somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি বড় গল্প

২৫ শে মে, ২০১৯ রাত ৯:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হেসে খেলে- দ্বিতীয় পর্ব
মামুন খান

।১।
কাশেম আলীর কথা আপনাদের মনে আছে ? কাশেমকে নিয়ে সর্ব প্রথম লিখেছিলাম আজ থেকে এক যুগেরও বেশি সময় আগে ( যা মাস দুই আগে এই ব্লগে পোস্ট করা হয়েছিল)। মহাকালের আপেক্ষিকে এক যুগ সময় আসলে কিছুই না। কিন্তু আমার আপনার ছোট্ট এক জীবনের জন্য এক যুগ সময় অনেকটা সময়। এক এই এক যুগ সময়ে অনেক গুলো তুষার ঝড় বয়ে গেছে প্রিয় শহর টরন্টোর উপর দিয়ে। জন্ম হয়েছে কত শত নক্ষত্রের, ঝরে গেছে কত শত নক্ষত্র। বিশ্ব রাজনীতি আর অর্থনীতিতে ঘটে গেছে কত অস্বাভাবিক ঘটনা। ডোনাল্ড ট্রাম্প নামের এক বদ্ধ উম্মাদ হয়েছে বিশ্ব মোড়ল। ভয়ানক শক্তিধর এক অজগর আস্ট্রে পিস্ট্রে পেঁচিয়ে ধরেছে আমার প্রিয় জন্মভূমিকে- হা করে গিলে ফেলার অপেক্ষা মাত্র । ডিজিটাল ফোন, ই-মেইল, মোবাইল ফোনের যুগ পেছনে ফেলে মানুষ প্রবেশ করেছে আই(i)-যুগে। এখন আর মানুষে মানুষে কথা বিনিময় হয় না, বিনিময় হয় স্ট্যাটাস - টুইটারে, ইনস্টিগ্রামে, ফেইসবুকে। সবাই ব্যাস্ত ছবি পোস্টিং এ। শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, চিত হয়ে, কাইত হয়ে, বদনা হাতে, ছবি, ছবি আর ছবি। পাঠক, খুব শীগগিরই আসছে নোউজ বুক যার কাজ হবে শুধু নাকে নাকে দূর্গন্দধ ছড়ানো। সে যাই হোক, এবারে মূল গল্পে ফিরে আসি।
কাশেমের সাথে আমার বন্ধুত্ব শুরু অনেক অনেক গুলো বছর, মাস আর দিন আগে , গ্রামের বাড়িতে। কাশেম তখন তার পরিবারের সাথে গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে অভিবাসনের চিন্তা ভাবনা করত। সেই সুদূর শৈশবে খেলা ধুলার ফাঁকে সে প্রায়ই আমাকে বলত, ‘‘ খুব শীগগিরই এই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে চলে যাব। গ্রামে থাকা অনেক কষ্টের। শহরে অনেক আরাম। একবার আব্বু ঢাকায় বদলি হলে আমাদের আর কোন কষ্ট থাকবে না। হেসে খেলে দিন গুলি কাটবে।’’ হেসে খেলে জীবনটা কাটানোর মহান অভিপ্রায়ে কাশেমের অভিবাসী জীবনের সেই যে শুরু। কালের আবর্তে ঢাকা শহরের এ গলি ও গলি ঘুরে, যৌবনের প্রায় শুরুতে আমাদের অনেকের হূৎপিন্ডে তেজস্ক্রিয় রশ্মির সূচালো আঘাত হেনে কাশেম অভিবাসী হয়ে পারি জমালো সেই সুদূর মার্কিন মুল্লুকে- উদ্দেশ্য হেসে খেলে জীবনটা কাটিয়ে দেয়া। নির্ঘুম, অক্লান্ত কালের চাকার সাথে তাল মিলিয়ে কলের চাকার মত ঘুরতে ঘুরতে, আমেরিকার এ শহর ও শহর প্রদক্ষিন করে, চলার পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চোর কাটা আর চোরাবালির ফাঁদ সযতনে এড়িয়ে কাশেম আবার পারি জমালো শ্বেত ভল্লুকের দেশ কানাডায়, টরন্টোতে- হেসে খেলে জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার অকৃত্রিম সেই ব্রত সামনে রেখে।
