somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঠাঁই (গল্প) - ১ম পর্ব

১৬ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১.
মুহিব দরদর করে ঘামছে, যদিও ভয়ে তার শীতে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। বিপদে পড়ার দোয়াটা যেন কি? তাও এই ঘোর বিপদের সময় মনে পড়ছে না। সে তার হাত ধরে থাকা ইরেন এর দিকে তাকাচ্ছে, ইরেন এখন কান্না বন্ধ করেছে, তবে চোখমুখ কুঁচকে আছে, মাঝে মাঝে ফোঁপাচ্ছে। কানের কাছে এখনো রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে, এতোটা সময় তুলো গুঁজে রাখার পরেও রক্ত বের হওয়া কি বন্ধ হয় নাই? আজ বাসায় গেলে যে কি হবে তা ভাবতে গেলেই দম আটকে আসছে। মুহিবের মামা সগিরুদ্দৌলা অসম্ভব রাগী মানুষ, আর মুহিবকে দেখলে তার রাগের পারদ যেন আকাশ ছুঁয়ে যায়। মামাতো ভাই ইরেনকে তার সাথে চুল কাটতে সেলুনে পাঠাবার সময় সগিরুদ্দৌলা মুহিবকে বার বার বলে দিয়েছেন চুল কাটার সময়য় সাবধানে ইরেনের মাথা ধরে রাখতে। ইরেন চুল কাটার সময় মাথা বারবার দুদিকে ঘোরাতে থাকে। এর আগেও একবার নাপিতের কাঁচির খোঁচায় ঘাড়ের কাছে কেটে গিয়েছিলো, সেবার মামা নিজেই ইরেনকে সেলুনে নিয়ে এসেছিলো।

আজ বাসায় মেহমান আসবে, মুহিবের মামী’র বোন জারুল খালাকে দেখতে। মুহিবের মামী’রা দু’বোন, মামী বড়, নাম পারুল। জারুল খালার বারবার বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিন্তু কথাবার্তা কিছুদূর আগানোর পর থেমে যায়। পাত্রপক্ষ স্পষ্ট কোন জবাব দেয় না, কিন্তু বিয়ের কথাবার্তা আর আগায় না। এবার যে সম্পর্ক এসেছে, সেটা এনেছেন মুহিবার মামা সগিরুদ্দৌলা নিজেই এবং তিনি বুদ্ধি করেছেন বিয়ের সকল কথাবার্তা তার বাড়ী থেকেই হবে। বিয়ের কাবিন না হওয়া পর্যন্ত পারুলদের আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশী কাউকে কিছু জানানো হবে না। মুহিবের মামা আজকের মেহমানদারীর আয়োজনে ব্যস্ত থাকায় মুহিবকে দিয়েছেন ইরেনের চুল কাটিয়ে আনতে। মুহিব সারাক্ষণ ইরেনের মাথা ঠিক মতই ধরে ছিলো, নাপিতও খুব সাবধানেই চুল কাটছিল। কিন্তু হুট করে ইরেন হ্যাচকা টান দিয়ে মাথা নীচের দিকে নামিয়ে নেয় ঠিক তখন, যখন ইরেনের কানের কাছের চুল নাপিত তার ধারালো ক্ষুর দিয়ে চেঁছে নিচ্ছিলো।

“ইরেন, এখনো কি ব্যাথা করছে, জ্বলছে?”

“হুম, আমি বাবাকে বলে দিবো…”

“প্লিজ ইরেন, বাবাকে কিছু বলিস না। তোকে আমি আইসক্রিম কিনে দিবো কালকে বিকেলে।”

“আমার টনসিলের ব্যাথা আছে, বাবা আইসক্রিম খেতে নিষেধ করেছে। তুমি আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে চাচ্ছো, আমি এটাও বাবাকে বলে দিবো।

মুহিবের মন চাচ্ছে মামাতো ভাইকে একটা আছাড় দিয়ে রাস্তার পাশের ড্রেনে ফেলে দেয়, বজ্জাত ছেলে। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে, সেলুনের লোকটা তুলোয় আফটার শেভ লাগিয়ে অনেকটা সময় চেপে ধরেছিলো। ইরেনের তখন কি চিৎকার, কানে তালা লাগার জোগার। এখন সে একেবারে চুপ, তবে মুখ বেজার করে বাসার দিকে হাঁটছে। মুহিব জানে বাসায় গিয়েই সে আবার উচ্চস্বরে কান্না শুরু করে দিবে, মহা বদমাশ পিচ্চিটা।

