somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফতোয়ার শিকারঃ নুরজাহানের আত্মহনন

১০ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১০:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সংবাদপত্রের কল্যাণে ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার লাভ করলে বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ এ ঘটনার প্রতিবাদে রুখে দাড়ান। দেশের নারী আন্দোলনের প্রথম সারীর নেত্রী বেবী মওদুদ, এডঃ আয়েশা খানম, মালেকা বেগমসহ জাতীয় দৈনিক গুলোর নামী দামী সাংবাদিক, কলামিষ্ট, লেখকদের অনেকেই ছুটে আসেন এ অখ্যাত গ্রামে।
আজ থেকে ১৫ বছর আগের কথা

সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড় টিলা বেষ্টিত ছোট একটি গ্রাম ছাতকছড়া। সেই গ্রামের আশ্রব উল্লার যুবতী কন্যা নুরজাহান লক্ষী ছিলো ভাই বোনদের মধ্যে চতুর্থ। নুরজাহান বেগম এর প্রথমে বিয়ে হয় শেরপুর এলাকার আব্দুল মতিনের সঙ্গে। বিয়ের পর দীর্ঘ দিন স্বামীর কোন খোজ খবর না থাকায় পিতা আশ্রব উল্লা মেয়ে নুরজাহানকে নিয়ে আসেন ছাতকছড়া গ্রামের নিজ বাড়ীতে। পিতার বাড়ীতে নুরজাহান আসার পর স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল মান্নান গৃহবধু সুন্দরী নুরজাহানের প্রতি কু-নজর পড়ে এবং তাকে বিয়ে করার জন্য নুরজাহানের পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।

নুরজাহানের পিতা আশ্রব উল্যা মাওলানার প্রস্তাবে রাজী না হয়ে একই গ্রামের মোতালিব হোসেন মতলিব মিয়ার সঙ্গে নুরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে দেন। এই দ্বিতীয় বিয়েকে কেন্দ্র করে সুত্রপাত ঘটে এই হৃদয় বিদারক ঘটনার। বিয়ে করতে না পেরে মাওলানা আং মান্নান প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং নানা ছলচাতুরী শুরু করে। বিয়ের ৪৫দিন পর মাওলানা আং মান্নান নুরজাহান ও আব্দুল মতলিবের ২য় বিয়েকে অবৈধ বলে ফতোয়া জারী করে এবং গ্রাম্য সালিশের ডাক দেয়। মাওলানা মান্নানের কথা মত ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারী সকালে একই গ্রামের নিয়ামত উল্লার বাড়ীতে গ্রাম্য সালিশী বিচার বসে।

সালিশী বিচারে গ্রামের মনি সর্দার, দ্বীন মোহাম্মদ, নিয়ামত উল্লা ও মাওলানা মান্নান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নুরজাহান ও মতলিবের পরিবারকে দোষী সাব্যস্ত করে। সেই বিচারে গৃহবধু নুরজাহানকে মাটিতে পুঁতে ১০১ টা পাথর নিক্ষেপ করার রায় ঘোষনা দেয়া হয়। সালিশী রায় কার্যকর করার পর উপস্থিত গ্রাম্য সর্দার মনির মিয়া নুরজাহানের উদেশ্যে বলতে থাকে এত কিছুর পর তোর বেঁচে থাকা উচিত নয়। তুই বিষ পানে মরে যাওয়া উচিত। গ্রাম্য এ সর্দারের কটা উক্তি সহ্য করতে না পেরে ক্ষুভে ও দুঃখে গৃহবধু নুরজাহান সেই দিনই বিষ পানে আত্মহনন করে।

যে রায়ে অত্মহনন করে গৃহবধু নুরজাহানঃ
অপমানের জন্য আত্মহত্যা করেছে গৃহবধু নুরজাহান সেটি ছিল আংশিক। পূর্ণাঙ্গ ফতোয়ায় ছিল নুরজাহান ও তার স্বামী মতলিব কে গলা পর্যন্ত গর্তে দাঁড় করিয়ে প্রত্যেককে ১০১টি পাথর নিক্ষেপ করা এবং ১০১টি বেত্রাঘাত করা হবে। নুরজাহানের বাবা আশ্রব উল্যা ও মা সায়েরা বেগমসহ বিয়েতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে কানে ধরে উঠ বস করতে হবে। বিচারে উপস্থিত মতলিবের বাবা, নুরজাহানের শশুর মতিউল্লা ফতোয়ার এ শাস্তি কমানোর আবেদন করিলে ও বিচারে উপস্থিত গ্রামবাসীর অনুরোধে গর্তের গভীরতা গলা থেকে কোমর পর্যন্ত কমে আসে এবং ১০১ ঘা বেত্রাঘাত কমে ৫১ ঘা করা হয়। শেষ পর্যন্ত দু’ পিঠে ১০২ ঘা বেত বসানো হয়।