সময় , কাল আর পথ পরিক্রমা ভিন্ন হলেও অভিবাসন সংস্কৃতির জোয়ারে ভেসে প্রায় অভিন্ন ব্রত নিয়ে হিমাংকের পচিশ ডিগ্রী নীচে ডিসম্বরের কোন এক তুষার শুভ্র সন্ধ্যায় দারা পুত্র পরিজন নিয়ে আমিও হাজির হলাম ইহ জগতের নাজাত, পরকালের মূক্তির সোপান, তীর্থ স্থান টরন্টো তে। নানাবিধ কারণে মাঝে কয়েক বছর কাশেমের সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও টরন্টো এসে আবার কাশেমের সাথে আমার দেখা আর সম্পর্ক পূনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। মাঝখানে সাময়িক বিরতি নেওয়া শৈশবের সেই বন্ধুত্ব আজ অবধি অটুট আছে। আমার সাথে হামেশাই কাশেমের দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে, পারিবারিক ভাবে আবার ব্যক্তি গত ভাবেও। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে কাশেমকে আপনাদের সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া আবশ্যক মনে করছি। কারণ কাশেমকে আপনারা অনেকেই হয়ত চেনেন না। একটু বর্ণনা দিলেই ওকে চিনতে পারবেন।
এর মধ্যে কি ভিক্টোরিয়া পার্ক, ড্যানফোর্থ এলাকায় বাংলাদেশী গ্রোসারীর সামনে কোন বাঙ্গালী ভাইকে দেখেছেন? যার হাতে পলিথিন ভর্তি কাঁচা বাজার, সাথে পশ্চিমা পোশাক পরা স্মার্ট মত এক যুবতি- হাতে আই ফোন, স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হেঁটে চলছে পার্কিং লটের দিকে। এই বাঙ্গালী ভাইটিই আমার বন্ধু কাশেম। Walmart বা অন্য কোন মলে প্রায়ই দেখে থাকবেন এক বাঙ্গালী যুবক Shopping Cart নিয়ে রাম ভক্ত হনুমানের মত স্ত্রীর পিছে পিছে হাঁটছে আর মনে মনে কী যেন হিসেব করছে। এই যুবকটিই আমার বন্ধু কাশেম। পাবলিক লাইব্রেরীর ‘স্টাডি এরিয়ায়’ হয়ত বা দেখেছেন কতিপয় মধ্য বয়ষ্ক বাঙ্গালী যুবক খুব মনযোগ দিয়ে আসন্ন Licensing Test এর প্রিপারেশন নিচ্ছে । এদের কারও মাথায় স্টেডিয়াম আকৃতির টাক, কারও মাথার চুল গুলো আধা পাকা, আধা কাঁচা, কারও চোখে পুরু লেন্সের চশমা। যৎসামান্য পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে আপনি হয়ত এদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছেন, “কী ভাই আজ কাল খুব কম দেখা যায়, খুব ব্যস্ত মনে হয়, খবর ভাল তো”?
উত্তরে সে হয়ত বলেছে, “না রে ভাই খবর খুব একটা ভাল না, পড়তে পড়তে লাইফ তামা হয়ে গেল। সামনের মাসে লাইসেন্সিং এর জন্য পরীক্ষা। দম ফেলার ফুরসৎ নাই”।
“লাস্ট ডিসেম্বরে না আপনি পরীক্ষা দিলেন”?
ঠোটের কোনে এক ফালি স্বলজ্জ হাসি দিয়ে সে বলছে, “দিয়েছিলাম, পাশ করি নাই। হে হে, বয়স হয়ে গেছে বুঝলেন না? মাথায় আজ কাল আর কিছু ঢোকে না”। এই শিক্ষিত যুবকটিই আমার বন্ধু কাশেম। গেল ডিসেম্বরে অথবা তারও আগের কোন এক Boxing Day’র কন কনে ঠান্ডা ভোরে Best Buy বা Future Shop এর সামনের এক বাঙ্গালী যুবককে নিশ্চয়ই দেখেছেন লম্বা লাইনের প্রায় অগ্র ভাগে অধির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে, কখন স্টোর খুলবে? সদ্য মার্কেটে আসা ৫২ ইঞ্চি Sony স্মার্ট টিভি কেনার এই তো মোক্ষম মওকা । তারও ঘন্টা খানেক পর দেখেছেন যুবকটি স্টোর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে,চেহারায় স্পষ্ট হতাশা।
“কি ভাই টিভি পেলেন না”?
যুবকটি কৃত্রিম একটা হাসি দিয়ে হতাশা ঢাকার মিথ্যা চেষ্টা করে হয়ত বলছে, “নাহ, শালার চানকু ( চাইনিজ) গুলি সব লুট পাট করে নিয়ে গেছে বুঝলেন না?
Home Depot অথবা Lowes স্টোরে প্রায়শই দেখে থাকবেন, এক বাঙ্গালী যুবককে। হাতে লম্বা লিস্ট, ট্রলি ঠেলে ঠেলে এ লাইন থেকে ও লাইনে ঘুরছে আর বাড়ি ঘরের দরকারি সরঞ্জাম তুলছে। আপনি হয়ত তাকে বলে থাকবেন, “ কি ভাই এবার উইন্টার কেমন যাচ্ছে”?
