somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাহফুজামঙ্গল : বহুমুখী জীবনের বিচিত্র আখ্যান

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
আশির দশকের অন্যতম কবি মজিদ মাহমুদ। কোনো কবির কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় দশক ওয়ারী বিভাজন যদিও নিষ্প্রোয়জন, তবে কাব্যবিচারে কবির সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া কোন সময়ে কবি কবিতার ভূবনে বিচরণ শুরু করছেন এই কৌতূহল কারো থাকতেই পারে।

আমাদের কবিতার যে দুর্নাম—বোঝা যায় না, জটিল, দুর্বোধ্য; বিশেষত আধুনিক কবিতা। এই অভিযোগ যথার্থ। তবে এ প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ্য যে—‘বুদ্ধিগম্য বিষয় বুঝিতে না পারিলে লোকে লজ্জিত হয়। হয় বুঝিয়াছি বলিয়া ভান করে, না হয় বুঝিবার জন্য প্রাণপন প্রয়াস পায়। কিন্তু ভাবগম্য সাহিত্য বুঝিতে না পারিলে অধিকাংশ লোক সাহিত্যকেই দোষী করে। কবিতা বুঝিতে না পারিলে কবির প্রতি লোকের অশ্রদ্ধা জন্মে, তাহাতে আত্মাভিমান কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় না। ইহা অধিকাংশ লোকে মনে করে না যে, যেমন গভীর তত্ত্ব আছে তেমনি গভীর ভাবও আছে। সকলে সকল তত্ত্ব বুঝিতে পারে না, সকলে সকল ভাবও বুঝিতে পারে না।’ (কাব্য : স্পষ্ট ও অস্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। আমাদের আলোচ্য কবির কবিতা দুর্বোধ্য নয়; বিনয়ী, সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। অনায়াসেই তাঁর কবিতার বিচরণ করা যায়, আহরণ করা যায় ভেতরের মণিমুক্তো। এর মানে আবার এই নয় যে, তাঁর কবিতা সরস। মজিদ মাহমুদ ভাষাগত দুর্বোধ্যতা তৈরি করেন না, তৈরি করেন কাব্যজাদুময়তা। বর্ণনাত্মক রীতি, গতিময় ভাষার গাঁথুনি ও সহজবোধ্য উপস্থাপনায় মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশ করেন বেশ তাৎপর্যময় ও জীবনের গভীর বোধ।

মজিদ মাহমুদের কাব্যভাষা আমাদেরকে এমনভাবে টেনে রাখে যে, আমরা এক ঘোরের ভেতর সাঁতার কাটতে থাকি। কবিতা পড়া শেষ হলেও সেই ঘোর লেগে থাকে, কেমন একটা দ্বিধা-দ্বন্ধে হারিয়ে যাই আমরা। একবার মনে হয় বুঝলাম; আবার মনে হয়, না, আরো কী যেন আছে, যা বুঝলাম না। এটি দুর্বোধ্য নয়, রহস্যময়তা। এর ফলে কবি আমাদেরকে দিয়ে আবার পড়িয়ে নেন তাঁর কবিতা। এই যে পাঠককে আবার পড়তে বাধ্য করান মজিদ মাহমুদ, এটি কেবল কোনো কবির লেখনি শৈলির মাধ্যমে সম্ভব নয়, এটি সম্ভব হয় কবিতায় বহুস্তর বিশিষ্ট্য ভাব বা চিন্তার ফলে। এ প্রসঙ্গে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘কবিতার ভাষা মানে ভাবের ভাষা, তার পারিপাট্য অপেক্ষা বড় প্রয়োজন ভাবাত্মক হয়ে ওঠা।’—(কবিতার ভাষা, বাংলা কবিতার কালান্তর)।

