চোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার, শরীরটায় কেমন আলাদা বল পাচ্ছি।

মহামতি আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, এই দৃশ্যটা বিরল একটা দৃশ্য, এগিয়ে গেলাম।
“মারুফ, তুমি আসলেই একটা জিনিস,” বললেন তিনি, এ ধরনের ভাষাও তার মুখ থেকে কখনো শুনি নি।
“কীরকম? বুঝলাম না,” অস্বস্তি নিয়ে বললাম আমি।
“পরের মিশনের জন্য তোমাকে তৈরি করা হবে, তার আগে দেখলাম তোমার শরীরে কোন ঝামেলা আছে কি না।”
“তো?”
“কোন ঝামেলা নেই, এরকম পার্ফেক্টলি অলরাইট মানবদেহ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, তোমাকে তো জিনিস বলতেই হয়,” বলে আমার কাধে রীতিমতো চাপড় দিলেন তিনি।
মুখ বাঁকিয়ে হাসলাম, স্বস্তি লাগছিল যে কোন কিছু বদলাতে হয় নি। এরপরের মিশনটা যে খুব চ্যালেঞ্জিং হবে আগেই জানতাম, তবে কার সাথে দেখা হবে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে কিছু জানি না এখনো।



১৯৬৩/১১/২১ রাত একটা কুড়ি, টেক্সাস হোটেল, টেক্সাস
তিনি ক্লান্ত। সকাল থেকে একের পর এক জায়গায় যাওয়া, লোকজনের সাথে কথা বলা, বক্তৃতা দেয়া এসব তার কাজের মধ্যে পড়ে। স্মরনকালের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট তিনি, সাথে আছে তার স্ত্রী, রীতিমতো ফ্যাশন আইকন জ্যাকুলিন।
টেক্সাস হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে আছেন, জ্যাকি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, আগামীকালের মিটিং আর অন্যান্য এজেন্ডা নিয়ে ডেপুটি জনসনের সাথে একটু আগে কথাবার্তা শেষ হয়েছে, এবার ঘুমানো যেতে পারে। বেডরুমে হাল্কা সুরে তার প্রিয় বন্ধুর রেকর্ডিং চলছে, ঠিক এই সময়ে অদ্ভুত একটা কিছু চোখে পড়ল।
একজন অপরিচিত ব্যক্তি, মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, পোশাক-আশাকের ধরন অপরিচিত, লোকটা এশিয়ান, সম্ভবত ভারতীয়, স্বাস্থ্য ভালো, উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয়ের বেশি হবে না। সিকিউরিটির এতো কড়াকড়ির মধ্যে এই লোকটা বেডরুমে ঢুকে গেল কেন ভেবে পাচ্ছেন না। তবে লোকটার চেহারা কিংবা হাসি দেখে ভয় পাওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না।
“কে আপনি? কী চান?” তিনি বললেন।
“আমি মারুফ রহমান, আপনার সাক্ষাৎকার প্রার্থী।”
“প্রটোকল ভেঙে কিভাবে এখানে এলেন?”