২.
পারুল রান্নাঘরে ব্যস্ত, গ্যাসের দুই চুলোতেই রান্না চড়িয়েছে। এরমাঝে ইরেনের বাবা এসে বলে গেছে চা দিতে। চা চড়াতে গেলে তরকারী যে কোন একটা চুলা হতে নামাতে হবে, এমনটা করলে তরকারীর স্বাদ নষ্ট হয়। মন চাইছে না তরকারীর নামিয়ে চা চড়াতে। এই গরমের চা খাওয়ার দরকার কি? সে বুদ্ধি করে লেবুর শরবত বানালো। ফ্রিজে কাগজী লেবু ছিলো, বেশী করে লেবুর রস, একটু বিট লবন দিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করলো বরফের কিউব দিয়ে। একটু পুদিনাপাতা দিতে পারলে পারফেক্ট হতো, প্রতি রমজানে পারুলের এই শরবত ছাড়া সগিরুদ্দৌলা ইফতার করেন না, তার অতি প্রিয়।

পারুল মুহিবকে দিয়ে ড্রইং রুমে দুই গ্লাস শরবত পাঠিয়ে দিলো। ড্রইং রুমে সগিরুদ্দৌলা তার অফিসের এক কলিগের সাথে বসে আছে, এই ভদ্রলোকই বিয়ের প্রস্তাব এনেছেন জারুলের জন্য।

“শরবত কেন? শরবত কে চাইছে?”

“মামী দিছে...”

সগিরুদ্দৌলা রাগী চোখে তাকালো ভাগ্নের দিকে। এই হাঁদারাম’কে নিয়ে সে আছে যন্ত্রণায়। তার বড়বোন থাকে ফরিদপুরের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে, দুলাভাই প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, সেই স্কুলেরও বেতন হয় না ঠিকমত। মুহিব মেট্রিকে ভালো রেজাল্ট করায় তাকে ঢাকায় মামার কাছে পাঠিয়েছেন, মামার কাছে থেকে ঢাকায় ভালো কলেজে পড়বে। সগিরুদ্দৌলা তাতে আপত্তি করেন নাই। কিন্তু মুহিব ঢাকায় আসার পর থেকে গত সাত মাসে তার কার্যকলাপ দেখে সগিরুদ্দৌলা বুঝে গেছেন, রেজাল্ট ভালো করলেও ছেলেটা একটা গর্দভ ছাড়া কিছু না। কোন কাজ তাকে করতে দিলে সে একটা না একটা ভজঘট পাকাবেই।

“এই শরবত নিয়ে যা, তুই আর তোর মামী বসে বসে শরবত খা, গাধার বাচ্চা কোথাকার। দিতে বলছি চা, আর নিয়ে আসছে শরবত”।

রান্নাঘর থেকে পারুল স্বামীর গলার আওয়াজ পেয়ে ছুটে এলেন। ইশারায় মুহিবকে ড্রইং রুম থেকে চলে আসতে বললেন। মুহিব মামীর হাতে শরবতের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বারান্দার দিকে হাঁটা দিলো। এই বাড়িতে টানা বারান্দার একটা অংশে একটা সিঙ্গেল চারপায়া খাটিয়ে মুহিবের থাকার জায়গা হয়েছে। গ্রীলের অংশটা বাইরে থেকে টিন দিয়ে আটকে দেয়া, খাটের পাশে একটু জায়গা, সেখানে একটা ছোট পড়ার টেবিল। এইটুকু জগতে মুহিব নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। খাবার সময় হলে সে ডাইনিং টেবিলে খায় না, খাবার এইঘরে নিয়ে এসে পড়ার টেবিলে খেয়ে নেয়। কারণ, আর কিছুই না, সে তার মামা সগিরুদ্দৌলা’কে অসম্ভব ভয় পায়।