বড় কবি-লেখক মাত্রই তাঁর লেখনি শৈলি ও বোধের জগতে পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখে এবং একই সঙ্গে উদ্দীপ্ত করে সুন্দর ও উন্নততর মুল্যবোধে। শক্তি চট্টপাধ্যায় অনূদিত রাইনার মারিয়া রিলকের দুইনো এলিজি আমি অনেকবার পড়েছি। রিলকের ঘোরে অনেক দিন নিমজ্জিত ছিলাম। সেই ঘোর এতই ব্যাপক ছিল যে, হাঁটতে হাঁটতে এবং প্রাত্যহিক কাজের সময় দুইনো এলিজির লাইন ভনভন করত আমার মাথায়। তখন রিলকের কিছুই বুঝতে পারি নি, কিন্তু কিসের যেন যন্ত্রণা ও প্রশান্তিতে ভরে উঠত মন। মজিদ মাহমুদের কবিতা এমনই এক ঘোর তৈরি করে। এবং অনেক সময় না বুঝলেও মনে হয় না যে বুঝতে পারলাম না, এই বুঝতে না পারার বিষয়টি ভুলিয়ে রাখে পড়ার আনন্দ। বার বার পড়তে ভালো লাগে, পড়তেই ভালো লাগে। পড়তে পড়তে আন্দোলিত হয়ে ওঠে হৃদয়।

দুই
মজিদ মাহমুদের ‘মাহফুজামঙ্গল’ বহুল পঠিত একটি কাব্যগ্রন্থ। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯ সালে, প্রথম প্রকাশ না বলে অবশ্য ‘যাত্রা’ বলা যথার্থ। কেননা প্রথম প্রকাশে এর কলেবর ছিল বেশ ছোট, ২০টি কবিতার সমন্বয়ে এর প্রথম প্রকাশ। প্রথম প্রকাশের ১৪ বছর পরে তৃতীয় সংস্করণ (২০০৩) প্রকাশের সময় এতে সংযুক্ত হয় নতুন একটি অধ্যায় ‘উত্তরখণ্ড’। এতে নতুন কবিতা স্থান পায় ৫৫টি। এরপর আবার ৯ বছর পরে (২০১২) এর চতুর্থ সংস্করণে যুক্ত হয় আরো একটি অধ্যায় ‘যুদ্ধমঙ্গলকাব্য’। এ অধ্যায়ে যুক্ত হয় ৮টি কবিতা। তার মানে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বইটি লেখা হয়। এখন ‘পূর্বখণ্ড’, ‘উত্তরখণ্ড’ ও ‘যুদ্ধমঙ্গলকাব্য’ এই তিনটি পর্বে বিভক্ত কাব্যগ্রন্থটির কবিতার সংখ্যা ৮৩টি।

কাব্যগ্রন্থটিতে একজন মাহফুজা বহুমাত্রিক ভাবের আধার হয়ে উঠেছে। বহুবিচিত্র রূপে মাহফুজাকে দেখতে পাই আমরা। মাহফুজাকে উপলক্ষ করে কবি লিখেছেন মনুষ্য জীবনের বহুমুখী বৈচিত্রের আখ্যান, সুন্দর ও উন্নততর মুল্যবোধে উদ্দীপ্ত করা এক ইতিহাস; প্রকৃত কবির এই তো কাজ।

তিন
এবার কয়েকটি কবিতা দেখা যাক। প্রথমেই আমরা ‘মাহফুজামঙ্গল পূর্বখণ্ড’-তে চোখ রাখব। ‘তোমারই মানুষ’ কবিতাটি। কবিতার শুরুতেই ‘তোমারই’ কথিত মানুষটির ভূমিকায় মজিদ মাহমুদ জানাচ্ছেন—

আমার তো একটাই জায়গা ছিল
পৃথিবীতে একটাই জায়গা ছিল আমার
তাও তুমি কেড়ে নিলে মাহফুজা
তাও তুমি কেড়ে নিলে

এখানে একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, ‘আমার তো একটাই জায়গা ছিল’ বলে এই একই কথা পরের লাইনেই আবার একটু বিস্তৃত করে বলা ‘পৃথিবীতে একটাই জায়গা ছিল আমার’ বলা। সেই জায়গাটি ‘তাও তুমি কেড়ে নিলে মাহফুজা’ পরক্ষণে আবার ‘তাও তুমি কেড়ে নিলে’ বলা। এই হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা শৈলির মধ্য দিয়ে কবি অথবা আমাদের কল্পনার চোখে যার এই পরিণতি তার জন্য, সেই মানুষটির জন্য বেদনায় আমাদের বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে যেন, আবার বেদনা কীনা তা-ও যেন বুঝতে পারি না। এরপরের পঙক্তি—