“ কী বলব? বরফ পরিষ্কার করতে করতে জান কয়লা রে ভাই। থাকেনতো এপার্টমেন্টে বুঝবেন না। আছেন সুখে- কানাডার বুকে”। পাঠক, এই যুবকটি আর কেউ না, আমার বাল্য বন্ধু কাশেম। এবারে তার টরন্টো জীবনের শুরুটা শোনা যাক।
।২।
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, ক্যানসাসের Wichita State ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর আন্ডার গ্র্যাড করার এক বছরের মধ্যেও যখন কাগজ এবং কাজ কোনটারই কোন কুল কিনারা হলো না তখন সে সিদ্ধান্ত নিল আর না। নো মোর USA. আমেরিকা না হয় কানাডা, পার্থক্য কী? যাহা গুলশান তাহাই গুলিস্তান। লিগ্যাল কাগজ পত্র থাকলে লাইন মত কাজ পাওয়া কোন ব্যাপার না। তারপর জীবনটা হেসে খেলে কাটিয়ে দেওয়া আটকায় কার সাধ্য। কিন্তু বিধি বাম। টরন্টোতে এসে কাশেম দেখল কাজের বাজার খুব টাইট, হেসে খেলে জীবন কাটানোর পর্বটা একটুর জন্য আটকে থাকে। কাশেমের সাথে যখন টরন্টোতে আমার প্রথম দেখা হয় তখন সে সেনেকা কলেজে নেটওয়ার্কিং এর ওপর একটা ডিপ্লোমা করছিল। আমি কৌতূহলী হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধু তুই না ইউ, এস, এর ব্যচেলর। তোকেও আপডেইট করতে হচ্ছে কেন?
আর বলিস না, বাংলাদেশের বাজারে ইন্ডিয়ান সামগ্রীর মতই এঞ্জিনীয়ারে এঞ্জিনীয়ারে সয়লাব হয়ে গেছে কানাডার জব মার্কেট। তুই নতুন এসেছিস, তোকে একটা কথা বলি। কাজের প্রবলেম এদেশে আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এর সমাধান আছে কোর্স থেরাপীতে। এখন হচ্ছে আই টির যুগ। আমি যে কোর্স টা করছি না- Networking এর উপর, কম্পলিট করার সাথে সাথে হেসে খেলে Seventy K ইয়ারলি।
আমি তখন নতুন, কাশেমের হেয়ালি মার্কা কথার অনেক কিছুই আমার বোধগম্য হয়নি তখন। তবে দিন কতক পরেই বুঝতে পেরেছি, মিলিওন ডলার দামী একটা কথা বলেছিল বন্ধু আমার- কোর্স থেরাপী। এ দেশটাই হচ্ছে কোর্সের দেশ। যে যত কোর্স থেরাপী নিতে পারবে তার ভবিষ্যত হেসে খেলে কাটানোর সম্ভবনা তত বেশী উজ্জ্বল। তবে এই কোর্স, সেই কোর্সের ঠেলাঠেলিতে আসল কোর্সের কথা মানুষ বেমালুম ভুলে যায়। তাই জনসংখ্যা সেই যে এক যুগ আগে তিন কোটি ছিল এখনও তা তিনেই আছে। ক্রিয়ার সমান্তরালে প্রতিক্রিয়া, নিউটনের তৃতীয় সূত্র।
কোর্স শেষে সেভেনটি- kর চাকুরীটা কানের পাশ দিয়ে বাতাস কেটে চলে গেলেও মোটামুটি চলন সই প্রফেশনাল লেভেলের একটা কাজ পেয়ে যায় কাশেম। কাশেমের টরন্টো জীবনের অগ্রযাত্রা সেই যে শুরু, কামিয়াবির এভারেস্টে আরহোন করে তবেই সেই যাত্রার পরিসমাপ্তি। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে ওর বিয়ে করার কথাটা না বললেই নয়। নিজের পকেটে যা ছিল আর সেই সাথে ক্রেডিট কার্ডে এক গাদা টাকা ধার করে কোন এক বসন্তে দুই মাসের ছুটি নিয়ে কাশেম উড়াল দেয় বাংলাদেশ পাণে- উদ্দেশ্য শাদীর লাড্ডু গলঃধকরন করা। বিদেশ থেকে ঝটিকা সফরে যেয়ে পাত্রী বাছাই করে বিয়ে করা যে কত বিশাল একটা কর্ম যজ্ঞ তা ভূক্তভোগী মাত্রই জানেন। তবে কাশেমের বিবাহ বলে কথা। দেশে নামার পর দিন থেকেই সে পাত্রী দেখার মহতী কর্মটির শুভ মহরত ঘটায় এবং পরবর্তি দিন গুলোতে সে একের পর এক পাত্রী দেখতে থাকে। তখনও ফেইস বুক, নোওজ বুকের প্রচলন হয়নি। মোবাইল ফোনের সুচনা লগ্ন কেবল। বাংলাদেশে ফোন করা এক্সপেন্সিভ। তবুও বন্ধুত্বের খাতিরে মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজ খবর নেবার চেষটা করি। আর তাতেই জানতে পারি বন্ধু আমার মহা ব্যস্ত। সকালে নরসিংদি যায় পাত্রী দেখতে তো বিকেলে যায় নারায়নগঞ্জে। আবার পরদিন হয়ত বা মানিকগনজে- বিরতিহীন, অদম্য, অপরাজেয় কাশেম । প্রায় দেড় মাস অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে প্রায় ডজন দুই পাত্রী থেকে কণে নির্বাচনের মত দুরুহ কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করল কাশেম- কনে সদ্য পাশ করা এম, বি, বিএস ডাক্তার। গায়ে হলুদ, বিবাহ, বউ ভাত, ফিরানি, ঘুরানিএবং বোনাস হিসেবে ঝগড়া ঝাটি সহ আনুসাঙ্গিক কর্ম