somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি বড় গল্প

২৫ শে মে, ২০১৯ রাত ৯:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হেসে খেলে
শেষ পর্ব

“ রেবেকা কাল রাতে পুলিশ কল করেছিল”।
“কেন”?
“একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। কখন জানিনা, ঠিক মনে পরছে না”, নিজের চুলগুলো দু’হাত দিয়ে টানতে টানতে মাঝ পথে কথা থামিয়ে দেয় কাশেম।
আমি জিজ্ঞেস করি, “ গায়ে হাত তুলেছিলি”?
উপর নীচ মাথা নাড়ে কাশেম। আমি ওর সামনে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি রাখি। পানি টুকু ঢকঢক এক নিঃশ্বাসে শেষ করে। তারপর ধীরে ধীরে পুরো ঘটনা বয়ান করে। বন্ধুর মুখ থেকে যতটুকু শুনলাম, তাতে মনে হলো রেবেকা কাজটা ভাল করেনি। অন্যায়টা তারই। তবে কথা একটা থেকেই যায়। নিজের দোষ উম্মুক্ত করে কেউ কখনও ঘটনার বয়ান করেছে এমন নজির সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। তাই মূল ঘটনা জানতে হলে অন্য পক্ষের ভার্সনও শোনা আবশ্যক। রেবেকার ভার্সন আমার আর শোনা হয়ে ওঠেনি। কাশেমের মুখ থেকে যতটুকু শুনেছি, আর তার সাথে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে ঘটনার সারসংক্ষেপ বর্ননা করছি।
দিন কতক আগে দেশ থেকে খবর এসেছে যে, রেবেকার মেঝো বোন মনিকা বাংলাদেশ মেডিকেল থেকে এম,বি,বি,এস পাশ করেছে। দুলাভাই হিসেবে কাশেমের ফরজ ছিল শ্যালিকাকে কংগ্রাচুলেট করা। কিন্তু সে ফরজ টুকু সে পালন করেনি। রেবেকা তাকে বার কয়েক স্বরণও করিয়ে দিয়েছে। কাশেমের ভাষ্য অনুযায়ী অনিচ্ছাকৃত ভুল। কিন্তু আমার ধারনা এটা ইচ্ছাকৃত ভুল। সে যাই হোক, ক’দিন ধরে কাশেমের কর্ম ক্ষেত্রে একটু ঝামেলা চলছিল। সেদিন ফেরার পথে ৪০১ হাইওয়েতে বিশাল এক্সিডেন্টের কারনে ঘন্টা দেরেক জ্যামে আটকা ছিল। এর মধ্যে রেবেকা দুই বার ফোন করেছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত হোক, কাশেম ফোন রিসিভ করেনি। ক্লান্ত, অবসন্ন কাশেম ঘরে ঢোকার সাথে সাথে অনেকটা আক্রমনাত্নক ভঙ্গিতে রেবেকা শুরু করে, “কী ব্যাপার এত দেরী যে”? ( পাঠক জানিয়ে রাখা ভাল যে ওদের ঝগড়ার ডায়ালগ গুলো কাশেম থেকে হুবহু নকল করা না। এর কিছু অংশ আমার চিত্রনাট্য।)
জুতা খুলতে খুলতে কাশেম উত্তর দেয়, “জ্যামে আটকা ছিলাম”।
“এতবার ( আসলে মাত্র দুই বার) ফোন করলাম, ফোনটাও তো রিসিভ করলা না”।
“ড্রাইভিং এর সময় সেল ফোন? এখন tough punishment জানো না”?
“Blue tooth-এ কথা বলতে পারতে”, আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্বরে বলে রেবেকা।
“Blue tooth নষ্ট”, কাশেমের সংক্ষিপ্ত উত্তর। মেজাজটা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছে সে।
“মনিকা কে কংগ্রাচুলেট করেছিলা”? প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে জমিয়ে রাখা অভিমানের হাড়ি ভরা ব্যাঙ থেকে একটা ব্যাঙ কেবল লাফিয়ে পরল।
“ভুলে গেছি। মনে ছিল না। আজকেই করব”।
“ ভুলে গেছি বললা, আর আমি বিশ্বাস করব”?
“বিশ্বাস না করলে করবা না, আমার কি তাতে”?
“ আমার কী তাতে মানে? আমি তোমার স্ত্রী, আমি বিশ্বাস করলাম বা না করলাম তাতে তোমার কিছু যায় আসে না? আমাকে এতটা হেয় করে কথা বল কেন তুমি? What do you think you are? তুমি নিজেকে কী মনে কর বলত”?
“আমি তোমাকে হেয় করে কথা বলি নাই। আমি বলেছি যে আমি ভুলে গেছি। I forgot, as simple as that”.
