অনেকে মনে করেন প্রাণের উৎপত্তি আপনা আপনি হতে পারে না। প্রাথমিক আদিকোষ এর উদ্ভবের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। তাদের জন্যই আজকে লিখছি।
সম্প্রতি ক্রেগ ভেন্টর তার সিন্থেটিক লাইফের গবেষণা থেকে প্রথম কৃত্রিম জীবকোষ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। আর সিডনি ফক্স কৃত্রিমভাবে প্রোটোএলাইভ বা জীবন সদৃশ মাইক্রোস্ফিয়ার তৈরি করেছেন (এর সম্পর্কে পরে আলোচনা করছি)। আর প্রাথমিক আদিকোষের প্রোটিন এখনকার প্রাণীদের প্রোটিনের মত ছিল না। সরল প্রোটিনয়েড থেকে ধাপে ধাপে নেচারাল সিলেকশন এর পর এখনকার এনিমেলের মত প্রোটিন এসেছে। এর সম্পর্কেও আলোচনা করছি।
প্রথমে একটা কথা বলে রাখি, বর্তমান পৃথিবীতে জড় থেকে প্রাণ সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব হলেও আদিম পৃথিবীর জন্য এটা অসম্ভব ছিল না। এধরণের কথা প্রথম জনসন্মুখে তোলেন ওপারিন এবং হাল্ডেন। তাদেদ তত্ত্ব মতে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল পাঁচ থেকে ছয় হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস, অক্সিজেন ছিলনা। হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, নাইট্রোজেন, মিথেন, এমোমিয়াম, জলীয় বাষ্প, খনিজ পরার্থ এসব ছিল। রিড্যুসিং বা বিজারক পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। পরে পৃথিবীর অভ্যন্তরের চাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে আর সূর্যের মহাকর্ষ টানে প্রাথমিক গ্যাসগুলো উড়ে যায়। যতটুকু অক্সিজেন ছিল তা অন্যান্য মৌলের সাথে মিলে অক্সাইড, কার্বন ধাতুর সাথে মিলে মেটাল কার্বাইড তৈরি করে। এভাবে পরে কার্বন ডাই অক্সাইড, সিলিকন ডাই অক্সাইড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, হাইড্রোফ্লোরিক এসিড, কার্বন অনোক্সাইড এসব তৈরি হয়। ওজনস্তর ছিলনা বলে এক্স রে, গামা রে এর বিকিরণের ফলে এইসব যৌগ জৈব রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে। পরে এরা নিজেদের মধ্যে ইন্টারেকশনের ফলে জটিল জৈব যৌগের সৃষ্টি করে। এগুলো থেকে পরবর্তিতে ঝিল্লী, ঝিল্লীবদ্ধ জৈব পদার্থ এর এনজাইম তৈরি দ্বারা বিপাকীয় ক্ষমতা অর্জন, পরে বংশগতির সংকেত প্রস্তুতির দ্বারা নিজের প্রতিকৃতি তৈরি ও মিউটেশন, সেখান থেকে আদি ও সরল জীবনের উদ্ভব। প্রথম দিকে তা ছিল অকোষীয়, পরে সেখান থেকে কোষীয় জীবনের সূত্রপাত।
ওপারিন-হাল্ডেন এর তত্ত্ব পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানী ইউরে-মিলার কৃত্রিমভাবে আদীম পরিবেশ সৃষ্টি করে সেই সময় থাকা গ্যাসগুলো থেকে এমিনো এসিড তৈরি করতে সক্ষম হন। পরে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ২০টির মধ্যে ১৮টিই এভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়। কিন্তু শুধু ল্যাবরেটরিতেই যে ওপারিন-হাল্ডেন তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় তা নয়। মহাকাশের তারা, ধূলিমেঘ ইত্যাদিতে জৈব মনোমার পাওয়া যায়। হ্যালির ধুমকেতুতে তো এল্ডিহাইড, এলকোহল ছাড়াও ফর্মাল্ডিহাইডের পলিমার পাওয়া গেছে। মহাকাশ থেকে আসা উল্কাপিণ্ডে জটিল জৈব পদার্থ পাওয়া যায়। চাদে প্রকৃতিতে পাওয়া ৬টি এমিনো এসিড পাওয়া যায়। একারণে আদি প্রাণের উৎস্য বাইরে থেকে আসার ধারণাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এছাড়া পৃথিবীতেই দেখা যায় নির্বাত প্রক্রিয়ায় আগ্নেওগিরির ধাতব কার্বাইড আর গলিত লাভা পানির সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোকার্বন তৈরি করে।
