নব্বই এর ঘরে জন্ম, তাই স্বভাবত মুক্তিযুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য কোনটাই হয়নি।
তবে আমি গন্ডগোলের (পড়ুন মুক্তিযুদ্ধ) সবকিছু দেখেছি আমার মায়ের চোখে। সন্ধ্যার সময় ছোট বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর জন্য মায়েরা বাঘ ভাল্লুকের গল্প শোনায়।আমি শুনেছি মেলেটারির গল্প (পড়ুন মিলিটারি -পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী)। কিভাবে একটা শিশুর এক পায়ের উপর পা দিয়ে আরেক পা টেনে মাঝ বরাবর টেনে ছিঁড়ে ফেলা হত সেটা শুনেছি। আবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করেছি আসলেই ছোট বাচ্চাদেরকেও গুলি করা হত কিনা?প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতাম। অবিশ্বাস চোখে নিয়ে বিশ্বাস করতাম যে আমার মত ছোটররাও তখন রেহাই পায়নি।ভয়ে কুঁকড়ো হয়ে মার বুকে লুকাতাম।বাঘ ভাল্লুক নয়, মেলেটারি ভয়। পাকিস্তান কে ভাল না বেসে যে "সাচ্চা মুসলিম " হওয়া যায়না, ইসলাম জিনিসটা পাকিস্তান ছাড়া পুর্নতা পায়, এসব তো দূরের কথা ইসলাম ভাল ভাবে বুঝার আগে মেলেটারির ভয় মনে ঢুকে গেছে।
আরেকটু বড় হয়ে গল্প শুনেছি বাপ চাচার কাছে।অসহায় হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা ঘুরার গল্প,জাদুরানির হাটে গিয়ে আর ফিরে না আসা মানুষের গল্প,লাশের স্তুপ থেকে বেঁচে ফিরে আসা মানুষের গল্প, বলতে বলতে কেউ হাসে,কেউ উদাস হয়ে যায় কেউ আবার গর্বে বুক উঁচু করে।কারন এসবের পরেই আসে মুক্তিফৌজ এর কথা।যাদের বীরত্বের কথা বলার সময় চোখ চকচক করে উঠা দেখেছি - স্বজন হারানো বেদনায়,বিজয়ের আনন্দে। এসব গল্প কখনো পুরাতন হয়না,যতবার বলে,ততবার তার গায়ে কাটা দিতে দেখেছি। আমার কাছে তাই হিরো কোন চার ছক্কা মারতে পারা ব্যাটসম্যান নয়,হিরো সেই মুক্তিফৌজ ভাইটি যে চার ছয় টা হলেও পাকিস্তানি মেরেছে। চেতনা (পড়ুন কিছু বোঝার ক্ষমতা) জিনিসটা এসেছে পাকিস্তানী জিনিসটা ঘৃণা করতে করতে।
আরেকটু বড় হয়ে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি বই পত্রে,টিভির পর্দায়।প্রথম মুক্তিযুদ্ধের যে বই পড়ে চোখে পানি এসেছিল সে বইয়ের নাম ভুলে গেছি -সম্ভবত ক্লাস সিক্সে কি সেভেনে।ধর্ষণ জিনিসটা বুঝতে শিখেছি প্রথম তখন। আর সেটার সাথে পাকিস্তানী শব্দটা জড়িত। আনিসুল হকের "মা " পড়ে বেশ কয়েক দিন ভাত খাওয়ার সময় গলায় লাগত,হুমায়ুন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের একেকটা বই পড়েছি আর থ হয়ে বসে থেকেছি। যেন পচা গলা লাশের গন্ধ বের হয়ে আসে বই থেকে। অনেক বড় হয়েও কুয়াতে তাকাতে ভয় পেতাম -লাশ আছে কিনা! জীবন কত সস্তা ছিল সে সময়। ইজ্জত ছিল আংগুলের ইশারায় (পুরুষ কিংবা নারী)। আজ যে মেয়েটা পাকিস্তানী কাউকে বিয়ে করার জন্য লাফায় সে হয়ত একটু খোজ নিলেই জানতে পারবে তার বাবাকে সবার সামনে দিগম্বর হতে হয়েছিল সে মুসলমান সেটা প্রমাণ করার জন্য।
ফিলিস্তিনে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। আহতের সংখ্যা কেউ বলেনা কখনো। বাংলাদেশের এমন কোন সুস্থ মানুষ নেই যার মনটা একবার হলেও কাঁদেনি।কিছু অর্থসাহায্য করার চেষ্টা আমরাও করেছি। ইসরাইলের নাম শুনলে থুথু ফেলি,ইহুদি শব্দ উচ্চারণ করলেই দাড়িয়ে হাত উঁচু করে হিটলার কে স্যালুট (হেইল হিটলার) দেয়,সেই আমরাই কি অবলিলায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের কথা ভুলে যাই? পাকিস্তান বলতে গদগদ করে উঠি!
