বউয়ের সাথে বনছে না, জেফ বই কিনে তাঁর সমাধান খুঁজছে। একদিন তাঁর রুমে যেয়ে দেখি ডেস্কের উপর একটি বই, Men are from Mars Women are from Venus. জিজ্ঞেস করলাম
‘বইটা কিসের উপর লেখা?’
‘আবউট রিলেশনশিপ।’
‘ইন্টারেস্টিং টপিক, রিলেশনশিপ নিয়ে কোন সমস্যা?’
‘বড্ড কঠিন সময় পার করছি, বউয়ের সাথে বনছে না।’
জেফ সুদর্শন ভদ্রলোক, লম্বা, সোনালী চুল, দুই কানে বড় বড় দুল, পেশাদার ভদ্রলোকের কানে দুল বেমানান লাগে।
প্রথম যেদিন তাঁর সাথে দেখা হয় জিজ্ঞেস করেছিল,
‘এই শহরে কোথায় উঠেছো?’
‘ডাউনটাউন, পার্কভিউ এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স।’
‘ও আচ্ছা।’
ডাউনটাউন সুন্দর, ফুল গাছে ঘেরা মনুমেন্ট আছে, সকালে দৌড়াতে সেখানে ভালো লাগে। ওখানে বারগুলি খুব কাছাকাছি।
‘কালকে বিকালে হাঁটলাম ওখানে’
‘আমি সেখানে ছিলাম কিছুদিনের জন্য, ডাউনটাউন সব পুরান বিল্ডিং, রাতে কেমন জানি ভৌতিক লাগে।’
‘ও তাই নাকি’
একটু থেমে সে বলল,
‘কয়েক দিন থাকার পর রাতে দুঃস্বপ্নে দেখতাম, দেখতাম আমার রুমটা ভেঙে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। আর আমি সিঙ্কহোলএ(sinkhole) পরে যাচ্ছি। কোন কিছুই আঁকড়ে ধরতে পারছি না। বিছানা, ড্রেসার, সব কিছুই আমার সাথে পড়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতি রাতেই এই স্বপ্ন দেখার পর আর ঘুমাতে পারতাম না। পরে সেই এপার্টমেন্ট ছেড়ে দেই।’
আরেক দিন জিজ্ঞেস করলাম,
‘কেমন যাচ্ছে দিনকাল?’
‘বউয়ের সাথে ভালো যাচ্ছে না। সে আমাকে সামুকের খোলস বলে, অফিস থেকে বাসায় ফিরে সে চায় আমি তাঁর সাথে বসে সারাক্ষণ টিভি দেখি, খুবই বোরিং, তাঁর চেয়ে ভিডিও গেম অনেক আনন্দের।’
‘কেন, Men are from Mars Women are from Venus বইএর এডভাইজ প্রয়োগ করোনি ?’
‘ফাকিং এডভাইজ।’
‘তাহলে এখন কি করবে?’
‘একটা সেমিনারে যাবো। ‘101 Ways Couples Can Improve Their Relationship’
অর্থাৎ ভালো রিলেশনশিপের ১০১ টা উপায়। আমি বুঝলাম এ যুগের ডেল কার্নেগির সেমিনার। এখন এরা অনেক কিছুতেই ‘১০১’ সংখ্যাটা জুড়ে দেয়। আমি বললাম,‘এতেও যদি কাজ না হয়?’
‘হতেই পারে, আর কিই বা করার আছে?’
আমি একটু হেসে বললাম,‘কাজ না হলে সেমিনারওয়ালাকে টোমেটো সস ছুঁড়ে মেরো!’
জেফ নাকি সুরে বেশ খানিকটা হাসলো। আমি ভাবতে লাগলাম দেশে থাকতে ভাবতাম এরা তুচ্ছ ব্যাপারে সম্পর্ক ছিন্ন করে কিন্ত এখানে এসে দেখলাম এরাও চায় বিয়ের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে।
সাধারণত আমি জেফের রুমে যাই, কিন্ত একদিন সেই আমার রুমে এলো। জানতে চাইলো,
‘এই উইকেন্ডে ফ্র্রি কিনা?’
‘কেন?’
‘বাসা বদলাচ্ছি।’
‘হেল্প লাগবে?’
‘তোমার সাহায্যকে appreciate করি।’
‘কবে, শনি না রবি?’