“ It is not as simple as that. আমার বোনকে সামান্য একটা কার্টেসি কল দিতে ভুলে যাও, আর নিজের বোনের সাথে তো প্রতিদিনই কথা বল। আচ্ছা মনিকার কথা বাদ দাও। ফেব্রুয়ারিতে চয়নিকার ( সব চেয়ে ছোট শ্যালিকা) জন্ম দিন গেল, বেচারী কত আশা করে ছিল যে তুমি একটা উইশ করবা। আচ্ছা চয়নিকার কথাও বাদ দিলাম, লাস্ট রোজায় আম্মু, আব্বু হজ্জে (আসলে ওমরায়) গেল। আত্মিয়, অনাত্মিয় এমন কেউ নাই যে ফোন করে দোয়া চায় নাই। তুমি একটা বার ফোন করছিলা? কি মনে পরে? ”, এক নিঃশ্বাসে অভিযোগ গুলো করে রেবেকা। হাড়ি থেকে একের পর এক ব্যাঙ যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বের হচ্ছে।
“শোন রেবেকা, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উইশ না করাটা জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা, মধ্য যুগিয় বর্বরতা, মানবতা বিরোধী অপরাধ। কি আর করার অপরাধ যখন করেই ফেলেছি তখন জেল ফাঁসি যা দেবার দাও। আর আমার বোনের কথা বলছ? You know that she is having tough time in her life.”
“ হ্যা, হ্যা, আমি শুধু তোমার বোনের সমস্যা জানব, আর আমার বোনের - - “
“ কী, তোমার বোন কী”? এবারে রেবেকা তার অভিযোগ পুরোপুরি পেশ করতে পারে না। কাশেম তার গলার স্বর অপেক্ষাকৃত উঁচু করে বলে, “ তোমার বোন প্রাইভেট মেডিকেল থেকে ডাক্তারী পাশ করেছে, তাতে কি হাতি, ঘোড়া করেছে? ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইভেট মেডিকেলে আর প্রাইভেট ডাক্তারের ছড়াছড়ি এখন বাংলাদেশে”।
যেহেতু রেবেকা নিজেও প্রাইভেট মেডিকেলের ডাক্তার, সেহেতু এধরনের তাচ্ছিল্য সে সহ্য করতে পারে না। অত্যন্ত ঝাঁঝালো কণ্ঠে তাই সে প্রতিবাদ জানায়। বলে, “ কি বলতে চাও তুমি? প্রাইভেটে পাশ করলে কি সে ডাক্তার না?”
“ ডাক্তার কি না তা নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস কর না”! কাশেমের হেয় প্রতিপন্ন করা এহেন বক্তব্যে প্রচন্ড অপমানিত বোধ করে রেবেকা। এই অপমানের একটা যুতসই জবাবও তার মস্তিস্কে তড়িৎ খেলে যায়। তাই এতক্ষণে ‘সি সার্প ‘ স্কেলে ঝগড়ারত রেবেকা এক লাফে তার স্বর ‘ই সার্পে ‘ উঠিয়ে এনে তর্জনি উচিয়ে বলতে থাকে, “ নিজেকে কী মনে কর তুমি? আমাদের বাবা, আমাদেরকে অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে পড়িয়েছে। তোমার বাবার মত তহবিল তসরুফ- - -“।
কথা কাটাকাটির প্রাথমিক পর্যায়ে ওদের মধ্যেকার দূরত্ব চামচ অথবা গ্লাস, বড় জোর হাঁড়িপাতিল ছোড়া দূরত্বের মধ্যে থাকলেও, স্বর যতই এক স্কেল থেকে আরেক স্কেলে উঠতে থাকে, দুজনের মধ্যেকার ভৌগলিক দূরত্বও বিপরীত অনুপাতে কমতে থাকে। কমতে কমতে দূরত্ব এক বিঘতের মধ্যে এসে যায়। রেবেকা হয়ত বলতে চেয়েছিল তার শশুর অর্থাৎ কাশেমের পিতা কর্ম ক্ষেত্রে অথবা অন্যত্র অর্থ আত্মসাত জাতীয় কোন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। যে হাড়ি থেকে এতক্ষণ লাফিয়ে লাফিয়ে ব্যাঙ বের হচ্ছিল, সেই হাড়ি থেকে এই পর্যায়ে রীতিমত দূর্গন্ধ ছড়ানো শুরু করল। মাত্র এক বিঘত দূরে থাকা কাশেম সেই দূর্গন্ধের ঝাঁঝ সহ্য করতে পারে না। একশ মাইল বেগে ধাবমান টর্নেডোর মত থাপ্পরটা রেবেকার গালে আছড়ে পরে। হত বিহ্বল হয়ে পরে দুজনেই। একজন ভাবে, এটা কি হলো? আরেকজন ভাবে, এটা কি করলাম? মঞ্চ নাটকের ফ্রীজ দৃশ্যের মত থেমে থাকে সময় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। একসময় আবার গতি ফিরে আসে। চড় খাওয়া গাল এক হাত দিয়ে ঢেকে ধাপ ধুপ পা ফেলে শশব্দে বেডরুমের দরজা আটকায় রেবেকা। আর অন্য দিকে দুই হাতে মুখ ঢেকে ধপাস করে সোফায় বসে পরে কাশেম এবং নিয়তির অপেক্ষা করতে থাকে।