যাই হোক এই পরীক্ষার দ্বারা প্রাথমিক জৈব উপাদানগুলো পাওয়া গেলেও জীবন গঠনের জন্য এটিপির মত জীবন গঠনের জন্য অণুর ধারণা পাওয়া যায় না। এর জন্য সিমুলেশন এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে যার থেকে এটিপি সহ আরও গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা পাওয়া গেছে। জীবনের ভিত্তি এই সিমুলেটেড পরীক্ষারই ফল বলে ধরা হয়। অনেকে মনে করেন এর মাধ্যমে সমুদ্রের গভীর তলদেশে উত্তপ্ত ঘন স্যুপে জীবনের সরল অণু তৈরি হয়েছিল। আবার অনেকে ভাবেন এর উদ্ভব সমুদ্রে ডুবে থাকা পাথুরে খনিজ বা কাদামাটিতে যা এখনকার মত না। বিভিন্ন কোয়ার্টজ, সিলিকেট এর জলীয় আবরণে এগুলো তৈরি হয়। এমিনো এসিডগুলোর পরষ্পর বিক্রিয়ার দ্বারা ডিহাইড্রেশনের মাধ্যমে যে পলিপেপটাইড বা প্রোটোপ্রোটিন তৈরি হয়েছিল তাতে এই খনিজ অনুঘটকের কাজ করেছিল। অধুনা অনেক জৈব রাসায়নিক পদার্থ তৈরির কারখানায় অনুঘটক হিসেবে খনিজ ব্যবহার করা হয়। এগুলোর পরে পরীক্ষার দ্বারা পরবর্তী ধাপগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সিডনি ফক্স মিলারের এমিনো এসিড, এসপারটিক এসিড আর গ্লুটামিক এসিড নিয়ে ১৩০ থেকে ১৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায়য় উত্তপ্ত করে প্রোটিনের মত দ্রব্য পান যাকে প্রোটিনয়েড বলা হয়। এগুলোকে ঠাণ্ডা করে পানিতে সেদ্ধ করলে পাওয়া যায় ঝিল্লীবদ্ধ প্রোটিনয়েড মাইক্রোস্ফিয়ার।
এই মাইক্রোস্ফিয়ারগুলো দেখতে আদিকোষের মত। এগুলোকে কৃত্রিমভাবে ফসিল বানিয়ে দেখা যায় ৩০০ কোটি বছর আগেকার প্রাথমিক ফসিলগুলোর সাথে অবিকলভাবে মিলে যায়। এই মাইক্রোস্ফিয়ার সম্পর্কে কিছু বলতেই হয়। এরা দুই স্তর বিশিষ্ট প্রোটিন দ্বারা তৈরি ঝিল্লী দ্বারা আবদ্ধ যাদের বাইরের স্তরটা এখনকার কোষের মত। এরা প্রোটিনয়েড শোষণ করে বড়ি হয়, এরা ইস্ট, ব্যাক্টেরিয়ার মত নাড়াচাড়া করে, অঙ্কুরিত হয়, বিভাজনে সক্ষম, এটিপি পেলে বিচিলন ক্ষমতা বাড়ে, এদের অসমোসিস আর সিলেক্টিভ ডিফ্যুশন ধর্ম আছে যা কেবল জীবিত কোষেই দেখা যায় কিন্তু নিউক্লিক এসিড (DNA, RNA) নেই। এদের কি জীব বলা যাবে? ফক্স বলেন জীব না তবে প্রোটো এলাইভ বা জীবন সদৃশ বলা যাবে। কেন, জীবন বললে কি হত? কারণ বিজ্ঞানীদের কাছে জীব ও জড়ের মাঝখানের সীমারেখাটি খুব একটা পরিষ্কার না। এসম্পর্কে কিছু আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। জড় থেকেই যেহেতু জীবের উদ্ভব তাই জড় আর জীবের মধ্যে এমন একটা সীমারেখা টানতে হবে যার আগের সব কিছুকেই জড় আর পরের সব কিছুকেই জীব বলা যায়। ভাইরাস নামে একটা বিশেষ ধরণের জিনিস আছে যা পোষক দেহে জীব আর বাইরে জড় হয়ে যায়। এর চাইতেও সরল জিনিস আছে। এর নাম ভিরয়েড যা প্যাচানো সরল জেনেটিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। এদের জন্য গাছপালায় বিভিন্ন ধরণের রোগ হয় যেমন coconut cadang cadang, tometo bunchy top ইত্যাদি। পরে এদের চেয়েও সরল জিনিস পাওয়া গেছে যা সবচেয়ে ছোট ভাইরাসেরও ১০০ ভাগের একভাগ থেকে ১০০০ ভাগের একভাগ পর্যন্ত হয়। এদের মধ্যে কোন জেনেটিক উপাদান নেই। কেবল প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এরাও জীবকোষে ঢুকে বংশবিস্তার করে। গবাদি পশুর scrapie, mad cow ইত্যাদি রোগের জন্য এরা দায়ী। এই প্রিয়নের অস্তিত্বই প্রমাণ করেছে যে নিউক্লিক এসিড ছাড়াও কোন জিনিস জীবের মত আচরণ করতে পারে। তাই জীব আর জড়ের সীমারেখাটা ভাইরাস না প্রিয়ন ঠিক কিসের উপর দিয়ে টানা হবে তা বের করাটা মুশকিল।