তোমার কারণে পারব না যেতে তোমারই সমুখ

‘তোমার’ কারণ বলতে কী সেই কারণ? যার জন্য তার, মাহফুজার সমুখে যাওয়া যাবে না। এই দ্বন্ধের ঘোর কাটতে না কাটতেই আরেক দ্বন্ধ, এই বোধ আমাদের উদ্বিগ্ন করে—এ কী অভিযোগ, না অনুযোগ?
দ্বিতীয় স্তবকে আমরা জানতে পারি মানুষটির কী কী নেই। আক্ষেপ করে সে বস্তুগত কিছু বিষয় তার না থাকার কথা বলে। এই না থাকা আপেক্ষিক। কারণ এইসব মাহফুজার আছে, তার নেই। পুঁজিতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় মানুষ নিজেকে কেমন করে দেখে? কেমন করে বেড়ে উঠে একজন ব্যক্তিমানুষ? মানুষে মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো চোখে আসে, কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয় এই সমাজ? মানুষটির কী নেই—তা এরই এক নির্লজ্জ চিত্র। আরো লক্ষ্যণিয় যে, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অনেক কিছুকেই আমরা আবশ্যিক বলে মনে করি, যার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু এমন অনেক কিছু না হলে আমাদের চলে না। কবিতা থেকে দেখা যাক—

তোমার তো সব ছিল মাহফুজা
তোমার এক্সপেনসিভ পানের জন্য
জমা আছে পেট্রো-ডলার
তোমার আছে বেগিন ব্রেজনেভ রিগান
প্রাচ্যের রান্না
নোবেল শান্তির এওয়ার্ড

এই আক্ষেপের ঠিক পর পরই সুর পাল্টে ফেলেন মানুষটি, অনেকটা অভিমান করেই (এই অভিমান আসলে অভিনয়, পুরো কবিতাটি পাঠ শেষেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে আমাদের কাছে) চরম নৈঃসঙ্গের দীর্ঘশ্বাস ফেলে—

তুমি ছাড়া কি ছিল আমার
কি আছে আমার

অতঃপর ‘তোমারই’ কথিত মাহফুজার মানুষটি মাহফুজাকে উদ্দেশ্য করে বলে—

তুমি দুঃখ দিলে দাও
তুমি বিরহ দিলে দাও
এতে আমার কিছুই থাকবে না বলার
আমি তো মমতায় গড়া তোমার মানুষ

এটি কবিতাটির তৃতীয় ও শেষ স্তবক। মানুষটি কি এতোই নিরীহ? কেউ তাকে দুঃখ আর বিরহ দিলেও তার কিছুই বলার থাকবে না? নিশ্চুপ থাকবে? নাকি ‘তোমার’, অর্থাৎ মাহফুজার নিজের মানুষ বলে? নাকি অক্ষম সে? মমতায় গড়া মানুষ কি অক্ষম হয়ে থাকে? নির্দ্বিধায় বলা যায়, হ্যাঁ, শত দুঃখ আর বিরহের আগুনে জ্বললেও, তবু, তা সত্বেও প্রেমিক হৃদয় তো ভালোবাসতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এই মানুষটি কি প্রেমিক? আক্ষেপ করে সে যখন জানায় তার কী কী নেই, তখন তাকে প্রেমিক বলে মনে হওয়ার কোনো কারণ আমরা খুঁজে পাই না; প্রেমিক হলে মাহফুজার যা আছে তা-ই দেখেই সে পরম সুখে জীবন কাটিয়ে দিত। আবার প্রথম স্তবকটি দেখে আসা যাক, তখন মানুষটিকে প্রেমিক বলে মনে হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃত্বীয় স্তবকে এসে ধুরন্ধর বলে মনে হয়, আবার প্রেমিক বলেও মনে হয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে মানুষটি ধুরন্ধর। প্রেমিক বলেও যে মনে হয়, এমন করে দেখান, এ তো কবির স্বার্থকতা। ধুরন্ধর মানুষরা তো এমনই হয়, প্রেমিক রূপেই সে আবির্ভূত হয়। আবার এমন করেও বলা যায়, মানুষটি প্রেমিক হয়ে উঠতে পারে নি; পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মানুষ যে তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারে না, এই কবিতাটির মানুষটি তারই এক উদাহরণ।