পাঠক, ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, তার একটা ধারনা পাওয়া গেল। এবারে এই ঘটনাটার উপসংহারে আলোকপাত করা যাক। বউয়ের গায়ে হাত তোলার পর মুহূর্তেই কাশেম বুঝতে পারে কাজটা সে ঠিক করেনি। আর স্বামীকে পুলিশে নেওয়ার পরক্ষনেই রেবেকা বুঝতে পারে যে সেও কাজটা ঠিক করে নাই। পরদিন এই ঘটনার মধ্যস্থতা করে কামাল ভাই নামের আমাদের এক বড় ভাই। কামাল ভাই, পুরো নাম কাজি কামাল। সদা আমুদে মানুষটা, একসময় মঞ্চ নাট্য জগতের মাটি কামড়ানো, শক্তিমান অভিনেতা। বছর খানেক আগে হজ্জ করে এসে তখন সে ফুল টাইম মুসুল্লী। কাজি কামালের বদলে সবাই তাকে ডাকে হাজি কামাল। সে যাই হোক, কামাল ভাইয়ের মধ্যস্থতায়, দুজনের বোধোদয়ের কারণে এবং সর্বোপরি আল্লহর অশেষ রহমতে ঘটনা ঘটার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ওরা দু’জন আবার দাম্পত্য জীবনে ফিরে যায় এবং হেসে খেলে সংসার ধর্ম পালন করতে থাকে। তবে পরবর্তি একবছর পর্যন্ত পুলিশ, সোস্যাল ওয়ার্কার, কোর্ট, উকিল এসবের পেছনে অনেকটা মূল্যবান সময় এবং কষ্টার্জিত অর্থ অপব্যায় করতে হয়।
কাশেমের দুর্ভাগ্য যে ঘটনাটা সাদা-কালো সিনেমা যুগের নয়। তাহলে স্ত্রীর বালিশ জড়িয়ে ক্রন্দন, ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক, অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা, বড়জোর বাপের বাড়ি গমনের মধ্য দিয়ে ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটত। আবার একদিক থেকে কাশেম ভাগ্যবানও বটে। কারন তখনও ফেইস বুক তার মহামারিময় যৌবনে প্রবেশ করেনি। তাহলে আপলোড, শেয়ার, লাইক, ডিজলাইক- আরও কত তেলেসমাতি কান্ড যে ঘটে যেত। সর্বোচ্চ গোপনীয়তা সত্বেও, যে ক’জন ঘটনাটা জেনেছে, তাদের কাছে কাশেমের মান-সম্মান একেবারে হিমাংকের অনেক নীচে নেমে গেল। বিশেষত মহিলা মহলে কাশেমের যে জ্যান্টলম্যান ইমেজ ছিল তা রীতিমত একশ আশি ডিগ্রী টার্ন নিল।
জনৈক বন্ধু পত্নীর ভাষায়, “ যে সব পুরুষ বউয়ের গায়ে হাত তোলে, তারা কাপুরুষ- যার কোন ফেমিনিন জেন্ডার হয় না। কাশেম ভাই একটা কাপুরুষ”।
।৫।
আগেই বলেছি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ওরা ওদের দাম্পত্য জীবনে ফিরে যায়। আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওদের কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। কাশেম প্রবেশ করে নতুন এক অধ্যায়ে। ছেলে নিয়ে ভীষণ ব্যাস্ত পিতা কাশেম। ফেইস বুকে প্রায়ই ছবি পোস্টিং দেখি কাশেম আর রেবেকার, সাথে কাশেম জুনিয়র। নিজেদের ছবি পোস্টের সাথে সাথে কাশেম উইশও করে। জন্ম দিনের উইশ, মৃত্যু দিনের উইশ, বিবাহ বার্ষিকীর উইশ, খৎনা বার্ষিকীর উইশ, আরও কত উইশ। কাশেম বরাবরই ছাত্র ভাল, শেখে খুব তাড়াতাড়ি, এবং সহজে ভোলে না। একরাত শ্রী ঘর বাস করে সেই যে কাশেম উইশ করা শিখেছে, ইহ জনমে তা আর সে ভুলবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।
ছেলে হওয়ার পর পরই এক মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে মনের মত একটা কাজও সে পেয়ে যায়। আমি বলি, “ পর পর দুই বাউন্ডারী হাঁকালি বন্ধু!”