“আমি এসেছি ২৫৮৯ সাল থেকে, মিঃ কেনেডি। ভয়ের কিছু নেই, আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েই চলে যাবো।”
হাসলেন তিনি। ২৫৮৯! বললেই হলো। বেডরুমের একপাশে ছোট একটা আলার্ম সুইচ আছে, সেখানে কোনমতে চাপ দিতে পারলেই হবে, এই পাগলটাকে নিয়ে যাবে ওরা।
“আমাদের সময়ের কোটি কোটি মানুষ আপনার এই সাক্ষাৎকার লাইভ দেখছে,” মারুফ রহমান বলল, “আপনি তাদের উদ্দেশ্যে ‘হাই’ বলতে পারেন।”
তিনি ‘হাই’ বললেন, মারুফের হাতে ছোট একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছেন, জিনিসটা ক্যামেরা না, তার অনেক অনেক অনেক আধুনিক সংস্করন। মারুফ এগিয়ে এলো তার দিকে, হাত বাড়াল। হাত মেলালেন তিনি, বুঝতে পারছেন বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন, কারন হাত মেলানোর সাথে সাথে শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন, মনে হচ্ছে শরীরে একধরনের বিদ্যুতিক তরঙ্গ বয়ে গেছে।
মুখোমুখি বসলেন তিনি, মুখে সবসময়ের সেই মনভুলানো হাসি। আমেরিকার জনগন এই হাসি ভালোবাসে, ভবিষ্যত পৃথিবীর মানুষও নিশ্চয়ই ভালোবাসবে।
“মিঃ কেনেডি, আপনাকে একটা তথ্য দিতে চাই,” বলল মারুফ রহমান, “আগামীকাল দুপুর বারোটায় আপনি মারা যাবেন, খুব কাছ থেকে গুলি করা হবে।”
“আচ্ছা,” হাসিমুখে শুনলেন তিনি, “এই চমৎকার তথ্য দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”
“খুব জটিল কোন প্রশ্ন করে আপনাকে বিব্রত করতে চাই না, শুধু একটা কথা বলবেন...”
“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করুন,” বললেন তিনি।
“প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার সফলতা কোনটি?”
“ভবিষ্যতের মানুষ হলে ইতিহাস আপনি জানেন, সফলতা-ব্যথর্তা সবই আপনাদের জানা,” হাসি মুখে বললেন।
“তা জানি, তবে আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
“আমি একটা মুক্ত, স্বাধীন, স্বাস্থ্যকর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্নের পথে সবার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ...”
“মিঃ কেনেডি, আপনি রাজনীতিবিদ হিসেবে কথা না বলে একজন সাধারন মানুষ হিসেবে আপনার সফলতাগুলো বলুন।”
“কোন সফলতা নেই, সফল হওয়ার কোন পথও নেই কারন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় যার কোনটাই ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দ নয়, যেমনঃ কিউবাতে আক্রমন, ইজরায়েলকে সমর্থন।”
“আপনার আমলেই ইজরায়েল বেশি ফুলে ফেঁপে উঠেছে।”
“ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করবে একসময়,” বললেন তিনি, “কিন্তু আমার কিছু করার নেই। এখানে ইহুদী লবিষ্ট গ্রুপ খুব শক্তিশালী।”
“আপনার স্ত্রী?”
“ঘুমাচ্ছে। আমি কিভাবে মারা যাবো?”
“খুব কাছ থেকে গুলি করা হবে, এরবেশি কিছু বলা সম্ভব নয়,” মারুফ বলল।
“আমার স্ত্রী’র কিছু হবে না তো?”
“না, উনি সুস্থ থাকবেন।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। মারুফ নামের লোকটার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ব্যবস্থা নিতে হবে। খুব কাছ থেকে গুলি ছোঁড়ার মতো অবস্থায় যাওয়ার আগেই, সিকিউরিটিকে জানিয়ে রাখতে হবে।
“মিঃ কেনেডি, আপনাকে একটা কথা বলা হয় নি,” মারুফ বলল।
“কি?”