যখন সম্পন্ন হল তখন ফিরতি ফ্লাইট ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। টরন্টো ফেরার পর কাশেমের অর্ধাংগীনির ছবি আর ভিডিও দেখে বন্ধু পত্নীরা প্রশংসার প্লাবনে ভাসিয়ে দিল। তবে সেই প্রশংসায় সত্যতা বা সততা কতটুকু ছিল তা কাশেমের মত আকেলমান বালকের না বোঝার কথা না। তাছাড়া বিয়ের কথা বার্তা পাকা হওয়ার সময় থেকেই তার দুঃসম্পর্কের এক মামা শ্বশুর (কাশেমের ভাষায় শালায় এক নম্বরের গিট্টু ) নানা ভাবে ভ্যাজাল করার চেস্টা করে আসছিল। কাশেমতো বিয়ের তিন দিনের মধ্যেই কানাডায় ফেরত আসল। কিন্তু সেই ভ্যাজাল পরবর্তিতে আরও খানিকটা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে তা তখন তার দূরপাল্লার সংসার জীবনে অশান্তির ক্যাটালিস্ট। কাশেমের গিট্টু মামা শ্বশুর আবার সরকারী দলের স্থানীয় হোমরা চোমরা।
কাশেমের যায় যায় দিন অবস্থা আঁচ করতে পেরে আমার গুনবতী স্ত্রী একদিন আফসোসের স্বরে আমায় বলল, “কাশেম ভাইর জন্য খুব কষ্ট হয়”।
আমি বলি, “কেন”?
উত্তরে সে বলে, “কাশেম ভাইর মত একটা স্মার্ট ছেলে এত বেছে বুছে এইটা কি বিয়ে করল? সামনের দাঁত দুইটা দেখেছ? কেমন কোদালের মত। আর চোখ দুইটা? থাক আল্লাহ্‌ মাফ করুক। মানুষের চেহারা নিয়ে ক্রিটিসাইজ করা ঠিক না। কিন্তু যাই বল, এর চাইতে টুম্পা কত্ত সুন্দরী ছিল দেখতে”!
পাঠকের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি যে টুম্পা হচ্ছে আমার স্ত্রীর বড় বোনের ভাসুরের শ্যালিকার মেয়ে- দেখতে অত্যন্ত রুপবতী। আমার স্ত্রী, কাশেমের কাছে টুম্পার জন্য বিয়ের প্রস্তাব করেছিল। কাশেম তা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করে। পতি বন্ধুর জন্য আমার পরঃকষ্ট কাতর স্ত্রীর কষ্ট টা যে আসলে কি কারনে তা বিবেকবান পাঠক নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পাড়ছেন! যেহেতু কাশেম আমার বাল্যবন্ধু তাই তার সাথে প্রটোকলের বাইরে গিয়েও অনেক কথা জিজ্ঞেস করা অশোভন কিছু না। কৌতুহলী হয়ে তাই একদিন তাকে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা বন্ধু একটা কথা জিজ্ঞেস করি যদি মনে কিছু না করিস। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে- আগে দর্শন ধারী পরে গুন বিচারী। বিয়ে করার সময় সবাই তো আগে চেহারা - - -
আধ-ফোঁটা বাক্য আমার মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে কাশেম বলে, “ মানুষের রুপটা কোন বিষয় না, অন্তরটাই আসল। প্রেমিকের রুপ অনন্ত কাল টেকে, কিন্তু ঘরের বউ এর রুপ- মেইড ইন চায়না। হানিমুনের পর থেকেই ফিকে হতে থাকে, টেকে না বেশি দিন।“
আমি অবাক হয়ে কাশেমের ফিলোসফি গলঃধকরন করি। উপযুক্ত শ্রোতা পেয়ে সে আরও উৎসাহের সাথে বলতে থাকে, “বউ যতই সুন্দরী হোক না কেন, পাঁচ বছরের মাথায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভাই বোনের মত হয়ে যায়। সেলিব্রেটিদের ম্যারেড লাইফ দেখিস না? অবশ্য সুন্দরী বউ নিয়ে ঘুরলে আর কিছু হোক না হোক পাড়া-প্রতিবেশী আর বন্ধু-বান্ধবের হক আদায় হয় বেশ! হো হো হো”। আমার অযাচিত কৌতূহলের এমন সমুচিত জবাব দিতে পেরে আত্ম তৃপ্তির হাসি হাসে কাশেম। আমিও বন্ধুর হাসিতে সামিল হই এবং তার দর্শনের গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে যাই। এরকম করে কোনদিন চিন্তা করিনি, আমার বন্ধুর কথায় মাহাত্য আছে।
হাসি থামিয়ে আবার বলে, “ রেবেকার অন্তরটা খুব পরিস্কার- যাকে বলে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার”। আমি মনে মনে ভাবি, মনের কথাতো আর এক বেলা দেখা সাক্ষাতে উদ্ধার করা সম্ভব না।
আমার মনের কথা যেন পড়তে পারে কাশেম। তাই সে বলে, “রেবেকাকে প্রথম যেদিন দেখতে যাই সেদিন দু-চারটা কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলাম, যে এ মেয়ের অন্তর আর বাহির- পার্থক্য ১৮০ ডিগ্রী”।
কাশেম এলেমদার মানুষ, বহু ঘাটের জল খাওয়া। দু’একটা টোকা-টাকি, ফুঁ-ফা, দিয়ে একটা মেয়ের মনই যদি না বুঝতে পারল তাহলে আর কিসের এলেম?