হতাশার সুরে সে বলে, “ বাউন্ডারী আর হাঁকাতে পারলাম কই? ইউ, এস, এ তে সেইম লেভেলের কাজে স্যালারী হেসে খেলে হান্ড্রেড কে’র উপরে আছে তা তুই জানিস”?
‘হান্ড্রেড কে’ মানে এক লক্ষ ডলার। বুঝলাম বন্ধু আমার এক লাখের কম বেতন পায়। মনে মনে একটু খুশি হই বটে।
বছর খানেক পরে শুনি কাশেম কন্ডোমিনিয়াম বিক্রি করে হাউজ কেনার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। আমি বলি,” কি ব্যাপার? তুই না বলে ছিলি হাউজ কিনবি না”?
“ তখন ছিল জীবনের এক অধ্যায়, আর এখন আরেক অধ্যায়। ছেলেটা বড় হচ্ছে, একটু খোলা মেলা জায়গা দরকার খেলার জন্য। রেবেকার আবার বাগান করার খুব শখ। তাছাড়া খামাখা মাসে মাসে কন্ডো ফী দেওয়া মানে টাকাটা ফালানি। আর বাড়িতে যা ইনভেস্ট করবি তার সবই তোর। দশ বছরে পেইড অফ করে দিতে পারলে হেসে খেলে - - -“।
এক বার আমি জনৈক শুভাকাংখীর কাছ থেকে এক ব্যবসার খোঁজ পাই। ব্যবসাটা আমার কাছে খুবই লোভনীয় মনে হয়। মোটামুটি যখন মনস্থির করি যে ব্যবসাটা শুরু করব, তখন কোন এক শুভক্ষণে ব্যপারটা কাশেমের গোচরীভূত করি। কাশেমকে বলার আগে খুব আত্মতৃপ্তি পাই। তৃপ্তি পাই এই জন্য যে জীবনে অন্ততঃ একবার কাশেমকে টেক্কা মারতে পারলাম। আমি আর কাশেমকে ঈর্ষা করব না, উলটো কাশেম আমাকে ঈর্ষা করবে।
“কাশেম, দোস্ত! একটা ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি”।
“ কী ব্যবসা’?
“বন্ধু টাকাই টাকা। মেপল লিফের মত টাকা ঝির ঝির করে তোর পায়ের পাতায় চুমু খাবে। তুই করবি নাকি বল”।
“ব্যবসাটা কি আগে শুনি না”।
“বিষয় টা একটু জটিল বুঝাতে সময় লাগবে। তবে in a nut shell, আমার কাজ কাজ হচ্ছে মেম্বার যোগাড় করে। যত বেশী member তত বেশি profit”।
“ ও, multi level marketing, সংক্ষেপে যাকে বলে MLM?“
“ তুই জানিস তাহলে’?
“ জানি মানে, রেবেকা গেল মাসে স্টার্ট করেছে। ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, এই উইকেন্ডে আমি আর রেবেকা তোর ওখানে যাব ভাবছিলাম”।
হায় মোর পোড়া কপাল! জীবনে প্রথম বারের মত কাশেমকে টেক্কা মারতে চেয়েছিলাম। আর সেখানে কাশেমের বউ কিনা দুই দিয়ে ট্রাম্প করল?
সময় বয়ে যায়, দিন গুলো যেন ঘন্টা, মাস গুলো যেন দিন, আর বছর গুলো যেন মাস। পেরিয়ে যায় বেশ কতগুলি বছর। এর মধ্যে অন্ততঃ অর্ধ ডজন কোর্স না হয় প্রফেশনাল ট্রেইনিং সার্টিফিকেট অর্জন করে কাশেম। কাশেমের ভাষায় যাকে বলে আপগ্রেইড। প্রতি আপগ্রেইডে যদি ন্যূনতম পাঁচ হাজার করেও বেতন বাড়ে, তাতে কাশেমের বেতন বাড়তে বাড়তে ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করার কথা। আমি দুর্বল চিত্তের মানুষ। এই দুর্বল চিত্তে আবার এক রাশ ঈর্ষা। তাই কাশেম ইয়ারলি কত ইনকাম করে তা আমি নিজে যেচে কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি।
কাশেম সর্বশেষ যে লাইসেন্সটি নেওয়ার জন্য বই পুস্তক নিয়ে দৌড় ঝাপ করে তা হচ্ছে রিয়াল এস্টেইট ব্রোকারীর, অর্থাৎ কিনা বাড়ি কেনা-বেচার এজেন্ট। আমি অতি আশ্চর্য হয়ে বলি, “ বন্ধু, লাইন ছেড়ে বে-লাইনে কেন”?