‘রবি, একটা বড় বাসা কিনলাম, 'জেসিকার ইচ্ছা আরো বড় বাড়ির, সেও একটা নতুন কাজ নিয়েছে, পে রেট খুব ভালো, দুজনের আয়ে হয়ে যাবে।,
‘অভিনন্দন, আমি আসছি।’
বুঝলাম এখন স্বামীস্ত্রীতে ভালোই বনিবনা হয়েছে, হয়ত সেমিনারের কোন পরামর্শ ছিল বড় বাড়ি কেনার, নতুন কিছুতে মেতে উঠা যাতে জীবনের একঘেয়েমি দূর হয়।
জেফকে ইদানিং দেখলে খুব সুখী সুখী লাগে, বাসা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে নতুন নতুন প্রজেক্ট করে, যেমন বেজমেন্টে রিক্রিয়েশন রুম বানালো, সেই রুমে ভিডিও গেম খেলার ইলেকট্রনিক্স স্থাপন করল, ব্যাকএয়ার্ডে কুড়ি ফুট লম্বা বিশাল ডেক(deck) বানালো। তাঁর অফিস রুমের বোর্ডে বেজমেন্ট আর ডেক তৈরী করার বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি, সবাইকে তাঁর এগুলো বানাতে কি কি ধরণের চ্যালেঞ্জ পোহাতে হয়েছে তা খুব আগ্রহ নিয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করে। আমাদের কয়েক সহকর্মীকে একদিন BBQ করে নতুন ডেকে বসে লাঞ্চ করালো।
এরা গ্রীষ্মকালে ছুটি নিয়ে ভ্যাকেশনে যায়, জানতে চাইলাম, যাচ্ছ কোথাও ভ্যাকেশনে?
‘ভ্যাঙ্কুভার’
‘চমৎকার টুরিস্ট শহর, একবার গেছি, কি প্ল্যান সেখানে?’
পৃথিবীর সেরা গেমাররা আসবে, স্টেডিয়ামে বিশাল টিভি স্ক্রিনে তাদের খেলা লাইভ দেখা যাবে, পঁচিশ হাজার দর্শক, দারুন উত্তেজনা।’
আমি অনুধাবন করলাম সে মস্ত ভিডিও গেম পাগল মানুষ, এই উত্তর আমেরিকার মানুষগুলোতে কমবেশি সকলের মধ্যেই পাগলামি আছে, আমার এক হাইকিং পাগল সহকর্মী ছুটিতে বান্ধবীকে নিয়ে তাঞ্জানিয়ায়ায় গেল কিলিমাঞ্জরের চূঁড়ায় কুড়ি হাজার ফিট হেঁটে হেঁটে উঠবে।
একদিন একটা ইমেইল পেলাম, জেসিকা স্মিথ লিখেছে তাঁর স্বামী জেফের জন্মদিনের দাওয়াত ফিওন ম্যাককুল নামে আইরিশ রেস্তোরাতে। ইমেইলে লেখা আছে স্ন্যাক দেওয়া হবে। অর্থাৎ রাতের ডিনার নিজের পয়সায় খেতে হবে। ফুলের তোড়া নিয়ে সে রাতে আমি জেফের জন্মদিনে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় সময় পার হয়ে যাচ্ছিল, এক সময় দেখি একদল লোক আইরিশ স্কার্ট পড়ে আমাদের টেবিলগুলোর পাশ দিয়ে আইরিশ বাঁশী বাজাতে বাজাতে চলে গেলো, সাথে সাথে জেসিকা এক বিরাট কেক নিয়ে হাজির, কেকের উপরিভাগের পুরোটা একটা ভিডিও গেমের জয়স্টিক, অসাধারণ নৈপুণ্যে তৈরি। হালকা বাদামি রঙের টপ স্কার্ট আর ফ্যাশনেবল চশমায় জেসিকাকে দারুন মানিয়েছে, হলিউডের নায়িকার মত লাগছে। সে বললো,
‘ভিডিও গেম জেফের খুবই পছন্দের তাই আমার এই সারপ্রাইজ, জেফ আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলে ছোট্ট একটা চমু দিলো।
সবাই গাইতে লাগলো, শুভ জন্মদিন তোমাকে, প্রিয় জেফ তোমাকেই।
মাঝে মাঝে ইমেইল আসে সে অসুস্থ, আজকে কাজে আসবে না। এই অসুস্থতা দেখলাম সোমবার গুলোতে হচ্ছে। এটা ফাঁকিবাজির অসুস্থতা, শনি,রবি দুদিন ছুটির পর আরো একদিন ছুটি, অর্থাৎ টানা তিনদিন ছুটি। এই ফাঁকিবাজি আগে তার মধ্যে দেখিনি। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা কি, সে জানালো রবিবারে তাঁর ভিডিও গেমের নেশাটা খুব বেড়ে যায়, খেলতে খেলতে সকাল হয়ে যায়।
একদিন সকালে দেখি ক্যাফেটেরিয়াতে সবাই কেমন জানি ফিস ফিস করে কথা বলছে, মাঝে মাঝে জেফ জেফ শব্দটা কানে আসছে। আমি সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি ব্যাপার জেফের কিছু হয়েছে?’