আমার স্যার (সরকার সোহেল আহমেদ) বলতেন -যুদ্ধে ত্রিশ লাখ নয়,ত্রিশ কোটি মানুষ মারা গেছে।তারা হয়ত বাবাকে মেরেছ সাথে সাথে মেরেছে তার পূরো পরিবার কে।খুন করেছে মাকে,কিন্তু জীবন নিয়েছে তার কোলে থাকা বাচ্চার। এটা এমন এক ক্ষতি যেটা সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ সম্ভব নয়।বিয়ের পিড়িতে বসা যে মেয়ে বিধবা হল,নিজের বাবা-মার সামনে যে মেয়ে ইজ্জত হারালো,বাবা হওয়ার আবেশ কমে না আসতেই যার চোখের সামনে একবছরের মেয়েটার দুই পা দুইদিকে চলে গেল তার কাছে ত্রিশ লাখ যা,ত্রিশ কোটিও তাই,তিনশ কোটিতেও কিছু যায় আসেনা।
আচ্ছা ঠিক আছে ত্রিশ লক্ষ ছিল না (অনেকেই স্বীকার করেনা,নির্ভর যোগ্য প্রমাণ না থাকায়), এক লক্ষ তো ছিল? সেটাও বাদ -এক হাজার তো ছিল? কারন আমার মা বাবা মিলে একটু চেষ্টা করলেই একহাজার মানুষের নাম বলতে পারবে যারা যুদ্ধে মারা গিয়েছিল (শহিদ বলব না,তাতেও আপত্তি অনেকের)। এই এক হাজার মানুষ যে পাকিস্তানিরা মারল,তারা ঘৃণা না পাক,কোন ভাবেই ভালবাসা পেতে পারেনা। সে যেই প্রজন্মের পাকিস্তানি হোক।"যে একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল সে যেন পূরো মানবজাতি কে হত্যা করল।"পাকিস্তানীরা এরকম হাজার হাজারটা মানবজাতি হত্যা করেছে।তাদের ভালবাসা মানে কি সেটা আমি জানিনা-জানার দুঃসাহসও করিনা কখনো।
পাকিস্তানীরা এখনও তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইনি। কারন তারা মনেই করেনা মানুষ মেরেছে। পূর্ব পাকিস্তানের কাউকে তারা মানুষ মনে করত না।এক হোস্টেলে থেকে পূর্বপাকিস্তান এর কারো টেবিলে বসার অনুমতি ছিল না, বসতে দিতনা তারা।(আনিসুল হকের মা উপন্যাস, এছাড়া আবিরের মায়ের কাছে গল্প শোনা)।
অনেকেই বলে খুন হত্যা মিলিটারি করেছে,সাধারণ পাকিস্তানি কে কেন ঘৃণা করব?
-এই ছিল সাধারণ পাকিস্তানিদের ব্যবহার আমাদের প্রতি।
আজ পাকিস্তানি কেউ বাংলাদেশের মেডিকেলে পড়তে আসে দেখে যেমন খারাপ লাগে,তেমনি তাদের করুণা করতে পেরে আনন্দ হয়।পরাজিত শত্রুকে করুনা করার মাঝে এক ধরনের আনন্দ আছে -পৈশাচিক আনন্দ।
আজ যে পাকিস্তানি আমাদেরই কোন স্যারের কাছে ডাক্তারি শিখে তার দেশের মানুষের জীবন বাঁচাবে, হয়ত সেই ডাক্তারের বাবাকে হয়ত পাকিস্তানি বুলেটের আঘাতে বুক ঝাঝড়া করে দিয়েছে।বাংগালীর হৃদয় কতটা বড় হলে সেটা সম্ভব! মানবতা কি জিনিশ এটা পাকিস্তানী কেউ কখনো বুঝবেনা।
আমি গরু খাইনা বলে মুরগী খেতে পারবনা সেটা যেমন অযৌক্তিক ।পাকিস্তান আর পাকিস্তানি কে ঘৃণা করতে হলে আগে বৃটিশ কে ঘৃণা করতে হবে,ভারত কে ঘৃণা করতে হবে সেটাও অযৌক্তিক।
সব কথার শেষ কথা,
আমি পাকিস্তান আর প্রত্যেকটা পাকিস্তানি কে ঘৃণা করি।এর পেছনে কোন যুক্তি হবেনা, কোন কারন থাকা লাগবেনা (আমার মায়ের কাছে শোনা গল্পই যথেষ্ট), এর জন্য আমাকে ক্রিকেট বোদ্ধা হতে হবেনা, এটার সাথে রাজনীতি হবেনা,রাজনীতির জ্ঞানও লাগবেনা, কোন পাকিস্তানি কবে জন্মালো,কতটা সাচ্চা মুমিন, কে পর্দা করল আর কে করলনা,সেসব দেখার প্রয়োজন আমার নাই,এটার সাথে কোন পণ্য ভাল আর কোনটা খারাপ সেটা দেখারও প্রয়োজন নাই,স্বাধীনতার ঘোষনা কে দিল তাতে কিছু যায় আসেনা, আমার চেতনা (আওয়ামীলীগ এর রাজনৈতিক চেতনা নয় -একজন মানুষের বুঝতে পারার ক্ষমতা) এসেছে পাকিস্তানি ঘৃণা করতে করতে - পাকিস্তানি ঘৃণা করার জন্য আমাকে দেশপ্রেমিক হতে হবেনা।এককথায় -
"বিষয়টা যখন পাকিস্তান -তখন কোন শর্ত প্রযোজ্য নয় "
বি.দ্র.সকল রাজাকার পাকিস্তানি। তাদের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য। এই পোষ্ট কাউকে ব্যাক্তিগত আক্রমণের জন্য নয়।নিতান্ত আমার মানসিক ভাল লাগার জন্য। তবে কোন পাকিস্তানি আমার এই পোষ্ট পড়ে কষ্ট বা লজ্জা পেলে খুশি হব (সম্ভাবনা কম।কারন তাদের বাংলা জানার কথা না)।