কাশেম আরও বলে, “ তাছাড়া, যতদিনে রেবেকা যখন কানাডায় আসবে ততদিনে ওর ইন্টার্নি হয়ে যাবে। ও খুব ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে। এখানে আসার পর কষ্টেসৃষ্টে যদি এম,ডি (ডাক্তারী) লাইসেন্সটা নিয়ে নিতে পারে, তাহলে বুঝলি না! হেসে খেলে - - “।
এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিস্বাদে। কাশেমের অত্যাধুনিক ডিজিটাল জীবন দর্শনের কাছে আমার মধ্যযুগিয় জীবন দর্শন পুরোপুরি ধরাশায়ী। হেসে খেলে জীবন কাটানোর ইসপাত কঠিন সংকল্প আর তা বাস্তবায়নের ডিজিটাল প্ল্যান শ্রবণ করে আমি অভিভূত। বিবাহ বানিজ্যে বন্ধুর এত বড় সাফল্যে আমি ঈর্ষান্বিত। সেই সাথে আমি গর্বিত কাশেম আমার বন্দধু বলে।
।৩।
যেই কথা সেই কাজ। বউ কানাডা আসার সাথে সাথে, কাশেম তার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুরোপুরি মনোনিবেশ করে। ইতমধ্যে সে তার নিজস্ব প্রফেশনে হাইলি পেইড স্যালারীর একটা চাকরীও পেয়ে যায়। একদিন সন্ধায়, সবে মাত্র কাজ থেকে ফিরেছি। এমন সময় কাশেমের ফোন, “দোস্ত, এখনই কফি টাইমের সামনে চলে আয়”।
আমি বিলি, “কেন”?
“আয় না আগে, আসলেই জানতে পারবি। তোর বউকেও সাথে করে নিয়ে আসিস”, আর কোন সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দেয় কাশেম।
মিনিট বিশেক পরে কফি টাইমের পার্কিং লটে এসে আমরা যারপর নাই বিস্মিত হই। টকটকে লাল রঙের, ঝকঝকে এক BMW-320 গাড়ির সামনে কাশেম তার বউ সহ দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞেস করি, “নতুন না কি”?
আনন্দে উদ্বেলিত কাশেম আকর্ন এক হাসি দিয়ে বলে, “ব্র্যান্ড নিউ না, এক বছরের পুরনো। কিন্তু বলতে গেলে জিরো কিলোমিটার”। এরপর কাশেম গাড়ির ফিচার গুলি একে একে বর্ননা করতে থাকে- টিন্টেড গ্লাস, এ, বি,এস, - - -“।
আমি অবশ্য গাড়ির এই ব্যপার গুলো ভাল বুঝি না। এর কারন প্রথমত জ্ঞানের অভাব, দ্বিতীয়ত আগ্রহের অভাব। তবে কাশেমের বক্তব্য শেষে এইটুকু বুঝলাম যে BMW-320 গাড়িটি হচ্ছে বর্তমান যুগে অন্যতম সেরা ‘লাক্সারী কার’। এই গাড়ি খানার বুক ভ্যালিউ হচ্ছে পঞ্চান্ন হাজার। কিন্তু সে কিনেছে অতি সস্তায়, নাম মাত্র মূল্যে। কারন এই গাড়ির আসল মালিক সদ্য প্রয়াত রইস এক বৃদ্ধা। বৃদ্ধা গত হবার পর ছেলে মেয়েরা নাম মাত্র মূল্যে গাড়িখানা বিক্রি করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
আমি বলি, “কত নিল তাই বল”।
“মাত্র উনত্রিশ হাজার ডলার-ক্যাশ,” উত্তর দেয় কাশেম পত্নী।