একজন জানালো ‘ও এখন পুলিশের কাস্টডিতে।’
আমি আকাশ থেকে পড়লাম,
‘কি করে সম্ভব এটা?’
‘আমরাও তাই ভাবছি।’
‘কি করেছে ও?’
‘পাশের বাড়িতে গুলি করেছে।’
‘হাই খোদা!’
এ সপ্তাহে বাকি দিনগুলোতে তাঁকে অফিসে দেখতে পেলাম না, পরের সপ্তাহে আসলো। সকালে তাঁর রুমে সহকর্মীরা জটলা করে নিচু স্বরে কথা বলছে, বুঝতে পারলাম সবার কৌতূহল ঘটনা জানার জন্য। আমি আর তার রুমে গেলাম না, কাজে ডুবে গেলাম, ভাবলাম লাঞ্চ আওয়ারে যাব। লাঞ্চ আওয়ারেও দেখি অনেকেই তার সাথে। দিন শেষে তাঁর রুমে গেলাম, বললাম,
‘হেই ম্যান, হোয়াটস আপ?’
‘ইটস এ লং স্টোরি।’
‘ঠিক আছে, বড় গল্পকে ছোট কর।’
‘প্রতি রাতের মতো আমি ভিডিও গেম খেলছিলাম। খুবই উত্তেজনাময় খেলার অবস্থা, আমার অনলাইন পার্টনার আর আমি মিলে বিরোধী দলের অবস্থা কাহিল করে দিয়েছি। আর পাঁচ মিনিট খেললেই জিতে যাব। এমন সময় জেসিকা এসে বলল তাঁর ঘুম পেয়েছে। বললাম, অল্প একটু পরেই গেম শেষ করে আসছি, ততোক্ষণ নিজে ঘুমুতে চেষ্টা কর।’
জেসিকা বললো,
‘এতক্ষণ নিজেই চেষ্টা করলাম, আর পারছি না।’
জেফ বলল, ‘তোমাকে বলা হয়নি, রাতে ঘুমুবার আগে আমি জেসিকার পিঠে কিছুক্ষণ সুড়সুড়ি দেই এবং এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। বদ অভ্যাসটা আমিই করিয়েছি , কিন্ত জেসিকার এটা ছাড়া নিদ্রা আসে না, আমি তাকে খুব ভালবাসি তাই এখনো করে যাচ্ছি।’
আমি আকাশ থেকে পড়ি, বুঝতে দেই না, মনে মনে ভাবি, এ ও সম্ভব! বললাম, ‘আমি আমার বাচ্চাকে এভাবে ঘুম পাড়াই।’
জেফ বলল, ‘একদম ঠিক, সে আমার বেবি।’
‘তো, তারপর কি হোলো?’