“আপনার সাথে আমার কথোপকথনের অংশটা আপনার স্মৃতিশক্তি থেকে মুছে যাবে, আমি চলে যাওয়ার সাথে সাথে, কাজেই প্রান বাঁচানোর প্ল্যান করে লাভ নেই।”
এই প্রথম রেগে গেলেন তিনি। দৌড়ে গিয়ে বেডরুমের একপাশের আলার্মে চাপ দিলেন। এই পাগলটাকে ধরা দরকার, সত্যি বলছে না মিথ্যে বলছে তা ইন্টিলিজেন্স ইউনিট একসেকেন্ডেই বের করে ফেলতে পারবে। তবে তাতে কাজ হলো না।
নিজেকে আবিষ্কার করলেন বেডরুমে, দাঁড়িয়ে আছেন স্থির হয়েছে, একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে চিরতরে, হাল্কা সুর ভাসছে চারদিকে, জ্যাকির ঘুমন্ত চেহারাটা দেখে ভালো লাগল খুব। আগামীকাল আরেকটা ব্যস্ত দিন আসছে।

২৫৮৯ সাল।
নিজের সময়ে ফিরে স্বস্তি লাগছে, আলার্মে চাপ দেয়ার সেকেন্ডের একশোভাগের একভাগ সময়ের মধ্যে ফিরতে হয়েছে, তা না হলে টাইমলাইনে গন্ডগোল হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল, তবে মিঃ কেনেডি’র হঠাৎ এই আচরনে একটা কাজ হয়েছে, আমাদের সময়ের দর্শকদের মাঝে এযাবতকালের সবচেয়ে বিনোদনমূলক পর্ব হিসেবে আজকের পর্বটা সবচেয়ে বেশি শেয়ার হয়েছে। বুঝতে পারছি, আরো বেশি পারিশ্রমিক দাবি করা উচিত আমার।
এবারও মহামতি আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ড আমাকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখলেন, নিকোলাই টেসলা দ্য থার্ড আমার দিকে তাকালেন বাঁকা চোখে, বুঝতে পারছি, মিঃ কেনেডি’র হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে আলার্ম চেপে দেয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আরো বেশি সাবধান হওয়া দরকার ছিল। অথচ গত দু’বছর এই ট্রাভেলের ব্যাপারে বিস্তর কাজ করেছি আমি, রীতিমতো গবেষনা করা যাকে বলে, মিঃ কেনেডি ইউএস আর্মিতে ছিলেন, কিন্তু প্রত্যুৎপন্নমতি হিসেবে তার তেমন সুখ্যাতি ছিল না। তার এমন রিফ্লেক্স আশা করি নি। যাই হোক, আরো সাবধান হতে আমাকে।
টাইমলাইনে যাতে কোন পরিবর্তন না হয় এজন্য ইন্টারভিউয়ের অংশটা আমরা ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি থেকে মুছে দেই, এটা আপনাদের আগেই বলেছি, তবে এখানে আরেকটা কথা আপনাদের বলা হয় নি, এই মুছে দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হয় মিঃ টমাস আলডা এডিসন দ্য ফিফথের তৈরি করা মেমোরি ল্যাপস সল্যুশন, যা ছোট একটা সিরিঞ্জে বহন করি আমি, হাতের তালুর মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়, হ্যান্ডশেক করার সাথে সাথে জিনিসটা পুশ করি।
এবার আর কোয়ারেন্টাইন রুমে যেতে হলো না। দুই মাসের ছুটি দেয়া হলো আমাকে। এই দুই মাসে আমি পৃথিবী ঘুরে দেখতে পারি, তবে সেসবের কোন প্রয়োজন অনুভব করলাম না। আগামী দুই মাস বাসায় বসে থাকবো, নতুন নতুন অনেক লেখকের লেখা বের হচ্ছে সেগুলো পড়বো, টিভি সিরিয়াল আর মুভি দেখবো। এরচেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।


তবে সেভাবে সময় নষ্ট করলাম না, বেশ কিছু টাকা জমেছে হাতে, সেগুলো সদ্বব্যবহার করলাম বলা যায়। নিজের ভবিষ্যত তো নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে, এখনকার জনপ্রিয়তা সবসময় থাকবে না, কাজেই এমন কিছু করে রাখা দরকার যাতে বাজে কিছু হয়ে যাওয়ার আগে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারি।