আমি আড় চোখে আমার পত্নীর দিকে তাকাই। বলাই বাহূল্য, তার চক্ষু চড়ক গাছ। একথা সত্য যে প্রায় পানির দরে বন্দধু আমার BMWর মালিক বনে গেছে। বন্ধুর মুনাফায় আমি যতটা না উতফুল্ল, তার চেয়ে খানিক বেশি ঈর্ষান্বিত, আর তার চাইতে অনেক মাত্রায় বেশি শঙ্কিত। ঈর্ষার মাত্রা, উৎফুল্লের মাত্রার চাইতে বেশি হওয়ার কারণ সবচেয়ে কম আকেলমান পাঠকও নির্ঘাত ‘সমোঝে’ আনতে পারবেন। কিন্তু শঙ্কার কারণটা অনুধাবন না করতে পেরে অনেক জ্ঞানী পাঠকেরও কপালে ভাঁজের অবতারনা করবে। উৎফুল্ল? বুঝলাম! ঈর্ষান্বিত? তাও না হয় বোঝা গেল। কিন্তু শংকিত! সে আবার কেন? পাঠক, একটু পরেই শঙ্কার কারনটাও খোলাসা হবে বলে আমার বিশ্বাস।
গাড়ি কেনার ইতি বৃত্তান্ত শেষ হলে, কাশেম পত্নী প্রস্তাব রাখে, “চলেন, নায়াগ্রা ফলস ঘুরে আসি। সেমি লং ড্রাইভ দিয়ে গাড়িটা উদ্বোধন হয়ে যাক। সত্য কথা বলতে কি, লাক্সারী কারের মালিক না হওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও, এতে চড়ার একটা সুপ্ত ইচ্ছা অন্তরের গোপন প্রকোষ্ঠে লুকায়িত আছে বইকি। কিন্তু আমি হা-না ভোট দেওয়ার আগেই আমার স্ত্রী বলে, “না ভাই রেবেকা তোমরাই যাও। সুমুর শরীরটা বেশ খারাপ। অকে নিয়ে এত রাতে আর না গেলাম”।
সুমু, ওরফে সুমাইয়া, আমার আদরের ছোট কন্য, বয়স ছয় মাস। এই মুহূর্তে তার জন্য নির্ধারিত ‘কার সিটে’ শুয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। আমার আদরের কন্যা যে অসুস্থ্য তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু কন্যার জননী যেহেতু বলেছে অসুস্থ্য, কাজেই সে অসুস্থ্য- আমার অজ্ঞতা। অগত্যা কাশেম দম্পতি আমাদের রেখেই নায়াগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
ঘরে ফেরার পথে আমার স্ত্রী চুপচাপ পাশের সিটে বসে থাকে। নিরবতা ভাঙ্গতে আমিই উদ্যোগী হয়ে ডায়ালগ ওপেন করে বলি, “কাশেমের গাড়িটা ভালই হয়েছে, কি বল”?
“ভাল না ছাই। এইটা একটা কালার হলো? কটকটে লাল। আমরা যখন নতুন গাড়ি কনব---“। পাঠক আমার শংকার কারণটা নিশ্চয়ই এখন পরিষ্কার হয়েছে?
নতুন গাড়ির সঙ্গে নতুন বাড়ির সম্পর্ক সর্বকালীন। পত্নী ভাগ্য বটে কাশেমের। বি এম ডাব্লিউর খবর বাসী হতে না হতেই বাড়ি কেনার খবর শুনতে পাই লোকমুখে। লোকমুখে বলতে আমার স্ত্রীর মুখে। যদিও আমার স্ত্রী শুনেছে আমার আরেক বন্দধু পত্নীর কাছ থেকে। জানিয়ে রাখা জরুরী যে, মার্কিন-রুশ কোল্ড ওয়ার অনেক আগেই শেষ হলেও, সে সময়ে আমার স্ত্রী এবং কাশেম পত্নী রেবেকার মধ্যে একটা শীতল লড়াই চলছিল। এই কোল্ড ওয়ারের কারন নিয়ে ঘাটাঘাটি কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না বলে সে পথে আমি পা বাড়াইনি।
বরাবরই আমি থার্ড হ্যান্ড নিউজের চাইতে ফারস্ট হ্যান্ড নিউজের পক্ষপাতী। ক্ষণকাল বিলম্বে হলেও আমি বন্ধুর কাছ থেকে দূরালাপন মারফৎ খবরের আধ-সত্যতা খুঁজে পাই। খবরটা আধ-সত্য এজন্য যে, কাশেম বাড়ি কিনছে না, কিনছে কন্ডোমিনিয়াম।
আমি বলি, “ কন্ডোমিনিয়াম কেন? হোয়াই নট পুরোদস্তুর বাড়ি”?