‘আমি খেলা বাদ দিয়ে তাকে সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করলাম, কিন্ত মনের মধ্যে তখন খেলার উত্তেজনা, ভাবছি আমাকে ছাড়া অনলাইন পার্টনার খেলায় জিতবে কি করে? মনে তখন ভিডিও গেমের দৃশ্য, অজান্তে আমার সুড়সুড়ি দেউয়ার গতি বেড়ে যায়, জেসিকা বিরক্ত হয়ে বলে, ঠিক করে দাও। আবার আমি আস্তে আস্তে হাত বুলাতে থাকি কিন্ত কিছুক্ষন পরে আবারো হাতের তালু জোরে চলতে থাকে। জেসিকা বলে,আজ এরকম করছ কেন? পাশের রুমে তখন ভিডিও গেম স্ক্রিন অন আছে, অটোমেটিক হ্যান্ডগানের আওয়াজ আসছে, আর সহ্য হয় না, মনে হয় যেয়ে দেখি খেলার কি অবস্থা। এদিকে জেসিকারও ঘুম আসে না। জেসিকা বিরক্তি ভরে বলে, ভিডিও গেম কিলিং ইয়উ। আমারও মেজাজ এরি মধ্যে সপ্তমে চড়ে ছিল, যে হাতের তালু দিয়ে পিঠে হাত বুলাচ্ছিলাম সেই হাত দিয়েই সজোরে মারি, চাটাস করে শব্দ হয়। জেসিকা লাফ দিয়ে উঠে বলে, তুমি আমাকে মারলে! আমিও তোমাকে মারব। এই বলে সে বালিশ দিয়ে আমার মাথায় মারে, আমিও তখন বালিশ দিয়ে তাঁর মাথায় মারি। এইভাবে কিছুক্ষণ বালিশ মারামারি চলতে থাকে, ক্লান্ত লাগে তবু সে হাল ছারে না, এক সময় প্রচন্ড জোড়ে মারি, বালিশ আটকে যায় তার কানে, হেচ্কা টান মারি, জেসিকা ওহ মাম বলে চিৎকার উঠে, কান বেয়ে রক্ত পড়তে থাকে, কানের দুল বালিশে খুলে আসে। আমি দুঃখিত প্রিয়তমা, বলে রক্তাত কানে হাত দেই। আমার হাত সরিয়ে দেয়, বলে, আমাকে স্পর্শ করবে না। আমি ব্যান্ডেজ নিয়ে আসি, সে ফুঁপাতে ফুঁপাতে কাঁদতে থাকে। কাছে গেলে বলে, আমাকে একা থাকতে দাও। আমি লিভিং রুমে এসে বসি। জেসিকা দরোজা বন্ধ করে দেয়। প্রচন্ড খারাপ লাগতে থাকে, ভিডিও গেম বন্ধ করে দিই, দরোজায় নক করি, সে কোন জবাব দেয় না। রাত বাড়তে থাকে, তাঁর কান্না থেমে আসে, ফ্রিজ থেকে বিয়ার বের করে খাই, আবার দরোজায় নক করি, সে কোন জবাব দেয় না। তাঁর ফোনে একটা টেক্সট করি, দুঃখিত প্রিয়তমা আর এরকম হবে না। সে টেক্সটের কোন জবাব দেয় না। কানের দুলটার কথা ভাবতে থাকি, এই দুলটা আমি তাঁকে সম্পর্কের শুরুতে জন্মদিনে দিয়েছিলাম, সিলভারের দুল, এমন কিছু দামি নয়, পড়ার পর ভারি সুন্দর লাগছিল, বলেছিলাম, তোমাকে ষ্টার-ওয়ার ছবির লেইআ অর্গানার মত লাগছে।’
জেফ হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে, চোখ বন্ধ করে। আমি বললাম, ‘তারপর?’
‘তারপর আমি লিভিং রুমে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি, ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নে, দেখি রুমটা ভেঙে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে, আমি সিঙ্কহোলে পরে যাচ্ছি। ঘুম ভেঙে যায়, আমি আর ঘুমুতে পারি না। আরো বিয়ার খাই কিন্ত ঘুম আসে না, অন্যদিকে জেসিকার গায়ে হাত তোলা ভাবলে আমার অসহ্য লাগে, আমি মুক্তি পেতে চাই অপরাধ থেকে, ক্ষমাহীন নির্ঘুম রাত চাই না। পিস্তলটা বের করে আনি, গুলি লোড করে মাথায় ঠেকাই, ট্রিগারে হাত দিই, অনেক চেষ্টা করি কিন্ত টানতে পারি না। শেষমেষ ট্রিগার টানি, গুলি বের হয়। আমি মরে যাচ্ছি মনে করে পড়ে থাকি। জেসিকা দরজা খুলে বের হয়ে আসে, আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে, চিৎকার করে কেঁদে বলে উঠে, আমার বেবির কি হলো! আমার বেবির কি হলো! আমি বলি, আমি ঠিক আছি, ভালো আছি। মাথায় হাত দিই, দেখি কোথাও রক্ত নেই, মনের অজান্তে মাথা আগেই সরে গিয়েছিল, গুলি জানালা ভেদ করে প্রতিবেশীর ঘরের দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। তারপর পুলিশের আগমন।'
আমি বললাম,
‘তারপরে তুমি কি আবার তাঁকে ঘুম পাড়াবার জন্যে পিঠে হাত বুলিয়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করলে?’
‘না সে রাতের পর থেকে তাঁর এমনি ঘুম আসে, এরপর থেকে আমিও আর ভিডিও গেম খেলি না। জানো, আমাদের জীবনটা ক্যাডিলাক গাড়ির মত দামি আর চকচকে অথচ আমরাই তাকে অটোমেটিক হ্যান্ডগানের গুলি দিয়ে ঝাঁঝরা করে ফেলি।’