সে বলে, “ এটা ঠিক বে-লাইনে চলে যাওয়া না। ব্যাক আপ বলতে পারিস। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমির যে যায় যায় দিন অবস্থা। যে কোন সময় যে কেউ কাজ থেকে লে-অফ হয়ে যেতে পারি। আমি বলি কি, তুইও লাইসেন্সটা নিয়ে নে। গন্ড মূর্খ গুলি পর্যন্ত হেসে খেলে হান্ড্রেড কে হিট করে বছরে”।
কথাটা আমার মনে ধরে। তাই বলি, “ দেখি চিন্তা ভাবনা করে”।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই টরন্টো থেকে প্রকাশিত সব গুলো বাংলা পত্রিকায় কাশেমের সুদর্শন হাস্যজ্জ্বল চকচকে চেহারা আর সাথে বাড়ি কেনা বেচার ঝকঝকে বিজ্ঞাপন চোখে পরতে থাকে।
কাশেম পরিবারের সেই সময়ের রুটিনটা জানিয়ে রাখি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, কোন রকমে কিছু একটা মুখে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে কাশেম। খানিক বেলা করে এক বাচ্চাকে স্কুলে, আরেক বাচ্চাকে ডে কেয়ারে রেখে অন্য গাড়ি নিয়ে ছোটে কাশেম পত্নী রেবেকা। বিকেলে বাচ্চা দুটিকে তুলে ঘরে ফেরে কাশেম। রেবেকা ফেরে আরও পরে। রেবেকা আসার পর কাশেম ব্যাস্ত হয়ে পরে অন্য কাজে। প্রফেশনাল এঞ্জিনীয়ার কাশেম, রিয়াল এস্টেইট এজেন্ট কাশেম, স্বামী কাশেম, বাবা কাশেম, ফেইস বুক এক্টিভিস্ট কাশেম, বাড়িওয়ালা কাশেম- হেসে খেলে জীবন কাটানোর অভিপ্রায়ে মহাব্যস্ত কাশেম।
বাড়িওয়ালা কাশেম সম্পর্কে আরেকটু না বললেই নয়। একদিন শুনি, নিজে যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়ির খুব কাছাকাছি আরেকটা বাড়ি কিনছে কাশেম। আমি অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি, “হঠাৎ সেকেন্ড হোম কেন বন্ধু? বাংলাদেশের মন্ত্রী মিনিস্টাররা না হয় মালোয়েশিয়া আর কানাডায় সেকেন্ড হোম করে। কিন্তু তোর সেকেন্ড হোমের কি দরকার বুঝলাম না”।
প্রত্যুত্তরে কাশেম আমাকে এক নাতিদীর্ঘ লেকচার দেয়, “ শোন টরন্টো তে যে হারে ইমিগ্র্যান্ট আসছে, তাতে আগামী পাঁচ বছরে দেখবি বাড়ির দাম কেমন হু হু করে বাড়ে- দ্বিগুন, চাই কি তিন গুনও হয়ে যেতে পারে । তুই নিজে যে বাড়িতে থাকিস, তা যদি বেড়ে পাঁচ গুনও হয় তবু তোর কোন লাভ নেই। কারন বাড়িটা তো আর তুই বিক্রি করছিস না। কিন্তু ধর, সেকেন্ড হোম যদি থাকে, তাহলে পাঁচ বছর কোন রকমে ভাড়ার টাকা দিয়ে পেমেন্ট চালিয়ে যা, তারপর মোক্ষম সময়ে বিক্রি করে ফেল। তারপর লাভের টাকা থেকে নিজের থাকার বাড়িটা পেইড অফ করে দে। ব্যাস হেসে খেলে , হে হে, বুঝলি না”?
অতি সাবধানি আমি বলি, “ যদি বাড়ির দাম না বেড়ে কমে যায়”?
“ রিস্ক একটু থাকে বটে- নো রিস্ক, নো গেইন। সময় মত বেঁচে দিলেই হলো। আর সত্যিকার অর্থে টরন্টোতে বাড়ির দাম কমার কোন সম্ভাবনা নাই”।
সময়টা ছিল রোজার মাস। কাসেম একদিন আমাকে ফোন করে বলে, “কালকে জোহরের সময় একটু মসজিদে আসিস”। যারপর নাই বিস্মিত হই আমি, কাশেম যেতে বলছে মসজিদে? ঘটনাটা কী? ঘটনাটা সেই ভেঙ্গে বলে। ড্যানফোর্থ আর ভিক্টোরিয়া পার্কের কোনায় নতুন যে মসজিদ হয়েছে তার একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হচ্ছে কাশেম।
আমি বলি, “ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আবার কি বন্ধু”?