“ফার্স্ট টাইম বাইয়ার। এত বড় রিস্কে যাওয়া ঠিক হবে না। আর তাছাড়া বাড়ি কেনা মানে ঝামেলা কেনা। আমি ভাই উইন্টারে স্নো পরিস্কার করতে পারব না। আর সামার আসলে গাছের পাতা পরে সয়লাব। দুনিয়ার ঝামেলা”, কাশেম উত্তর দেয়।
“তা কিনলি যখন ড্যানফোর্থে বাঙ্গালী এলাকায় কিনলেই পারতিস”।
“তুই জানিস না। ভিক্টোরিয়া পার্ক, ড্যানফোর্থ এলাকার কন্ডো গুলোর রি-সেইল ভ্যলিউ নেই। আমি যে এলাকায় কিনেছি সেটা ইহূদী এলাকা, পাঁচ বছরে হেসে খেলে দাম বেড়ে হবে দ্বিগুণ। নেইবাররা সব হাইলি এডিউকেটেড। আর তাছাড়া রেবেকাও বাঙ্গালীদের সাথে- - - , বুঝলি না?”, বন্ধু আমার রহস্য খোলাসা করে।
নতুন গৃহে প্রবেশের পর্বটা ধর্মীয় ভাব গাম্ভির্যের সাথে করতে মনঃস্থির করল কাশেম। আমি যতদূর জানি ধর্ম কর্মের সাথে কাশেমের খুব একটা সম্পর্ক নাই। তাই কৌতূহল বশত শুধাই, হঠাত মিলাদ কেন”?
সে বলে, “না না মিলাদ না। আজকাল মিলাদ আর কেউ পড়ায় না। এই একটু ধর্মীয় আলোচনা আর কি”। কথার ফাঁকে নাক দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আবার বলে, “ দুনিয়ার জীবন আর কয়দিন? হেসে খেলে কেটেই যাবে। কিন্তু তারপর”? প্রশ্নটা যেন আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা।
আখেরাতের বিষয় টেনে এনে বন্ধু আমাকে হালকা করে চপেটাঘাত যখন করলই তখন আমিও পালটা আঘাত হানার উদ্দশ্যে বলি, “কিন্তু দোস্ত সুদ দিয়ে যে কোন কিছু কেনা তো হারাম, তা সে হোক না কেন বাড়ি। মিলাদ বলিস আর দোয়ার অনুষ্ঠান বলিস জলজ্ব্যান্ত হারাম তো আর দোয়ার জোরে হালাল হয়ে যাবে না”। প্রিয় বন্ধুকে যুক্তিতে কুপোকাত করতে পেরে আমি বেশ তৃপ্তির সাথে মাথা দুলাই সেই সাথে একটু বক্র হাসি উপহার দিই।
“ আরে ধ্যাৎ এসব কাঠ মোল্লাদের কথা”, কাশেম আমার ফতোয়া আর বক্র হাসি তর্জনীর ইশারায় ওভার রুল করে। শুধু তাই নয়, তাৎক্ষণিক ভাবে পালটা ফতোয়া হাজির করে বলে, “ শেখ আব্দুল্লাহ আল গামাল আজহারি কি ফতোয়া দিয়েছে জানিস না”?
“ গামাল আহাজারী টা আবার কে”?
আমার অজ্ঞতায় মৃদু ভর্তসনার স্বরে কাশেম বলে, “ আরে ছাগল আহাজারী না, আজহারী। ইজিপ্টের আল-আজহার ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছে, তাই নামের শেষে আজহারী। ফেইমাস ইসলামিক স্কলার। তুই চিনিস না”?
আমি ডান-বায়ে অজ্ঞতার মাথা নাড়ি আর বলি, “তা আজহারী কি বলেছে”?
“আজহারী সাহেব বলেছেন, নন-মুসলিম কান্ট্রিগুলোতে থাকার জন্য সুদে একটা বাড়ি কেনা জায়েজ”।
“দ্যাটস ভেরি ইন্টেরেস্টিং”, আমি বলি।
“কথা তো উনি মন্দ বলেন নাই। থাকার জন্য একটা বাড়ি থাকলেই না হেসে খেলে জীবনটা কাটানো সম্ভব”, কাশেম তার মতামত ব্যক্ত করে। সেই সাথে আরও বলে, “ শুনলে তুই আশ্চর্য হয়ে যাবি। ভিক্টোরিয়া পার্ক আর ড্যনফোর্থ ইন্টারসেকশনে নতুন যে মসজিদের জায়গা কেনার কথা বার্তা চলছে না”?
আমি বলি, “ হ্যা, শুনেছি”।
“জায়গাটা সুদ দিয়ে কেনা হচ্ছে। আমার তোর থাকার ঘর না রীতিমত আল্লাহ্‌র ঘর হচ্ছে সুদ দিয়ে। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো? আমার বাড়ির মিলাদের অনুষ্ঠানে নতুন মসজিদের মাউলানা সাহেব আসছে, তাকেই জিজ্ঞেস করিস”। ধর্ম কর্মের ব্যপারে আমার জ্ঞান একেবারে শুন্যের কোঠায়। তাই আর তর্কে জড়াই না।
যথারিতী গৃহ প্রবেশের দিন আসন্ন হল। আর দশ জনের মত আমিও আমন্ত্রিত। অনুষ্ঠানের আগের রাতে আমার স্ত্রী বলল, “তুমি যাও আমি যাব না”।
আমি প্রশ্ন রাখি, “কেন”?