‘মাহফুজামঙ্গল উত্তরখণ্ড’ থেকে দুটি কবিতা দেখব, ‘নদী’ ও ‘পুরস্কার’। প্রথমেই ‘নদী’ কবিতাটি। মজিদ মাহমুদের কবিতা ‘কিছু বলতে চাওয়া’ প্রবন নয়, নানা বাঁক ও নানা ঢেউয়ে মানুষের চেতনাকে সমৃদ্ধ করা এক স্বপ্নময় জগৎ। প্রথমেই পুরো কবিতাটি তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না, এক অনুচ্ছেদে ছোট্ট একটি কবিতা—

সুউচ্চ পর্বতের শিখর থেকে গড়িয়ে পড়ার আগে
তুমি পাদদেশ নদী বিছিয়ে দিলে মাহফুজা
আজ সবাই শুনছে সেই জলপ্রপাতের শব্দ
নদীর তীর ঘেঁষে জেগে উঠছে অসংখ্য বসতি
ডিমের ভেতর থেকে চঞ্চুতে কষ্ট নিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে
কিন্তু কেউ দেখছে না পানির নিচে বিছিয়ে দেয়া
তোমার কোমল করতল আমাকে মাছের মতো
ভাসিয়ে রেখেছে

এই কবিতাটিতে মাহফুজাকে কোন রূপে আমরা দেখতে পাই? নদী নারীর বহুল ব্যবহৃত প্রতীক। কিন্তু এখানে মাহফুজা নারী হলেও নদীর প্রতীক হয় আসে নি। এবং কোনো নির্দিষ্ট সম্পর্কে কারো সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, অর্থাৎ মাহফুজা কারো মা, প্রেমিকা, বোন বা অন্য কোনো বাঁধনে সম্পৃক্ত নয়। আবার এর যে কোনো সম্পর্কই আমারা মাহফুজার সঙ্গে স্থাপন করতে পারি। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’কে স্মরণ করা যেতে পারে—‘আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। হাজার বছর ধরে অথবা অন্তহীন পথ কিংবা এবড়ো-থেবড়ো পথ কিংবা দুই মিনিটের মসৃণ পথ হেঁটে প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে এসে দুদণ্ড শান্তি পান। হয়তো প্রেমিকার মুখ দেখেই তার পরাণ জুড়িয়ে যায়। বিষয়টা উল্টো করে বললে খাপছাড়া মনে হবে। নারী হলো আশ্রয় বা অবলম্বনের প্রতীক। ‘নদী’ কবিতাটিতে মাহফুজা এরই প্রতিফলন। মজিদ মাহমুদ এখানেই থামেন নি। তিনি উন্মোচন করেছেন নারী-চরিত্রটির আরেক বৈশিষ্ট্য। সংসারে কী বাইরে নারী তার প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি পান না। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় নারীকে তো মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয় না; ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হয় এবং সেভাবে উপস্থাপন করা হয়। তবে প্রতি সমাজেই কিছু মানুষ থাকে, তারা উপলব্ধি করতে পারে, তাদের মধ্য থেকে কেউ আবার সেই উপলব্ধি মানুষের ভেতরে জাগিয়ে তোলে। আর আমরা সাধারণরা মহৎ উপলব্ধিতে আলোড়িত হই, আবার মেতে উঠি নিজের সঙ্গেই নিজের লড়ইয়ে, পাশ ফিরে আমাদের তাকানোর সময় কোথায়?