“ মসজিদ শুরুর সময়, আমি দশ হাজার ডলার ডোনেট করেছিলাম। তাই আমি এই মসজিদের আজীবন মেম্বার”।
“ ওহ! বুঝলাম, মানে জান্নাত গ্যারান্টেড? ভাল, খুব ভাল“।
“ ফাজলামো রাখ। কালকে মসজিদ কমিটির নির্বাচন। আমি অতিরিক্ত যুগ্ম সচিব পদে কম্পিট করছি। ফেইস বুক লাইভে এসে কালকে ক্যাম্পেইন করলাম। অলরেডি শত-পাচেক লাইক পরেছে।“
সত্যি সত্যি আমি অভিভূত হই কাশেমের কথা শুনে। আমি জানতাম না, বন্ধু আমার শুধু দুনিয়াতে না আখেরাতেও হেসে খেলে জীবন কাটানোর কোমড় বেঁধে নেমেছে। আমি জানতাম না, দশ হাজার ডলার দান করলে মসজিদের আজীবন সদস্য হওয়া যায়। আমি জানতাম না সোস্যাল মিডিয়া জগতে কাশেমের এত শুভাকাংখী আছে। কাশেম না জানালে, এই ধরার অনেক জ্ঞানই অধরা থেকে যেত।
।৬।
পাঠক, আমি আগেই বলেছি, আমি কাশেমের একজন অনুসারী। ওর বুদ্ধি। প্রজ্ঞা, সুদূর প্রসারী চিন্তা, হিংসা করি- বেজায় হিংসা করি। কাশেম যখন যেন তেন বলে চার আর ছক্কা হাঁকায়, তখন আমি হিংসায় জ্বলি। সেই সাথে ভাবি, শুধু ভাবি আর ভাবি- ইস আমি যদি কাশেম হতাম”! আমার সাধ্য থাকলে আমি ওকে একটা গণ-সংবর্ধনা দিতাম। ‘আমরা সবাই কাশেম হব’ নামের একটা সংগঠন করতাম। প্রতি বছর সেই সংগঠনের পক্ষ থেকে এক হালি দুই হালি করে কাশেম নির্বাচন করতাম আর ভ্যাজাল মিশ্রিত স্বর্ন পদক দিতাম। সাধ থাকলেও, সাধ্য নেই আমার। তাই সেই দুরূহ চিন্তা ভাবনা থেকে নিজেকে সন্তর্পনে সরিয়ে রেখেছি।

সংবাদটা আসে হঠাত, কিন্তু বড়সড় আওয়াজ দিয়ে আসে। কাশেমের ক্যান্সার হয়েছে- কোলন ক্যান্সার। সংবাদটা শুনে আমার মনে হলো কাছে ধারে যেন বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়েছে। আমি বধির হয়ে যাই, স্থবির হয়ে যাই যেন অনন্তকালের জন্য। এই তো সপ্তাহ খানেক আগেও কাশেমের সাথে আমার দেখা হোম ডিপোতে। এক গাঁদা মাল সামান কিনল বাড়ি মেরামতের জন্য। জিজ্ঞেস করায় বলল দ্বিতীয় বাড়িটা বিক্রি করে দেবে- হেসে খেলে টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফিট। তাই টুকাটাকি মেরামত চলছে। মাত্র ছয় মাস আগে কাশেম তার দুই বছরের পুরনো Honda Accord ট্রেইড ইন করে লেটেস্ট মডেলের Toyota Prius hybrid কিনল। দু’দিন আগেই তো ফেইসবুকে ওর আর ওর বউয়ের হাস্যোজ্বল ছবি দেখলাম, সেই সাথে জানলাম ওর নতুন প্রমোশনের খবর। ম্যানেজার হয়েছে কাশেম, শ’তিনেক ফ্রেন্ডস কংগ্রাচুলেট করেছে পোস্টটিতে। আমার প্রানের প্রিয় বন্ধু, সেই কাশেমের ক্যান্সার হয়েছে, কাশেমের?