“ ক্যান যাব? আশে পাশে অনেককেই তো রেবেকা নিজে ফোন করে ইনভাইট করছে। আমাকে একটা বার ফোন করতে পারত না?”
অর্ধাঙ্গিনীর যুক্তি একেবারে ফেলবার মত নয়। তবুও ওকে বোঝাবার চেষ্টা করি এবং যথারীতি বিফল হই। এক বছরের প্রিয় কন্যা সুমু সে যাত্রা আমাদের বন্ধুত্ব রক্ষা করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সত্যিকার অর্থেই সুমাইয়া সেদিন অসুস্থ হয়ে পরে। ওকে নিয়ে Hospital for Sick Kid-এ পর পর তিন দিন ছোটাছুটি করতে হয়। অসুখ, বিসুখ, এমার্জেন্সি, নির্ঘুম রাত- এসব মন্দের মধ্যে যে ভালটা হলো, তা হচ্ছে দুই পরাশক্তির মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করা। তিন দিন বাদে মেয়েকে নিয়ে যখন সুস্থির ভাবে ঘরে বসতে সক্ষম হই তখন আমার স্ত্রী আর রেবেকার মধ্যেকার সম্পর্ক cold war থেকে এক ধাপ উপরে luke warm অর্থাৎ কুসুম-উষ্ম সম্পর্কে এসে পৌঁছে যায়। পরবর্তি দিন গুলোতে সেই সম্পর্ক উষ্ম থেকে উষ্মতর হয়। আবার ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই সম্পর্ক উঠানামাও করে।
। ৪ ।
গাড়ি নতুন, বাড়ি নতুন, হেসে খেলে ভালই চলছিল কাশেমের। কিন্তু এর মধ্যে একটা সমস্যা এসে দাঁড়ায়। আগেই বলেছি কাশেমের প্ল্যান যে রেবেকা এখানকার ডাক্তারি সার্টিফিকেট অর্জন করে। সে অনুযায়ী টুকটাক পড়াশোনা শুরুও করেছিল। কিন্তু বছর খানেক বই পুস্তক নিয়ে নাড়াচাড়া,এ স্টাডি গ্রুপ থেকে ও স্টাডি গ্রুপে যাতায়াত করে রেবেকা বেগম বুঝতে পারে কানাডার ডাক্তারী সার্টিফিকেট তাকে দিয়ে না-মুমকিন। আজকাল লেখা পড়া আর মাথায় ঢোকে না। অনেক তো হলো লেখা পড়া, আর কত? আমার বন্ধুর তো মাথায় হাত। তার প্ল্যান যে ছিল অন্য রকম। একবার যেন তেন ভাবে ডাক্তারী টা পাশ দিতে পারলে আর কে আটকায়, হেসে খেলে - - - । অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে কাশেম, সেই সাথে আমরাও। কিন্তু রেবেকা তার অবস্থানে অনড়। প্ল্যান ‘এ’ কার্যকরী হোল না? ‘কো-ই বাত নেহি’, প্ল্যান ‘বি’ আছে না! এবার সে স্ত্রীকে রাজী করায় ফার্মাসী এসিসটেন্ট ডিপ্লোমার জন্য। যাহা ডাক্তার তাহাই কম্পাউন্ডার- ক্যায়া ফারাক? Pharmacy Assistant ডিপ্লোমা করার ইচ্ছাও রেবেকার ছিল না। স্বামী সংসার নিয়ে কার না হেসে খেলে জীবন কাটানোর খায়েস জাগে। তাই স্বামীর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত সে রাজি হয় এবং বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনার সাথে পূনরায় বই পুস্তকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে।
কোন এক রবিবার সকালের কথা। কাজে যাবার তাড়া নাই। বাসার সবাই ঘুম, উইক এন্ডে যা হয়। দরজায় করাঘাতের শব্দে সুখ-নিদ্রায় বিঘ্ন ঘটে। চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে দেখি সামনে দন্ডায়মান কাশেম। ওর চুল গুলো উসকো খুসকো, চোখ জোড়া রক্ত জবার মত লাল টকটকে। চেহারা দেখে মনে হয় সুনামী বয়ে গেছে বেচারার উপর দিয়ে।
“ কিরে দোস্ত, এত সকালে? সব ঠিক আছে তো”?
“ আগে ভিতরে বসি, তারপর বলি”, আমাকে একরকম ঠেলে লিভিং রুমের সোফায় বসে কাশেম। ওর মুখ পানে চেয়ে থাকি, ঘটনা টা বোঝার চেষ্টা করছি।
নাক দিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে বাতাস ছাড়ে সে। তারপর বলে, “ কাল সারারাত থানা হাজতে ছিলাম। সারারাত বলতে রাত বারটা থেকে সকাল পর্যন্ত”।
আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই, বাকহীন হয়ে পরি। শুধু হা করে তাকিয়ে থাকি ওর চতুর্ভংগ চেহারার দিকে।
“ রেবেকা কাল রাতে পুলিশ কল করেছিল”।

চলবে

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৯ রাত ১০:৩২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×