প্রেমের চিরন্তন ও অতি পরিচিত একটি আবেগ নিয়ে প্রেমিকের অন্তর্বেদনা ফুটে উঠেছে ‘পুরস্কার’ নামক কবিতাটিতে। রাষ্ট্রিয়, ধর্মীয় ও পারিবারিক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখী এক প্রেমিক। তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে গ্রামের মৌলবী, চৌকিদার পাঠিয়েছে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, খুঁজছে থানার দারোগা, জনকের ভিটে নিষিদ্ধ। অসহায় ও নিরুপায় প্রেমিকের হৃদয়বিদারী আর্তি—

তোমাকে ভালোবাসার এমন বধির পুরস্কার
আমি ছাড়া কেউ তার অর্থ জানে না
তোমার সম্মুখে কার্যকর হবে ফাঁসির আদেশ
ক্রুশদণ্ড ভেদ করে আমাকেও দাঁড়াতে হবে
এই মৃত্যুর উৎসবে তুমিও সেদিন
কেবলই নীরব দর্শক

উদ্ধৃত এই অংশের শেষ দুই পঙ্ক্তি লক্ষ্যণীয়—প্রেমিকের ফঁসি কার্যকর হবে; এই মৃত্যুকে ‘উৎসব’ কেনো বলা হচ্ছে? এবং প্রেমিকা কেবলই নীরব দর্শক হয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, এর রহস্য কী? আরো লক্ষ্যণীয় যে, ‘তুমি’ এবং ‘কেবল’ এই দুই শব্দে যথাক্রমে ‘ও’ এবং ‘ই’ যুক্ত হয়ে আমাদেরকে আরো ভাবিয়ে তুলছে।

প্রেমিকা যদি ‘কেবল’ নীরব দর্শক হয়, তাহলে ভাবের যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়, আর ‘কেবল’ এর সঙ্গে ‘ই’ যুক্ত হয়ে যে ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে; এই দুই এর আকাশ পাতাল তফাৎ। কবি যদি ‘কেবল নীরব দর্শক’ বলতেন তাহলে কবিতার পুরো বিষয়টিকে তাৎক্ষণিক ও ছোট একটি ঘটনা বলে মনে হতো। কিন্তু কবি যখন ‘কেবলই নীরব দর্শক’ বললেন, এতে করে আমাদের মনে হয় এটি একটি চলমান ঘটনা, এর আগে পৃথিবীতে এরকম ঘটনা আরো অনেক ঘটেছে। একে আবার আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে, এই প্রেমের গল্প আমাদের সমাজ বাস্তবতায় কথিত অবলা নারীর গল্প। শুধু এই কবিতাটির প্রেমিকার চরিত্রে সে নীরব দর্শক নয়, কেবল‘ই’, অর্থাৎ এ আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস। হাজার বছর ধরে নারী ‘কেবলই নীরব দর্শক’।

‘তুমি’র সঙ্গে ‘ও’ যুক্ত হয়ে প্রেমিকের আক্ষেপ, আকুতি ও হৃদয়ক্ষরণের গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে। ‘ও’ বাদ দিয়ে একবার দেখে নেয়া যাক—‘এই মৃত্যুর উৎসবে তুমি সেদিন/কেবলই নীরব দর্শক’। ‘ও’ না থাকলে আরো একটি বিষয় মনে হয়, প্রেমিক প্রেমিকার কাছ থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থান করছে—এই কথা যেন সে কোনো একজনকে বলছে। প্রেমিকার প্রতি তার কোনো অধিকার নেই, আবেগ নেই, সে যেন আর দশজন দর্শকের মতোই একজন।

রাষ্ট্রীয় কিছু অর্জন পালন করাকে আমরা উৎসব বলি, এছাড়া ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক; এককথায় বড় পরিসরে আনন্দের আয়োজনকে উৎসব বল হয়। এটা বলাই বাহুল্য যে, মৃত্যুকে আমার উৎসব বলি না। কিন্তু এখানে মৃত্যুকে উৎসব বলা হচ্ছে। কারণ এই মৃত্যু তো একজন প্রেমিকের, এ তো সাধরণ কারো মৃত্যু নয়, এ যে প্রেমে শহীদ। প্রেমিক হৃদয় জানে এ মৃত্যু যে মৃত্যু নয়।