কাশেম ভর্তি হয়েছে ‘প্রিন্সেস মার্গারেট’ হসপিটালে, আমি কাজ করি কলেজ স্ট্রীট আর ইউনিভার্সিটি এভিনিউ ইনটারসেকশনে- হাসপাতাল থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে। দু’একদিন পরপরই কাশেমকে হাসপাতালে দেখতে যাই। সেদিন ছিল শুক্রবার। বিকেল থেকে তুষারপাত শুরু হয়েছে। বছরের প্রথম তুষারপাত। তাপমাত্রা শুন্যের কাছাকাছি, খুব একটা ঠাণ্ডা নেই। কাজ শেষে হাটতে হাটতে চলে এলাম কাশেমঅকে দেখতে। দরজা খোলা কেবিনে নিঃশব্দে প্রবেশ করে দেখি কাশেম উল্টাদি কে পাশ ফিরে জানালা পানে তাকিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমাচ্ছে না জেগে আছে, বোঝা যাচ্ছে না। ছোট্ট করে একটা গলা খাকারী দিয়ে আমার উপস্থিতি জানানোর চেষ্টা করি। শব্দ শুনে পাশ ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পায় সে। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে- ঠিক যেন ক্ষয়ে যাওয়া এক ফালি বাঁকা চাঁদ।
“ সরি বন্ধু, ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম’?
“ নাহ, আমি জেগেই ছিলাম। শুয়ে শুয়ে তুষার পরা দেখছিলাম। আয় বোস”।
ইদানিং কি হয়েছে, কাশেমের চেহারার দিকে তাকিয়ে, ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারিনা। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। কি জানি, কাশেমও হয়ত ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাই হয়ত ওর শিয়রের পাশে চেয়ারটাতে বসার পরই, আবার জানালা পানে পাশ ফিরে শোয়।
“ কেমন আছিস দোস্ত”?
“ আলহামদুলিল্লাহ, ভাল। শুয়ে শুয়ে তুষারপাত দেখছিলাম। তুষার পরা দেখতে যে এত আনন্দের তা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া - -। কানাডা আসার পর প্রথম ‘ স্নো ফল’ দেখে বাচ্চা ছেলের মত আনন্দে গড়াগড়ি করেছিলাম। সে যে কী ভাল লাগা! আর আজকে হাসপাতাল বেডে মৃত্যু শয্যায় শুয়ে - - -। মাঝখানে চলে গেছে কতগুলি দিন, মাস আর বছর”। একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয় কাশেম সেই সাথে আমার দিকে পাশ ফিরে শোয়।
“ কিহ সব আবোলতাবোল বকছিস? ক্যান্সারে আজকাল কেউ মরে নাকি। মাত্র কয়টা কিমো পরেছে, তাতেই মাশাল্লাহ - -“। আমার বালখিল্য সান্ত্বনা বাক্যে খুব একটা কান দেয় না কাশেম। আবার শুরু করে সে, “ কি বিচিত্র এই পৃথিবী। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমি মানুষ। আমি কাশেম, আমি ইঞ্জিনীয়ার , আমি প্রিয়তম স্বামী , আমি প্রিয় বন্ধু , আমি প্রান প্রিয় বাবা আরও কত কি! আর মরার পর? আমি হয়ে যাব লাশ। লাশ কোথায়, কখন দাফন হবে, জানাজা কোথায় হবে? লাশ, আমি শুধুই লাশস”!
আমি এবার কাশেমের কপালে হাত রাখি সান্ত্বনা দেবার উদ্দেশ্যে। ওর কপাল বেশ গরম। হয়ত জরের ঘোরে প্রলাপ বকছে।
কাশেম আমার হাত টেনে ধরে নিজের বুকে উপর চেপে ধরে বলে, “ থাক দরকার নাই। ওরা দেখে ওষুধ দিয়ে গেছে। Its normal. একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। দোস্ত আমাকে একটা প্রমিস করবি”?
“কি”?