পরপর কয়েকবছর একটানা ইন্টারভিউ নিলাম, মাও সে তুং এর জন্য শিখতে হলো চাইনীজ ভাষা, গ্যালিলিও গ্যালিলি, কলম্বাসের সাথে কথা বলার জন্য শিখলাম ইটালিয়ার আর স্প্যানিশ ভাষা, নিউটনকে ইন্টারভিউ করাটা কঠিন ছিল, যদিও ইংরেজি জানতাম, কিন্তু সেসময়ের ইংরেজি বোঝা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছিল আমার জন্য, দর্শকদের কাছে সেজন্য ক্ষমাও চাইতে হয়েছে আমাকে।
একের এক সফল ইন্টারভিউ আমাকে রীতিমতো মিডিয়া আইকন বানিয়ে ফেলল, কয়েক বিলিয়ন ইউনিট জমা পড়ল আমার ইউনিভার্সেল অ্যাকাউন্টে। আমার জন্য আলাদা সেক্রেটারি রাখতে হলো, বডিগার্ড চারপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল।
তারপর একরাতে বদলে গেল সবকিছু।

২৫৯৪ সালের ৭ই মে, রাত বারোটার উপর বাজে, পয়ত্রিশতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা আসছিল, একের পর এক, স্রোতের মতো। বিভিন্ন দেশের রাস্ট্রপতি থেকে শুরু করে সাধারন জনগন, সাইন্টেফিক সোসাইটির বিজ্ঞানী থেকে অনলাইন গেমসের তারকারা শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, সবাইকে উত্তর দিচ্ছি, ভালো লাগছে। তবে সমস্যা একটাই, এই বয়সেও আমি একা। বাসায় বার্থডে কেক কেটেছি একটু আগে, একা একাই, সেটা লাইভ সম্প্রচার করেছে বেশ কয়েকটি মিডিয়া এবং সেজন্যও যথেষ্ট পরিমান ইউনিট জমা হয়েছে আমার ইউনিভার্সেল অ্যাকাউন্টে। তবে, সবকিছুর পরও যথেষ্ট একা অনুভব করছি। এই ইন্টারভিউ ইন্টারভিউ খেলা এখন বিরক্তিকর ঠেকছে আমার কাছে, তবে সাইন্টেফিক সোসাইটির চিন্তাভাবনা অন্যরকম, শুরুতে তারা প্রথাগত ইন্টারভিউয়ের দিকে ঝুঁকে ছিল, এখন নতুন নতুন কিছু জিনিস যোগ করতে চাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাকে সরাসরি কিছু জানানো হয় নি, তবে তাদের ভেতরে কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাথে খুব দহরম মহরম আমার, কাজেই তথ্য পেতে খুব একটা সমস্যা হয় নি। কিছু কিছু ব্যক্তির টাইমলাইনে তারা খানিক রদবদল করার চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন, এক্ষেত্রে দারুন ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন তারা, কারন, হিটলার কিংবা নেতাজি সুভাষ বসুর মৃত্যুকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা মানে পুরো মানবসভ্যতার ইতিহাস বদলে দেয়ার সামিল, তাতে আজকে যে আমরা ভালো আছি, যুদ্ধ-বিগ্রহহীন শান্তিময় জীবন যাপন করছি তা একদম বদলে যেতে পারে।

সবার সাথে কথা বলা শেষ করে বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহারথি ডঃ হেইনরিখ শুলজের সাথে কথা বললাম। তিনি আমার কাছ থেকে তিন লক্ষ ইউনিট নিয়েছেন, তিন লক্ষ ইউনিট একজন মানুষ সারাজীবন পরিশ্রম করেও রোজগার করতে পারে না, আমি সেই তিন লক্ষ ইউনিট তাকে দিয়ে দিয়েছি, বদলে খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা কাজ তিনি করে দিয়েছেন, ছোট একটা ডিভাইস বানিয়ে দিয়েছেন, সেটা কাজে লাগবে কি না জানি না, তবে সাবধানতার মার নেই, প্রাচীন এই তত্ত্বটা আমি ভুলি নি।