এবার ‘যুদ্ধমঙ্গলকাব্য’ পর্বের একটি কবিতা দেখব, ‘যুদ্ধ ২’। টানা গদ্যে লিখিত কবিতাটির শেষে কবি এক নিষ্ঠুর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন—‘কে আমাদের যুদ্ধে নামিয়েছে?’—প্রশ্নটি বুলেট-গতিতে এসে বিদ্ধ করে আমাদের বুক। প্রথম স্তবকে যুদ্ধের পরিণতি সম্বন্ধে অবহিত হই আমরা। যুদ্ধের মায়দানে উলুখাগড়ার শুধু প্রাণ যায় না, এর নিষ্ঠুরতা আরো ব্যাপক। মাহফুজার উদ্দেশ্যে কবি বলছেন—


মাহফুজা, আমরা যারা যুদ্ধের ময়দানে মরি। কিংবা যুদ্ধ না করলেও আমরা যারা মরি। আমাদের মেয়েরা যুদ্ধের ময়দানে ধর্ষিতা; যুদ্ধের বাইরে রক্ষিতা, তাদের জন্য তোমার কি কিছু বলার নেই মাহফুজা? যাই বল, যুদ্ধ তো আমরা বাঁধাইনি। আমরা যারা যুদ্ধের শিকার। যারা যুদ্ধ জয়ী, আমাদের মেয়েরা তো তাদের ভোগ্য। আমাদের হাতগুলো তাদের পয়ঃপরিস্কারের জন্য। আমাদের শ্রম তাদের উদ্বৃত্ত মূল্য ও মেদের জন্য। আমাদের ক্ষেতগুলো কর্ষিত হয় তাদের সেবাদানে।

অনেক যুদ্ধের কথা আমরা জানি। ৭১ ও ৫২’র সঙ্গে রয়েছে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। রক্তের সম্পর্ক—আমি বলব, পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধের সঙ্গেই। কবিতাটিতে নির্দিষ্ট কোনো যুদ্ধের কথা বলা হয় নি, সর্বত্র যুদ্ধে বিজয় ও পরাজয়ের যে চিত্র, তারই সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু কবি মজিদ মাহমুদ যুদ্ধের ধারাভাষ্যকর নয়, ক্যানভাসার। ক্যানভাসার নান গল্প বলেন, কৌতুক করেন, গান করেন, খেলা দেখান; কিন্তু এসব তার উদ্দেশ্য নয়, একসময় তিনি আড়ালে রাখা পোটলার ভেতর থেকে ঔষধ বের করেন—আরোগ্য লাভের উপায়। যুদ্ধের যে নিষ্ঠুর খেলা মজিদ মাহমুদ আমাদেরকে দেখান; এই নিষ্ঠুরতা দেখান তার উদ্দেশ্য নয়, এর থেকে তিনি উত্তরণের উপায়ের ইঙ্গিত দেন—যারা যুদ্ধের শিকার, তাদের হয়ে কবি বলেন, মাহফুজার কাছে জানতে চান, যুদ্ধের নিষ্ঠুর ফাঁদে যারা আটকে পড়েন, তাদের জন্য, তাদের ধ্বংসাত্মক চিত্র দেখেও কি তার কিছু বলার নেই? এই মাহফুজা এখানে ক্যানভাসারের ঔষধরূপী যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা থেকে উত্তরণের উপায়; মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম আদালত, মনুষ্যবোধ—নিজেকেই নিজের কাছে প্রশ্ন রাখা।

এখন দেখা যাক—‘কে আমাদের যুদ্ধে নামিয়েছে?’ এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। পৃথিবীর ইতিহাস তো নানা ফর্মে, না আঙ্গিকে লড়াইয়ের ইতিহাস, শোষক আর শোষিতের ইতিহাস; এই দুই ভাগে বিভক্ত পৃথিবী। আশুলিয়াতে নূন্যতম মজুরির জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকদের কিছুদিন পর পর যুদ্ধ করতে হয়। কে তাদের যুদ্ধে নামায়? নিজেরাই, নাকি মালিক পক্ষ? না কোনো তৃতীয় পক্ষ? এটা স্পষ্ট যে, যুদ্ধ তাদের অনিবার্য—