যে ভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠলোঃ
সংবাদপত্রের কল্যাণে ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার লাভ করলে বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ এ ঘটনার প্রতিবাদে রুখে দাড়ান। দেশের নারী আন্দোলনের প্রথম সারীর নেত্রী বেবী মওদুদ, এডঃ আয়েশা খানম, মালেকা বেগমসহ জাতীয় দৈনিক গুলোর নামী দামী সাংবাদিক, কলামিষ্ট, লেখকদের অনেকেই ছুটে আসেন এ অখ্যাত গ্রামে। প্রথমদিকে পুলিশ প্রশাসন বিষয়টির ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে অভিযুক্ত ইমাম আব্দুল মান্নান, দ্বীন মোহাম্মদ, আব্দুল মিয়া, নিয়ামত উল্লা, এছামত উল্লা, সুনা মিয়া ও বুরহান উদ্দিন নামে ৯ জনকে গ্রেফতার করলেও আদালতে ফাইনাল চার্জ সীট জমা দিতে সময় লাগে ৪ মাস। অতঃপর ১৯৯৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারী অভিযুক্ত ৯ জন আসামী প্রত্যেককে ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করে আদালত। সাজাপ্রাপ্ত ৯ জনের মধ্যে ৮ জন সাজা ভোগ করার পর এলাকায় ফিরে এসেছে।

যে আশার বাণী শোনানো হয়েছিল গ্রামবাসীকেঃ
হতভাগী নুরজাহানের আত্মহননের ঘটনার পর সরকারী উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরা এলাকায় সেই সময়ে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য দূর্গম গ্রামটির রাস্তা সংস্ড়্গার এবং কালভার্ট তৈরী করা হবে এবং রাস্তাটির নামকরন হবে নুরজাহানের নামেই। যে টিলায় নুরজাহানকে কবর দেয়া হয়েছিল তৎকালীন জেলা প্রশাসক সেই টিলাটির নামকরন করেছিলেন “নুরজাহান টিলা”। এছাড়া নারী পরিষদ নুরজাহানের কবর পাকা করনেরও ষোঘনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই টিলাটি অন্য ব্যক্তির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় সেখানে লাগানো হয়েছে নানান জাতের গাছ গাছালি। এমনকি আরও অনেক আশার বাণী শোনানো হয়েছিল গ্রামবাসীকে। কিন্তু সেই আশার বাণীই আশাতেই রয়ে গেছে। দীর্ঘ ১৩ বছর পূর্বে যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে গ্রামটি। গ্রামের কোন পরিবর্তন হয়নি। নুরজাহান নামের সড়কটির কাজও হয়নি। ফতোয়াবাজীর ঘটনার শিকার নুরজাহানের আত্মহননের ঘটনার পর যে টিলায় তাকে কবর দেয়া হয়েছিল সেটি এখন গভীর অরণ্যে ঢাকা। নুরজাহান টিলা হিসাবে পরিচিত এই কবর স্থানটি সংস্ড়্গার বিহীন অবস্থায় পড়ে থাকার কারণে বর্তমানে সেই কবর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

নুরজাহানের মায়ের কথাঃ
সরেজমিনে নুরজাহানের বৃদ্ধা মা সায়েরা বেগমের সাথে আলাপকালে জানান, নুরজাহানের আত্মহত্যার পর স্বামী আশ্রব উল্যা অসুস্থ হয়ে ২০০০ সালে মারা যান। মেয়েরা স্বামীর সংসারে আছে আর ছেলেরা নিজেদের সংসার নিয়ে অন্যত্র বসবাস করছে। আমি স্বামীর সংসারে অতি কষ্টে অর্ধাহারে ও অনাহারে দিন যাপন করছি। আমাকে সাহায্য করার কেউ নেই এবং এখন আর কেউ খোঁজ খবরও নেয় না।

নুরজাহানকে নিয়ে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত লেখার লিংক

Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০০৯ দুপুর ১:৫৬
৩২টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×