৩.
রাত কয়টা বাজে এখন, মুহিব আন্দাজ করলো দশটাতো হবেই। এখনো মেহমানেরা যায় নাই, খাওয়া দাওয়াও শুরু হয় নাই। মুহিবের খুব ক্ষুধা লেগেছে, দুপুরে ঠিকমত খাওয়া হয় নাই। সে যখন দুপুরে তার ঘরে বসে ভাত খাচ্ছিলো, তখনই মামার ডাকাডাকি’তে খাবার রেখে তাকে ছুটতে হয়েছে। মামার অফিসের পিয়নের সাথে তাকে পাঠিয়েছে মেহমানদের জন্য নাস্তা, মিষ্টি, দই এসব কিনে আনতে। ফিরে এসে আর খাবার কথা মনে ছিলো না। এখন খুব ক্ষুধা পেয়েছে। সন্ধ্যার আগে থেকে সে তার ঘর থেকে বের হচ্ছে না, মামা হয়তো সবার সামনেই তাকে “গাধার বাচ্চা” বলে গালি দিয়ে বসবে, লজ্জায় তার মাথা কাটা যাবে। ইরেন এর ব্যাপারটা নিয়ে এখনো মামা কোন কিছু বলে নাই, মামীও কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই। ইরেন হয়তো রাতে শোয়ার সময় ঠিকই বাবা-মা’কে বলবে আজকের ঘটনাটা। ঘটনা শোনার পর হয়তো মামা তার ঘরে এসে দেখবেন মুহিব ঘুমুচ্ছে। সেই অবস্থাতেই তাকে হয়ত লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিবেন। গত সাতমাসে মামার এসব ব্যবহারে সে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। ঢাকা শহরে মাথা গোঁজার জন্য ঠাই, তিনবেলা পেটে খাদ্যের জোগান, কলেজের বেতন এসবের বিনিময়ে মামার সব রকমের আচার আচরণ মেনে নিতে তার আপত্তি নেই। তার ভয়, তাকে বাসা থেকে বের করে না দিলেই হয়।

“মুহিব, তোর খাবারটা ধর, খেয়ে নে।” মুহিবের মামী পারুল মুহিবের বারান্দার ঘরে প্লেট হাতে ঢুকলেন।

“সন্ধ্যার নাস্তা কিছু খেয়েছিস? আমি তো এতো ব্যস্ত যে মনে হয় যে কোন সময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবো।”

মুহিব কিছু বললো না। মুহিবের মামী তাকে খুব স্নেহ করেন, মামা তাকে যখনই বকাঝকা করেন, মামী তাকে পরে সান্ত্বনা দিতে আসেন, “তোর মামার মাথা সারক্ষণই গরম, তুই মনে কষ্ট নিস না” বলে মুহিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে যান। মুহিবের তখন খুব কান্না পায়, মা-বাবা’র কথা মনে পড়ে যায়। সাত মাস হতে চললো তাদের সাথে দেখা হয় না, কথা হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় পড়ালেখা সব বাদ দিয়ে গ্রামে ফিরে যায়। পদ্মার পাড়ে তাদের ভাজনডাঙ্গা গ্রাম, ধানক্ষেতের আইল ধরে পদ্মার পাড়ে গিয়ে বসে থাকে।

কিন্তু তার স্কুল শিক্ষক বাবার সাধ ছেলে ঢাকায় থেকে ভালোমত পড়ালেখা করে বড় কোন চাকুরী করবে। বাবার মত প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষক হয়ে সারাটা জীবন যেন দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে বাঁচতে না হয়। বাবার সেই স্বপ্নের কথা চিন্তা করেই গত সাত মাস ধরে মামার এখানে টিকে আছে। মামার বাসার বাজার সদাই করা, ইরেনকে স্কুলে আনা নেয়া, বাসার ছোটখাটো নানান কাজ করা, সবকিছুই বিনা সংকোচে করে যাচ্ছে মুহিব। এমনকি মাঝে মাঝে মামা তাকে দিয়ে তার জুতা পলিশ করাতেও দ্বিধা করেন না। জুতা পলিশ করতে করতে মাঝে মাঝে মুহিব ভাবে পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাস্তায় বসে জুতা পলিশের কাজ করলেই হয়, টাকা কামাই করা হবে, সেই টাকায় কোন একটা মেসে উঠে যাবে, প্রাইভেটে পরীক্ষা দিবে। কিন্তু ভাবনাগুলো সব ভাবনা হয়েই রয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১:৩৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×