টমাস আলভা এডিসন দ্য ফিফথের ফোন এলো আরেকটু পর, আমি ঘুমানোর প্ল্যান করছিলাম পড়েছিলাম, ভদ্রলোককে এক লক্ষ ইউনিট দেয়ার কথা, উনার কাছ থেকে ডেলিভারি পেয়ে গেছি আগেই, তাই ফোনটা রেখেই ইউনিট ট্রান্সফার করে দিলাম।

এবার ঘুমানোর পালা, তবে জন্মদিনের রাত। আরেকটু রাত জাগতে কেউ আমাকে বারন করছে না, আমি ডাটাবেজ নিয়ে বসলাম। আমার একজন সঙ্গী দরকার, প্রাচীনকাল, বর্তমান সব ঘুরে দেখছি আমার কম্পুনেটে, দেখতে দেখতে একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। প্রায় ছয়শ বছর আগের কিছু ছবি, ভিডিও দেখে মনে হলো, ঠিক আমাকেই যেন দেখছি আমি, লোকটার স্বাস্থ্য আমার মতো, হাসিটাও, এমনকি কথাবার্তাও বলে খুব কম, যেন কষ্ট হয় কথা বলতে। একদম অমিশুক একজন মানুষ, তবে তার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে কথা শোনার চমৎকার একজন সঙ্গী আছে তার, দেখতেও সুন্দরী। স্বীকার করতেই হচ্ছে, আমার চেয়ে লক্ষগুন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে লোকটা।

ডঃ শুলজের ডিভাইসটা হাতে নিলাম। ব্যাপারটা একদম অনুচিত, অমানবিক একটা কাজ। নিজের প্রতি করুনা হতে থাকল আমার। রেখে দিলাম যেখানে ছিল।
এক গ্লাস পানি নিয়ে বেডরুমে ঢুকলাম, চমকে গেলাম সাথে সাথে।


“হাই,” বলল ছেলেটা, চকচকে একটা ছেলে, ফর্সা, সুদর্শন, বেডরুমের বিছানার পাশে আমার পড়ার চেয়ারটেবিল, সেখানে একটা চেয়ার দখল করে বসে আছে। এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মেলাল।
বৈদ্যুতিক একটা তরঙ্গ খেলে গেল শরীরে।
“স্যার, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,” ছেলেটা বলল।
“তোমার নাম কি?”
“রিচার্ড হেফনার,” ছেলেটা বলল।
“তো, মিঃ রিচার্ড, তুমি কি বলবে আমি ঠিক কিভাবে মারা যাবো?”
“স্যার,” হাসল ছেলেটা, “আপনি মারা যাবেন বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে, আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে।”
“গুড, সত্যি কথাটা জেনে ভালো লাগল। এখন তোমার প্রশ্ন করো,” বললাম আমি, যথেষ্ট রিলাক্সড বোধ করছি। যদিও এইসব মুহূর্তে অন্য অনেকেই ভয় পায়, নিউটন সাহেব তো রীতিমতো কাকুতিমিনতি শুরু করেছিলেন। তবে আমি ভয় পাচ্ছি না, লক্ষ লক্ষ দর্শকরা এখন আমাকে দেখছে, লাইভ, একসময় তাদের কাছে আমি আইডল ছিলাম, এখন ভয় পেলে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবো।
“আপনি কোন জীবনসঙ্গী বেছে নেন নি কেন?” রিচার্ড হেফনার জিজ্ঞেস করল, “এই প্রশ্নটা আমার নয়, আপনার লক্ষ লক্ষ ভক্তের।”
“সময়ই তো পেলাম না, সঙ্গী খোঁজার, এছাড়া উপযুক্ত সঙ্গী পাওয়াও খুব মুশকিল,” বলে হাসলাম আমি, “আপনারা কেউ কিছু মনে করবেন না আবার,” জানি অনেক মেয়ে ফ্যান আছে আমার, তারা আবার মন খারাপ করতে পারে।
“আরেকটা প্রশ্ন, আপনি ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসেন, ঠিক কোন সময়টাকে আপনি বেশি উপভোগ করেছেন?”
“ইন্টারনেট আবিষ্কার হওয়ার আগ পযন্ত মানুষের জীবনটাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, সেটা সম্ভবত ১৯৮০ সালের কথা হবে।”
“আপনি তো জানেন, আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যে আপনি মারা যাবেন, এ নিয়ে আপনার অনুভূতি কি?”