এতে আর কোন সন্দেহ নেই যে এই মাইক্রোস্ফিয়ার এর মত জিনিসগুলোই ছিল আদি কোষ। এখন প্রশ্ন হল এগুলোর মধ্যে নিউক্লিক এসিড ঢুকল কিভাবে? প্রোটিন আগে না নিউক্লিক এসিড আগে তৈরি হয়েছে? প্রোটিন তৈরির জন্য লাগে নিউক্লিক এসিড যা এমিনো এসিড থেকে প্রোটিন সংশ্লেষণ করে আর নিউক্লিক এসিড তৈরির জন্য লাগে এনজাইম যা একধরণের প্রোটিন। এই প্রশ্নের সাম্ভাব্য দুটি উত্তর আছে। একটা হল ফ্রিম্যান ডাইসনের প্রোটিন ফার্স্ট মতবাদ যা বলে আদি প্রোটিন থেকে নিউক্লিক এসিডগুলো তৈরি হয়েছিল এবং তখন এনজাইমের প্রয়োজন হয় নি। এই প্রোটিনগুলোর প্রতিরূপায়নের ক্ষমতা ছিল। রেজা ঘাদিরি দেখান যে পেপাটাইড শিকল সত্যি প্রতিরূপ সৃষ্টিতে সক্ষম। এছাড়া প্রিয়ন নিজেও প্রোটিনের প্রতিরূপের উদাহরণ। আর একটা হল RNA world এর ধারণা। সরল রাইবোজাইম থেকে RNA তৈরি হয় যারা এরা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারত এবং প্রতিরূপ তৈরি করতে পারত। দেখা গেছে আদি RNA এর এই কাজ করার ক্ষমতা ছিল। তখন DNA বলতে কিছু ছিল না। এখনো কিছু ভাইরাস আছে যাদের DNA এর বদলে কেবল RNA আছে। এই RNA এমিনো এসিডের সাথে যুক্ত হয়ে প্রোটিন অণু তৈরি করত।
প্রথমে তৈরি হয়েছে ছোট একতন্ত্রী RNA অণু যা এনজাইমের সাহায্য ছাড়া প্রতিরূপায়নে এবং প্রোটিন তৈরির অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। অনুঘটকের ঘটকালিতে তৈরি প্রোটিনের সাথে RNA সংস্পর্শে আসায় RNA এর স্থায়িত্ব বেড়ে যায়, এরা লম্বা হয় আর প্রতিরূপায়নে দক্ষ হয়। প্রতিরূপায়নের কিছু ভূলের কারণে RNA থেকে DNA তৈরি হয়। এটা RNA থেকেও বেশি লম্বা, স্থায়ী, তথ্য অনেক বেশি নিরাপদে সঞ্চিত থাকে। প্রোটিনের সাথে সহাবস্থানের কারনে এর কার্যকারিতাও বেড়ে গেল। ভাইরাসের মত সরল জীবের তৈরি হল। পরে নিউক্লিওপ্রোটিন (নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিনের সমষ্টি) ও বিভিন্ন অণু নিয়ে ঝিল্লীবদ্ধ কোষের তৈরি হল।শক্তির সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়ায়, প্রকৃতিতে টিকে রইল তারাই যারা প্রোটিনকে এনজাইমে রূপান্তরিত করে সরল উপাদান থেকে জটিল বস্তু তৈরী করতে পারত, আর সেসব দ্রব্য থেকে শক্তি নির্গত করতে পারত। প্রোক্যারিয়ট তৈরি হল। শ্বসনের ফলে অক্সিজেন তৈরি হওয়ায় প্রকৃতিতে বিজারক থেকে জারক পরিবেশ তৈরি হল।
প্রোক্যারিয়ট তৈরির পর এদের একেকটার একেকভাবে বিবর্তন হয়। কোনটার হয়তো ফ্লাজেলা আছে, কোনটা বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণে বেশি পারদর্শী, কোনোটার ক্লোরোফিল আছে। বিভিন্ন ধরণের প্রোক্যারিয়ট একত্রে কাছে আসার ফলে দেখা গেল সংঘবদ্ধ ভাবে থাকায় এদের পারিপার্শ্বিক দক্ষতা বেড়ে যায়। এভাবে মেলামেশার ফলে সংঘবদ্ধ প্রোক্যারিয়ট থেকে ইউক্যারিয়ট এর আবির্ভাব ঘটেছে। সংঘবদ্ধ প্রোক্যারিয়ট থেকে তৈরি বলে এদের আয়তন ও জেনেটিক পদার্থের পরিমাণও বেশি থাকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্রোমোজোম নিয়ে বিভাজন মুশকিল বলে এদের একত্রে ধরে রাখার জন্য নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। এভাবেই জড় থেকে প্রকৃত এককোষী জীবের উদ্ভব।
প্রাণের উদ্ভব