“ আমি মরে গেলে, আমাকে, মানে আমার লাশটাকে দেশে পাঠাবি প্লীজ। আমাদের গ্রামের শেষ মাথায় একটা কবরস্থান আছে। জায়গাটা খুব নিরিবিলি, গাছপালার ছায়া ঘেরা, খুব শান্তির জায়গাটা। কবরাস্থানের ঠিক উলটা দিকে মাদ্রাসা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে মুখর থাকে সারাটা সকাল। আমার মায়ের কবরের ঠিক পাশে যদি শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম, তাহলে হে হে সে খে লে কবরের জীবনটা। হি হি হি”, কাশেম হাসে, কষ্টের হাসি।
কাশেমকে কি বলব তা ঠিক বুঝতে পারি না আমি। এক হাত ওর কপালে আর আরেক হাত ওর বুকের উপর রেখে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি।
“ শৈশবের কথা মনে পরে তোর?”, আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে কাশেম। আমি কোন কথা বলি না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
“ আমার কেন যেন ছোট বেলার কথা খুব মনে পরে। আমাদের গাঁয়ের পশ্চিম দিক দিয়ে একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের সেই ছোট্ট নদী। আমাদের ছোট নদী, চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে - - - “। এই পর্যন্ত বলে কাশেম আবার বিরতি নেয়। আমিও কোন কথা বলি না। পিন পতন নীরবতা। কাঁচের শার্শীর বাইরে ধবল তুষার, অঝোরে ঝরছে।
নীরবতা ভেঙ্গে আবার কাশেম বলতে থাকে, “ সব কিছু কেমন যেন সিনেমার ফ্ল্যাশ ব্যাকের মত জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আজকাল। ছোট্ট নদী, বাঁশ ঝাড়, গভীর রাতে শো শো বাতাসের শব্দ, ডাহুকের করুণ আর্তনাদ, ঝি ঝি পোকার বিরামহীন ডাক, জ্বোনাকীর আলোকসজ্জা, কাল বৈশাখী ঝড়, টিনের চালে আম পরা, ঝুম বৃষ্টি, হলুদ সবুজ শর্ষে ক্ষেত, চারিধারে মো মো গন্ধ। মনে হয় এই তো মাত্র সেদিনের কথা। গ্রাম থেকে একসময় চলে আসলাম মফঃস্বল শহরে। সেখান থেকে ঢাকা শহর, ঢাকা থেকে সোজা উড়াল লস এঞ্জেলস, লস এঞ্জেলেস থেকে এ স্টেইট ও স্টেইট ঘুরে প্রিয় শহর টরন্টো। স্ত্রী, সংসার, সন্তান- মায়ার বাঁধন। আমার বাচ্চা দুটো এমন হয়েছে জানিস, আমাকে ছাড়া ঘুমাতেই পারে না। তুলতুলে হাত দিয়ে ওরা যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে, আদর করে, চুমু খায়। আহ সে যে কি সুখ, কি যে শান্তি”।
কাশেম তার দু’হাত নিজের গালে বুলাতে বুলাতে ডুকরে কেঁদে ওঠে, “ আমি বাঁচতে চাই দোস্ত, আমি বাঁচতে চাই। টাকা পয়সা কিছু চাই না, বাড়ি গাড়ি, খ্যাতি কিচ্ছুই চাই না আমি। আমি শুধু বাঁচতে চাই। আমি শুধু আমার বউ বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাই। এ মায়ার বাঁধন ছেড়ে যেতে চাই না আমি”।
কাঁদছে কাশেম, অঝোরে কাঁদছে। আমিও কাদছি। কাশেমের সাথে পাল্লা দিয়ে টপ টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পরছে আমার কপোল বেয়ে।
সেদিন অনেক রাতে ঘরে ফিরে দেখি সবাই গভীর ঘুমে। চুপিসারে আমার ছয় বছরের ছেলেটার পাশে গিয়ে শুয়ে পরি। ছেলেটা আমাকে ছাড়া ঘুমাতেই পারে না। আজকে হয়ত অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। ছেলেটা ঘুমের ঘোরেই আমার মুখে হাত রাখে। অন্ধের মত হাতের তালু দিয়ে গলা, গাল, থুতনিতে হাত বুলিয়ে নিশ্চিত হয় তার বাবার অস্তিত্ব। তারপর আমার গলা জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায়। আমি বুক ভরে গন্ধ নিই। আমার সন্তানের গায়ের গন্ধ। সেই গন্ধ নিঃশ্বাসের সাথে মিশে যায় আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, প্রতিটি রক্ত কণায়। আহ শান্তি, কি যে শান্তি। এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই।
স্বপ্নে কাশেমকে দেখি। দেখি কাশেম দৌড়াচ্ছে অচেনা এক রাস্তা দিয়ে। আমিও ওর পেছনে ছুটছি। ছুটছি আর ছুটছি। হঠাৎ অনেক গুলো রাস্তার সংযোগে এসে কাশেমকে আর না দেখতে পেয়ে থেমে যাই। আমার সামনে, পিছনে, ডাইনে, বাঁয়ে শুধু দর্পন। দর্পন আর দর্পন। সেই দর্পনে এক ঝলক নিজেকে দেখতে পাই। পরমুহূর্তেই আর নিজেকে দেখতে পারি না। দেখতে পাই কাশেমের প্রতিচ্ছবি। আমার সামনে পেছনে, ডাইনে, বাঁয়ে শুধু কাশেম আর কাশেম। আমি আর আমাতে নেই, কাশেম হয়ে গেছি।
মামুন খান
Brampton
March 23, 2019
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৯ রাত ১০:৩০
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×