মাহফুজা আমরা যাতে যুদ্ধ থেকে না পালাই, সে জন্য আমাদের পশ্চাতে নিয়োজিত প্রশিক্ষিত কুকুর বাহিনী। সামনে শত্রুর তরবারি; পিছনে ততোধিক নিষ্ঠুর সম্ররাটবাহিনী। মাহফুজা, কথা হলো, কে আমাদের যুদ্ধ নামিয়েছে?

এই উদ্ধৃত অংশের শুরুতে ‘মাহফুজা’র পরে কমা (,) বসতে পারত। কবি কমা দেন নি। কমা না থাকায় এক নিঃশ্বাষে আমরা পড়ে যাই—‘মাহফুজা আমরা যাতে যুদ্ধ থেকে না পালাই...’। নিজেকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন দাঁড় করান। অঃতপর সেই প্রশ্নটি, প্রশ্নটিতে এসে আমাদের পাঠের গতি কমে যায়—‘মাহফুজা, কথা হলো, কে আমাদের যুদ্ধ নামিয়েছে?’ একই স্তবকে অন্য প্রসঙ্গের চেয়ে এই প্রশ্নটি ধীর গতিতে উপস্থাপিত হওয়ার ফলে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি এই প্রশ্ন, এ তো মানুষের চেতনাকে উসকে দেয়া উপলব্ধি, প্রেমের পৃথিবীর জন্য আক্ষেপ ও আকাঙ্খষার আকুতি। এ প্রসঙ্গে আহমদ ফারাযকে স্মরণ করা যেতে পারে—

ফারায, প্রেমের পৃথিবী তো বড় সুন্দর দেখি
এর মাঝে বিরহ বিচ্ছেদের আপদ রাখলো কে?

মজিদ মাহমুদ প্রেম ও শোষিতের পক্ষে; কবিমাত্রই হৃদয়বাদী, আর হৃদয়বাদী মানুষ সবসময় শোষিতের পক্ষ নেন, প্রেমিক হন। এই সূত্র ধরে আমরা দেখব কাব্যগ্রন্থটির নাম। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ধারক মঙ্গলকাব্য এবং এই কাব্য ধর্মবিষয়ক আখ্যান নামে পরিচিত। ‘মাহফুজামঙ্গল’ ধর্মবিষয়ক আখ্যান নয়, বহুবিচিত্র রূপে দেখা এক ‘মাহফুজা’কে উপলক্ষ করে মজিদ মাহমুদ দেখিয়েছেন মনুষ্য জীবনের আখ্যান; তবে এই আখ্যান মঙ্গলকাব্য। বলা হয়ে থাকে যে কাব্যের কাহিনী শুনলে সবধরনের অকল্যাণ দূর হয় এবং পরিপূর্ণ মঙ্গল লাভ হয় তাই হচ্ছে মঙ্গলকাব্য। ‘মঙ্গল’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘কল্যাণ’। এই কাব্যগ্রন্থের নাম যদি ‘মাহফুজামঙ্গল’ না হতো তাহলেও এটি ‘মঙ্গলকাব্য’ হতো। কথায় আছে—নামে কী-বা আসে যায়! পৃথিবীর সমস্ত মহৎ কবির কাব্যগ্রন্থের নামের সঙ্গে ‘মঙ্গল’ যুক্ত নেই। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত মহৎ কবি মানুষকে উদ্ভাসিত করেন প্রেম ও সুন্দরের পথে। একজন কবির কাছে এই তো আমাদের প্রত্যাশা।

মাহফুজামঙ্গল, মজিদ মাহমুদ ॥ জানুয়ারি ২০১৪, কবি প্রথম সংস্করণ ॥ প্রচ্ছদ, চারু পিন্টু

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৭
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×