হাসলাম আমি, রিচার্ডের হাতে থাকা ডিভাইসটার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ালাম, আমার বেডরুমটায় ছোটখাট একটা সিগন্যাল লকার আছে, চেয়ারে থাকা ছোট বোতামে চাপ দিয়ে লকারটা অন করে দিলাম, এখন আর দর্শকরা আমাদের লাইভ শো দেখতে পারবে না, যদিও রিচার্ড টের পাবে না সেটা, কারন সব ধরনের সিগন্যালের এখন এই রুমে প্রবেশ নিষেধ।
“রিচার্ড, আমি যাচ্ছি, তোমার সাথে কথা বলার সময় নেই আমার,” বলে উঠে দাঁড়ালাম, রিচার্ডকে অসহায় দেখাচ্ছিল।
“কিন্তু আপনি সেটা করতে পারেন না, টাইমলাইন বদলে দেবার কোন সুযোগ আপনার নেই।”
উঠে এলো রিচার্ড, আমার দিকে, ভেবেছে আমাকে ধরে ফেলবে, কিন্তু তার আগেই আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলাম। বাকি কাজ করতে একটু কষ্ট হলেও এছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। রিচার্ড চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করল আমার চেয়ারে বসা অবস্থায়, লেসার রে ওর চারপাশ ঘিরে রেখেছে, একটু নড়লেই মরবে।
“রিচার্ড,” বললাম আমি, “জানতাম, এমন দিন আসবে, যেদিন আমার ইন্টারভিউ নিতে আসবে কেউ। তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল। আর এক ঘন্টা পর বৈদ্যুতিক শটসার্কিটে পুরো বাড়ি স্রেফ ছাই হয়ে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না চেয়ারে মরে থাকা লোকটা কে? তুমি না আমি? সেটা বের করতে করতে আমি অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো।”
“কিন্তু আপনি টাইমলাইনে কোন পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখেন না, আমি নিজের হাতে আপনার হাতে মেমোরি ল্যাপস সল্যশুন পুশ করেছি,” রিচার্ড বলল।
“আমি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম, বেটা,” হেসে ওর মাথার সোনালী চুলগুলো এলোমেলো করে দিলাম, “মিঃ এডিসন দ্য ফিফথ আমাকে এর প্রতিষেধক তৈরি করে দিয়েছেন, কাজেই তোমার ঐ সল্যুশনের কোন ক্রিয়া হয় নি আমার উপর।”
“ওহ! কি জঘন্য! লোকটা টাকার জন্য সবকিছু করতে পারে,” রিচার্ড বলল মুখ বাঁকিয়ে।
“হু, ইউনিট খরচ করলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়, কথাটা একেবারে ফেলনা নয়,” বললাম আমি, তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
রিচার্ডের হাত থেকে ওর ট্রাভেল ডিভাইসটা কেড়ে নিয়েছি, আমার কম্পুনেটটা সেলফ ডিস্টাক্ট মোডে আছে, কোন সময়ে যাচ্ছি সেটা বের করতে পারলেও আমাক খুঁজে পাবে না আইনস্টাইন দ্য সেকেন্ড আর উনার সাঙ্গপাঙ্গরা।
“কিন্তু তোমাকে খুঁজে বের করবে সোসাইটির বিজ্ঞানীরা, তারপর...” রিচার্ড হাসল, “তোমার কী যে করবে সেটা চিন্তাও করতে পারবে না।”
“সোসাইটির নিয়ম ভাঙলে উনবিংশ স্তবকের খ ধারা অনুযায়ী আমার শাস্তি হবে মৃত্যুহীন প্রান। আমার শরীরকে বাঁচিয়ে রাখা হবে বছরের পর পর, শুধু শাস্তি দেয়ার জন্য, তাই তো?”
