somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গো-মাংস খাওয়া বেআইনি নয়

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৭:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) বুঝতে পেরেছে, তারা যদি গরুর মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান বজায় রাখে, তাহলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার অজানা বিপদের মুখে পড়তে পারে। এর ফলে মুসলমানরা আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। আরএসএস সেটা বুঝতে পেরে মুখ বন্ধ করেছে। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা এল কে আদভানি বলেছিলেন, বিজেপি হিন্দুদের সমর্থন নিয়ে লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে, কিন্তু মুসলমানদের সহযোগিতা ছাড়া দেশ পরিচালনা করা কঠিন। তারপরও ব্যাপারটা শুধু কাগজে-কলমে রয়ে গেছে।
সংঘ পরিবার মুসলমানদের সমর্থন লাভের ব্যাপারটা যদি সত্যিই তীব্রভাবে অনুভব করত, তাহলে তারা তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিত। তারা মনে করে, প্রকৃত অর্থে দেশ পরিচালনায় মুসলমানদের ভূমিকা নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দিকেই লক্ষ করুন, সেখানে শুধু একজন মুসলমান মন্ত্রী রয়েছেন, তা-ও আবার অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে।
সম্প্রতি ভারতে এক অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, গরুর মাংস কি নিষিদ্ধ করা উচিত, নাকি উচিত নয়। যে দেশের হিন্দুদের সঙ্গে গরুর আবেগের সম্পর্ক রয়েছে, সেখানে এই প্রশ্ন তোলাটাই ভুল। হিন্দুরা গরু পূজা করে। আসল প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মানুষকে গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে মেরে ফেলা হবে কি না। আবার এই অভিযোগটাও তোলা হয়েছে মিথ্যা গুজবের ভিত্তিতে। ব্যাপারটা যেন এমন, হিন্দু চরমপন্থীরা সেই মানুষদের ধর্মবোধ কেমন হবে, তা নির্দেশ করা শুরু করেছে।
গরুর মাংস খাওয়া–বিষয়ক বিতর্কটা বেশি দিন চলেনি, এটা একরকম আশীর্বাদই বটে। এই আলোচনা সমাজকে বিভক্ত করেছে। হয়তো এই উপলব্ধি থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য হিন্দু-মুসলমানকে একত্র হতে হবে, তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করা চলবে না। তিনি এক সপ্তাহের মতো নিশ্চুপ ছিলেন, আর জনগণের চাপ না থাকলে হয়তো তিনি এই দ্ব্যর্থবোধক অবস্থান নিতেনও না। আর শেষমেশ তিনি যা বললেন তা এত ঈষদুষ্ণ যে মনে হয়েছে, তিনি স্রেফ অনুশীলন করছেন।
দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে, সেটা আরও খারাপ ব্যাপার। তাদের মধ্যে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। মনে হয়, তারা উভয়ই নিজেদের জগতে বাস করে। এর মুখ্য কারণ হচ্ছে এই ক্রমেই গভীর হওয়া বিভাজন, সংঘ পরিবার উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে বিভাজনের গোড়ায় পানি দিয়ে যাচ্ছে।

কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের আকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় এই ব্যাপারটি সামনে এসেছে, পুরস্কার ফেরত প্রদানকারীদের মধ্যে আছেন জওহরলাল নেহরুর ভাগনি নয়নতারা সেগাল। কর্তৃপক্ষকে দেওয়া চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, ভারতে বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। হ্যাঁ, তাঁরা ভারতীয় মূল্যবোধের কথাই বলেছেন। যে প্রজন্ম বাক্স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদের আবহে বেড়ে উঠেছে, তাদের কাছে বিজেপির এই গেরুয়াকরণ গ্রহণযোগ্য হবে না।