“হ্যা, তাই,” চিৎকার করে বলল রিচার্ড, তাকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই।
“তুমি ভেবো না, সে ব্যবস্থাও করা আছে,” ডঃ শুলজের ডিভাইসটা দেখালাম রিচার্ডকে, “এটা কি জানো?”
“জানি না, জানার প্রয়োজনও বোধ করছি না।”
“এটা দিয়ে আমার ডিএনএ রি-অর্ডার করা হবে, ঠিক যেমন হতে চাই, তেমনটা হয়ে যাবো দশ মিনিটের মধ্যে। তুমি দেখবে এর কেরামতি?”
“সব বিজ্ঞানীগুলো দেখছি বেঈমান!”
অনেকক্ষন সময় পার হয়ে গেছে, দর্শকদের সাথে রিচার্ডের অনলাইন স্ট্রিমিং বন্ধ, এমনকি রিচার্ডের সাথে সোসাইটির বিজ্ঞানীরা যোগাযোগও করতে পারছে না, কাজেই যে কোন সময় পুলিশ ফোর্স চলে আসবে। রুমের সিগন্যাল চালু করে দেয়ার আগে, ডঃ শুলজের ডিভাইসটার ছোট সবুজ বোতামে চাপ দিলাম।
নিজের মধ্যে পরিবর্তনটা টের পাচ্ছি।
আমি বদলে যাচ্ছি, কম্পুনেটে দেখা সেই লোকটার আদলে তৈরি হচ্ছে আমার মুখমন্ডল, আমার শারীরিক গঠন, এগুলো কাছাকাছি থাকায় পাচ মিনিটের কম সময়ে নতুন একজন মানুষ হিসেবে রিচার্ডের সামনে আবিভূত হলাম।
রিচার্ড বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, বিশ্বাস করতে পারছে না একটু আগে যা দেখেছে।
“ডঃ শুলজকে তিন লক্ষ ইউনিট দিয়েছি! তো, কেরামতি কেমন দেখলে?”
উত্তর দিলো না রিচার্ড। বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিটের আলামত শুরু হয়ে গেছে, বেডরুম, বারান্দার বাতি জ্বলছে, নিভছে, যেকোন সময় আগুন লেগে যেতে পারে।
চারদিকে শেষবারের মতো তাকালাম। বিদায় ২৫৯৪। রিচার্ডের ট্রাভেল ডিভাইসে সাল, তারিখ সব ঠিক করে রেখেছিলাম, এবার চেপে দিলাম। মূহূর্তেই পায়ের নীচে মেঝে কেপে উঠলো, রিচার্ডের আর্তচিৎকারে ভরে উঠলো চারদিক। তবে সেসব দেখার সময় নেই আমার।

২০১৪ সাল।
প্যাচপ্যাচে গরমে লেখক সাহেব বসুন্ধরা সিটি মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে সিগারেট, মুখ সবসময়ের মতো গম্ভীর। বয়স পয়ত্রিশের কাছাকাছি, স্বাস্থ্য বেশ ভালো, মোটাসোটাই বলা যায়, গতকয়েক বছরে একটা ট্রিলোজি লিখে একটু-আধটু নাম করেছেন। চমৎকার সঙ্গী পেয়েছেন, তবে সমস্যা একটাই, একবার শপিং মলে ঢুকলে বেরুনোর নাম নিতে চায় না। আগের লোকটাকে সরাতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি, একই চেহারার আরেকজনকে দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠেছিল লোকটা, সে সুযোগে একদম গায়েব করে দিয়েছেন ডিসাস্টার গান দিয়ে। একদম ধুলো হয়ে মিশে গেছে মাটির সাথে। মেয়েটাও কিছু টের পায় নি, কথা কম বলার এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় সুবিধা।
মারুফ রহমান নামটা ব্যবহার করেন না এখন আর। তবে এখনো কেউ কাউকে মারুফ বলে ডাকলে চমকে উঠেন, তার নতুন নামটাও খারাপ না, বইয়ের মলাটে বেশ ভালোই মানিয়ে যায়।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×