দিল্লির কাছে দাদরিতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, সেখান থেকে সাবেক আরএসএস প্রচারক মোদির শিক্ষা নেওয়া উচিত। একজন মুসলমান গরুর মাংস খেয়েছেন—এই গুজবের ভিত্তিতে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি যদি তা খেয়েও থাকেন, তাতেই বা কী, ভারতে তো এমন কোনো আইন নেই যে গরুর মাংস খাওয়া যাবে না। এটা ঠিক যে দু-তিনটি রাজ্য বাদে সব রাজ্যেই গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু গো-মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়নি।
মোদি যদি এখনো বুঝে না থাকেন, তাহলে তাঁর বোঝা উচিত, বহুত্ববাদ ভারতীয় সমাজের প্রাণ। সংঘ পরিবারের অনেক চরমপন্থী সেটা পছন্দ না-ও করতে পারে, কিন্তু বিপুলসংখ্যক ভারতীয়ের কাছে ভারত হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমতার নামান্তর। সন্দেহ নেই, ভারতের অনেক ছোট ছোট জায়গায় সংখ্যাগরিষ্ঠরা লাগামহীন হয়ে পড়েছে, তারা বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে। কিন্তু এটা ভারতের জন্য সার্বিকভাবে প্রযোজ্য নয়। ভারত সংখ্যালঘিষ্ঠদের মুক্তবাকে বিশ্বাস করে, তাদের এই অধিকার সে রক্ষাও করবে।
ওদিকে যাঁরা টিভির পর্দায় গরুর মাংস খাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে পুষ্ট করছেন না। ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাসের কথা বুক চাপড়ে বলতে গিয়ে তাঁরা প্রকারান্তরে এর ক্ষতিই করছেন।
গুরুর মাংস খেয়েছেন—এই গুজবের ভিত্তিতে মোহাম্মদ ইকলাখকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে খুন করা হয়েছে, এ ঘটনাটির প্রতি জাতির দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা উচিত। সেটা সত্যি হলেও এ প্রশ্ন উঠবে: কোনো মানুষ গো-মাংস খেলেই কি তাঁকে খুন করতে হবে? ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানের দিকনির্দেশনামূলক নীতিতে বলা হয়েছে, ‘রাজ্যগুলোকে কৃষি ও প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে, আর বিশেষ করে, প্রজাতির সংরক্ষণ ও উন্নয়নে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে, গরু, বাছুর, অন্যান্য দুগ্ধদাত্রী প্রাণী ও মালবাহী পশু হত্যা নিষিদ্ধ করতে হবে।’
গো-মাংসের বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা হয়েছে। আদালত রায়ে বলেছেন, কেউ গো-মাংস খাবেন কি খাবেন না, সেটা তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার, আর তিনি তা খেলে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী হবেন না।
আসল কথা হলো, হিন্দু চরমপন্থীরা নির্বাচনকে সামনে রেখে গো-মাংসের ভিত্তিতে সমাজে মেরুকরণ ঘটিয়েছে। একইভাবে মহারাষ্ট্রভিত্তিক হিন্দু চরমপন্থী সংগঠন শিবসেনার কারণে রাজ্যটির বদনাম হয়েছে। শিবসেনা শুধু ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোরই মানহানি করেনি, সে ভারতের মুখে কালি লেপ্টে দিয়েছে। শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে বুঝতে পেরেছেন, সহিংসতা করে লাভ নেই। তিনি এর নিন্দাও করেছেন। ফলে শিবসেনা কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, আর মুখ্যমন্ত্রীর পদের জন্য নিজেদের মানুষকে মনোনীত করেছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও শিবসেনার তরুণ তুর্কিরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পছন্দ করেন না। শিবসেনা বিজেপি ঘরানার মানুষ ও সম্মানিত সাংবাদিক সুরিন্দর কুলকার্নির মুখে কালি মেখে দিয়েছে, তারা এখন এভাবেই কাজ করে। এই ঘটনার পর যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সংঘ পরিবারের বোঝা উচিত, ভারতের আত্মায় ধর্মনিরপেক্ষতার অধিষ্ঠান।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৭:০৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×